সূর্যশিশির পর্ব ১০

0
359

সূর্যশিশির
১০.
নিজের হাতজোড়া ঘাড়ের কাছে ঠেকিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছেন সুমনা। বারেক মিয়া চৌকাঠ মাড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই তিনি তেড়ে এসে বললেন, ‘তুমি থাকতে হোটেলে ভেজাল লাগে কী করে? এখন বিচার বসবে, লোকে জরিমানা চাইবে হয়তো ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে তখন এই এতগুলো বাচ্চার মুখে কী দেবে? এইটা একবারও মনে আসেনি?’

রিনি দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলো। উঁকি দিয়ে বাবা-মা’কে দেখছে। বারেক সুমনাকে অগ্রাহ্য করে রিনিকে বললেন, ‘তোর আপা কি উপরে?’

রিনি মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ সূচক বুঝালো। বারেক দ্বিতীয় তলায় যেতে চাইলে সুমনা পথরোধ করে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘ঝামেলাটা যদি না হতো মেয়ের কাঁধ সেলাই করতে এতগুলো টাকা গচ্ছা যেত না। তোমার কি বিবেকবুদ্ধি নাই? তুমি একজন ব্যবসায়ী হয়ে কী করে সন্ত্রাসদের সাথে তর্কে যাও?’

বারেক শীতল কণ্ঠে বললেন, ‘ওরা তোমার মেয়েকে নিয়ে কেমন নোংরা কথা বলেছে জানো তুমি?’

‘কী করেছে? হা? কী করেছে? না হয় কয়টা কথাই বলেছে। কথাতে কী এসে যায়? মেয়ে হলে তো কত কথাই শুনতে হয়। আমরা কি শুনিনি?’

বারেক সুমনার সাথে তর্ক করার মতো সাহসী নন। এটা ভয় নয়, অন্ধ প্রেম। যেদিন সুমনা তাকে পাওয়ার জন্য পড়াশোনা ছেড়ে, পরিবার ছেড়ে অজানা শহরে পাড়ি জমিয়েছিল সেদিন থেকে সুমনা যা বলেন তাই জীবনের লক্ষ্য ধরে নেন।

তিনি স্বাভাবিক গলায় বললেন, ‘মেয়েটা আহত সেই খেয়াল নেই, কত টাকা খরচা গেল সেই চিন্তা তোমার! তোমারই তো রক্ত সুমনা…তোমার জোয়ানকালের চুলগুলো রুমি, রিনি পায়নি, রূপাই কিন্তু পেয়েছে। দেখেও কি মায়া হয় না?’

সুমনা তাৎক্ষণিক উত্তর দিতে পারলো না। অল্প সময় চুপ থেকে বললো, ‘মায়া…মায়া হবে না কেন? মেয়ে তো পালছি, পেলে বড় করছি। কয়দিন পর বিশে পা দিবে৷ এতো বড় কি মায়া ছাড়া হইছে?’

বারেক বুঝতে পারেন, সুমনাকে কিছু বলে লাভ নেই। সে যা ভাবতে চায়, বলতে চায় তাই ভাববে, বলবে। কারো কথায় পরিবর্তন হওয়ার মানুষ সে নয়। তিনি চুপচাপ সিঁড়ি বেয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠে গেলেন। রূপা শুয়ে ছিল, বারেককে দেখে উঠে বসলো। বললো, ‘আব্বা, আমার ফোনটা হোটেলে….’

বারেক শার্টের পকেট থেকে ফোন বের করে বললেন, ‘ক্যাশ কাউন্টারে ছিলো। অরুনিকার কল আসছিলো, সুজন ধরছে।’

আজ অরুনিকার ফেরার কথা ছিলো। রূপা ফোন নিয়ে দ্রুত কল লিস্টে যায়। শেষ কল অরুনিকার। তিন মিনিটের মতো কথা হয়েছে! নিশ্চয়ই সুজন সব বলে দিয়েছে। ফোনে চার্জ ১%। এখুনি বন্ধ হয়ে যাবে। রূপা এক হাতে ফোন চার্জে লাগিয়ে বললো, ‘দোকানের জিনিসপত্র সব গুছাইছেন আব্বা?’
বারেক বিছানার এক কোণে বসে সরল গলায় বললেন, ‘গুছিয়েই আসছি। তুই ঔষধ খেয়েছিস?’

‘হুম। হোটেল কি বন্ধ করে দিছেন?’

বারেক বিপন্ন গলায় বললেন, ‘এখন বন্ধ। সন্ধ্যার পর দেখি কি হয়।’

‘ওই ছেলে কি আর আসছিলো? ‘

‘না, আসে নাই।’

বাবা-মেয়ের মাঝে নেমে আসে পিনপতন নীরবতা। ভাষার ভান্ডারে যেন বলার মতো কিছুই নেই।
রূপা জানালার বাইরে তাকাতেই বারেক রূপার দিকে তাকালেন। রূপার লম্বা চুলগুলো কাঁধের এক পাশে রাখা। চুলের অবস্থা করুণ। আগা লাল, রুক্ষ। বারেক বললেন, ‘মাথায় একটু তেল দিতি।’

রূপা তাকিয়ে হাসলো। বললো, ‘তেল দিতে ভালো লাগে না। কেমন ভার ভার লাগে।’

‘দিয়ে অভ্যাস করলে ভালো লাগবে।’

রূপা মাথা নাড়িয়ে বললো, ‘আচ্ছা দেব।’

‘আমি যাই, গোসল করতে হবে। তুই একটু ঘুমিয়ে নে।’

বারেক চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর রূপা বাইরে বেরিয়ে এলো। ঘন্টাখানেক শুয়ে-বসে থেকেই অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেছে। কতদিন বাসায় থাকতে হয় কে জানে!

দ্বিতীয় তলার ফাঁকা অংশজুড়ে হাঁটতে থাকে রূপা। তার পরনে ট্রাউজার ও ফতুয়া। তখন সন্ধ্যার আগ মুহূর্ত। আকাশে কমলা রঙের ছোঁয়া। সূর্যাস্তের সময় ঘনিয়ে এসেছে।

রূপা হাঁটতে হাঁটতে রেলিঙের কাছে এসে দাঁড়ালো। পাশের বিল্ডিংটি এক তলার। দুই বিল্ডিংয়ের মাঝে দূরত্ব বড়জোর দুই হাতের। চিলেকোঠার জানালা খোলা। হুট করে ফাইয়াজ চলে আসে। রূপা অপ্রস্তুত হয়ে ওঠে। ফাইয়াজ প্যান্টের পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে সিধে হয়ে দাঁড়ালো। বললো, ‘ একটু আরাম বোধ হচ্ছে?’

রূপা চোখ নত করে বিনয়ের সঙ্গে বললো, ‘আগের চেয়ে ভালো। ধন্যবাদ স্যার।’

‘ধন্যবাদ কেন?’

‘দুপুরে আপনি না আসলে আরো খারাপ কিছু হতে পারতো।’

ফাইয়াজ মৃদু হাসলো। তারপর বললো, ‘আচ্ছা ওইযে লোকটা কি জানি বৈঠকখানা বলছিল, কখন যেতে হবে?’

রূপা অবাক হয়ে তাকায়৷ বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘আপনিও যাবেন?’

‘যাবো না? আমিও তো জড়িত।’

কথাটি শুনে রূপা মনে মনে সাহস পায়, শক্তি পায়। হোটেল হারানোর আতঙ্কটা মুহূর্তে উবে যায়। ফাইয়াজ গেলে নিশ্চয়ই অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে৷ তার পাশে কেউ একজন তো থাকবে!

রূপা প্রফুল্লচিত্তে বললো, ‘সন্ধ্যার পর বললেও আটটা বেজে যাবে৷’

‘তাহলে সাতটা ত্রিশে বের হলেই হচ্ছে?’

‘জি।’

ফাইয়াজ সৌজন্যমূলক হেসে চলে গেল।

রূপা নিজের রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। সিঁড়িতে কারো পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে! যেন সিঁড়ি ভেঙে কেউ ছুটে আসছে। এতো জোরে কে ছুটছে? রূপা উৎসুকভাবে তাকিয়ে রইলো।

অরুনিকা! তার চোখমুখে উৎকণ্ঠা। বেণী থেকে কিছু চুল ছুটে গিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে চোখেমুখে। রূপা মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। অরুনিকা রূপার কাছে এসে ‘দোস্ত’ বলে জড়িয়ে ধরে।

তার বুক হাঁপরের মতো ওঠানামা করছে। রূপা অরুনিকার পিঠে হাত বুলিয়ে বললো, ‘ইশ! এমন পাগলা ঘোড়ার মতো কেউ ছুটে!’

অরুনিকা মুখ তুলে তাকালো। তার চোখ দুটো ভীষণভাবে আহত! কে জানে সুজন কী বলেছে! সুজনের আবার বাড়িয়ে বলার স্বভাব। রূপা বললো, ‘আরে মাত্র তিনটে সেলাই লাগছে। এখন ঠিক আছি আমি। সুজন তোরে কি বলছে?’

অরুনিকা কিচ্ছুটি বললো না। সে রূপার কাঁধ থেকে ফতুয়া সরিয়ে ক্ষত কতটুকু দেখার চেষ্টা করে। রূপা আহ করে উঠতেই দ্রুত ছেড়ে দিয়ে বললো, ‘কার সাথে লাগছিলি তুই? কোন বাপের ব্যাঠার এতো সাহস?’

রূপা রসিকতা করে বললো, ‘হায় হায় বাপের নামটা তো জানা হয়নি।’

‘মজা করবি না একদম। তিনটা সেলাই লেগে গেছে, কি সিরিয়াস ব্যাপার! তুই কি করছিলি? তোর হোটেলে কি ব’টি ছিল না? কো’প দিয়ে মাথাটা আলাদা করে দিতি বে’জন্মাটার। তা না করে মার খেয়ে এলি!’

‘ওরে আমার মাস্তান রে। তোর কথা শুনলেই তো স’ন্ত্রাস-পন্ত্রাস দৌড়ে পালাবে।’

অরুনিকা রাগী চোখে তাকায়। বললো, ‘তোর মুখ দিয়ে যে কেমনে হাসি বের হচ্ছে! সুজন যখন বললো, তোর কাঁধ কে’টে ফেলছে…’

অরুনিকার গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেল। রূপা দাঁতে দাঁত চেপে বললো, ‘ওরে খালি আবার সামনে পাই!’

তারপর কণ্ঠ খাঁদে নামিয়ে বললো, ‘মাত্র তিনটে সেলাই লাগছে। ছোট ক্ষত। সুজনের কথা কখনো বিশ্বাস করবি না। ও বানিয়ে কথা বলে।’

অরুনিকা ফের রূপাকে জড়িয়ে ধরলো। রূপা অরুনিকাকে জড়িয়ে ধরতে গেলে অনুভব করলো বাম হাত ব্যথায় অবশ হয়ে আছে৷ বাম কাঁধে ক্ষত হওয়াতে বাম হাতটা তোলা যাচ্ছে না।

সে এক হাত দ্বারা অরুনিকার পিঠ জড়িয়ে ধরে বললো, ‘এখন সব শেষ। খারাপ সময় ভুলে যাওয়াই ভালো। আয় বসে সূর্যাস্ত দেখি।’

দুটো চেয়ার পাশাপাশি রেখে অরুনিকা বললো, ‘যা ই বলিস রূপা, কেউ তোকে এতো বড় আ’ঘাত দিয়ে আমার মুখোমুখি হবে না ব্যাপারটা আমার হজম হচ্ছে না। তুই ওদের ঠিকানা জানিস?’

‘কি করবি? গিয়ে পি’টাবি?’

‘দরকার পড়লে তাই করবো। পি’টিয়ে চামড়া তুলে বাথরুমের পাপস বানিয়ে রাখবো।’

রূপা সশব্দে হেসে ওঠলো। বললো, ‘আরে এসব বখাটে ছেলেপেলের কী ঠিকানা আছে? কই থেকে আসছে আল্লাহ জানে। হুট করে এসে হাঙ্গামা শুরু করে দিলো।’

রূপা হীরার ঠিকানা জানা সত্ত্বেও লুকিয়ে গেল। বললে অরুনিকা ঠিক চলে যাবে। বিপদ ঘটিয়ে তবেই থামবে৷ কি দরকার প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে ঝুঁকি নেয়ার।

সূর্যাস্তের কমলা রঙ ছড়িয়ে পড়েছে ধরণীতে। সৃষ্টি করেছে এক মায়াবী জগৎ। অপরূপ সৌন্দর্য ! রূপা আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তোর সাথে সূর্যাস্ত দেখার ইচ্ছে ছিল। পূরণ হয়ে গেল।’

রূপার কথা শুনে অরুনিকার মন গলে। সে আকাশের দিকে তাকায়। ইতিমধ্যে কমলা রঙ তাদের মুখশ্রী ছুঁয়েছে। অরুনিকা বিভ্রম নিয়ে বললো, ‘আমার খুব ইচ্ছে তোর সাথে সূর্যোদয় দেখার।’

রূপা তাকালো। আক্ষেপের সুরে বললো, ‘আমরা আজও একসাথে থাকিনি!’

অরুনিকা চেয়ার নিয়ে রূপার পাশ ঘেঁষে বসে। তার ডান বাহু দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘ একদিন থাকবো। রাত জেগে মুভি দেখবো, চাঁদ দেখবো। তোকে শাড়ি পরাবো, আমি শাড়ি পরবো। অনেক ছবি তুলবো। সূর্যোদয় দেখে এরপর ঘুমাবো। আর এই সবটাই হবে কাশ্মীরে।’

‘তাই যেন হয়।’

‘তাই হবে রূপা।’

পশ্চিমাকাশে অল্প অল্প করে ডুবে যাচ্ছে গোধূলির আবিরে রাঙা অস্তয়মান লাল সূর্য। প্রকৃতিতে নেমে আসছে রহস্যময় অন্ধকার। দুই সখি পাশাপাশি বসে বিভোর হয়ে চেয়ে আছে। বন্ধুত্বের ঊর্মিছন্দায় ভেসে যাচ্ছে দূরে, বহুদূরে।

_
হীরা একটার পর একটা সিগারেট টানছে। সদ্য কেনা জিনিসপত্র ভাংচুর করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে ঘরে। রাগে তার ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে।
তিনটে মানুষ তাকে এভাবে আঘাত করলো! হীরা সামনে থাকা জগটি লাথি দিয়ে দেয়ালে ছুঁড়ে ফেলে।

তার পাশে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে দুলাল। জগ দেয়ালে বারি খেতেই বিকট শব্দ হয়৷ সেই শব্দে কেঁপে উঠে সে। দুলাল যতবার হীরার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে ততবার থাপ্পড় খেয়েছে। এখন আর কথা বলার দুঃসাহস নেই।
ঘর থেকে বেরোবারও সাহস নেই। এদিকে ক্ষুধায় পেটের ভেতর গুড়গুড় শব্দ হচ্ছে। আর সহ্য হচ্ছে না!

হীরা প্যাকেটের শেষ সিগারেটটিতে আগুন ধরাতে ধরাতে বললো, ‘ওই খান** ঝি আর ওর বাপরে যদি আমার পা না চাটাই আমি এক বাপের পুত না!’

দুলাল একটু দূরে সরে বললো, ‘আর ওই চশমাওয়ালা বেঠা?’

হীরার চোখদুটো জ্বলে ওঠে। সে কিড়মিড় করে বললো, ‘ওর সব খবর এনে আমারে দিবি। কু’ত্তার বাচ্চারে আমি জ’বাই দেব।’

দুলাল মাথা নাড়িয়ে বললো, ‘জি ভাই।’

কলিং বেল বাজছে। দুপুরের ঘটনার পর অনেকে এসেছে স্বান্তনা দিতে বা উসকে দিতে৷ বার বার এ ও আসায় হীরা ভীষণ বিরক্ত৷ কলিং বেলের শব্দ শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। দরজার ওপাশে যেই থাকুক তাকে যা ইচ্ছে তাই বলে দেয়ার উদ্দেশ্যে হীরা দরজা খুলতে এলো।

দরজা খুলে সে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। হাতের সিগারেট দ্রুত লুকিয়ে ফেললো।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার বাবা হামিদুর রহমান। যার উপস্থিতি অপ্রত্যাশিত! হীরা নত হয়ে হামিদুরের পা ধরে সালাম করলো। হামিদুর তীক্ষ্ণ চোখে হীরার আপাদমস্তক দেখে বললেন, ‘তোমার নাক, কপাল ফুলে আছে কেন?’

হীরা নিশ্চুপ। দুলাল দৌড়ে এসে হামিদুর রহমানকে সালাম করলো। হামিদুর দুলালকে এড়িয়ে হীরাকে বললেন, ‘শুনলাম মাস্তানি করে বাপের সম্মান বাড়াচ্ছো! সত্যি নাকি?’

এবারও হীরা উত্তর দিলো না। হামিদুর রুমের ভেতরটা এক নজর দেখে বললেন, ‘ব্যাগ গুছাও। আগামী সপ্তাহে তোমার বিয়ে।’

হীরা বিনাবাক্যে দ্রুত ব্যাগ গুছাতে শুরু করে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here