সূর্যশিশির পর্ব ১১

0
320

সূর্যশিশির
১১.
মনের মতো অবাধ্য, বেপরোয়া আর দুটো নেই। এতো করে বুঝানো হলো, তবুও কথা শুনলো না। ঠিক ফুসলিয়ে আবার বাজারে নিয়ে এলো! অরুনিকা নিকাবে নিজের মুখশ্রী ভালো করে ঢেকে নিলো।

নতুন বোরকা পরেছে যেন রূপা চিনতে না পারে।
তিন মাস অতিক্রান্ত হয়েছে, সেই মানুষটিকে দেখার! এখনো বুকের অভ্যন্তরে সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভব হয়, অস্থিরতা হয়। এই অনুভূতিকে সে উপেক্ষা করতে পারে না। উপেক্ষা করতে গেলেই হাঁসফাঁস লাগে।
গত তিন মাসে অগণিত বার মানুষটির খুঁজে বাজারে এসেছে। চতুর্পাশে চোখ বুলিয়েও, পুরো বাজার তন্নতন্ন করে খুঁজেও তার সাক্ষাৎ মিলল না।

প্রতিবারই রূপার কাছে হাতেনাতে ধরা পড়েছে।শেষবার রূপা হুমকি দিয়ে বললো, ‘আরেকবার ওদিকে যাওয়ার চেষ্টা যদি করিস, একেবারে কথা বলা বন্ধ করে দেব।’

অরুনিকা আপ্রাণ চেষ্টা করেছে না আসার, পারলো না! মনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে সে। যত চেপে ধরে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য তত বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এ কেমন যন্ত্রণা?

সে ভাবে, ‘একটা মেয়ে মানুষ কী করে এক দেখায় কাউকে এতোটা পছন্দ করতে পারে? আচ্ছা সে মানুষটার কি আমাকে ভালো লাগেনি? ভালো লাগলে নিশ্চয়ই আমায় খুঁজতো।’

অভিমানে অরুনিকার হাঁটার গতি শ্লথ হয়। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, এবারই শেষ। আজ যদি দেখা না পায় আর কখনো মানুষটাকে খুঁজবে না। দরকার পড়লে ঘুমের ট্যাবলেট খাবে। খেয়ে দিনভর ঘুমাবে।

ক্যারাম খেলার দোকানের সামনে এসে দাঁড়াতেই পেছন থেকে কেউ একজন হাত টেনে ধরলো। অরুনিকা চমকে ওঠে। অস্পষ্ট করে উচ্চারণ করলো, ‘রূপা!’

রূপা অরুনিকাকে টানতে টানতে নিয়ে যেতে থাকে। অরুনিকা শুরুতে ভয় পেয়ে গেলেও পরে নিজেকে সামলে নিলো। মুখ গোমড়া করে বললো, ‘তোর কাছে কি জাদুর প্রদীপ আছে? বাজারে এলেই টের পেয়ে যাস। ধুর!’

রূপা না তাকিয়ে কঠিন সুরে বললো, ‘মুখটা বন্ধ রাখ।’

রূপা শক্ত করে হাত ধরে রেখেছে। পথচারী, দোকানদাররা উৎসুক হয়ে তাদের দেখছে। অরুনিকা যতই নতুন বোরকা পরুক, গত তিন মাসে এতোবার বাজারে এসেছে, দোকানদাররা তার হাঁটা দেখলেই চিনে যায় মানুষটা আসলে কে!

অরুনিকা উৎসুক জনতার দিকে তাকিয়ে কিছুটা অস্বস্তিবোধ করলো। চিনে ফেললো নাকি?

রূপা অরুনিকাকে হেঁশেলে এনে ছেড়ে দিলো। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো, ‘তুই কি ধরেই নিয়েছিস আমার কথা শুনবি না? আমার কথার দাম নাই?’

অরুনিকা নিকাব তুলে চেয়ারে বসলো। তার কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। সুজন এক গ্লাস পানি নিয়ে এলো। অরুনিকা গ্লাস হাতে নিয়ে কপাল কুঁচকে ফেললো। সন্দেহ নিয়ে বললো, ‘এতে কি থুথু আছে?’

সুজন তাৎক্ষণিক জিভ কাটে। মাথা ছুঁয়ে বললো, ‘আল্লাহর কিরা, নাই। তুমি হইলা আমগো রূপাবুর নায়িকা, তোমার পানিতে ছেপ দিমু? জীবনেও না। মায়ের কিরা, বাপের কিরা, দেই নাই। যদি পারতাম জমজম কোয়ার পানি আইনা পত্তিদিন খাওয়াইতাম তোমারে।’

রূপা চেঁচিয়ে ওঠলো, ‘সুজন যা এখান থেকে।’

আচমকা চিৎকার শুনে অরুনিকার হাত কেঁপে ওঠে। পানি ছিটকে পড়ে বোরকার উপর। সে দ্রুত চেপে বসলো। পানি খেলো না। রূপার সাথে ঘটে যাওয়া দূর্ঘটনার পর বাজার বৈঠকখানায় বখাটে ছেলেটি আসেনি। সে নাকি একেবারে চলে গিয়েছে। তাই আর বিচার সভাও হয়নি। তখন সুজন জানালো, তার কুকীর্তির কথা!
এরপর থেকেই সে হোটেলে এলে সুজনের হাতে কিছু খায় না। রূপা দিলে তবেই খায়।

সুজন চলে গেল।

অরুনিকাকে চুপচাপ দেখে রূপা পূর্বের সুরেই বললো, ‘মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছিস কেন? বল, আমার দাম নাই? কমে গেছে?’

অরুনিকা অপরাধী সুরে বললো, ‘সরি।’

‘সরিটরি শুনতে চাই না। তুই বল কবে ওখানে যাওয়া বন্ধ করবি?’

‘আমিতো চেষ্টা করি। পারি না।’

‘এই শোন, তোর আর বাজারেই আসতে হবে না।’

অরুনিকা অসহায় ভঙ্গিতে তাকালো। ভেজা কণ্ঠে বললো, ‘তোর হোটেলে আসবো না আমি? কোচিং, বাসা আর এই হোটেল ছাড়া আমার আর যাওয়ার জায়গা আছে? আমারতো আর কোনো বন্ধু নেই। একা লাগলে তোর কাছে চলে আসি। তোর এটা সহ্য হচ্ছে না? আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছিস!’

রূপা অধৈর্য হয়ে বললো, ‘তুই তো শুধু হোটেলে আসিস না, অন্যদিকে চলে যাস।’

অরুনিকা কিছু বললো না। রূপা অরুনিকার পাশে বসে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘এতগুলো বছর আমাকে বুঝিয়ে এলি। একসময় তুই অবুঝ হয়ে যাবি, তোকে আমার বুঝাতে হবে ভাবিনি।’

অরুনিকা অভিমানী সুরে বললো, ‘কী করেছি আমি?’

‘তুই দুই-তিন দিন পর পর বোরকা পরে একটা আবাসিক হোটেলের সামনে ঘুরঘুর করিস। যে হোটেলে নিম্নশ্রেণির কিছু মেয়ে বোরকা পরেই নোংরামি করতে আসে। বাজারের লোক কানাঘুঁষা করে। তোর পাপা জানলে কী হবে? তুই এইটা একবারও ভাবিস না? আংকেল বাসায় বেশি থাকেন না বলে সেই সুযোগে এমন ভুল করে বেড়াবি? তুই একটা সুন্দর, শিক্ষিত, গর্বিত বংশের মেয়ে। তোর এই কাজ সাজে? আবার বহুবার নিকাব তুলে বসে বসে বাদামও চিবিয়েছিস। কেউ বিরক্ত করেনি?’

‘না তো। আমি কারো গায়ে কাদা না ছুঁড়লে আমার গায়ে কেন কেউ ছুঁড়বে?’

অরুনিকার চোরা চাহনিতেই বোঝা যাচ্ছে, সে বহুবার বখাটেদের কুরুচিপূর্ণ আচরণের শিকার হয়েছে৷ কিন্তু রূপার কাছে স্বীকার করবে না। সব সহ্য করে হলেও সেই ছেলেকে বের করবে!

রূপা বলার মতো আর কথা খুঁজে পেল না।

রূপাকে হতাশ হতে দেখে অরুনিকা বললো, ‘এবার সত্যি আর যাবো না। মানুষটাকে আর খুঁজবো না।’

রূপার চোখেমুখে ঔজ্বল্য প্রকাশ পায়। তবুও সন্দেহ নিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘সত্যি?’

‘আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি রে রূপা।’ তার অশ্রুসিক্ত চোখ।

রূপার ভীষণ মায়া হয়। সে চেয়ার টেনে অরুনিকার সোজাসুজি বসে বললো, ‘জানিস, আমারও ইচ্ছে হয় তোর মানুষটাকে দেখার। কে সে? যে এক পলকে এতোটা মায়ায় জড়িয়ে নিলো! এক পলকে প্রেম হয়ে গেল! আমার এলাকায় এক মেয়ে ছিল, রং নাম্বারে এক ছেলের কণ্ঠ শুনেই প্রেমে পড়ে যায়। লজ্জায় নিজ থেকে দুই সপ্তাহ কল করেনি। এরপর যখন করলো, ফোন বন্ধ পায়। দুই বছর অপেক্ষা করে, প্রতিদিন নাম্বারটাতে ফোন দিত। কখনো খোলা পায়নি। মানুষের মন, অনুভূতি কত অদ্ভুত হয়! কেউ মুহূর্তে প্রেমে পড়ে, কেউ সারাজীবন এক ছাদের নিচে থেকেও প্রেমে পড়ে না।’

‘কে এক ছাদের নিচে থেকেও প্রেমে পড়েনি?’

রূপা কপাল চুলকে বললো, ‘ফেসবুকে একজন নিজের জীবন কাহিনি শেয়ার করছে ওখানেই পড়েছি।’

অরুনিকা ছোট করে বললো, ‘ওহ।’

‘এখন বল, সত্যি আর খুঁজবি না?’

‘সত্যি খুঁজবো না। আগের মতো তীব্র অনুভূতিটাও পাই না, ফিকে হচ্ছে সব।’

এই কথা শুনে রূপা খুশি হয়ে গেল। নিজের উরু চাপড়ে উঠে দাঁড়ালো। বললো, ‘তাহলে তো ভালোই হচ্ছে। আর আগেই বলছি জুয়া খেলে এমন ছেলে ভালো হবে না। আল্লাহ ভালোর জন্যই আর তোদের মুখোমুখি করেনি। তোর জন্য শুদ্ধ ছেলে প্রয়োজন। আগাগোড়া সম্পূর্ণ শুদ্ধ হতে হবে।’

‘যদি পেতাম আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে শুদ্ধ করে দিতাম।’

রূপার ঠোঁট থেকে হাসির রেখা মিলিয়ে গেল। সে ক্যাটক্যাট করে বলে উঠলো, ‘এমন ন্যাকামিমার্কা কথা আমার সামনে একদম বলবি না। তোর বয়স কত?’

অরুনিকা থতমত খেয়ে বললো, ‘উনিশ।’

‘কিন্তু কথা তো বলছিস চৌদ্দ, পনেরো বয়সী মেয়েদের মতো। ভালোবাসা দিয়ে শুদ্ধ করতে গিয়েই তো মেয়েগুলো বাঁশ খায়। শোন, একেবারে ভুলে যা। যেহেতু ফিকে হচ্ছে সব। তুইও ফিকে হতে দে। ইচ্ছে করে ভাবনায় আনবি না।’

অরুনিকা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়িয়ে বললো, ‘আচ্ছা।’

রূপা গ্লাস ধুয়ে জগ থেকে নতুন করে পানি নিয়ে এসে বললো, ‘তারপর পড়াশোনার কী অবস্থা? শেষ? না আছে?’

অরুনিকা পানি খেয়ে তৃষ্ণা মিটিয়ে বললো, ‘একদম ঠিকঠাক।’

‘সারাজীবন এভাবে পড়াশোনাকে ভালোবাসবি। যাই হোক ছাড়বি না।’

‘তুই আর পড়াশোনা আমি কখনোই ছাড়ব না।’

রূপার হাসি আরো প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। হাসির মধ্যেই যেন তার সব সৌন্দর্য। সে বললো, ‘আরো কিছুক্ষণ থাকতে পারবি? হোটেলে নতুন ডেকোরেশন হচ্ছে, দেখে যেতি।’

_
মধ্যাহ্নে বারেক, সুজন, রূপা বাড়িতে খেতে এলো। হোটেলে কাজ চলছে বলে রান্নাবান্না করা হয়নি।

রুমি তখন স্কুল থেকে ফিরে। তার চেহারা ক্ষুব্ধ, ভীষণ বিরক্ত। রূপা উঁকি দিয়ে দেখে, রুমি কাঁধের ব্যাগ ছুঁড়ে ফেললো বিছানায়। জুতা জোড়া খুলে লাথি দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো। রূপা খেতে খেতে গলা উঁচিয়ে বললো, ‘কি রে, এতো রেগে আছিস কেন?’

রুমি কটমট করে তাকিয়ে আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। রূপা জানে রুমি তাকে কিছুই বলবে না তবুও জিজ্ঞাসা করলো। না বললে নাই। কিন্তু সত্যিই রুমিকে খুব রাগী দেখাচ্ছে। কোনো সমস্যা হলো নাকি! রূপা সুমনাকে ডেকে বললো, ‘আম্মা, দেখো তোমার মেয়ের কি হইছে।’

সুমনা রান্নাঘর থেকে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে বললেন, ‘স্কুলে মাইরটাইর লাগছে মনে হয়। রুমি…রুমিরে?’

সুমনা দরজার সামনে যেতেই রুমি ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিলো।
রূপা সরল গলায় বললো, ‘তবুও খোঁজ নিতে সমস্যা কী? আর ওরে আমি সেদিন রাতে দেখলাম, কোচিং থেকে বের হয়ে রিক্সা করে অন্যদিকে চলে গেছে। বাসায় এসে বলছে কোচিংয়ে বেশি পড়াইছে। দিনকাল তো ভালো না। ওরে সামলাও। ও আমার কোনো কথাই শুনে না। তিন মাসে তিনটা মেয়ে খু’ন হয়ে গেছে। একা একা যেদিকসেদিক যেন চলে না যায়।’

বারেক খাওয়ার মাঝে বললেন, ‘মেয়েগুলোর খু’নী কি একজন?’

‘আমারতো তাই মনে হয় আব্বা। খু’নের ধরন তো একই।’

‘তুইও সাবধানে চলাফেরা করিস। কি যে হচ্ছে দেশটার!’

‘জি আব্বা।’

রিনি এসে রূপার পাশে বসলো। ধীর কণ্ঠে বললো, ‘আপা, চকলেট?’

রিনির দাঁতে পোকা। সুমনার কড়া নিষেধ, রিনিকে চকলেট দেয়া যাবে না। রূপা মাঝেমধ্যে বাধ্য হয়ে নিয়ে আসে। বার বার ছোট বোন কিছু আবদার করলে কি না করা যায়? রূপা সবার আড়ালে পকেট থেকে চকলেট বের করে রিনির হাতে তুলে দেয়।

সুমনা রুমিকে তখনো ডাকছেন। অবশেষে রুমির জবাব এলো, ‘যাও তো আম্মা, গোসল করবো।’

এরইমধ্যে আশিক, আরমানও স্কুল থেকে ফিরে। দুজনে কেবল পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। সুমনার অনেক বড় সংসার, অনেক দায়িত্ব। তিনি দৌড়ে যান ছেলেদের হরলিক্স প্রস্তুত করতে। এরপর গোসল করিয়ে ঘুম পাড়াবেন, কোচিংয়ে নিয়ে যাবেন। কত কাজ! এতো কাজ করতে দেখে রূপা নিজের অভিযোগগুলো ভুলে যায়। মানুষটা তো কম কষ্ট করে না!

_
গোধুলি লগ্নে কোচিং শেষে নিজেদের ব্যক্তিগত গাড়ি চড়ে বাড়ি ফিরছিলো অরুনিকা। শহরের সবচেয়ে বড় ব্রিজে গাড়ি উঠতেই লক্ষ্য করলো, একটা ছেলে বাইক নিয়ে ঠিক তাদের গাড়ির পেছন পেছন আসছে। সে আরো ভালো করে দেখে, হা হয়ে গেল। তীব্র অনুভূতির ঝাঁকুনিতে স্তব্ধ হয়ে গেল। অবশ হয়ে এলো হাত-পা।

সেই মানুষটা! কালো পাঞ্জাবি, কালো সানগ্লাস পরে বাইক নিয়ে ছুটে আসছে। দৃশ্যটি অরুনিকার তপ্ত মরুর বুকে নিয়ে এলো এক পশলা বৃষ্টি!

সে কিছু না ভেবেই ড্রাইভারকে বলে উঠলো, ‘আংকেল, গাড়ি থামান।’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here