সূচনায় সমাপ্তি ৭

0
177

#সূচনায়_সমাপ্তি
#পর্ব_০৭
#লেখনীতে_নুসরাত_তাবাস্সুম_মিথিলা

পুরনো ব্যথায় আঘাত পেলে মানুষের ঠিক কেমন অনুভূতি হয়? আজকে সেই অনুভূতিটাই অনুভব করতে সক্ষম হলো রূপক। গুছিয়ে নেয়া ফাইলগুলো যেন হাতের বাঁধন ছাড়া হতেই অতি প্রিয় ভূমিকে আলিঙ্গন করে নিল। বিষবাণের ন্যায় সাগ্রতের কথা রূপকের সর্বাঙ্গে বিষ ছড়িয়ে দিল নিমিষেই। নেত্রযুগল ভরে উঠল অশ্রু নামক জলরাশিতে। ঠিক কতটা সময় পেরোলো তা বোধগম্য হচ্ছে না কারো। দু’জনেই যেন প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে নিজেতেই হারিয়েছে।

“স্যার এখানে তো আপনার নাম উল্লেখ থাকলেও আপনার স্বাক্ষর নেই। অথচ আপনার স্ত্রীর নামটি স্বাক্ষরিত। তাহলে আপনাদের মাঝে তো ডিভোর্স হয়নি। একজনের সম্মতিতে আর অপরজনের অসম্মতিতে তো আর সংসার নামক মায়াজাল ছিন্ন হতে পারে না। তবে আপনি কেন বিগত তিন বছর ধরে নিজেকে ডিভোর্সী বলে পরিচয় দিচ্ছেন?” মাত্রাতিরিক্ত আশ্চর্য হয়ে রূপককে পুনরায় প্রশ্নবাণে ঘায়েল করল সাগ্রত।

রূপক নিশ্চুপ, নির্বিকার হয়ে মাটিতে বসে পড়ল। পায়ের জোরও বোধহয় মনের সাথে সঙ্গ দিচ্ছে। সবটা পানসে লাগছে তার। নিজের প্রতি নিজেই যেন বিক্ষুব্ধ। তা আচরণেই প্রতীয়মান হচ্ছে ক্রমশ। সাগ্রত অবাক চোখে অদ্ভুত মানুষটাকে অবলোকন করছে। লোকটা যে এতটা দুর্বল তা বোধহয় কেউ কখনো জানতেই পারেনি। সাগ্রত হাঁটু গেড়ে বসল মাটিতে তারপর বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া রূপকের কাঁধে হাত রাখল। রূপক ছলছল দৃষ্টিতে তাকালো সাগ্রতের দিকে। এই বুঝি অতি মূল্যবান অশ্রুকণা টুপ করে কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়বে। তবে ছেলেদের যে অশ্রুকণা কাউকে দেখাতে নেই! সেই রীতির কী হবে? সাগ্রত পিঠ চাপড়ে রূপককে আশ্বস্ত করলো, আর ইশারায় বললো তাকে “কষ্টগুলোকে ভেতরে জমিয়ে রাখতে নেই, নিজেকে মুক্ত করুন।”

রূপক মুহূর্তে সেই ইশারায় সায় মেলালো। অতি মূল্যবান অশ্রুকণাকে বিসর্জন দিয়ে দিল অতি আবেগে। কিন্তু সেই অশ্রু বিসর্জন পর্ব সম্পূর্ণ শব্দবিহীন, কেবল গড়িয়ে পড়ছে। আর সেই মারাত্মক দৃশ্য সাগ্রতের কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না। কষ্টে তার হৃদয়ধাম ঝাঁঝড়া হয়ে এলো বলে।

কয়েক মুহূর্তব্যাপী দুঃখ বিনিময়ের পর রূপক শান্ত হয়ে বিছানায় বসে রয়েছে। আর সাগ্রত সেও বসে রয়েছে রূপকের ঠিক পাশে। তবে দু’জন মানবের মুখেই শব্দ নেই। পরিবেশ গা ছমছমে হয়ে রয়েছে এই অঘোষিত নিরবতায়।

“স্যার প্লিজ বলুন এই ঘটনাগুলোর প্রকৃত রহস্য। মনের মাঝে এত কষ্ট চেপে রাখবেন না।” বিনম্র কণ্ঠে বলল সাগ্রত।

“কী বলবো বলো? এসব কথা নিজের মাঝে চেপে রেখেই তো বেশ আছি।” এতটুকু বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল রূপক।

“আমাকে বন্ধু ভেবেই বলে ফেলুন।”

“একতরফা সিদ্ধান্তের জোরে সে ছেড়ে গিয়েছে আমায়। কৈফিয়ত দেয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ অবধি দেয়নি সে। সে যে হৃদয়হীনা, স্বার্থপর। আমাকে কী ভালোবেসে ছিল কভু!” ছন্দে ছন্দে নিজের জমিয়ে রাখা আবেগী বক্তব্য সাগ্রতের নিকট জাহির করল রূপক।

১৬.

রুথিলার সামনে থেকে রিমির মৃতদেহ সরানো হয়েছে। কিন্তু তারপরেও সে স্বাভাবিক হতে পারছে না। বারংবার দৃষ্টিপটে সেসব দৃশ্য ভেসে উঠছে। আর দ্বিখণ্ডিত করার মুহূর্ত স্মরণ হলেই শিরা-উপশিরা বেয়ে হিম শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে রুথিলাকে বন্দি রাখার স্থান পরিবর্তন করা হয়েছে। বর্তমানে রুথিলাকে যেই কক্ষে রাখা হয়েছে তা বেশ পরিষ্কার। আর সবচেয়ে বড়ো কথা আবদ্ধ নয়, খোলামেলা।

“কিরে খেয়ে নিচ্ছিস না কেন?” রাফিদ বলে উঠল।

“ভাইয়া বল না এগুলো স্বপ্ন, আমি ঘুমিয়ে দেখেছি।” করুণ কণ্ঠে বলল রুথিলা।

“পাগলামি বাদ দিয়ে খেয়ে নে আর পাসওয়ার্ড বলে দে।” কথাগুলো বলার সময় রাফিদের ফর্সা মুখশ্রীতে রক্তিম আভা ফুটে উঠল।

“তুই সামান্য ইমেইলের পাসওয়ার্ডের জন্য পাগলা কুকুরের মতো আচরণ করছিস কেন? ভাইয়া তোর কী সেই সব দিনগুলোর কথা মনে পড়ে না। আমাদের জীবনটা কত সুন্দর ছিল। কত হাসিখুশি ছিলাম আমরা কিন্তু হঠাৎ ঝড়ে, এলোমেলো হাওয়ায় সবটা তছনছ হয়ে গেলো। ভাইয়া তুই এমন পাষাণ হৃদয়ের হয়ে গেলি কী করে?” বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লো রুথিলা।

সেই করুণ কান্নার সুর পাথরের মন গলিয়ে ফেলতেও সক্ষম হয়ত। ধুর পাথরের আবার মন আছে? এতটুকু ভাবল রাফিদ। তবে আর কিছু ভাবনায় আনতে চাইল না সে। ব্যথায় মাথার ভেতরে টনটন করছে যেন। একটা চেয়ার এগিয়ে নিয়ে তাতে বসল রাফিদ। দু’হাতে মাথা আকড়ে ধরল। আর তা দেখে রুথিলা বলে উঠল,

“কষ্ট হচ্ছে ভাইয়া? তোর মাইগ্রেনের ব্যথা এখনো করে? ভাইয়া আমারও না অনেক কষ্ট হচ্ছে। তুই মেয়েটাকে কেন মেরে ফেললি? তুই তো এমন ছিলি নারে, এমন কেন হলি। ও ভাইয়া তুই তো আমার জীবনের বটবৃক্ষের ছায়া হয়ে ছিলি। সেই তুই আজ এমন করে আমায় কষ্ট দিচ্ছিস? তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছিস কী করে? বল না কী করে?”

রাফিদ আর সহ্য করতে পারল না তড়িৎ উঠে দাঁড়ালো আর রুথিলার দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এগিয়ে গেল। তারপর ওর গাল চেপে ধরে হুংকার করে বলল,

“চুপ কর, আর একটা কথা বললে এখানেই জ্যান্ত পুঁতে ফেলব।”

এতটুকু বলেই রুথিলার মুখ বেঁধে ফেলল রাফিদ। কিছুতেই অতীত ভেবে দুর্বল হওয়া চলবে না। নিজের লক্ষ্যে অনড়, অটুট, অবিচল থাকতে হবে। আর স্বার্থ হাসিল করতে হবে। এসব ভেবেই রাফিদের মুখে ফুটে ওঠে হাসি। রুথিলার উদ্দেশ্যে একটা ভিডিয়ো ক্লিপ প্লে করে দেয় রাফিদ। তারপর বলল,

“খুব তো মানবাধিকার কর্মী হয়েছিস, এবার একটু অমানবিক হয়ে দেখা দেখি। নাহলে এদের সাথে সাথে বাকিদের ক্ষতি হবে।”

ভিডিয়ো ক্লিপটি দেখে রুথিলার অন্তর কেঁপে উঠল। নুরা মারমা, তার স্বামী আর বাচ্চা ছেলেটিকেও তুলে আনা হয়েছে। নুরা মারমার চেহারার বিভৎস অবস্থা। ঠোঁটের কোণে রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। চোখ দু’টো অসম্ভব রকমের ফুলে রয়েছে। শরীরের কাপড়ের কোনো ঠিক নেই, অর্ধ নগ্ন করে রাখা হয়েছে। এই শীতের মাঝে ছোট ছেলেটার ওপরেও কম অত্যা’চার চলছে না। রুথিলা “উম উম” করে শব্দ করে কিছু একটা বলতে চাইল। আর তা বুঝতে পেরে রাফিদ বলে উঠল,

“একটা অকাজের কথা বলবি তো কসম ওদের জানে মে’রে ফেলব।”

রুথিলা অগত্যা মাথা নেড়ে সায় জানালো যে সে কোনো অপ্রয়োজনীয় কথা বলবে না। তারপর পুনরায় রুথিলার মুখ বাঁধন মুক্ত করা হলো। রুথিলা দ্রুত বলে উঠল,

“ভাইয়া ওদের ছেড়ে দাও। ওরা কী করেছে? তুমি বলো আমাকে কী করতে হবে? আর ওদেরকে আবার কবে ধরে আনলে!”

“বলেছি না অকাজের কথা বলবি না! যেদিন খুশি ধরে এনেছি। যা মনে চায় তাই করবো ওদের সাথে। তুই যদি আমার কথা না মানিস তাহলে কিন্তু তোর দোষে ম’রবে ওরা।”

“বলো কী করব আমি?”

“একটু পর হিরন আসবে সব কিছু বুঝিয়ে বলবে তোকে। আর হাত ধুয়ে দিচ্ছি, খেয়ে নে। পালানোর চেষ্টা করিস না। বাঁচতে পারবি না। আর কিছু বলবি!”

“ভাইয়া আমি কী ভুল বুঝলাম আমার রূপককে? তুমি তো দিব্যি বেঁচে আছো।”

এ কথাটুকু শুনে রাফিদ বেশ জোরে হেসে উঠল আর বলল,

“তুই তো গাধা। কোনো কিছু যাচাই করেছিলি? এখনই দেখ তোর মাথার কী অবস্থা? একবার বলছিস আমাকে তুই তো আর একবার তুমি। কাজের প্রসঙ্গে আসি, আর যেই মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছিল তার চেহারা দেখেছিলি? তোর উত্তর আমিই দিচ্ছি, না তো আমি দেখিনি। কিন্তু তোমার জাতীয় পরিচয়পত্র তো ওই লা’শের পকেট থেকে পাওয়া গিয়েছিল। কী তাই না?” প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো রাফিদ।

রুথিলা কিছু বলল না কেবল মাথা নেড়ে সায় জানালো। রাফিদ আবার বলতে শুরু করল,

“ও আমার লোক ছিল যাকে রূপক এনকাউন্টার করেছিল। রূপক একে একে আমার সব লোকজনকে খুঁজে বের করে ফেলছিল যা আমার জন্য হুমকি স্বরূপ। তাই পথের কাঁটা সরাতে ‘নিরপরাধ ব্যক্তিকে নিজের আক্রোশের দরুন হত্যার’ ট্যাগ ওকে লাগিয়ে দিলাম। আর বেঁচারা গেল দারুণ ভাবে ফেঁসে। মনে আছে একবার আমার সাথে ওর ঝামেলা হয়েছিল? তারই শোধ তুলেছি আর পথের কাঁটাও সরিয়েছি। তুই ছিলি ওর মানসিক শক্তির উৎস। তাই তোকেই সরালাম ওর জীবন থেকে। তুই বিনা বেচারা পাগলপ্রায়। কোথায় কোথায় খোঁজেনি তোকে। ইশ তুই যদি দেখতি সেসব। আর তুই তো এতদিন নিজের ছদ্মনামে লিখালিখি করতি তাই তোর খোঁজ পায়নি। তবে কী ভেবে যেন কয়দিন আগে বান্দরবানে এসেছে। ওকে যেভাবেই পারি তাড়াবো এখান থেকে। নাহলে মে’রে ফেলব। তারপর আমার রাস্তা পরিষ্কার। আহারে তোর খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না?” আফসোসের স্বরে কথাগুলো বলল রাফিদ। তারপর বেরিয়ে গেল।

রুথিলা টলটলায়মান নয়নে রাফিদের চলে যাওয়া দেখল। আর ডুকরে কেঁদে উঠল। কার জন্য কাকে কষ্ট দিয়েছে এই ভেবে। রাফিদের প্রতি ঘেন্না হচ্ছে রুথিলার। কতটা অমানবিক হলে নিজের বোনের ঘর ভাঙতে পারে একজন ভাই? আর রূপক সে কেমন আছে? ঠিক যেমনটা ফেলে এসেছিল তেমনটাই নাকি বদলেছে বহুগুণ? কিছুই জানে না রুথিলা। সবটা জানতে চায় সে, সবটা। আজ বাবা-মাকে খুব মনে পড়ছে রুথিলার। তারা যদি জীবিত থাকতেন রাফিদ কী বিপথে যেতে পারতো? একটা সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে অকালে দুনিয়া, নিজের সন্তানদের মায়া ত্যাগ করতে হয়েছিল তাদের। তখন রাফিদ কলেজে পড়ে আর রুথিলা পঞ্চম শ্রেণিতে। সেই থেকেই ভাইয়ের ছায়ায় বেড়ে ওঠা। আর ভাই বলতে অজ্ঞান ছিল রুথিলা। সেই ভাইয়ের আমূল পরিবর্তন স্বচক্ষে না দেখলে সে কোনদিন বিশ্বাস করতো না, মরে গেলেও না। রুথিলার জীবনে বাবার পরে ছিল রাফিদের অবস্থান, এরপরে ছিল রূপকের। ভাইয়ের জন্য স্বামীকে দূরে ঠেলে দিতে দু’বার ভাবেনি সে। রূপকের সাথে প্রণয় হয়েছিল রাফিদের সম্মতিতেই। হঠাৎই যেন অতীতের সব স্মৃতি একসাথে দৃষ্টিপটে ভেসে উঠতে চাইলো। তারই ফলশ্রুতিতে জীবনের সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো একত্রে হানা দিল রুথিলার মনের আঙিনায়।

~ চলবে ইনশাআল্লাহ ~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here