সূচনায় সমাপ্তি ১১

0
215

#সূচনায়_সমাপ্তি
#পর্ব_১১
#লেখনীতে_নুসরাত_তাবাস্সুম_মিথিলা

২২.

“মাত্র দু’টো মেয়ে মিলে আমার এতদিনের সাধনা নস্যাৎ করে দিল! ওদের তো সেই জন্য শাস্তি ভোগ করতেই হবে। অবশ্যই হবে।” কটমটিয়ে কেউ বলে উঠল।

তারপর সে পেনড্রাইভের ভেতরে থাকা ফাইলগুলো নষ্ট করতে নিজের দু’হাতে একটা বিশাল আকারের পাথর উঠালো তারপর তা দিয়ে সজোরে আঘাত করল পেনড্রাইভটিতে। মুহুর্তেই জিনিসটি ছোটো ছোটো টুকরোতে বিভক্ত হয়ে গেল। পেনড্রাইভটিতে বেশ অনেকগুলো স্থিরচিত্র ও ভিডিয়ো ছিল। যার অধিকাংশই উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট। জোরে জোরে কিছুক্ষণ শ্বাস নিয়ে সে পুনরায় একটি ব্যাগ হাতে তুলে নিল। তাতে একটি গো প্রো ছিল। সেটিও মাটিতে ফেলে পাথর দিয়ে আঘাত করে ভেঙে ফেলল। তারপর শব্দ করে হাসতে লাগল। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ছে, সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে পুরোটা দিনের স্মৃতি। মাঘ মাসের শেষ সূর্যাস্তের সেই মনোরম দৃশ্য দেখে উক্ত ব্যক্তির কঠিন হৃদয়েও আনন্দের দোলা বয়ে গেল। এমন মুহূর্তে কাধে সে স্পর্শ পেয়ে পিছু ফিরে তাকালো। তারপর হাসি মুখে বলে উঠল,

“আরে সুহানা যে! কখন এলে?”

“আহ এত বেশি কথা বলছ কেন? সব প্রমাণ লোপাট করেছো?”

“সব করা শেষ।” বলেই উক্ত ব্যক্তি সুহানার কোমর ধরে নিজের কাছে নিয়ে এল। ফুঁ দিয়ে কপালে আছড়ে পড়া কেশগুচ্ছ উড়িয়ে দিল মুক্ত অনলে। সুহানা মুখ লুকালো উক্ত ব্যক্তির উষ্ণ বুকে। হঠাৎই সুহানা অনুভব করল তার কোমরের ঠিক উপরের দিকে ঈষৎ জ্বালাপোড়া করছে আর ক্রমেই তা বেড়ে চলেছে। কোনো ধারালো বস্তু হয়তো ঢুকেছে সেখানটায়। সম্বিৎ ফিরে পেতেই বুঝল কাজটা তার সামনে দন্ডায়মান ব্যক্তিটি করেছে। অতি কষ্টে নিজের হাত যন্ত্রণা হওয়া স্থান অবধি নিয়ে গেল সে। তারপর স্পর্শ করতেই উষ্ণ স্রোতের প্রবাহ নিশ্চিত করলো সুহানা। এই উষ্ণ স্রোত অন্য কিছুর নয়, তার শরীর থেকে প্রবাহিত রক্তের ধারা। তার মানে সে ঠকে গেল! শুষ্ক অধরজোড়া জিভ দিয়ে আলতো স্পর্শে ভিজিয়ে সুহানা বলল,

“শেষমেশ আমায় ঠকালে? তোমার জন্য আমি কী করিনি বলো! রুথিলার সংসার জীবন তছনছ করতে সবসময় লেগে থেকেছি। রূপকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েছি। ওকে অচেতন করে ওর পিস্তল বদলেছি, যেটা দিয়ে মুহিতকে মেরেছিলে। মুহিতের লাশটাকে রাফিদের লাশ বলে সংবাদ সম্মেলন করেছি।”

“ওগুলো তো তুমি নিজের ফায়দা লাভের জন্য করেছ। আমি না বললেও করতে। আর তোমাকে ছেড়ে দেয়া মানে জীবন হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো। সাগ্রত কোনো প্রমাণ রাখে না। স্যরি ডার্লিং, এসো আরেকটু কাছে। আমার তরফ থেকে শেষ চুম্বন তোমার জন্য।” এটুকু বলেই সাগ্রত সুহানার চিবুক ধরে উঁচু করল। তারপর সুহানার অধরযুগলকে নিজ আয়ত্তে আনতে যেই এগুলো, অমনি তড়িৎ গতিতে একটি বুলেট এসে বিকট শব্দের হিল্লোল তুলে সাগ্রতের মাথা ভেদ করে অপর পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে একটি গাছে আটকে যায়। সাগ্রত লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। ঘটনাটি ঘটতে ন্যানো সেকেন্ড সময়ও হয়ত নেয়নি। কিয়ৎক্ষণ স্তম্ভিত নয়নে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে ছিল সুহানা। তারপর ভূপৃষ্ঠের দিকে দৃষ্টিপাত করে দেখে সাগ্রতের নিথর দেহ পড়ে রয়েছে ঠিক তার সামনে। তার নিজের চোখজোড়াও ঝাপসা হয়ে এলো, গুলি করা ব্যক্তিকে দেখতে পেল না। নিজেও ঢলে পড়ল মাটির ওপর। আর কিছুটা সময় রক্তক্ষরণ চললে হয়ত সেও পাড়ি জমাবে মৃত্যুর দেশে।

মূল অপরাধীদের উৎখাত করতে পেরে শামীমের মুখে ফুটে উঠল বিজয়ের হাসি। তারপর সে নিজের পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে কল করল। মুখে স্বস্তির ছাপ ফুটিয়ে বলল,

“রূপক স্যার, অস্ত্র পাচারকারী চক্রের প্রধান কনস্টেবল সগ্রত ও সিলেট জোনের এস আই সুহানা দু’জনেই মৃত। সাগ্রতকে ডাইরেক্ট ফায়ার করেছি। অবশ্য রুথিলা ম্যামের কালেক্ট করা এভিডেন্সগুলোকে সেভ করতে পারিনি।”

“ইট’স ওকে। ইউ হ্যাভ ডান অ্যা গ্রেট জব। ওয়েল ডান ডিয়ার।”

“থ্যাংক ইউ সো ম্যাচ স্যার।” উৎফুল্ল হয়ে এস আই শামীম বলল।

২৩.

প্রতিটি সংবাদ মাধ্যমের আলোচ্য বিষয় দু’দিন যাবৎ একটি ঘটনাকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ থেকে কুখ্যাত সন্ত্রাসী হয়ে ওঠা রাফিদের সকল অপকর্ম একে একে জনসম্মুখে উন্মোচিত হচ্ছে। পাশাপাশি কনস্টেবল সাগ্রত ও এস আই সুহানার রহস্যজনক মৃত্যুর রহস্য। ধারণা দু’জনে সুইসাইড করেছে। কিন্তু কেন? এসব সংবাদ শুনে দেশের জনগণ অবাক তো হচ্ছেই সাথে চরম বিস্মিত। রুথিলা টিভির রিমোট চেপে তা বন্ধ করে দিল। রূপক চমকে উঠল, হঠাৎ পরিবেশ নিস্তব্ধ হয়ে যাওয়ায়। পিছু ফিরে দেখল রুথিলা রিমোট হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে, আয়েশী ভঙ্গিমায়। রূপক কিছু একটা ভেবে বলে উঠল,

“এখন কেমন আছো?”

রুথিলা কথাটি শোনামাত্র তার হাত থেকে রিমোটটি স্বশব্দে ভূপৃষ্ঠে পতিত হয়ে শব্দের আলোড়ন তুলল। রূপক বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে রুথিলাকে দু’হাতে ধরল। তারপর বলল,

“তুমি ঠিক আছো তো? এত দুর্বল শরীর নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে আসলে কেন?”

“আমাদের সম্পর্কে এত ফর্মালিটি কী কখনো ছিল? তুমি আমায় দেখলে বুঝে যেতে আমি কেমন আছি, কী ভাবছি? সেই তুমি আজ আমায় জিজ্ঞাসা করছ আমি কেমন আছি? এটা শোনার পর আমি ঠিক থাকতে পারিনি রূপ। আমি ঠিক থাকতে পারিনি।”

রূপক প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে, রুথিলার কপালে আলতো করে চুমু খেল। তারপর আলতো করে রুথিলাকে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকের মাঝে আবদ্ধ করল। ডান হাত দিয়ে রুথিলার মাথার চুলগুলো ঠিক করে, তার মাথায় দু’বার চুমু খেল। তারপর লম্বা শ্বাস নিল। কিছুক্ষণ ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। অনেকদিন পর রূপকের এতটা কাছে এসে রুথিলার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। তবুও মুখ বুজে দাঁড়িয়ে রইল আর সময়টাকে উপভোগ করতে চাইল। রূপক অস্ফুট স্বরে বলল,

“আমি আজও বুঝি তোমার চাহনীর অর্থ। তবুও অনেকটা সময় পেরিয়েছে তো! স্বাভাবিক কথাবার্তা বলতে গেলেও কেমন যেন অস্বস্তি কাজ করে। আমি জানি আমার সান্নিধ্যে তোমারও এমন অস্বস্তিকর অনুভূতি হচ্ছে। তাই টুকটাক কথা বলে স্বাভাবিক হতে চাইছিলাম। তবে মহারানী যে বড্ড বেশি বুঝে ফেলেন।”

“আমায় ক্ষমা করে দাও রূপ প্লিজ। আর কখনো বেশি বুঝতে চাইব না, তোমাকে ভুল বুঝব না।”

“তোমাকে যদি ক্ষমা নাই করতাম, আবার কী বিয়ে করতাম নাকি? বোকাটা! সবসময় খালি কান্না। আর যেন কাঁদতে না দেখি।” রূপক হাসি মুখে বলল।

“সেদিন আমি অবাক হয়েছিলাম তবে খুব খুশি দ্বিতীয়বারের মত তোমার স্ত্রী হতে পেরে। রূপ, চল দূর সীমানায় পাড়ি জমাই। নিজেদের সংসার পুনরায় সাজাই। যেখানে কোনো ভয় থাকবে না, কোনো ভুল বোঝাবুঝি থাকবে না। শুধু তুমি আর আমি, আমাদের অনাগত ভবিষ্যৎ। আমাদের ছোট্ট পৃথিবী চল না নিজ ভালোবাসায় রাঙিয়ে সাজাই।” রুথিলা রূপকের চোখে চোখ মিলিয়ে বলল।

“প্রেমঘন সন্ধ্যায় শুধু হবে প্রেমালাপন। অন্য কথা হবে কোনো একদিন। শুধু তুমি আর আমিই তো আছি। রাঙাতে চাও নিজেকে আমার রঙিন ভালোবাসার ছোঁয়ায়, ডুবতে চাও আমাতে?”

রুথিলা লাজুক হেসে বলল, “আমি ডুবতে রাজি আছি তোমার খোলা হাওয়ায়।”

তারপর রূপককে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। নিজেদের ভালোবাসাময় খুনসুটিতে কপোত-কপোতি মেতে উঠল। তাদের রঙহীন জীবনে এসেছে রঙের ছোঁয়া। বসন্তের মাতাল হাওয়ায় প্রেমময় সন্ধ্যায় তারা হারালো এক ভালোবাসার জগতে। ফাগুন যে এসেছে প্রেমের বার্তা নিয়ে। সেই বার্তা কী প্রত্যাখ্যান করা যায়?

~ চলবে ইনশাআল্লাহ ~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here