সুখের অ-সুখ পর্ব-২২

0
1297

#সুখের_অ-সুখ
#মম_সাহা

পর্বঃ বাইশ

দরজার সামনে নিজের সহধর্মিণী’কে দেখে ভীষণ বাজে ভাবে চমকে যায় লিয়াকত আলী অর্থাৎ রেদোয়ানের বাবা। চমকে যাওয়া কণ্ঠে ক্ষানিকটা বিষ্ময় মাখিয়ে বলে,
-‘লিলুয়া,তুমি এখানে!’

লিলুয়া নামের রমনী উত্তর দেয় না। কিছুটা সময় মৌণ কাটায়। লিয়াকত আলী পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখের বিন্দু বিন্দু ঘাম টা মুছেন কম্পমান হস্তে। বহু পুরোনো ধূলোমাখা অতীত আকষ্মিক বের হয়ে আসতে পারার ভয়ে ক্ষানিকটা কেঁপে উঠে সে।

সুখ হাসে, ভীষণ প্রকাশ্যে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ঝুলায় ঠোঁটের কোণে। তাচ্ছিল্য মাখা কণ্ঠে বলে,
-‘ভয় হচ্ছে ফুপা? বড্ড ভয়? কী করেছিলেন ফুপা আমার মায়ের সাথে? বেঁচে আছে মানুষটা!

লিয়াকত আলী সুখের প্রশ্নের উত্তর দেন না বরং স্ত্রী’র পানে তাকিয়ে জোড় করে একটু হাসার চেষ্টা করে বললো,
-‘দেখেছে লিলু! মেয়াটা পাগল হয়েছে বোধহয়, কী যা তা বলেছে।’
-‘খুব কী ভুল বলছি ফুপা? আমার মায়ের ডায়েরি’তে সে ভীষণ যত্নে তার অভিযোগ গুলো লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলো, তা কী মিথ্যে ছিলো?’

সুখের জেরা করার ভঙ্গিতে লিয়াকত আলী বুঝলেন যে ছাড় পাবেন না। সে আবার আগের ন্যায় সোফায় বসে পড়লেন। সুখ এগিয়ে গিয়ে লিলুয়াকেও সবার মাঝখানে নিয়ে আসলো। লীলাবতী সুখের দিকে এগিয়ে আসলো, প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-‘কী বলছো আপা? বড় মা তবে পালিয়ে যায় নি?’
-‘না রে লীলা।’
-‘তবে? তুমি কীভাবে জানলে এই চির লুকায়িত রহস্যের খোঁজ?’

সুখ ছোট্ট শ্বাস ফেলে। তার চোখ ভেঙে অশ্রুকণা বাহিরে আসার তীব্র ইচ্ছে জাগায় কিন্তু সে সামলে নেয় নিজেকে। অনেক তো কাঁদিয়েছে জীবন তাকে আজ সব কিছু সুদে আসলে ফেরত নেওয়ার পালা। কেনো তার জীবনটাই সুখহীনতায় কাটাবে? যেহেতু এতটা বিসর্জনের পরও জীবন তার প্রতি নরম হয় নি তবে এবার তার শক্ত হওয়ার পালা। কিছু জিনিস ছিনিয়ে নিতে হয়। দাদীজান একটা কথা বলো, “মেয়ে হয়েছো বলে তুমি সব মেনেই নিবে মানিয়েই নিবে তা তো হতে পারে না,মেয়ে হয়েছে বলে কী বাঁচার শখ জাগে না! বাঁচার জন্য কখনো কখনো স্রোতের বিপরীতে গাঁ ভাসানোই উচিৎ।” আজ দাদীজানের কথা’টা ফলানোর দিন। অনেক তো হলো মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়া।

সুখ একটা চিঠি, রুমাল আর ডায়েরি ছোট্ট টেবিলটার উপর রাখলো। লীলাবতী’র দিকে তাকিয়ে বললো,
-‘মনে আছে লীলা, প্রায় মাস খানেক আগে লাইব্রেরী’র রুমে একটা চিঠি পেয়েছিলাম! সে কার লিখা জানিস?’
-‘না তো আপা। আমাদের বাড়ির কারো লিখা তো ছিলো না।’

সুখ রুমালটা উঠায়, লীলাবতী’র সামনে রুমালে সুক্ষ্ম লিখা গুলো মেলে ধরে বলে,
-‘দেখতো এ লিখা গুলো চিনিস কী না?’

লীলাবতী কতক্ষণ লিখা গুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে তড়িৎ বেগে মাথা নাড়িয়ে বিষ্মিত কণ্ঠে বলে,
-‘হ্যাঁ, হ্যাঁ আপা, এই লিখা গুলো আমি চিনি। লাইব্রেরী’র রুমে পাওয়া চিঠির লিখা আর এগুলো প্রায় এক। প্রায় বললে ভুল হবে, পুরো একরকম। কার লিখা আপা এগুলো?’
-‘আমার মায়ের।’

লীলাবতী অবাক নয়নে তাকায় সুখের দিকে, দু’কদম পিছিয়ে যায় যেনো। নিজের ভিতরে উত্তেজনা চাপিয়ে না রেখে সে তৎক্ষনাৎ সেটা প্রকাশ করে বলে,
-‘ছেলেদের প্রতি এমন তীব্র ধিক্কার মাখানো চিঠিটা তবে বড় মায়ের ছিলো! কিন্তু আব্বু তো এমন মানুষ ছিলেন না। তবে! ধিক্কারটা কার প্রতি ছিলো?’

-‘আব্বু বাদেও পৃথিবীতে অনেক নরপশু আছে। তাদের’কেই বলেছে আম্মু। আর দুর্ভাগ্যবশত এমন মানুষ আমাদের পরিবারেই উপস্থিত ছিলো। যা আমার মা বুঝতে পেরেছিলো যার দরুন সে এখন চরিত্রহীনার ট্যাগ লাগিয়ে উধাও হওয়া মানবী। আদৌও সে চরিত্রহীনা ছিলো কিনা কেউ জানার চেষ্টাও করলো না রে লীলা। আসলে নারী জাতদের সমাজে এই অবস্থানই, কোনো কিছু না করলেও তারা দোষী। নারীর হাজারটা ভালো কাজ তারা এক নিমিষে ভুলে যায় যখন সামান্য মশলা মাখানো খারাপের আভাস পায়। যাচাই-বাছাই করার প্রয়োজনও বোধ করে না।’

এবার লিলুয়া মুখ খুললো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-‘কুহেলিকা মানে সুখের মায়ের সাথে বড্ড অন্যায় হয়েছে, আর সে অন্যায় কত বছর আগে আমার স্বামী করেছিলো। আমি সবটা জেনে বুঝেও চুপ ছিলাম যার ফলস্বরূপ আমিও অন্যায়ের অংশীদার হয়ে গেছি।’

লিয়াকত আলী সবাই কিছু বুঝার আগেই তার সাথে থাকা পিতলের ফুলদানি’টা উঠিয়ে লিলুয়ার দিকে ছুঁড়ে মারলো। আর দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ফুলদানী’টা লিলুয়ার কপালে ছিটকে পড়ে। ফিনকি দিয়ে বের হয়ে আসে ভয়ংকর রক্ত সাথে লিলুয়ার ব্যাথাময় আর্তনাদ। লিয়াকত আলী ফুঁসে ওঠে বলে,
-‘সেদিন তোকেও পুঁতে ফেলা উচিৎ ছিলো। তাহলে আর তুই আমার কাল হয় দাঁড়াতি না।’

লিলুয়ার মাথায় রক্তের জোয়ার দেখে সুখ এগিয়ে যেতেই লিলুয়া থামিয়ে দেয় তাকে,কপালে হাত দিয়ে রক্ত টা মুছে নেয়। তবুও রক্ত টপ টপ করে পড়ছে। লিলুয়া স্বামীর দিকে এগিয়ে যায়,সবাই’কে অবাক করে দিয়ে তার নরম হাতের শক্ত চড় লাগায় স্বামীর গালে। সবাই রীতিমতো হতবাক। সবসময় লিলুয়া স্বামী প্রীতি দেখাতো এবং তা অতিরিক্তই ছিলো। আর আজ! এমনকি লিয়াকত আলীও লিলুয়ার এহেন আচরণে অবাক।

লিলুয়া তার স্বামীর বা’গালে আরেকটা চড় দিয়ে উচ্চস্বরে ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
-‘এই চড় গুলো যদি অনেক বছর আগে দিতাম তাহলে হয়তো আজ কুহেলিকা এখানে থাকতো। সবার জীবন ধারা থাকতো অন্যরকম। সুখের জীবনটাও অন্য ধারায় বইতো। তুমি এখন অস্বীকার করো সবটা! এত বড় কলিজা যে এত বড় মিথ্যা টা অস্বীকার করো? তোমার সব সত্যি’র প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমি। আমার সামনে অন্তত বুক কাঁপা উচিৎ ছিলো তোমার। তুমি কুহেলিকা ভাবী’রে অসম্মান করো নি? ভাইয়ার মনে কুহেলিকা’র নামে সন্দেহ প্রবেশ করাও নি? ওদের সংসারে আগুন লাগাও নি? পবিত্র মানুষটা আজও চরিত্রহীনা নামে আখ্যায়িত হচ্ছে কেবল তোমার জন্য। মানুষটাকে তো তুমিই বাঁচতে দিলে না।’

পুরো ড্রয়িং রুম জুড়ে পিনপতন নীরবতা। সবার মুখে যেনো কুলুপ এঁটেছে। অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু শুনলে প্রতিক্রিয়া তো এমনই হওয়া উচিৎ।

লিয়াকত আলী এবার সোফার হ্যান্ডেল ধরে বসে পড়লেন। আজ তার স্ত্রী’র পরিবর্তন তার গালে যেনো হাজার চড় ফেলেছে। মাথা নত করে সে বললো,

-‘হ্যাঁ হ্যাঁ সব আমিই করেছি। আমি করেছি সব। কি করতাম আমি! কুহেলিকা’র প্রতি আমার আকর্ষণ কাজ করতো। কিন্তু যখন তাকে সেটা জানালাম অনেক সুখে থাকার অঙ্গীকার দিলাম সে মুখ ফিরিয়ে নিলো। আমাকে ভয় দেখালো সে সব আজাদ শেখ মানে সুখের বাবা’কে বলে দিবে। আমার এত মান সম্মান ধূলিসাৎ হয়ে যাবে ভেবে আমি ভয়ে ছিলাম। লিলুয়া কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলো। কিন্তু ততদিনে কুহেলিকা’র রূপ যৌবন আমার সর্বনাশ করে ফেলেছে। তাকে আমার একটুর জন্য হলেও প্রয়োজন এমন একটা রাগ মাথা চড়ে বসেছিলো। অবশেষে একদিন সবাই যখন পুরো বাড়ি খালি রেখে বিয়ের আয়োজনে গেলো আমি সে সুযোগটার কাজে লাগালাম। নিজের অনেক দিনের মনোবাসনা পূরণ করলাম। মাথায় যখন নিজের করা কাপুরুষতা’র কথা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো ততক্ষণে অনেক দেড়ি হয়ে গিয়ছিলো। ছোট্ট সুখ তখন খাটে চিৎকার করছে। কুহেলিকা জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে ছিলো। লিলুয়াও সে মুহূর্তে সেখানে হাজির হয়, এটা দেখে ফেলে। তাকে আমি ভয় দেখিয়ে আরেকটা রুমে আটকিয়ে রাখি। বলেছি সে যদি এটা কাউকে জানায় তবে রেদোয়ান’কে আমি মেরে ফেলবো। লিলুয়া ততক্ষণে ভয়ে মূর্ছে যায়। আমি কী করবো ভেবে না পেয়ে, মেরে ফেলি কুহেলিকা’কে। তারপর আলমারি থেকে তার কিছু স্বর্ণ গয়না বের করে তাকে সহ একটা বস্তায় ভরে পুঁতে রাখি তোমাদেরই বাড়ির পিছের জায়গাটাতে। কারণ সেখানটা তখন আরও জঙ্গলের মতন ছিলো। লিলুয়া’কে নিয়ে চলে যাই নিজের বাড়ি। লিলুয়া নিজের ছেলের ভয়ে মুখ খুলে নি। অতঃপর কুহেলিকা’কে পাওয়া যাচ্ছে না জানাজানি হলে আমিই প্রথম তুলি যে সে আরেকজনের সাথে পালিয়েছে। যেহেতু আজাদের মনে আগেই সন্দেহ ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম সেহেতু আজাদও ধীরে ধীরে এটা বিশ্বাস করে। আর এভাবে পৃথিবী থেকে আমি লুকিয়ে ফেলি আরও একটা সত্যি।’

-‘আদৌও সত্যি লুকাতে পেরেছেন মি.লিয়াকত!’

গম্ভীর আর ভরাট পুরুষালী কণ্ঠে লিয়াকত সেখানে ফিরে তাকায়। কণ্ঠটা মেঘের ছিলো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মেঘ, ইউসুফ এবং কিছু সংখ্যক পুলিশ।

লিয়াকত দাঁড়িয়ে যায়। সুখের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত কণ্ঠে বললো,
-‘তুমি তবে আমাকে ফাঁসিয়ে দিলে?’

সুখ ততক্ষণে কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো,
-‘আমি আপনাকে ফাঁসিয়েছি? আপনি চিরতরের জন্য সুখের জীবনে অ-সুখে ডুবিয়েছেন সেটা? আজ আমি সন্দেহের বশে মায়ের এতদিন যাবত বন্ধ থাকা রুমটা খুলে অনেক ঘেটে খাটের নিচে ট্রাঙ্ক থেকে এই ডায়েরি’টা ভাগ্যিস খুঁজে পেয়েছিলাম। তাই তো আমার মা নামক অভাগীনির কলঙ্কের দাঁগ একটু মোচন করতে পারলাম। তার ডায়েরিতে ধোঁয়াশা না রেখে ভাগ্যিস লিখেছিলো লিয়াকত নামক পুরুষে আজকাল তার বড্ড ভয় হচ্ছে। ভাগ্যিস, এত বছর পর আমার ফুপি’র আমার জন্য মন গললো, তার পাপের প্রায়শ্চিত্তের জন্য সব স্বীকার করলো নাহয় সারাজীবন চরিত্রহীনা’র মেয়ে শুনেই মরতে হতো।’

লিলুয়া চুপ রইলো। মেঘ সুখের পাশে এসে দাঁড়ালো। সুখের হাত পা ভীষণ কাঁপছে। ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি বোধহয় ফুরিয়েছে। মেঘ শক্ত হাতে সুখ’কে আগলে ধরে। সুখ অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। তার দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি হচ্ছে না। ধীরে ধীরে সে লুটিয়ে পড়ে মেঘের বাহু বন্ধনে। মেঘের শার্টের এক কোণা আকড়ে ধরে বলল,
-“পুরুষের আকর্ষণ বুঝি এতই খারাপ! নারীদের বুঝি সুন্দর ভাবে বাঁচার অধিকার নেই?”

#চলবে

[দেড়ি হওয়ার জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখীত]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here