সুখের অ-সুখ পর্ব-২৩

0
1315

#সুখের_অ-সুখ
#মম_সাহা

পর্বঃ তেইশ

সুখ পাগলের মতন কান্না করছে, মায়ের মৃত্যু রেশ যেনো তাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। মা’কে নতুন করে একটু দেখা আর ছোঁয়ার ইচ্ছায় মরুভূমি হচ্ছে হৃদয় জমিন। জ্ঞান ফেরার পর প্রায় ঘন্টাখানেক সে চিৎকার করেই কেঁদেছে। ভীষণ কান্না যাকে বলে, দমবন্ধকর কান্নার দাপটে নড়ে উঠেছে পরিবারের প্রতিটা সদস্য। অবশেষে কাটখোট্টা’র ন্যায় সানজিদা বেগমের কঠোরতার দেয়াল ভাঙলো। সুখের কাছে এসে পরম মমতার আলিঙ্গনে জড়িয়ে নিলো তাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে রাজ্যের স্নেহ ঢেলে দিয়ে বললো,
-‘আমি কখনোই তোমার মা হতে পারি নি। সত্যি বলতে আমি মা কিংবা স্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা রাখি নি। আমি আদৌ মানুষ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছি কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ। তবুও আমি তোমায় বলছি, পৃথিবীতে ভালো মানুষ খুব অল্প সময়ই বেঁচে থাকে। তোমার মায়ের চলে যাওয়াটা হয়তো নির্মম ছিলো,কিন্তু বিশ্বাস করো সে আজও আমাদের আশেপাশে আছে। অনুভব করলেই তুমি বুঝবে তোমার মা কত গোপনে লুকিয়ে আছে তোমার হৃদয় মাঝে। মায়েরা কখনো মরে না।’

সুখ থামে না, বরং এ কথা গুলো তার কান্নার পরিমাণ দ্বিগুণ করে দেয়। এই জীবনে এত কান্না সে কখনো কাঁদে নি। আজ কাঁদছে। মা’কে সে কখনো দেখে নি কিন্তু তবুও কাঁদছে। মায়ের সাথে সন্তানের টান যে এখানেই।

চারপাশে আঁধার করে ভীষণ বাতাস, ধুলোবালি উড়ছে। বিকেল বেলা’টা যেনো গভীর রাতে রূপান্তরিত হলো। সুখ আচমকা খাট থেকে নেমেই ছুট লাগালো। হঠাৎ এমন কান্ডে হতভম্ব সবাই। তৎক্ষণাৎ তার পিছু ছুট লাগালো সবাই। মেয়েটা না আবার কিছু করে বসে ভেবে বুক কাঁপলো মেঘের।

বাড়ির পিছন দিকে এসে একটু থমকালো সুখ। ফুপা মা’কে ঠিক কোথায় পুঁতে ছিলো ভেবে পায় না সে। দিক বেদিক দিশেহারা’র মতন খুঁজে গাছের আড়াল থেকে কোদাল টা তুলে নিলো। বাতাস,ধুলোবালিতে প্রায় জবুথবু হলো কিন্তু থামালো না মাটির উপর কোদালের কোপ। কখনো এখানে একটু গর্ত খুঁড়ছে, কখনো ওখানে।

মেঘ দ্রুত এসে সুখের হাত ধরলো। বোঝানোর চেষ্টা করে বললো,
-‘পাগল হলেন অপরিচিতা! কী করছেন এগুলো?’

-‘আমার মা’কে আমি একটু দেখবো মেঘ সাহেব। আমি একটু ছোঁব তাকে। এই, এই মাটির নিচেই তো তাকে রেখেছিলো। আমি খুঁজে বের করবো। মা নামক স্বর্গের স্বাদ আমি নিবো। ঐ সৃষ্টিকর্তা বড্ড নিষ্ঠুর মেঘ সাহেব। বড্ড নিষ্ঠুর। সে আমায় বাঁচার কারণ কেড়ে নিয়েছে অথচ মৃত্যু দেয় নি।’

-‘আপনার মা’কে এখানে মাটি দেওয়া হয়েছে প্রায় একুশ বছর আগে। এতদিনও সে এখানে থাকবে? হাড় গুলোও বোধহয় মিশে গেছে।’

-‘ না, নাহ্। মোটেও এমন কথা মুখে আনবেন না। আমি মা’কে দেখবো। আমি জানি আমার মা এখানেই আছে। আমি খুঁজবো।’

সুখের পাগলামি ততক্ষণে আকাশ ছুঁয়েছে। সে কারো কথা শুনছে না। পাগলের মতন এখানে ওখানে গর্ত করছে। হঠাৎ একটা গর্ত করার সময় কোদালের সাথে জেনো কিছু একটা সংঘর্ষ হলো। সুখ অবাক হলো, আবার কোপ দিতেই শব্দটা দ্বিগুণ হলো। এবার বাকি সদস্য রাও হতভম্ব। মেঘ সুখের বাহু ধরে একটু দূরে নিয়ে স্বান্তনার স্বরে বললো,
-‘আপনি দাঁড়ান, আমি দেখছি। আমি খুঁজছি।’

সুখ শান্ত হলো। মনের কোণে যুক্তিহীন ক্ষীণ আশা জেগে উঠলো। মেঘ মাটি খুঁড়তে যাওয়ার আগেই ইউসুফ সেখানে চলে যায়। আশ্বাসের স্বরে বললো,
-‘আপনি ভাবী’কে ধরে দাঁড়ান আমি দেখছি।’

মেঘ মাথা নাড়িয়ে সুখ’কে ধরে দাঁড়ালো। এবার সুখ না, উপস্থিত সবার মাঝে ভীষণ অনাকাঙ্খিত কৌতূহল জেগে উঠলো। ইউসুফ মাটি টা একটু ভালো করে সরাতেই একটা বড় ধারালো রামদা চোখে পড়লো। ইউসুফ কী ভেবে পকেট থেকে নিজের রুমালটা বের করে রামদা’টা মাটি থেকে তুললো। রামদা’টাই এখনো কালো হয়ে কিছু একটা লেগে আছে। খুব সম্ভবত রক্ত।

সবাই আৎকে উঠলো। দু’পা পিছিয়ে গেলো উত্তেজনায়। কেবল একজনের উত্তেজনা জাগে নি, জেগেছে ভয়। এবার বুঝি তার সত্যিও বেড়িয়ে আসবে! পাপ যে বাপকেও ছাড়ে না।

রামদা’টা দেখেই সবাই আন্দাজ করতে পেরেছে এটা দ্বারা কি কাজ করা হয়েছে। সানজিদা বেগম দ্রুত পুলিশ অফিসার’কে কল লাগায়। সুখ চুপ করে রয়। আবারও নতুন ঝড় আসবে। টিকে থাকতে পারবে তো সে! নাকি নতুন ভাবে ভেঙে গুড়িয়ে যাবে সে! সুখের জীবন তবে এমন অ-সুখে’ই কাটবে!

——

গতকালকের দিনটা খুবই বিশ্রী ছিলো। তবে,আজ শুভ্র রাঙা রোদ উঠেছে। সুখ বেশ স্বাভাবিক। নিজের স্বামীর বাড়ি ফিরে এসেছে। ঐ বাড়ি’তে থাকলে তার নাকি দমবদ্ধ মনে হয়। সকাল সকাল উঠে স্বাভাবিক ভাবে সব কাজকর্ম সম্পন্ন করেছে। বিকেলে আবার ঐ বাড়িতে যেতে হবে রামদা’র রহস্য জানার জন্য। পুলিশ অফিসার আজকে সবাই’কে থাকতে বলেছে।

ঘামে চুপ চুপ শরীরটা’কে বিশ্রাম দিতে চলে যায় স্নানাগারে। দীর্ঘ এক স্নানের পর রুমে আসতেই ড্রয়িং রুম থেকে কথার শব্দ ভেসে আসলো। মিনা’র, ছোটমা’র,ইউসুফ এমনকি মেঘের কথা’র শব্দও ভেসে আসছে। সুখ অবাক হয়। এত তাড়াতাড়ি বাড়ি আসার কথা তো মেঘের ছিলো না, তবে!

দ্রত পায়ে এগিয়ে যায় ড্রয়িং রুমের দিকে। বেশ কথা কাটাকাটি হচ্ছে মেঘ ও ছোট মায়ের মাঝে। সুখ সেখানে উপস্থিত হতে মেঘ অভিযোগে’র স্বরে বললো,
-‘দেখেন না অপরিচিতা, ছোট মা নাকি এ বাড়িতে আর থাকবে না। সে নাকি কোনো এতিমখানায় থাকবে।’

সুখ কিছু বলতে উদ্যোত হতেই রুমি বেগম তাকে থামিয়ে দেয়, শীতল কণ্ঠে বলে,
-‘না সুখ, আমি স্থির করে নিয়েছি। এ বাড়িতে আমি আর থাকতে পারছি না। আমার খালি ওদের কথা মনে পড়ে। আমি বাকি জীবন’টা কোনো এতিমখানায় কাটিয়ে দিবো। তাদের মাঝে আমি তোদের প্রতিচ্ছবি গড়ব, কাটিয়ে দিবো বাকি কয়েকটা বছর। আর না করিস না।’

সুখ মনে মনে তাচ্ছিল্য হেসে বলে উঠলো,
-‘সে বাচ্চা গুলো নিষ্পাপ। তাদের ভিতর স্বয়ং ফেরেশতা। কিন্তু ছোটমা তোমার ছেলে, সে তো নর্দমার কীট। তার সাথে ওদের মিলাচ্ছো!’

কিন্তু আফসোস! সে কথা গুলো মুখ ফুটে উচ্চারণ করতে পারলো না। আটকে গেলো কণ্ঠনালী অব্দি।

বেশ খানিকক্ষণ ইউসুফ, সুখ, মেঘ ভদ্রমহিলা’কে বোঝানোর চেষ্টা করলো কিন্তু সবাই ব্যর্থ। কেবল মিনা চুপ রইলো। রান্নাঘরের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলো থম মেরে। ভুলবশত সে বড় ভুল করে ফেলেছে। এ ভুলের মাশুল না আবার সুখ’কে দিতে হয়।

বেশ বাকবিতন্ডার পর অবশেষে হার মানলো সবাই। রুমি বেগম বিদায় নিলেন চিরতরে। যাওয়ার আগে সুখ’কে ফিসফিস করে বললো,
-‘হঠাৎ করে তুমি আমার গলার কাঁটা হয়ে গেলে। তোমাকে না গিলতে পারছি, না উগড়ে ফেলতে পারছি। তবে,তোমাকে উগড়ে ফেলার করুন ইচ্ছেটা আমার ঠিক নেই। আজ অনুভব করছি, কিছু কাটাঁ থেকে যাওয়া ভালো। ভালো থেকো তোমার সাম্রাজ্যে।’

সুখ বুঝতে পারে নি রুমি বেগমে’র হঠাৎ এহেন তিক্ত কণ্ঠের কারণ। তবে তিক্ততা’র মাঝে বিষাক্ততা ছিলো না। কিন্তু এমনটা বলার কারণ কী!

——–

সুখের শরীর’টা বেশ খারাপ। ভীষণ মন খারাপ আর অসুস্থতা নিয়েও হাজির হয়েছে বাবা’র বাড়ি। দুইদিন আগে বলেছিলো খুনি’র ব্যাপারে জানা যাবে কিন্তু সেদিন বিকেলে খোঁজ আসলো কিছু সমস্যা’র কারণে তারা আসে নি। একবারে পাঁকা পোক্ত প্রমাণ নিয়েই নাকি আসবে। তাদের কাছে এখন যথেষ্ট শক্ত প্রমাণ আছে।

সুখদের ড্রয়িং রুম জুড়ে পিনপতন নীরবতা। মেঘেরও মন ভীষণ খারাপ। ছোটমায়ের চলে যাওয়া’টা সেও মানতে পারে নি।

সুখ বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়, ধীর পায়ে হেঁটে যায় বাবা’র লাইব্রেরীটার দিকে। ধূলোহীন বই গুলো একটু নেড়েচেড়ে দেখে। কেউ একজন ভীষণ যত্ন নেই রুমটা’র। দেখেই বুঝা যাচ্ছে। খুব ভুল না হলে কাজ’টা লীলাবতী করে। মেয়েটা কেমন বদলে গেলো হঠাৎ করে। যেনো অগ্নি হঠাৎ করে জলে রূপান্তরিত হয়েছে।

হঠাৎ মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো সেদিন রাতের মসৃনের সাথে বিরাট কথোপকথন। হ্যাঁ, এবার লীলাবতী’র কাছ থেকে সত্যি টা জানতে হবেই। লীলাবতী’র আড়ালে থাকা সত্যি টা এবার সবার সামনে আসা উচিত।

ইতিমধ্যে বাহির থেকে ভরাট পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে আসছে। অফিসার বোধহয় এসে গেছে। আচমকা সুখের বুকের ভিতর ছ্যাৎ করে উঠে। আচ্ছা, যদি মানুষটি মেঘ সাহেব হয়!

সুখ দ্রুত পা’য়ে বেড় হতে নিলেই দরজার পাশে থাকা টেবিলের কোণে ধাক্কা খায়। ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠে সে। টেবিলে’র উপরে কিনারায় থাকা খোলা ডায়েরিটাই নজর যায় সুখের। পুরোনো হয়েছে বলে মলাট টা খুলে গিয়েছে। বাবার হাতের লিখা সেখানে প্রতিফলিত হচ্ছে। সুখের ডায়েরির পাতা উল্টিয়ে দেখলো কতরকমের লিখা। খুব যতনে সংসার নাম রণক্ষেত্রের ছোটখাটো বিশ্লেষণ দেওয়া। ডায়েরী’টার ঠিক মাঝামাঝি পৃষ্ঠায় লিখা,
“জীবন যেথায় যেমন চলে,গাঁ ভাসাও তার তালে তালে,
রাজা হতে বিপরীতে যেও, কিন্তু তলিয়ে যেও না অতলে।”

সুখ ডায়েরী টাতে হাত বুলিয়ে খুব যতনে টেবিলের পাশটাতে রেখে ড্রয়িংরুমটাতে এগিয়ে গেলো।

ড্রয়িংরুমে সবাই উপস্থিত হতেই অফিসার বলে উঠলেন,
-‘আপনারা যে রামদা’টা দিয়েছেন, আপনারা পরীক্ষা করার আগেই হয়তো বুজেছেন সেটা দিয়ে কী করা হয়েছে। তবুও বলছি, এটাই সেই অস্ত্র যেটা দিয়ে ভিক্টিম’কে খুন করা হয়েছে।’

সবার ভিতরে চাপা থাকা সন্দেহ টা সত্যি’তে রূপান্তরিত হলো। একজনের তো গলা শুকিয়ে এলো।

সুখ নিরবতা ভেঙে শীতল কণ্ঠে বললো,
-‘খুনটা কে করেছে স্যার?’

-‘খুনটা কে করেছে তা আমরা একটু দ্বিধায় আছি। কারণ অস্ত্র টার মাঝে কারো হতের চিহ্ন ছিলো না। অনেক দিন কেটে গেলে ফিঙ্গার প্রিন্ট না থাকাটাই স্বাভাবিক।’

ড্রয়িং রুমের কোণায় থাকা মানুষ স্বস্তির শ্বাস ফেললো। পরক্ষণেই পুলিশ অফিসার বললো,
-‘তবে!’

সানজিদা বেগম অবাক কণ্ঠে বলে,
-‘তবে কী!’

-‘তবে আমাদের সন্দেহের তালিকায় একজন আছে। খুব বেশিই সম্ভাবনা খুনটা সে করেছে।’

সুখের ছোট চাচা বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
-‘কে সে?’

-‘সে হলো মেঘ।’

সুখ দু’কদম পিছিয়ে যায়। সোফার হ্যান্ডেল ধরে নিজেকে কোনরকম দাঁড় করিয়ে রেখে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে,
-‘মেঘ সাহেব!’

-‘হ্যাঁ মেঘ। আর যথেষ্ট কারণও আছে এ সন্দেহের। তাই আপাতত মেঘকেই আমরা এরেস্ট করবো।’

সুখ সোফায় বসে পড়ে। যা ভয় পেয়েছিল তবে কী তা-ই হবে! মেঘ সাহেবই তবে এ কাজটা করেছে!

সবার মাঝে যখন হঠাৎ বিস্ফোরণ হলো তখন ড্রয়িং রুমে উপস্থিত থাকা এতক্ষণের ভীত মানুষটা প্রচন্ড সাহসী হয়ে উঠলো। দু’কদম এগিয়ে এসে বললো,
-‘খুনটা আমি করেছি অফিসার।’

এ জেনো নিস্তব্ধ বজ্রপাত। সবার জেনো বিশ্বাসই হচ্ছে না। অথচ অফিসার রহস্যময় বাঁকা হাসি হাসলেন।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here