সুখের অ-সুখ পর্ব-২১

0
1208

#সুখের_অ-সুখ
#মম_সাহা

পর্বঃ একুশ
(লেখিকার অনুমতি ব্যাতীত কপি নিষেধ)

ভয়ঙ্কর অগ্নিসংযোগের ঘটনায় পুরো বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কেবল ধ্বংসাবশেষ হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে পুড়ে যাওয়া কালো দু’তালা বিল্ডিং এর অস্তিত্ব। বাড়ির ভিতরে থাকা মানুষ গুলো ঘুমিয়ে ছিলো বিধায় বের হতে পারে নি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বেশ চেষ্টা করে এই ভয়ঙ্কর অগ্নিকান্ড থামিয়েছে।

পথের ধারে বসে আছে মেঘ, রুমি বেগম। সুখ দুজনকে সামলাতে বেশ হিমশিম খাচ্ছে। এখন রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। এতক্ষণ চারপাশে অনেক মানুষের ভীড় থাকলেও এখন সেটা খুব স্বল্প আছে। দু’জন মানুষ খুব বেশিই ভেঙে গেছে। মেঘ তো কতক্ষণ কেঁদেছে ঠিক নেই। সুখ দু’জনকেই থামিয়েছে। অবশ্য দু’জনকে থামাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে তাকে।

বাড়ির ভিতরে কোনো জিনিসই অক্ষত নেই। মানুষ গুলোর অব্দি এক অংশ পরিশিষ্ট নেই। কী ভয়ঙ্কর আগুন ছিলো! গ্রাস করে নিলো সবটা, সাথে গ্রাস করলো একজনের হৃদয়ের জ্বলতে থাকা আগুনও।

হঠাৎ’ই একটা মেয়ে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো রুমি বেগম’কে। মেয়েটাকে ঠিক চেনে না সুখ। সে কেবল ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো মেয়েটার পরিচয়। মেয়েটার পিছে এক ভদ্র লোক আর ভদ্র মহিলাও এগিয়ে আসলো।

মেয়েটা রুমি বেগম’কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো, কাঁদতে কাঁদতে বললো,
-‘এটা কী করে হলো মাম! বিহঙ্গ, বিহঙ্গ আর আসবে না মাম? বিহঙ্গ চলে গেলো আমাকে ছেড়ে? ওর প্রতিশ্রুতি ও মিথ্যে করে চলে গেলো? পাপা আর আন্টিও আমাদের একা রেখে দিলো?’

রুমি বেগম ডুকরে কেঁদে উঠলো। মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
-‘জানিনা কী সর্বনাশ হয়ে গেলো। আর কখনো আমার সোনার সংসার টা আমি পাবো না রে মোহনা। সব ছাড় খার হয়ে গেলো। সব শেষ, সব।’

ভদ্রলোক এবার মুখ খুললেন, পাথরের ন্যায় বসে থাকা মেঘকে স্বান্তনার স্বরে বললেন,
-‘কীভাবে এসব হলো মেঘ? ওরা বের হতে পারলো না কেনো! তোমরাও বা কোথায় ছিলে?’

-‘জানিনা আঙ্কেল, কী থেকে কী হয়ে গেলো। তবে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বলছে কারেন্টের তাঁড় থেকে আগুনটা লেগেছে। এ জন্যই কেউ বাঁচতে পারে নি, খুব দ্রুত আগুনটা ছড়িয়ে গিয়েছিল। আর মা ও বিহঙ্গ ঘুমে ছিলো বোধহয়। আঙ্কেলও বোধহয় ঘুমিয়ে ছিলেন। সব শেষ হয়ে গেলো, সব শেষ। আমরা যদি ঘুরতে না যেতাম তবে বোধহয় আমরাও পুড়ে ছাই হয়ে যেতাম। সুখের জন্য আমরা বেঁচে গেছি।’

ভদ্রলোক অবাক কণ্ঠে বললো,
-‘তোমরা ঘুরতে গিয়েছিলে মানে! সুখটা কে?’

মেঘ একটু চুপ রয় তারপর ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলে,
-‘আমার ওয়াইফ সুখোবতী। হঠাৎ করেই বিয়েটা করেছিলাম তাই কাউকে জানাই নি। জানানোর জন্য’ই ঢাকা এসেছিলাম তারপর নানান ঝামেলায় জানানো হয় নি। ভেবেছিলাম বিহঙ্গের আর মোহনার বিয়ের ডেইট ঠিক করবো সাথে আমার বিয়ের কথাটাও জানাবো। সুখ’ই আজ বায়না ধরলো ঘুরতে যাবে, মামুনি আর আমিও রাজি হলাম। ওদেরকেও বলেছিলাম যাওয়ার কথা কিন্তু ওরা সবাই ঘুমে ছিলো। তাই আর যেতে পারলো না।’

সুখের এবার বোধগম্য হলো এই মেয়েটা কে। তার মানে বিহঙ্গের বিয়ে ঠিক হয়ে ছিলো! মোহনা নামের একটা মেয়ের কথা সে শুনেছিলো তবে এই সে মোহনা!

মোহনা মেয়েটার কান্না করতে করতে অবস্থা নাজেহাল। অবশেষে বাধ্য হয়ে তাকে নিয়ে গেছে তার বাবা মা। মেঘদেরও বলেছিলো তাদের বাড়িতে যেতে কিন্তু মেঘ না করে দিয়েছে। খুব দ্রুতই এ শহর ছেড়ে তারা চলে যাবে। সব ফর্মালিটি শেষ করেই তারা পড়ি জমাবে নিজেদের শহরে। এ’শহর তো সব কেড়ে নিলো, সব।

—–

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর আজ পনেরো দিন অতিবাহিত হলো। সুখ একা হাতে সামলিয়েছে মেঘ আর রুমি বেগম’কে। দু’জনই বেশ চুপ হয়ে গিয়েছে। এমন পরিবর্তন বেশ পীড়াদায়ক হলেও মানতে হচ্ছে সবটা। একা হাতে একদম পাক্কা গিন্নীর মতন সংসার সামলাচ্ছে সে।

প্রতিদিনের মতন আজও মেঘ ঘুম থেকে উঠে রেডি হয়েছে অফিসে যাওয়ার জন্য। তারা যশোর এসে পড়েছে পরেরদিনই। আগের মতন কাজ কর্মে মনোনিবেশ করার চেষ্টা চালাচ্ছে পুরো দমে। সুখ মাত্রই চায়ের কাপ এনে ডাইনিং টেবিলের উপর রেখেছে তখনই কলিং বেল বেজে উঠলো। মেঘ টেবিলের দিকেই আসতে নিয়েছিলো কিন্তু কলিং বেলের শব্দ শুনে সে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।

দরজা খুলতেই ইউসুফের শুভ্র রাঙা মায়াময় মুখটা ভেসে উঠলো। মেঘও হাসির বিপরীতে ছোট হাসি দিয়ে বললো,
-‘ভিতরে আসো ইউসুফ।’

ইউসুফ যেনো পিছে ঘুরে কাকে ডাক দিলো। মেঘ ভ্রু কুঁচকে সেখানে তাকিয়ে রইলো। সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠা মানুষটাকে দেখে মেঘ চমকে গেলো। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মানুষটার দিকে। সুখও এবার দু’কদম এগিয়ে আসলো। মানুষটা এবার মেঘেদের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। মেঘ বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
-‘মিনা, তুই! তুই এখানে কীভাবে!’

মিনা চোখ তুলে তাকালো, অশ্রুসিক্ত নয়নযুগল মেঘের দিকে নিবদ্ধ করে বললো,
-‘আমারে মাফ কইরা দেন বড়ভাই। আমি একটা ছেলেরে পছন্দ করতাম, তার হাত ধইরাই পালায় গেছিলাম আপনাগো স্বর্ণ গয়না নিয়া। কিন্তু সে ভালো না, তাই আমি তার কাছ থেইকা লুকাইয়া চইলা আইছিলাম আপনাগো বাড়ি কিন্তু আইসা হুনি সর্বনাশ হইয়া গেছি। এ কি হইলো! মানুষ গুলান আমাগো রে ছাইড়া চইলা গেলো। আমি আর টিকতে না পাইরা চইলা আইছি আপনার কাছে। আপনি চাইলে আমারে পুলিশের কাছে দিয়া দেন, মাইরা ফেলেন তবুও আমি আপনারে ছাইড়া যামু না৷’

মেঘ কিছুক্ষণ চুপ রয়। ইউসুফের দিকে তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
-‘তুমি ওরে কই পাইছো ইউসুফ?’

-‘আমাদের বাড়ির সামনেই তো বাস স্ট্যান্ড,সেখান দিয়ে আসার সময় দেখি ও দাঁড়ায় আছে পরে অনেক আকুতি মিনতি করছে তাই নিয়ে আসছি স্যার।’

মেঘ ছোট্ট শ্বাস ফেললো। মিনা’কে সে বরাবরই নিজের ছোট্ট বোনের মতন ভাবতো। কখনো কাজের মেয়ে ভাবে নি। মেয়েটার হয়তো একটু মাথায় সমস্যা কিন্তু তবুও অনেক ভালো। মেঘ ঠিক কি করবে বুঝতে না পেরে সুখের পানে তাকালো। সুখও ঠোঁট উল্টিয়ে বুঝালো সে কিছু বুঝতে পারছে না।

হঠাৎ করে রুমি বেগমের গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে আসলো,
-‘ওরে থাকতে দেও মেঘ।’

সুখ, মেঘ, ইউসুফ রুমি বেগমের দিকে তাকালো। রুমি বেগম এগিয়ে এসে আশ্বাসের কণ্ঠে বললো,
-‘মিনা আমাদের বিশ্বাসের যোগ্য মানুষ ছিলো। ওর ছোট মস্তিষ্ক হয়তো আমাদের বিশ্বাসের মর্যাদা দিতে ভুল করেছে কিন্তু তাই বলে মেয়েটা খারাপ না। আমরা আরেকবার ওরে বিশ্বাস করতেই পারি।’

মেঘ আর কিছু বললো না রুমি বেগমের কথার পরিপ্রেক্ষিতে কেবল গম্ভীর কণ্ঠে মিনা’র দিকে তাকিয়ে বললো,
-‘তাহলে, আজ থেকে এখানেই থাকিস। আর কখনো বিশ্বাসের অমর্যাদা করিস না। তোকে আমরা সবাই অনেক ভালোবাসি।’

মিনা মেয়েটা কৃতজ্ঞতায় দু’ফোটা অশ্রু বিসর্জন দিলো। মেঘ’কে সালাম করে মনে মনে বললো,
-‘আমি বিশ্বাসের অমর্যাদা করি নাই বড়ভাই। আপনার জন্য-ই তো সব করলাম। আপনারেও যে আমি ম্যালা ভালোবাসি। আপনি খুব ভালা মানুষ, আর ভালা মানুষ গো পৃথিবীতে আরও অনেক বছর বাইচ্চা থাকতে হইবো।’

মেঘ মিনা’র মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
-‘আমার অফিস যেতে হবে, তুই থাক তোর ভাবী আর চাচীর সাথে। অফিস থেকে আসার পর কথা হবে।’

মিনা মাথা নাড়ালো। মেঘ সুখের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় বললো “আসছি”। সুখও মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।

মেঘ বেরুতেই সুখ রুমি বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,
-‘আমি একটু একটা কাজে বাইরে যেতে চাই ছোটমা।’

ছোট মা কেবল চোখের ইশারায় সম্মতি দিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। সুখ দ্রুত তৈরী হয়ে মিনা’কে সাবধানে থাকতে বলে বের হয়ে যায়।

——-

” আপনি আমার মা’কে মেরেছেন তাই না ফুপা!”

সুখের কথায় চমকে যায় লিলুয়ার স্বামী। অবাক কণ্ঠে বলে,
-‘কী বলছো এসব? তোমার মা পালিয়ে গেছে সেই কবে আর আজ তুমি এসব বলছো। আমাকে তোমাদের বাড়িতে কী এ জন্য ডেকে এনেছো!’

-‘না ঠিক এ জন্য না। আসলে আপনার জন্য সারপ্রাইজ আছে তাই ডেকে এনেছি, এবার বলুন আপনিই মেরেছেন আমার মা’কে?’

সুখের সৎমা এগিয়ে এলো,চওড়া কণ্ঠে বললো,
-‘এই মেয়ে কী পাগল হলো? আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করলো,স্বামীর বাড়ি নিয়ে আমার শাশুড়ি’কে মারলো সেটাও আমাদের জানায় নি। এখন আবার এ বাড়িতে সেই সকালে এসে কী খোঁজাখুঁজি করলো পাগলের মতন তারপর এখন আবার ভাইসাহেব’রে ডেকে এনে উল্টাপাল্টা কথা বলছে।’

-‘একদম চুপ থাকবেন আপনি। আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি আমি? একদম একটা কথা কেউ বলবে না। এই ব্যাপারে শুধু আমি কথা বলবো, সবাই চুপ।’

সুখের এহেন আচরণে সবাই অবাক, এ কোন সুখকে দেখছে তারা! সুখের ছোট চাচা লিয়াকত আলী এগিয়ে আসলেন, ঘড় কাঁপিয়ে এক ধমক দিয়ে বললেন,
-‘এত বেয়াদব কীভাবে হলে তুমি! বড়দের মুখের উপর কথা বলছো তাও অসভ্যের মতন? চোরের মায়ের বড় গলা। চরিত্রহীন মহিলার মেয়ে এখন মা’কে নিয়ে গলা বাজি করছো? আমার মা’কে তো মেরে ফেললে, আর সেটা আমাদের জানানোর প্রয়োজন করলে না?’

-‘জানালে কী হতো চাচা? সম্পত্তির আরেক দফা ভাগাভাগি হতো তাই তো?’

লীলাবতী’র এহন সত্যি কথায় ভড়কে গেলো চাচা লিয়াকত। কীভাবে কথার যুদ্ধে জিতবে সে ভেবে সে আবারও লীলাবতী’র উপর চেঁচিয়ে বললো,
-‘বড়টার দেখাদেখি ছোট টাও অসভ্য হচ্ছে। সেও পেট বাঁধিয়ে বসে আছে আবার এত বড় বড় কথা।’

-‘তাতে আপনার কী চাচা? আপনার ভাগ থেকে সম্পত্তি দিতে হবে না আমাদের, নিশ্চিন্তে থাকুন।’

লিয়াকত আলী থতমত খেয়ে যায়। সুখ বিরক্তিকর কণ্ঠে বললো,
-‘এবার আসল কথা-ই আসি ফুপা? তা কেনো মেরেছিলেন আমার মা’কে?’

ভদ্রলোক এবার সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম টা রুমাল দিয়ে মুছে থতমত চেহারা নিয়ে বললেন,
-‘কী প্রমাণ আছে তোমার কাছে যে এসব বলছো? সাহস তো কম না তোমার। প্রমাণ দেখাও আগে।’

সুখোবতী বাঁকা হেসে বললো,
-‘এই তো প্রমাণ আপনার পিছের দরজায় দাঁড়ানো মানুষ’টা। দেখুন তো চিনতে পারছেন কিনা অতি পুরোনো প্রমাণ টা?’

ভদ্রলোক পিছে ফিরে চাইলো। অতি বিষ্ময়ে চোখ বড় করে ফেললো। ভয়ার্ত ও অবিশ্বাস্যকর কণ্ঠে বললো,
-“তুমি!”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here