সুখের অ-সুখ পর্ব-১৫

0
1190

#সুখের_অ-সুখ
#মম_সাহা

পর্বঃ পনেরো
(লেখিকার অনুমতি ব্যাতিত কপি নিষেধ)

মেঘ নিজের মা’কে জড়িয়ে ধরে আছে, রেহানা বেগম কেবল ড্যাবড্যাব করে বৃদ্ধ মনোয়ারার পানে তাকিয়ে আছে। সুখ এক দৃষ্টিতে মসৃনের দিকে তাকিয়ে আছে আর, মসৃনও অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে সুখের দিকে। এ যেনো নিরব বিস্ফোরণ ঘটেছে সবার মাঝে। একজনকে দেখে আরেকজনের ভিতরে রাজ্যের কথা উগড়ে আসছে কিন্তু কিসের এক অদৃশ্য দেয়ালের জন্য সে কথা গুলো বের করতে পারছে না। মেঘ মায়ের গলা ছেড়ে অপরাধী কন্ঠে বলল,
-‘প্রথমেই অনেক দুঃখীত মা কারণ, আমি তোমাদের না জানিয়েই বিয়ে’টা করেছি। সেই পরিস্থিতিতে জানানোর সুযোগ হয়ে উঠে নি তা-ই আর অপেক্ষা না করে বউ নিয়ে চলে এসেছি তোমাদের কাছে যেনো ভুল না বুঝো।’

সবার নিরবতার মাঝে একজন মহিলা এগিয়ে আসলো, সুখের থুঁতনি ধরে মুখ উঁচু করে ধরে বলল,
-‘মাশাল্লাহ মেঘ, এ জেনো আকাশ থেকে এক টুকরো তারা পেরে এনেছিস। দারুন তার মুখের গড়ণ। ছোট্ট পুতুল জেনো। এই মেয়ে, তুমি এত আদুরে কেনো? নাম কী গো মেয়ে? কোথায় থাকো?’

সুখ কিছু বলে না। আসলে সে ভাষা খুঁজে পায় না বলার মতন। কাকে বিশ্বাস করবে সে? অবিশ্বাসের রাজ্যে বিশ্বাসের হাত’টা কার, সে বুঝবে কীভাবে!

মেঘ হাসি মুখে আগ বাড়িয়ে বলে,
-‘ওর নাম সুখোবতী। ও যশোর শহরেই থাকে। আমি যেখানে থাকি তার থেকে একটু দূরেই ওদের বাসা। আগে ভিতরে ঢুকতে দেও মামুনি, অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছি। সেই যশোর থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে খুলনা গিয়েছিলাম অফিসের কাজে, ওদের গাড়িতে বসিয়েই কাজ শেষ করে সেখান থেকে ঢাকা এসেছি। আর দাদীজান বৃদ্ধ মানুষ, অসুস্থ হয়ে যাবে তো।’

মামুনি নামের মহিলা’টা একটু থমকে যায় যেনো, সাথে একটু চমকেও যায় বোধহয়। আড় চোখে তাকায় রেহানার দিকে। অদ্ভুত কন্ঠে বলে,
-‘তোর শ্বশুরের নাম কী?’

মেঘ ভ্রু কুঁচকালো বড় খালার এমন প্রশ্নে তারপর সুখের দিকে তাকিয়ে শীতল কন্ঠে বলল,
-‘আজাদ শেখ।’

মহিলা টা দু’কদম পিছিয়ে গেলো। অদ্ভুত চোখে তাকালো,বিষ্মিত কন্ঠে ভয়ংকর আর্তনাদ করে বলল,
-‘এ কী সর্বনাশ করলি মেঘ? শেষে কিনা তোর মায়ের সর্বনাশের বীজ ঘরে তুললি?’

নিজের খালার কথার মানে মেঘ বুঝে না। তার মায়ের সর্বনাশের বীজ বলতে কী বুঝালো খালামনি? প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
-‘কী বলছো মামুনি? ও আমার অর্ধাঙ্গিনী। এসব কী বলছো?’

মামুনি নামের মহিলাটা মুখ খোলার আগেই রেহানা গম্ভীর কন্ঠে বলল,
-‘কিছু না,তুই আগে ভিতরে আয়। বাকি কথা ভেতরে এসে বল।’

মেঘ ঘাঁড় নাড়ালো। অতিরিক্তই ক্লান্ত সে। এক টানা এতক্ষণ সে খুব কমই গাড়ি চালায়। ইউসুফ’ই অবশ্য সবসময় ড্রাইভিং করে আর নাহয় ড্রাইভার। আজ এতটা পথ এসে ক্লান্তি বিরাজ করছে শরীরে। তাই সে সুখের পানে তাকিয়ে ক্লান্ত স্বরে বলল,
-‘ভিতরে আসেন অপরিচিতা। দাদীজান আসুন আমার সাথে।’

কথাটা বলে দাদীজানের হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো, যেনো বৃদ্ধার পরম আশ্রয় এই মানুষটা। সুখ কেবল ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে রয়। মেঘের আচরণ দেখে যতটা বুঝা যাচ্ছে, মেঘ কিছুই জানেনা। তাহলে, এ কেমন গোলকধাঁধায় আটকে গেলো সুখ?

সুখকে ঠাঁই দাড়িয়ে থাকতে দেখে রেহানা গম্ভীর কন্ঠে বলল,
-‘বাড়ির বউ হয়ে এসেছো ঘরের চৌকাঠ অব্দি দাঁড়িয়ে থাকার জন্য? ভিতরে আসো।’

হাজার খানেক প্রশ্নের সমুদ্রে উত্তরের আশায় সুখ দাদীর পানে তাকালো, দাদী চোখ দিয়ে ইশারা দিলো ঘরে প্রবেশ করার জন্য। সুখ নিবিড় সম্মতিতে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো।

রেহানা বেগম গলার স্বর একটু উঁচু করলো, উঁচু কন্ঠে কাজের মেয়েটাকে ডাক দিলো,
-‘আশা,এখানে আয়।’

ডাক দেওয়ার পর ঠিক মিনিট খানিকের মাঝে কাজের মেয়েটা হাজির হয়, হাজির হয় বলতে ভুল হবে কারণ সে এখানেই ছিলো। এসেই ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বলল,
-‘জ্বি আম্মা বলেন?’

-‘ওদের জন্য শরবত করে আন। অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছে। আর, দু’তালার বা’দিকের রুমটা পরিষ্কার কর নতুন বউ’র দাদীর জন্য। তোর বড়ভাইয়ার রুমটাও একটু পরিষ্কার করে দে।’

কাজ দিতে দেড়ি কিন্তু আশা মেয়েটার ড্রয়িং রুম থেকে প্রস্থান করতে দেড়ি হয় নি। সুখ নির্বাক হয়ে গেলো। তার বাবা যে মানুষটার স্বপ্ন ভেঙে বিয়ের আসর ছেড়ে চলে এসেছিলো সেই মানুষটার ছেলের বউ হয়েই সে গৃহে প্রবেশ করলো? কিন্তু মসৃন যে বলেছিলো মানুষটা আর কারো সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় নি! তাহলে কী মসৃন মিথ্যা বলেছিল! আর মেঘ সাহেব তো কিছুই জানেন না বোধহয়, এমনকি তার মায়ের যে বিয়ে ভেঙে ছিলো সেটাও জানেন না। নাকি আরও বড় প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এ অব্দি তাকে টেনে এনেছে মেঘ? মেঘ তো এতটুকু জানে,একটা ছেলে তাকে বিয়ের আসরে রেখে গিয়েছিল। ছেলেটার নাম অব্দি জানে তাহলে কোনো প্রতিক্রিয়া করে নি কেনো? এমন হাজার খানেক প্রশ্ন নিয়ে ভাবনার দুনিয়ায় ডুব দিলো সুখ।

হঠাৎ মেঘের গম্ভীর কন্ঠ কানে এলো,
-‘বিহঙ্গ কবে আসলি ট্যুর শেষ করে? কেমন ট্যুর হলো?’

সুখ ফিরে তাকায়। এখানে মেঘ আর মসৃন বাদে তো কোনো ছেলে নেই, তাহলে কাকে বিহঙ্গ বললো? তাহলে কী মসৃনই বিহঙ্গ!

-‘এই তো দাভাই ভালোই হলো।’

সুখ জেনো অবাকের উপর অবাক হচ্ছে। মসৃনের নাম তাহলে বিহঙ্গ? ছদ্মনাম ব্যবহার করে ছিলো এই প্রতিশোধের জন্য? মন থেকে ছিটকে আসতে চায় ধীক্কার কিন্তু না,যেহেতু তাদের বাড়ির মানুষ মেঘের সামনে কিছু বলছে না আর যতটুকু মেঘের মা, মসৃনের মাকে দেখে মনে হয়েছে তারা হয়তো এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না। আগে পরিস্থিতির মোড় বুঝতে হবে তারপর সব ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। নিজেকে ধাতস্থ করলো সুখ।

রেহানা বেগম নিজের রুমে গিয়ে মিনিট দুই এর মাঝে আবার ড্রয়িং রুমে হাজির হয়। ধীর গতিতে সুখকে মেঘের পাশে বসায়। হাতের মুঠোয় থাকা মোটা চুড়ি গুলো সুখের দু’হাতে পড়িয়ে দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,
-‘আমার ছেলে কী কারণে আমাকে না জানিয়ে বিয়ে করেছে আমি জানি না। আর এই কারণে আমার প্রচুর খারাপ লেগেছে কিন্তু আমি এর জন্য তোমাকে কোনোরূপ দোষারোপ করবো না। এই বিয়ে নিয়ে যদি কোনো অভিযোগ, অভিমান থাকে তাহলে সেটা একান্তই আমার ছেলের প্রতি। তোমার জন্য আমার দোয়া থাকবে কেবল। তুমি আমার ছেলের বউ, তোমার প্রতি আমার কোনো রাগ নেই। এই চুড়ি গুলো নতুন বউ এর মুখ দেখে পড়িয়ে দেওয়ার জন্য রেখেছিলাম। তাই, এগুলো তোমার।’

সুখ যেনো মহিলার আচরণে বিমোহিত। এই মহিলার হয়ে আরেকজন প্রতিশোধ নিতে গিয়ে তার জীবন টাই বদলে দিলো আর মহিলার’ই সে নিয়ে কোনো হেলদোল নেই! কথায় আছে না- যার বিয়ে তার খবর নেই, পাড়া প্রতিবেশী ঘুম নেই। মসৃনের অবস্থা হলো এমন। অহেতুক জেদের বশে কেবল তার জীবন টা নষ্ট করলো এমনকি তার ছোট বোনের জীবনটাও।

মসৃন গটগট পায়ে তার রুমে চলে গেলো। সুখ সেদিকে তাকিয়ে ছোট্ট শ্বাস ফেলল। সে সব ধোঁয়াশা পরিষ্কার করেই এখান থেকে ফিরে যাবে। সবটা পরিষ্কার করবে।

মেঘ মায়ের গলা জড়িয়ে ধরলো, আহ্লাদী কন্ঠে বলল,
-‘সরি তো মা। তখন বিয়েটা করা খুব প্রয়োজন ছিলো। জানানোর সময় ছিলো না। তাই তো বিয়ে করেই নতুন বউকে নিয়ে চলে আসলাম। এতদিন পর আসলাম আর তুমি কি না রাগ করে থাকবে?’

মেঘের মা কিছু বলার আগেই ড্রয়িং রুমে এক ভদ্রলোক প্রবেশ করলো, বিষ্ময় কন্ঠে বলল,
-‘আরে মেঘরাজ যে? কখন এলে?’

সুখ চমকে সেখানে তাকালো। একজন পঞ্চাশ কিংবা পঞ্চান্ন বয়সী মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। বেশ উঁচু, লম্বা পুরুষ। মেঘ হাসি মুখে এগিয়ে গিয়ে বলল,
-‘বাবাই কেমন আছো? মাত্রই এলাম।’

সেই পুরুষটি মেঘকে বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করলো। আদুরে কন্ঠে বলল,
-‘কতদিন পর এলে বলো তো। যাও ফ্রেশ হও আগে তারপর সব কথা হবে।’

মেঘ আর কিছু বলতে নিলে রেহানা বেগম গম্ভীর কন্ঠে বলল,
-‘কোনো কথা আর না। যাও, বিহঙ্গের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হও তারপর খাবার খাবে, ঘুমাবে। কাল সকালে সব কথাবার্তা হবে।’

মেঘ ভ্রু কুঁচকিয়ে বলল,
-‘বিহঙ্গের রুমে কেনো? আমার রুমে কী হয়েছে?’

রেহানা ছেলের কান টেনে দিয়ে বললেন,
-‘যে মেয়েটা এসেছে তাকেও তো ফ্রেশ হওয়ার সুযোগ দিতে হবে তাই না? তুমি ঐ রুমে ফ্রেশ হলে ও তোমার রুমে ফ্রেশ হতে পারবে। তাহলে একসাথে খেতে পারবে। যাও।’

মেঘ মাথা চুলকিয়ে হেসে চলে গেলো। মেঘ চলে যেতেই রেহানা ছোট্ট শ্বাস ফেলল, তারপর কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
-‘তুমি আজাদ শেখের মেয়ে এটা মানা আমার জন্য খুব কষ্টকর কিন্তু তবুও আমি তোমায় মেনে নিচ্ছি। তুমি নিশ্চয়ই জানো,অনেক বছর আগে তোমার বাবা কী করেছে? না জানলে তোমার দাদীর কাছ থেকে জেনে নিও। আমার ছেলে মেঘ এসব কিছু জানেনা। তাই, ওর অগোচরেই রেখো সবটা। তা নাহলে হয়তো ঘটনা অন্য দিকে চলে যাবে। তুমি আমার ছেলের বউ এটাই বর্তমানের বড় সত্যি। যাও, ফ্রেশ হও। আর, আপা এবং দুলাভাই আপনারাও কাউকে কিছু বলবেন না।’

সুখ দাদীর দিকে তাকালো। দাদী চোখ দিয়ে ইশারা করলো, যার অর্থ ‘যা হচ্ছে, হতে দে।’ সুখ বুঝলো দাদীর ইশারার মানে। ততক্ষণে রেহানা আশা নামের মেয়েটিকে আবার ডাক দিলো। মেয়েটি উপস্থিত হতেই তাকে বলল,
-‘তোর ভাবীকে মেঘের রুমে নিয়ে যা।’

আশা ঘাড় কাত করতেই সুখ মুখ ফুটে বলে উঠলো,
-‘দাদী?’

মসৃনের মা দাদীর কাছে এসে বলল,
-‘তুমি যাও, আমি খালাম্মাকে তার রুম দেখিয়ে দিবো।’

সুখ ধীর গতিতে আশা নামের মেয়েটির পিছে পিছে চলে গেলো। ড্রয়িং রুমে বয়ে গেলো কারো গোপন বিষাক্ত শ্বাস। সব যে তার হাতের বাহিরে চলে গেলো।

মেঘের রুমে ঢুকতেই সুখ থমকে গেলো। কী অসাধারণ রুম। পুরোটা রুম ঝকঝকে সাদা। একদম যশোরের ফ্লাটের মতন। মেঘ নামক পুরুষটি বেশ গোছানো আর পরিপাটি।

আশা সুখের সুটকেস টা রুমে থাকা সোফা টার সাথে রেখে সুখের একটু কাছে এসে ধীর গতিতে বলল,
-‘ এ বাড়িতে না এলেই তো পারতেন ভাবী। মানুষ গুলা পুতুল যেনো। থাইকেন না ভাবী। চইলা যাইয়েন। এ বাড়ির চোখের আড়ালে সূর্যের তেজ, চোখের সামনে কেবল নিশি।’

আশা মেয়েটা দাঁড়ালো না এত মুহূর্ত। সুখ ডাক দিলেও শুনে নি। সুখ কেবল যেনো রহস্যের অতলে তলিয়ে গেলো। মেয়েটা কী বলল এটা?

#চলবে

[দুঃখীত এত অনিয়মিত গল্প দেওয়ার জন্য। তবে এখন থেকে প্রতিদিন পাবেন গল্প।আর এখন থেকে কাহিনী গভীরে যাবে তাই প্রতিদিন দিতেই হবে নাহয় পড়ে মজা পাবেন না। আর ভালোবাসা। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here