সুখের অ-সুখ পর্ব-১৪

0
1213

#সুখের_অ-সুখ
#মম_সাহা

ধামাকাদারঃ চৌদ্দ
(লেখিকার অনুমতি ব্যাতিত কপি নিষেধ)

এইতো সেদিন বিয়ে হলো, দেখতে দেখতে পাঁচদিন কেটে গেলো যেনো চোখের পলকে। গত পরশু গ্রীষ্ম বিদেয় হয়ে প্রকৃতিতে অবতীর্ণ হলো বর্ষা।আষাঢ় মাসের তিন তারিখ চলছে। সারাদিন ব্যাপী তুমুল বর্ষণ প্রমাণ করছে প্রকৃতিতে বর্ষার আগমন। আজকের দিনটা অন্য দিনের তুলনায় আলাদা। এইতো, সুখ নিজের জামা কাপড় গুছিয়ে নিচ্ছে শ্বশুর বাড়িতে যাবে বলে। একদম অপরিচিত মানুষটাকে তো জীবন সঙ্গী করলো, এখন সেই মানুষটাকে সম্পূর্ণ রূপে চেনার জন্য এই পদক্ষেপ।

হঠাৎ সুখের ফোনটা শব্দ করে বেজে উঠলো। সুখ হকচকিয়ে গেলো। নাম্বারটা একটু পরিচিত মনে হলো, তাই সাথে সাথেই রিসিভ করলো। ফোনের অপরপাশ থেকে পুরুষালী কন্ঠ ভেসে এলো,
-‘আমি মসৃনের রুমমেট বলছি আপু, আপনাকে একটা ইনফরমেশন দেওয়ার জন্য কল দিয়েছি।’

সুখ দ্রুত গতিতে বলল,
-‘কী ইনফরমেশন?’

-‘মসৃনকে যে বড় ভাইয়ের কথাতে আমার সাথে থাকতে দিয়েছিলাম সে বড় ভাই আবার বিদেশ চলে যাবে কাল পরশু তাই আপনি দ্রুত তার সাথে যোগাযোগ করুন।’

সুখ আৎকে উঠলো। লীলাবতী’কে সে কথা দিয়েছিলো যেভাবেই হোক মসৃনকে সে খুঁজে বের করবে, এ কথা কোনো ভাবে অপূর্ণ রাখবে না সে। তাই, ব্যতিব্যস্ত স্বরে বলল,
-‘কীভাবে তার সাথে যোগাযোগ করবো ভাইয়া? কোনো উপায় জানা থাকলে বলুন। আমি তো তাকে চিনি না। কীভাবে তার কাছে যেতে পারবো?’

-‘আমি আপনাকে একটা ঠিকানা দিচ্ছি। আপনি সেখানে গেলেই ঐ ভাইয়ারে পাবেন। এটা উনার অফিসের ঠিকানা।’

সুখ “আচ্ছা” বলতেই ছেলেটি একটা ঠিকানা গড়গড় করে বলল। সুখ ফোন রেখে ঘড়ির দিকে তাকালো,এখন ঘড়িতে সময় দেখাছে এগারোটা। সকাল এগারোটা হলেও পরিবেশ দেখে তা বুঝার উপায় নেই। মনে হচ্ছে জেনো সদ্য সন্ধ্যা নেমেছে পরিবেশে। তারা এখান থেকে রওনা দিবে দুপুর একটার দিকে, সকালেই রওনা দিতো কিন্তু মেঘের অফিসে কাজ পড়ে যাওয়ায় যেতে পারে নি। ভাগ্যিস যায় নি সকালে, নাহয় এত বড় সুযোগ হাতছাড়া হতো।

সুখ গোসল করে একেবারেই তৈরী হয়ে গিয়েছিলো বিধায় এখন তাকে আর কিছুতে সময় অপচয় করা লাগে নি বরং দ্রত গতিতে ফ্লাটের বাহিরে চলে যায়। দাদী ঘুমিয়ে ছিলো বিধায় বলে আসে নি। তবে,আগে একটা গতি হোক তারপর নাহয় বলা যাবে। এমনিতেও মেঘকেও মসৃনের ব্যাপারে জানানো হয় নি। একবারে সবাইকে তাহলে জানানো যাবে।

বিল্ডিং এর বাহির হতেই সৌভাগ্যক্রমে একটা সিএনজি পেয়ে যায়। ঠিকানা বলতেই সিএনজি ড্রাইভার যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে যায়। আকাশ ঘন-কালো মেঘে ঢেকে যায় হঠাৎ করেই। এ জেনো নতুন ঝড়ের পূর্বাভাস। সুখ কেবল সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে, তার কাছে জীবন নামক ঝড়ের চেয়েও বড় ঝড় হতে পারে না কিছু।

একটা বিশাল প্রাচুর্য ঘেরা বিল্ডিং এর সামনে এসে সুখের সিএনজি টা শব্দ করে থামে। সুখ দ্রুত সিএনজি থেকে নেমে ভাড়া পরিশোধ করে দেয়। ইতিমধ্যে ধুলোবালি উড়া শুরু হয়ে গেছে। সুখ অফিসের ভিতর ঢুকতে যাওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে রাস্তার অপরপাশে থাকা মানুষটির উপর চোখ যায়। অবাকে, বিষ্ময়ে সে হা হয়ে যায়। অফিসে না ঢুকে সে আঁধারময়ী বাতাসেও কষ্ট করে রাস্তা পাড় হয়। মানুষটার দিকে এগিয়ে এসে অবাক কন্ঠে বলে,
-‘হিমা, তুই এখানে কী করছিস?’

নিজের নাম অপরিচিত রাস্তায় শুনে চকিত হয় হিমা কিন্তু বান্ধবী’কে দেখে আগের ন্যায় উচ্ছ্বসিত হতে পারে না। বরং নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সুখ নিজের উচ্ছ্বসিত বান্ধবীর নিষ্প্রাণতা দেখে অবাক হয়। বিচলিত কন্ঠে বলে,
-‘এমা,হিমা! কী হয়েছে তোর? কি সমস্যা?’

হিমা কিছুক্ষণ চুপ রয়,ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলে,
-‘আমার কষ্ট হচ্ছে সুখ,ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে মরে যাচ্ছি।’

-‘এমন কথা কেনো বলছিস হিমা? কিছু কী হয়েছে? আর তুই এখানে কেনো? কোনো দরকারে এসেছিস?’

হিমার মতন শক্ত মেয়েও হঠাৎ তুমুল ভেঙে পড়লো। জাপ্টে ধরলো সুখকে, কেঁদে দিয়ে বলল,
-‘আমি ভালো নেই সুখ। তোরাও বুঝলি না আমার খারাপ থাকা। আমার বিয়ে ঠিক করেছে বাড়ি থেকে।আমি তোর বাসাতেই মানে মেঘ ভাইয়ার বাসাতেই যাচ্ছিলাম।’

সুখও পরম আবেশে জাপ্টে ধরলো হিমাকে। সে অবাক হলো হিমার আচরণে,সামান্য বিয়ে ঠিক হওয়ার জন্য কাঁদার মেয়ে তো হিমা না। সে হিমার মাথায় পরম মমতায় হাত বুলিয়ে বলল,
-‘এমা,সামান্য ব্যাপারে কাঁদছিস? আচ্ছা ছেলে পছন্দ না তোর? বিয়েটা করবি না? কী হয়েছে খুলে বল।’

-‘আমি প্রণয়ের আগুনে ঝাঁপ দিয়েছি সুখ। আমি পুড়ে যাচ্ছি ভীষণ ভাবে। আমাকে বাঁচা।’

সুখ হা হয়ে যায়। হিমার মতন মেয়ে প্রেমে পড়েছে? ভাবা যায় এটা আদৌও? যাক তার উরনচন্ডী বান্ধবী যে কাউকে ভালোবেসেছে সে’ই অনেক। সে হিমার মাথায় হাত বুলিয়ে ধীর কন্ঠে বলল,
-‘বাহ্,এটাতো ভালো কথা। তা সে সৌভাগ্য বান পুরুষটি কে?’

-‘ যদি বলি মেঘ ভাইয়া,তাহলে?’

হঠাৎ যেনো সুখ ভুল কিছু শুনে ফেলেছে এমন প্রতিক্রিয়া করলো, অবাক নয়নে কতক্ষণ তাকিয়ে রইল হিমার পানে। সে কী ভুল কিছু শুনলো?

অবাক,বিষ্মিত কন্ঠে সে ক্ষানিকটা চেঁচিয়েই বলল,
-‘কীহ্! মজা করছিস হিমা?’

হিমা ভ্রু কুঁচকায়, বেশ গম্ভীর কন্ঠে বলল,
-‘মজা কেনো করবো? তোর কী আমাকে দেখে মজার মুডে আছি বলে মনে হচ্ছে? আমি মেঘো মায়ায় কীভাবে যেনো আকৃষ্ট হয়ে গেছি সুখ। মেঘ সেই মায়াজাল, যার থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা সম্ভব না। বাসায় যখন বিয়ের কথা হলো তখন আমি মেঘের জায়গায় অন্য কাউকে ভাবতে পারছি না সুখ। কী করবো তুই বল? এখন যা করার তুই ই করতে পারিস, তাই তোর কাছে ছুটে গিয়েছিলাম। কিন্তু মাঝ পথে সৌভাগ্যবশত দেখা হবে ভাবি নি।’

সুখের মাথা যেনো ঘুরছে, দেখাটা কী সৌভাগ্যক্রমে হলো নাকি দুর্ভাগ্যবশত সে বুজে উঠতে পারছে না। সেদিন যদি বিয়ের কথা বলতো তাহলে আজ এমন দিন দেখতে হতো না। সুখ’কে চুপ থাকতে দেখে অধৈর্য কন্ঠে হিমা বলল,
-‘কিরে বল? কিছু। কি করবি? কিছু করিস বোন।আমি এখন একটু অনুর বাসায় যাবো,তুই ভালো খবর দিবি আশা রাখি।’

সুখ পাথরের ন্যায় ঘাড় নাড়ালো। “অভাগা যেখানে যায়, সাগর শুকিয়ে যায়” এই প্রবাদ বাক্য টা জেনো একমাত্র সুখের জন্য’ই বানিয়েছিলো কেউ। আকাশ কেঁপে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামে,সুখের তখন ধ্যান ফিরে। সে ছুট লাগায় অফিসের দিকে, আগে বোনের জীবন বাঁচুক তারপর না হয় তার জীবনের কথা ভাববে।

বাহিরে অনর্গল বৃষ্টি পড়ছে, সুখ বেশ বড় এক অফিসের শীতল এবং নীরব রুমটিতে বসে আছে। তার সামনে বড় চেয়ারটাতে বসে আছে সেই ব্যাক্তি, যার মুখ থেকে বের হওয়া একেক টা কথা বদলে দিবে কারো জীবনের মোড়। আচ্ছা যদি সব দিক দিয়ে বদলটাও সুখের আসে তাহলে কেমন হবে?

সামনের ছেলেটি বেশ আন্তরিক কন্ঠে আফসোসের স্বরে বলল,
-‘আমি শুনেছি সব ঐ ছেলেটার কাছ থেকে। ও যে এমন নীচুমনের ছেলে হবে ভাবতে পারি নি। মানুষের খোলশটা দেখে কী অন্তর বোঝা যায়! আমিও বুঝি নি ওর নোংরা অন্তর।’

সুখ স্বাভাবিক ভাবেই বসে রইল, সাধারণ কন্ঠেই বলল,
-‘ছেলেটা আপনার কী হয় মি.ধীশক্তি? আপনি তাকে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন নিশ্চয়ই চিনেন?’

সামনে বসে থাকা বেশ তেজী রমনীকে দেখে ধীশক্তি আব্রাহাম এর আনমনেই বিশেষ অনুভব হলো। কী তেজী তার রূপ! মুগ্ধ হলো আব্রাহাম। যতটুকু শুনেছিলো মেয়েটা সম্পর্কে, ততটুকু থেকে সে আঁচ করেছিলো মেয়েটা বেশ অসহায় হবে কেঁদে কেটে ভাসাবে কিন্তু ঘটলো পুরো উল্টোটা? বেশ ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন বলা চলে।

ধীশক্তি আব্রাহাম এবার নড়েচড়ে বসলো। ধীর কন্ঠে বলল,
-‘ছেলেটা আমার বন্ধুর ভাই হয়। বেশ চেনা জানা ওর সাথে। মাঝে মাঝে এ শহরে আসে ট্যুর দিতে, তখন এখানে সেখানে থাকে। আমি এবারও ঠিক তেমনটাই ভেবেছিলাম কিন্তু, ও যে এমন বের হবে কে জানতো? আমার অফিসের কাজের জন্য বাহিরে যেতে হচ্ছে আবারও নাহয় আমার বন্ধুর সাথে আমি সবটা বলতাম।’

সুখ ছোট্ট শ্বাস ফেলল,নম্র কন্ঠে বলল,
-‘আমাকে আপনার বন্ধুর নাম্বার টা দেন। যা বলার আমিই বলবো।’

ধীশক্তি আব্রাহাম নাম্বারটা বলার আগেই তার মিটিং এর ডাক আসে। সে সুখের নাম্বারটা নিয়ে নেয় পরে ম্যাসেজ করে পাঠাবে বলে বের হয়ে গেলো মিটিং এর জন্য। সুখও আর অপেক্ষা করলো না,বেশ বেলা হয়ে গেছে সাথে বৃষ্টিও হচ্ছে। কোনোরকম বাড়ি অব্দি পৌঁছাতে পারলেই মুক্তি। তবে,কোথাও যেনো বিরাট পাথর চাঁপা দিলো মনে হচ্ছে। হৃদয়ের কোণে হঠাৎ উঁকি দেওয়া সুপুরুষ টা প্রিয় বান্ধবীর প্রণয়ের নাম। কী উপায়ে বের হবে এই চক্র গুহ থেকে? স্বামী নাকি সই!

_____

এশারের আজানের ধ্বনিতে মুখরিত চারপাশ। বিশাল তিন তলা বাড়িটার সামনে এসে গাড়ি থামে সুখদের। সেই দেঢ় টার দিকে রওনা হয়েছে আর এখন সন্ধ্যা সাত’টা বাজছে। বেশ লম্বা জার্নি। খুলনা থেকে ঢাকা অব্দি এসেছে তারা এত জার্নি করে। তবে পুরোটা পথ মেঘ বেশ খেয়াল রেখেছে দাদী আর সুখের।

গাড়ি থেকে নামতেই দারোয়ান ছুটে এসে গাড়ি থেকে ব্যাগ টা নামালো। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল,
-‘বড়বাবা কেমন আছেন আপনি?’

মেঘ সালাম দিলো মধ্য বয়স্ক দারোয়ানটাকে। হাসিমুখে উত্তর দিলো,
-‘এই তো চাচাজান,ভীষণ ভালো।’

ততক্ষণে সুখ আর দাদীও গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। দারোয়ান তাদের দিকে তাকিয়ে কাচুমাচু কন্ঠে বলল,
-‘আপনার সেখানকার আত্মীয় বুঝি বাবা?’

মেঘ সুখের পানে তাকালো। মেয়েটা কেমন আড়ষ্ট ভঙিতে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘ হেসে বলল,
-‘না চাচাজান, আপনাদের বড়বউ উনি।’

দারোয়ান যেনো ভড়কে গেলো, তবে আর প্রশ্ন করলো না। নিজের সীমার বাহিরে তো আর যেতে পারে না সে, তবুও কৌতুহল জাগলো ভীষণ। বড়বাবার মতন ছেলে কি না লুকিয়ে বিয়ে করেছে?

মেঘ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুটা সময় নিজেকে ধাতস্থ করে কলিং বেলে চাঁপ দিলো। এর মাঝেই সুখের ফোনে মেসেজের নোটিফিকেশন আসলো। অপরিচিত নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে। সুখ ফোনের মেসেজ টা ওপেন করতেই দেখে একটা ফোন নাম্বার। এটা যে সেই ধীশক্তি নামের লোকটা পাঠিয়েছে বুঝাই যাচ্ছে। নাম্বার টা একটু খেয়াল করে দেখতেই সুখের হৃৎপিন্ড থেমে গেলো। দীর্ঘ পাঁচদিনে এতবার দেখেছে নাম্বারটা যে মুখস্ত হয়ে গেছে। এই তো পাঁচদিন আগে এই নাম্বারটা “মেঘ সাহেব” নামে তার কল লিস্টে সেভ করেছিলো। তার মানে মসৃণের ভাই,,,,

বাকিটা ভাবার আগেই চিরপরিচিত কন্ঠ স্বর ভেসে আসলো। সুখ চোখ উঠিয়ে তাকিয়ে বিস্ময়ের সপ্তম আকাশে চলে যায়। অস্ফুটস্বরে ভেসে আসে ‘মসৃন’।

দাদীজান মসৃন’কে দেখে যতটা না অবাক হয়েছে ততটা অবাক হয়েছে মেঘের মা’কে দেখে। সেই বছর ত্রিশ আগে দেখেছিল মেয়েটাকে। দাদীজানও বিষ্ময় কন্ঠে মনে মনে উচ্চারণ করলো,”রেহানা”!

সুখ একটু ছিটকে গেলো। তবে কী এবার বিশ্বাসঘাতকতা বেশ বড় পর্যায়ের?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here