সম্মোহন পর্ব ১

0
1147

#সম্মোহন

পর্ব-এক

পাঁচতারা হোটেলের শুভ্র বিছানায় স্লিভলেস নাইটি পরে আঁধশোয়া অবস্থায় মোবাইলের স্ক্রিন ননস্টপ স্ক্রল করে যাচ্ছে ঊনিশ বছর বয়সী মীরা। পাশেই মীরার পেটে হাত রেখে আরাম করে ঘুমাচ্ছে যে ছেলেটা তার নাম জাবেদ। পেশায় ডাক্তার। উজ্জল স্যামলা, পাঁচ ফিট আট ইঞ্চি উচ্চতা আর সুস্বাস্থ্যের অধিকারী জাবেদের সামনের একটা দাঁত অন্যগুলোর চাইতে একটু বেশি বেড়ে যাওয়াতে হাসিটা মীরার কাছে লাগে মধুর মতো। তার উপর বারতি ইনোসেন্স যোগ করেছে চিকন ফ্রেমের চশমাটা। ডাক্তার জাবেদের এই হাসিতে কত জুনিয়র কুপোকাত সেই হিসেব মীরা কতবার যে কষেছে তার ইয়াত্তা নেই। ঘড়িতে রাত বারোটা বেজে কুড়ি মিনিট। মীরার ঘুম পাচ্ছে না। মোবাইল রেখে জাবেদের দিকে তাকায় মীরা। এত সুন্দর, এত নিশ্পাপ জাবেদের চেহারা! চোখ ধরে যায় তবু চোখ ফিরাতে চায়না। কোন অদ্ভুত মায়ায় এমন লাগে মীরা নিজেই জানেনা।

জাবেদের ঘুমন্ত মুখে ক্লান্তি স্পষ্ট। পুরো আট ঘন্টার জার্নি। ঢাকা থেকে কক্সবাজার। আগের রাতে হঠাৎ করেই স্পেশাল ও টি পরে যায় জাবেদের। পুরো রাত ঘুমোয়নি। তারপর সকালেই আবার এত লম্বা জার্নি। রাতের জার্নি হলে কিছুটা আরাম পাওয়া যেতো। কিন্তু জাবেদ ই জোর করছিলো সকালে রওনা হতে। অথচ রোদ, ধূলো, জ্যাম আর গরমের কারণে যাত্রা বিরতিতে খেতে বসে নিজেই ভক ভক করে দুবার বমি করেছে জাবেদ। আর তারপর গাড়িতে কেমন নির্জীব হয়ে ঘুমোচ্ছিলো মীরার কাঁধে মাথা রেখে। আর শক্ত করে ধরে ছিলো মীরার হাত। মীরা যতবার সেই হাত ছাড়িয়ে নিতে চেয়েছে ঘুমের ভেতর জাবেদ আগলে ধরেছে। এই আগলে রাখা ব্যপারটাতে জাবেদের প্রতি মুগ্ধতা আরো বাড়ে মীরার।

মীরা অবশ্য এই জার্নিতে টায়ার্ড একটুও না। জাবেদ সঙ্গে থাকলে মীরার কেনো যেনো সমস্ত কষ্ট চলে যায়। মীরা আস্তে আস্তে হাত বুলায় জাবেদের মাথায়। চুলে বিলি কাটতে কাটতে ক্ষীন কন্ঠে ডাকে:

-জাবেদ? এই জাবেদ? ঘুম হলো??

জাবেদ “হুঁ” বলে পাশ ফিরে শোয়। মীরা উঠে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। মীরা লম্বায় পাঁচ ফিট তিন, ভাসা ভাসা চোখ, কোমর ছাড়ানো লম্বা চুল, চিবুকে টোল। মায়াবতী বলতে সাধারনত চাপা গাত্রবর্নের মেয়েদের ই বুঝি আমরা অথচ মীরার টকটকে গায়ের রং হওয়া সত্ত্বেও কি ভিষণ মায়াবী!! মেরুন নাইটটিতে মীরাকে চমৎকার লাগছে। মীরা নিজেই নিজেকে দেখে। আর মনে মনে খুঁজতে থাকে তার সৌন্দর্য্য কোথায় কম? তারপর ই মনে পরে জাবেদ সবসময় মীরার এই সৌন্দর্য্যে বিভোর থাকে। মীরার ঠোঁটের কোনে গর্বিত লাজুক হাসি।

মীরা দু কাপ কফি বানায়। কিন্তু ঐভাবে ঘুমোতে দেখে জাবেদকে আর ডাকেনা। বরং একটা কাপ হাতে করে নিয়ে বেলকনিতে দাঁড়ায়। রাতের সমুদ্রটা একদম ই আলাদা। মনে হচ্ছে এক ঝাঁক সাদা বেলি ফুল সাঁই সাঁই আওয়াজ করে বারবার আঁছরে পরছে সমুদ্র কিনারে। হুড়মুড় করে বাতাস ঢুকে রুমের সাদা পর্দাগুলোকে একটা ছন্দে দোলাচ্ছে। নোনতা ঘ্রান সেই বাতাসে। কেমন একটা নেশা ধরা সৌন্দর্য্য। মীরা উদাস হয়ে যায়। মীরার মনে পরে জাবেদ বলেছিলো এই মাসেই ওদের বিয়ের কথাটা বাসায় বলবে। কিন্তু ওর বাসা থেকে নাকি মেনেই নিবেনা। কারণ মীরার মা ডিভোর্সী। মীরা বুজতে পারে না এতে মীরার দোষটা কোথায়?? আর জাবেদ হঠাৎ করে এত পরিবারের বাধ্য ছেলে হয়ে গেলো কি করে? শুরু থেকেই তো সবটা জানতো। এমনকি লুকিয়ে বিয়ে করার সময় ও তো বলেছিলো সব প্রতিকুলতা সামলে নিবে।

-মীর?

চমকে উঠে মীরা! হাতে থাকা কফির মগটা ঝাঁকুনি দিয়ে অনেকটা কফি মীরার পায়ের কাছে এসে পরে। মীরা ধমকে বলে:

-ওহ জাবেদ! এভাবে কেউ আচমকা ডাকে? আরেকটু হলেই তো পুরো কফিটা সোজা গায়ে এসে পরতো।

জাবেদ মীরাকে পেছন থেকে শক্ত করে ধরে।

-কি হতো পরলে?

-কি হতো মানে? গরম কফি জাবেদ, পুড়ে যেতাম আমি!

-আর আমি যে আপনার রুপের আগুনে পুড়ে খাঁক হয়ে যাচ্ছি তার বেলা?

-জাবেদ! ইয়ার্কি মেরো না তো!

-আচ্ছা সরি। কিন্তু ম্যাডাম এভাবে ভয় পেয়ে গেলেন কেনো? এখানে তো আপনি আর আমি ছাড়া কেউ নেই।

-ভেবেছিলাম সারারাতে তোমার আর ঘুম ভাঙবে না। তাই অপ্রস্তুত ছিলাম।

-ইসস!!! অমনি না?? এখানে কি ঘুমোতে এসেছি?? প্রেম করবো না??

-না খেয়ে?

-এই রে!! ক টা বাজে মীর?

-বারোটা পেরিয়ে গেছে অনেক আগে।

-সরি মীর। ভুল হয়ে গেছে। চলো কিছু খাই।

-খেতে ইচ্ছে করছে না।

-মীর তোমার ভালো লাগছে না এখানে এসে?

-লাগছে। তবে এভাবে লুকিয়ে আর কতদিন? আমরা বিয়ে করেছি সেইটা সবাইকে বলে দিলেই তো হয়। অশান্তি হচ্ছে।

-ওহ হো মীর, এই দুটো দিন অন্তত মাথা থেকে এসব ঝেড়ে ফেলে দাও।

বলতে বলতে মীরাকে নিজের দিকে করে নেয় জাবেদ। মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে মীরাকে। অভিমানে মীরার কপালে ভাঁজ পরে। জাবেদ সেই ভাঁজ পরা কপালের চুল সরিয়ে কপালে একটা চুমু খায়। আলতো করে ছুঁয়ে দেয় মীরার পাতলা ঠোঁট। আর মীরা অভিমান ভুলে পোষা বিড়ালের মতো চোখ বন্ধ করে ফেলে।

মীরা আজ পরেছে হলুদ রং এর জামদানী। শাড়ি পরার সময় জাবেদ হো হো করে হাসছিলো। আর মীরাকে বলছিলো:

-সমুদ্রে এসে মেয়েরা পরে নীল শাড়ি। তুমি হলুদ। এটা কেমন পিকুলিয়ার লাগছেনা?

-কোথাও লেখা আছে নাকি যে সমুদ্রে এলে নীলই পরতে হবে?

– না তা নেই। কিন্তু তুমি এই হলুদ শাড়িটা আনতে গেলে কেনো?

-কারণ এই শাড়িটা তুমি দিয়েছিলে।

-আমি? এইটা? মীর কি বলছো তুমি? এই শাড়ি কবে দিলাম?

-কেনো সেবার আমার জন্মদিনে!

-এইটা ছিলো?

-হ্যাঁ!

-ইসস! এই জন্যেই না অনলাইন থেকে কিছু কিনতে হয়না। আমি যেইটা অর্ডার করেছিলাম সেইটা তো ছিলো সবুজ! তোমাকে তো দেখিয়েছিলাম। মনে নেই?
-আছে!

-তো তখন বলোনি কেনো যে ওরা ভুল শাড়ি দিয়েছে?

-কারণ আমি তখন খুলনাতে ছিলাম। আর শাড়িটা তুমি ঢাকার এড্রেসে দিয়েছিলে। আমিও এখানে আসার আগেই দেখেছি। আমার ও মনে হয়েছিলো তুমি সবুজ শাড়ি দেখালে আর হলুদ অর্ডার করলে কেনো? প্রোডাক্ট ডিটেইলস এ ইয়োলো ই লেখা ছিলো!

-এটা ওদের মিসটেক!! ইউ নো মীর আই লাভ সবুজ জামদানী। শীট!

-কেনো এটাও তো আমার কাছে বেশ ভালো লেগেছে।
-হ্যাঁ কিন্তু…!

-জাবেদ আমি কি রং এর শাড়ি পরলাম, বীচে গিয়ে পরলাম নাকি কবিতা আবৃত্তির মঞ্চে উঠলাম শাড়ি পরে ইটস ডাজনট মেটার। আমি কার জন্যে শাড়ি পরলাম আর কার সাথে পরলাম এইটা হচ্ছে মেটার। দেখতে খারাপ লাগলে বলো অন্য রং টা পরবো।

-হেইইইই মীর। এত এক্সাইটেড হয়ে যাচ্ছো কেনো?? এইটাতেও মানাচ্ছে। আ’ম জাষ্ট কিডিং ইয়ার!

-ইটস ওকে। তবে তুমি আমার জন্য এই শাড়িটাই অর্ডার করেছিলে। সবুজ হয়তো অন্য…

এই পর্যন্ত বলে থেমে যায় মীরা। জাবেদ কপাল কুচকে মীরার দিকে তাকিয়ে বলে:

-অন্য কি? থামলে কেনো?

-না কিছুনা। চলো সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। এরপর বীচে গিয়ে বালির উপর হেঁটে মজা পাবোনা।

জাবেদ আর কথা বাড়ায় না। ঠিকাছে বলে নিচে নেমে যায়।

-দুপুরে খেয়ে ঘুমানোটা বড্ড বোকামী হয়ে গেছে। ঠিকি বলছো মীর একটু পর ই অন্ধকার হয়ে যাবে!

হোটেলের রিসেপশনে এসে কথাগুলো বলতে বলতে পকেটে হাত দেয় জাবেদ।

-এই রে! ফোন আনিনি মীর। ওখানটাতে বসো। এক্ষুনি আসছি।

জাবেদ ভীষণ তারাহুরো করে উপরে চলে যায়। এমন সময় হোটেলের সামনে একটা লাল রং এর গাড়ি এসে থামে। গাড়ি থেকে নামে অনিন্দ্য সুন্দরী এক তরুণী। মেয়েটি এসে সরাসরি মীরার সামনে দাঁড়ায়।

-মিস মীরা?

-জ্বী। আপনি??

-সুরাইয়া!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here