শ্রাবনসন্ধ্যা পর্ব:-১৪
# আমিনা আফরোজ
জানালার একপাশে দাঁড়িয়ে আছে সন্ধ্যা। দৃষ্টি বাহিরের পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়া রুক্তিম সূর্যের পানে। চারিদিকে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। পাখিরা তাদের নীড়ে ফেরার জন্য রক্তিম আকাশে এদিক-সেদিক উড়ে বেড়াচ্ছে। ধীরে ধীরে দিনের আলো ফুরিয়ে নেমে আসলো অন্ধকার। আর সেই সাথে দূরের মসজিদ থেকে ভেসে আসছে আযানের সুমিষ্টি সুর। আযানের শব্দে ঘোর কাটল সন্ধ্যার।তাই আর দেরি না করে ওযু করতে চলে গেল ও। রোদ আর সন্ধ্যা দুজন একসাথে নামাজ শেষ করল। তারপর দুজনেই চলে গেল মিসেস রাবেয়া বেগমের কাছে।দুজনকে এক সাথে ঘরে আসতে দেখে মিসেস রাবেয়া বেগম বললেন,
–“কি ব্যপার আজ দুজন একসাথে আমার ঘরে এলে?”
মায়ের কথা শুনে রোদ বলে উঠলো,
–“কেন আসতে পারি না নাকি?”
–“তা পারো । তবে তুমি তো খুব একটা আমার ঘরে আসো না তাই বললাম আর কি।”
–“তেমন কিছু নয়।আজ মন চাইল তোমার সাথে একটু আড্ডা দেয় তাই আসলাম।”
–“থাক আর মিথ্যা বলতে হবে না। কি ব্যাপারে কথা বলতে এসেছিস তা বলে ফেল।”
রোদকে কথা বলতে না দিয়ে এবার সন্ধ্যা নিজেই বলে উঠলো,
–“আন্টি আপনি কি ওনাকে রোদের পড়ার ব্যপারে কিছু বলেছেন?”
–“এখনো বলি নি তবে চিন্তা করো না ও আসলেই আমি বলে দেবো।”
–“ঠিক আছে আন্টি।”
–“যাও তোমরা বরং পড়তে বস। শ্রাবণ যেকোনো সময়ে এলো বলে।”
রোদ ও সন্ধ্যা সম্মতি সূচক মাথা নাড়িয়ে নিজেদের ঘরের দিকে চলে গেল।ঘরে এসে সন্ধ্যা পড়াগুলো আবার দেখতে লাগলো।বেচারি রোদ অসহায় মুখ করে সন্ধ্যাকে বলল,
–“আমার না কিছুই ভালো লাগছে না আপু চলনা একটু লুডু খেলি।”
–“কেন তোমার আবার কি হলো?”
–“বিকেল থেকে তো ঐ রাগী স্যারটার শাস্তির কথা মনে পড়ছে। আজ যদি ঐ রাক্ষসটা আমাকে ধরতে পারে তবে নির্ঘাত আমাকে কাঁচাই খেয়ে ফেলবে।”
রোদের কথা শুনে সন্ধ্যা হাসতে হাসতে বলল,
–“এ কথাটা তখন মনে পড়ে নি?”
–” তখন কি এতসব মাথায় এসেছিল নাকি। তখন তো মাথা গরম ছিল তাই ওরকম একটা উদ্ভট কাজ করে বসেছি।”
–“আহারে এখন কি হবে তাহলে?”
–“আপু তুমি তো আমার দুশ্চিন্তা কমানোর বদলে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছো।”
–“আরে চিন্তা করো না । তোমার ঐ রাক্ষস স্যার তোমাকে ধরতেই পারবে না।”
–“এইটা হলে আমি সব থেকে বেশি খুশি হব।”
–“চল তবে তোমার ঐ রাগী ভাই আসার আগেই লুডু খেলা শুরু করি।”
রোদ সন্ধ্যার কথা শুনে হাসি মুখে লুডুর গুটি আর লুডুর পাতা আনল।পরপর দুবার খেলেও রোদ কিছুতেই সন্ধ্যার সাথে জিতকে পারল না।সন্ধ্যা রোদের পাকা গুটি গুলো এক এক করে কেটে ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছি।সন্ধ্যার এমন কান্ডে তো রোদ রিতিমত বার দুয়েক কেঁদেও দিয়েছে।বেচারি সন্ধ্যা রোদকে এভাবে কাঁদতে দেখে তো নিজেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। কেমন অসহায় মুখ করে তাকিয়ে আছে রোদের দিকে।রোদের অবশ্য এতে কোন ভাবান্তর দেখা যাচ্ছে না।ও তো রিতিমত এখনো কেঁদেই চলেছে।রোদকে এভাবে কাঁদতে দেখে সন্ধ্যা বলল,
–“আরে তুমি এভাবে কাদছো কেন?”
রোদ নিজের অশ্রুসিক্ত চোখগুলো মুছে কোন রকমে বলল,
–“তুমি আমার পাকা গুটি গুলো এভাবে কেটে দিলে। তুমি এতটা নিষ্ঠুর কিভাবে হলে আপু?”
রোদের কথা শুনে সন্ধ্যা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,
–“কিন্তু লুডু খেলায় তো এইটাই নিয়ম ।”
–“তাই বলে তুমি আমার সবগুলো পাকা
গুটি কেটে দিবা।”
–“আচ্ছা এখন আর কেঁদো না। তুমি না হয় পরে কোন একদিন আমার সবগুলো পাকা গুটি কেটে দিও। তাহলেই তো সব কাটাকাটি হয়ে গেল।”
রোদ হেসে বলল,
–“ঠিক আছে কথাটা যেন মনে থাকে।”
সন্ধ্যা রোদের কথার উত্তর দেওয়ার আগেই এক মহিলা এসে খবর দিল শ্রাবণ নাকি ওদের স্টাডি রোমে যেতে বলেছে। শ্রাবনের কথা শোনা মাত্রই দুজনের নজর গেল ঘড়ির দিকে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল দুজন। ঘড়িতে তখন কাটায় কাটায় সাড়ে আটটা বাজে। খেলতে খেলতে কখন যে এতটা সময় পার হয়ে গেছে কেউ বুঝতেই পারে নি। তাই আর দেরি না করে বই খাতা নিয়ে পড়িমড়ি করে ছুটতে ছুটতে দুজন চলে গেল স্টাডি রুমের দিকে।
অন্যদিকে শ্রাবন আজ সাড়ে সাতটার দিকেই বাসায় এসেছে। বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে একটু বিশ্রাম নিয়েছে ও। সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীর যেন ওর অবশ হয়ে আসছে তবুও কান্ত শরীর নিয়েই চলে গেল স্টাডি রুমের দিকে।স্টাডি থেমে গিয়ে রোদকে সন্ধ্যার সাথে বসে থাকতে দেখে ভ্রু-কুচকে জিজ্ঞাসা করল,
–“কি রে তোর পড়াশোনা নেই?যখনি দেখি তুই সবার সাথে ফিসফিস করতে থাকিস?তোর কি সমস্যা হয়েছে বল তো?তোর আবার ফিসফিসানি রোগ হলো না তো?”
শ্রাবণের এমন কথা শুনে রোদের তো আবারও কান্না পেয়ে গেল সেই সাথে রাগ ও ওঠে গেল। নিজেকে কোনরকমে সামলিয়ে বলল,
–“সেই জন্যই তো তোমার কাছে পড়তে আসলাম।আমার তো একা একা পড়া হচ্ছে না।”
–“এমনিতেই এক গাধীকে নিয়ে পারছি না এখন আবার অন্য এক গাঁধী এসে জুটল।”
শ্রাবনের কথা শুনে সন্ধ্যা মনে মনে ভাবতে লাগল,
–” এই লোক ইচ্ছা করেই ওকে সব সময় অপমান করে। অপমান করার কোন সুযোগই ছাড়ে না সে।একদিন শুধু ও সুযোগ পাক তখন এই ছেলেকে মজা দেখাবে ও।”
সন্ধ্যার ধ্যান ভাঙল রোদের চিৎকারে।রোদ রাগে বলল,
–“ভাইয়া তুমি সব সময় আমার সাথে এমন করো কেন?”
–“কেমন করি?”
–“এই যে সব সময় আমাকে গালি দাও।”
–“থাক থাক আর রাগ করতে হবে না এবার পড়া শুরু কর।”
শ্রাবণ রোদকে পড়া বুঝিয়ে দিয়ে সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে বলল,
–“আজ পড়া হয়েছে নাকি আজ ও শান্তি দিতে হবে।”
–আজ পড়া হয়েছে।
শ্রাবণ মুচকি হেসে বলল,
–“পড়া হয়েছে কি নাকি হয়নি এইটা তো একটু পরেই বুঝতে পারব।”
আজ সন্ধ্যা শ্রাবণকে নিভূলভাবে পড়া দিল। শ্রাবণ অবশ্য নিজেও খুশি হয়েছে সন্ধ্যার প্রতি। তবুও গম্ভীর স্বরে বলল,
–“একদিন পড়া দিতে পেয়েছো বলে এত খুশি হওয়ার কোন কারণ নেই।”
সন্ধ্যা কিছু না বলে চুপ করে রইল।এই বদ রাগী লোকটার সঙ্গে খুব একটা কথা বলতে চায় না ও। শ্রাবণের কাছে পড়া শেষ করতে করতে প্রায় দশটা বেজে গেল।রাতের খাবার খেয়ে এসেই সন্ধ্যা ঘুমিয়ে গেল।নিস্তব্ধ রাত্রিতে কেবল একলা জেগে রইল রোদ। আকাশে আজ গোল চাঁদ উঠেছে।চাঁদের আলোতে আলোকিত হয়ে আছে চারিদিক। জানালা দিয়ে আসা চাঁদের আলোতে বসে নিজ ডায়রিতে কিছু একটা লিখল রোদ । তারপর সন্ধ্যার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল ও।একটা সময় ধীরে ধীরে তলিয়ে গেল ঘুমের রাজ্যে।
সকালে হালকা রোদে হেঁটে হেঁটে কলেজে এসে পৌঁছালো রোদ।গাড়িতেই আসতে চেয়েছিল ও কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনের ইচ্ছাতেই হেঁটে এলো । রোদের কলেজ ওর বাসা থেকে খুব একটা দূরে না।তাই হেঁটে আসতে খুব একটা কষ্ট হয় নি ওর।রোদদের প্রথম ক্লাসটাই নেহালের। নেহাল আজ খুব স্বাভাবিক ভাবেই পড়াচ্ছিল।নেহাল কে স্বাভাবিক দেখে মনে মনে সস্তি পেল ও।ভাবলো নেহাল হইতো কিছুই বুজতে পারে নি। কিন্তু রোদের সেই সস্তিটুকু বেশিক্ষণ বজায় থাকল না।ক্লাস শেষে নেহাল বেরিয়ে যাওয়ার আগে রোদকে বলল,
–“মিস নৌশিন আহমেদ রোদেলা আপনি আমার কেবিনে আসুন।”
কথাটা বলেই রোদকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই দ্রুত ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল ও।নেহালের কথাগুলো শুনে ভয় পেয়ে গেল রোদ।তবে কি নেহাল সব বুঝতে পারল?
চলবে
(কেমন হয়েছে জানাবেন আর ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।নিরব পাঠকরা দয়া করে সাড়া দিবেন। আপনাদের সাড়া পেলে লেখার আগ্রহ বেড়ে যায়। ভালো থাকবেন সবাই।হ্যাপি রিডিং ???)