শ্রাবন সন্ধ্যা পর্ব:-১৫

0
1989

শ্রাবন সন্ধ্যা পর্ব:-১৫
#আমিনা আফরোজ

কলেজের নিস্তব্ধ বারান্দা দিয়ে হেঁটে চলেছে রোদ। গন্তব্য নেহালের কেবিন। বারান্দার শেষ মাথার বা দিকের কবিনটাই নেহালের জন্য বরাদ্দ । ক্লাসের সময় পুরো কলেজটাতেই শুনশান নীরবতা বিরাজ করে। কলেজের বিশাল মাঠটাও শূর্ণ্য থাকে এ সময়। তবে টিফিনের ঘন্টা পড়লেই এই শুন্য মাঠটাও মুখরিত হয়ে ওঠে চেনা – অচেনা সকল মুখে। ঠিক সেই সময় দেখতে পাওয়া যাবে মাঠের একপাশে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে আড্ডা দেওয়া কিছু প্রাণোচ্ছল তরুণ-তরুণীকে। যাদের হাসির শব্দেই মুখরিত হয়ে আছে পুরো কলেজ। ক্যান্টিনতাতেও ততক্ষনে বেড়ে যাবে মানুষের আনাগোনা।

এসব ভাবতে ভাবতেই রোদ ধীর পায়ে পৌঁছে গেল বারান্দা শেষ প্রান্তে। বাঁ দিকে তাকাতেই দৃষ্টিগোচর হলো নেহালের কেবিনটা। ভীরু ভীরু পায়ে রোদ এগিয়ে গেল সেদিকে।
দরজায় হালকা টোকা দিয়ে নরম বলে উঠলো,

–“মে আই কামিং স্যার?”

হঠাৎ কোনো মেয়েলি কণ্ঠ শুনে দরজার দিকে তাকাল নেহাল।এতক্ষণ অব্দি ও যে কাঙ্খিত কণ্ঠস্বরের ব্যক্তিটার জন্যই অপেক্ষা করছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। গম্ভীর স্বরে নেহাল বলল,

–” ইয়েস।”

দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল রোদ। তারপর ধীরপায়ে এগিয়ে গেল টেবিলের সামনে। ভয়ে বুক কাঁপছে রোদের। না জানি আজ কোন শাস্তির মুখোমুখি হতে চলেছে ও। শাস্তির কথা ভাবতেই বুকের ভেতর ধক করে উঠলো রোদের।

রোদকে দেখে গতকালের চাপা রাগটা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠল নেহালের। এতক্ষণ অব্দি খুব কষ্ট করেই নিজেকে স্বাভাবিক রেখেছিল ও। তবে রোদকে দেখে মনে হয় না আর নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারবে ও।

গতকালের ঘটনা শত চেষ্টা করেও ভুলতে পারছে না নেহাল। গতকাল বিকেল বেলা রোদ চলে যাবার পর নেহাল ও ওর বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল কলেজ থেকে। কিন্তু মাঝপথে থেমে যায় ওর বাইক।নেহাল রাস্তার একপাশে বাইক থামিয়ে দেখল ওর বাইকের পিছনে চাকার হাওয়া শেষ হয়ে গেছে। বাইকের এমন অবস্থা দেখে নাজেহাল অবস্থা তখন নেহালের। আরো পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারল সামনে চাকাটার হওয়াটাও ফুরিয়ে যাচ্ছে। মিনিট ত্রিরিশের মাঝে গাড়ির সামনের চাকার অবস্থাটাও হয়তো এমনটা হবে। বাইকের এহেন অবস্থা দেখে ভ্রু কুঁচকে গেল নেহালের। নেহালের স্পষ্ট মনে আছে আজ সকালে গরুর গাড়ি চাকাগুলো ঠিকই তবে এখন এই অবস্থা হলো কিভাবে? এমনিতেই বেলা ফুরিয়ে এসেছে তখন। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসবে ধরণীর বুকে। তার ওপর আশেপাশে হয়ত কোন গ্যারেজ ও পাওয়া যাবে না এখন। এ অবস্থায় বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠল নেহালের চোখে -মুখে। কোনরকমে বাইকটা সামনের দিকে ঠেলে এগুতে লাগলো ও। নেহালের ভাগ্য নেহাত গতকাল অতটাও খারাপ ছিলনা তাইতো মিনিট ত্রিরিশেক হাঁটার পরেই রাস্তার পাশে একটা ছোট গ্যারেজের দেখা মেলে ওর। অতঃপর সেই গ্যারেজ থেকেই নতুন চাকা লাগিয়ে বাসায় আসতে আসতে আটটা বেজে যায় নেহালের। তবে চাকা লাগানো সময়ই নেহাল জানতে পারে কোন পিন জাতীয় কিছু দিয়ে গাড়ির চাকা ফুটো করা হয়েছিল। কথাটা শুনে বুঝতে পারে এমন কাণ্ড রোদ ছাড়া আর কেউ করতে পারে না। বাসায় এসে বুঝতে পারে ততক্ষণে ক্লান্তি পুরোপুরি ভাবে গ্রাস করে নিয়েছে ওকে। তাই রোদের ভাবনাগুলো সাময়িকভাবে স্থগিত রেখে কোনরকমে ফ্রেশ হয়ে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যায় ও।

নেহালকে চুপ করে থাকতে দেখে রোদ বলে উঠল,

–“স্যার আমাকে কি জন্য ডেকেছিলেন বললেন না তো ?”

রোদের ডাকে গতকালের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো নেহাল।রোদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,

–“কেন তুমি কিছু জানো না?”

–“আমি কিভাবে জানবো স্যার?”

–“তোমারই তো জানার কথা।আমি ভাবছি আজ তোমাকে কি শাস্তি দেওয়া যায় ?”

শাস্তির কথা শুনে রোদের মনে ভয়টা যেন আরো জেকে বসল। কিন্তু এসময় ভয়কে প্রশয় দিলে হবে না। নার্ভাস হলেই সব কিছু ধরা পড়ে যাবে ওর।তাই নিজেকে স্বাভাবিক রেখেই বলে উঠলো,

–“কিসের শাস্তি স্যার? আমার জানা মতে আমিতো কোন অন্যায় কিছু করি নি। তাহলে শাস্তির কথা আসছে কোথায় থেকে?”

–“তাই নাকি। তোমার কি গতকাল বিকেলের কথা কিছুই মনে পড়ছে না?”

–“গতকাল বিকেলে কিছু কি হয়েছিল স্যার?”

–“আমার তো মনে হচ্ছে তোমার শর্ট টাইম মেমোরি লস হয়েছে। সে যাই হোক, শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে।”

–“শাস্তি দেওয়ার কারণটা তো বলবেন?”

–“গতকাল আমার বাইকের চাকায় পিন দিয়ে ফুটো করার অপরাধে শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে।”

–” আপনার কাছে কি এমন কোন প্রমাণ আছে যে কাজটা আমিই করেছি?”

–“প্রমাণ অবশ্য এই মুহূর্তে আমার কাছে নেই। তবে আমি শতভাগ নিশ্চিত এই কাজ তুমি ছাড়া কেউ করতে পারে না। আমার বাইকের কাছে শেষ তোমাকে দেখা গিয়েছিল।”

–“তাহলে আগে প্রমাণ নিয়ে আসুন তারপর নয় শাস্তির কথা ভাবা যাবে।”

নেহাল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে উঠলো,

–“ঠিক আছে প্রমান তো আমি জোগাড় করবোই তবে তুমিও শাস্তির জন্য তৈরি থেকো।”

–“সে না হয় পরে দেখা যাবে।”

–“ঠিক আছে তুমি এবার আসতে পারো। তোমার সাথে আমার অতি শীঘ্রই আবার দেখা হবে। সেদিন তোমার কপালে দুঃখ আছে।”

রোদ আর কোন কথা না বলে নিঃশব্দে নেহালের কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো। রোদের কাছে সবকিছুই এখন বিরক্ত লাগছে। সবকিছুরই ফিকে লাগছে ওর কাছে। আপাতত কিছুদিন আর কলেজে আসবে না ও। এরমধ্যে নেহাল নয়তো সবকিছুই ভুলে যাবে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ক্লাসের দিকে চলে গেল ও।

অন্যদিকে সন্ধ্যার মনটাও আজ বিষন্নতায় ছেয়ে গেছে। সব কিছুই কেমন যেন একঘেয়ে লাগছে ওর কাছে। সন্ধ্যার বিষন্নতার কারণ সকালে ফোনে বলা ওর বাবার কথাগুলো। ওর বাবার সাথে কথা বলার পর থেকেই অন্য কোন কাজে মন বসাতে পারছি না ও। সবকিছুই কেমন অস্বস্তি লাগছে ওর কাছে।

প্রতিদিনের মত আজ সকালেও রোদ চলে যাবার পর শ্রাবণের দেওয়া পড়া গুলোই পড়ছিল ও। এমন সময় শুনতে পায় ওর বাবা ওর সাথে কথা বলতে চায়। কথাটা শুনতে পেয়ে একরকম প্রায় দৌড়ে চলে যায় রশিদ সাহেবের ঘরের দিকে। সন্ধ্যাকে ঘরে আসতে দেখেই রশিদ সাহেব ওর দিকে উনার সেলফোনটা বাড়িয়ে দেন সন্ধ্যার দিকে। সন্ধ্যাও আর দেরি না করে ফোন নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। কতদিন বাবার সাথে কথা বলে নি ও।

–“হ্যালো বাবা।”

–“সন্ধ্যা মা ভালা আছোস নি?”

–“হু বাবা ভালা আছি। তোমরা কেমন আছো?”

–“আমরা সব্বাই ভালাই আছি। শোন তোরে একখান জরুরী কথা কওনের লাইগা ফোন দিছি।”

–“কি কথা বাবা?”

–“আমি তোর বিয়া ঠিক করছি। ছেলে অনেক ভালা। তুই সুখেই থাকবি।”

–” এসব তুমি কি বলছো বাবা?”

–“দেখ আমি যা কইতাছি তোর ভালার জন্যই কইতাছি। রশিদের পোলা শ্রাবণ তোর জন্য উপযুক্ত পোলা। একমাস পরেই তোর বিয়া ঠিক করছি আমি।”

–“কিন্তু বাবা…….

–“আর কোন কিন্তু না। তোরা আর শ্রাবণের বিয়ে তো আগেই হইয়া গেছিল এখন শুধু শরীয়ত মতে আবারো তোদের এক করে দেওয়া।”

–“মানে ….

–“তোর এত কিছুর উত্তর জানতে হইব না। শুধু আমার কথাগুলো মনে রাখবি।”

–“তোমরা আইবা না?”

–“না আমি বা তোর মা কেউ যামু না।আমরা যাওনের লগে লগে সামাদ চেয়ারম্যান বা নেহাল সব জাইনা যাইব।”

নেহালের নামটা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল সন্ধ্যার। বাবার সাথে আর কিছুক্ষণ কথা বলে নিঃশব্দের নিজের ঘরে চলে এলো ও। আচ্ছা নেহালকে কি ও ঠটিয়েছে। নিজের মনকেই জিজ্ঞেস করল ও। সাথে সাথে জবাব পেয়ে গেল সন্ধ্যা। হ্যা নিঃসন্দেহে নেহালকে ঠকিয়েছে ও। নেহাল তো ওকে নিয়ে সুন্দর একটা জীবনের স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু সন্ধ্যা নিজ স্বার্থের জন্য নেহালকে ধোঁয়াশার মধ্যে রেখে পালিয়ে এসেছে। আচ্ছা নেহাল কি এখনো ওকে খুঁজছে? ও কি সন্ধ্যাকে নিয়ে এখনও নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখে চলছে? নাকি সময়ের স্রোতে সন্ধ্যাকে ভুলে এগিয়ে গেছে? কথাগুলো ভাবতেই বুঝতে পারল চোখ ভিজে উঠেছে ওর। তবে কি নেহালের জন্য কষ্ট হচ্ছে ওর ? নিজের অজান্তেই কি নেহালের জন্য সূক্ষ্ম অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে সন্ধ্যার মনে?

চলবে

(কেমন হয়েছে জানাবেন আর ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।যারা নীরব পাঠক আছেন তারা দয়া করে সাড়া দিবেন। আপনাদের সাড়া পেলে লেখার আগ্রহ বেড়ে যায়।গল্প নিয়ে কারো কোনো মতামত থাকলে জানাতে পারেন। ভালো থাকবেন সবাই।হ্যাপি রিডিং ???)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here