শ্রাবনসন্ধ্যা পর্ব:-০৭
#আমিনা আফরোজ
জানালার এক পাশে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে সন্ধ্যা। দৃষ্টি জানালার ওপারের দূর সীমান্তে।যদিও বৃষ্টির কারণে বেশিদূর অবদি দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল না তবুও বাইরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ও।কানে বাজছে রিমঝিম বৃষ্টির শব্দ। সন্ধ্যা বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকে অবলোকন করছে প্রতিনিয়ত। ভাবছে তার জীবনের চলমান ঘটনাগুলোর কথা। সন্ধ্যার অনুপুস্থিতিতে ওর পরিবারের সদস্যদের কথা চিন্তা করে একবার ভাবলো ফিরে যাবে ও ঐ নরকে কিন্তু পরমুহুর্তে ভাবলো এত সহজে সে ধরা দিবে না নিহালের কাছে। প্রচন্ড ঝাঁকুনিতে সন্ধ্যার ধ্যান ভেঙ্গে গেল। সন্ধ্যা আশে-পাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল কি হয়েছে। কিছুক্ষন পর বুঝতে পারলো সন্ধ্যা ওর গন্তব্যে পৌঁছে গেছে। এতটা সময় যে কি করে কেটে গেল বুঝতেই পারে নি ও। ট্রেন থেকে নেমে দাঁড়িয়ে পরল সন্ধ্যা। ওর বাবার দেওয়া তথ্য অনুসারে এখানে আসার কথা রশিদ সাহেব অর্থাৎ ওর বাবার বন্ধুর। তাই সন্ধ্যা আশে পাশের বেশ ভালো করে দেখতে লাগল।
সন্ধ্যা দেখল ওর থেকে একটু দূরে সাদা রঙের শার্ট পড়ে ওর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যার কেন যেন মনে হচ্ছে ছেলেটি ওকে খুব ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।একে তো অচেনা -অজানা জায়গা তার উপর ছেলেটির এমনভাবে তাকিয়ে থাকা যেন সন্ধ্যার অসস্তি আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। সন্ধ্যা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে দেখল ছেলেটি বেশ লম্বা, গায়ের রঙ ফর্সা,মুখে চাপদাড়ি আর মাথা ভর্তি সিল্কি চুল। সন্ধ্যা আবারো তাকিয়ে দেখল ছেলেটিকে বৃষ্টি ভেজা শার্ট পড়ে যেন আরো বেশি সুন্দর লাগছে।
সন্ধ্যার এসব উদ্ভট ভাবনার মাঝেই ছেলেটি ওর সামনে এসে দাড়ালো। হঠাৎ করে সামনে কারো অনুভব করতেই সন্ধ্যা ওর ভাবনা ইতি টানলো। এতক্ষণ এসব ভাবার কারনে এখন বেশ লজ্জা পাচ্ছে সন্ধ্যা। সন্ধ্যার ভাবনার ইস্তোফা ঘটিয়ে অচেনা ছেলেকে জিজ্ঞেস করল,
–“আপনি আশরাফ আঙ্কেলের মেয়ে সন্ধ্যা তাই না?”
–“জি কিন্তু আপনি কে?”
–“আমি আপনার বাবার বন্ধু রশিদ সাহেবের বড় ছেলে। আমার নাম আরহান আহমেদ শ্রাবণ। আমি আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।”
–“জি।”
–“ঠিক আছে। চলুন তবে যাওয়া যাক।”
–“আচ্ছা চলুন।”
সন্ধ্যা আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ও সন্ধ্যা শ্রাবন নামের ছেলেটি পিছনে পিছনে গিয়ে উঠে বসলো। তারপর আবার রওনা দেয় ওর নতুন ঠিকানার পথে।
রশিদ সাহেব আর আশরাফ সাহেব দুজনে বাল্যকালের বন্ধু ছিল। একসাথে বেড়ে ওঠা ওনাদের। একই গ্রামের লোক হওয়ায় বন্ধুত্বটাও বেশ গভীর ছিল দুজনের । বন্ধুত্বের সুবাদেই দুজনে একই ভার্সিটিতে পড়াশোনা করেন। পড়াশোনা শেষ করে আশরাফ সাহেব গ্রামে ফিরে গেলেও রশিদ সাহেব আর গ্রামে ফিরে যাননি। ঢাকাতেই ব্যবসা শুরু করেন তিনি।ধীরে ধীরে ব্যবসার উন্নতি হলে গ্রাম থেকে বাবা-মাকে নিয়ে আসেন নিজের কাছে। তারপর শ্রাবণের মা অর্থাৎ রাবেয়া বেগম কে বিয়ে করেন। রশিদ সাহেবের এক ছেলে-মেয়ে। ছেলের নাম আরহান আহমেদ শ্রাবণ। সবাই শ্রাবন বলে ডাকে ওকে এবং মেয়ের নাম নৌশিন আহমেদ রোদেলা। শ্রাবণ এবার অনার্স চতুর্থ বর্ষে পড়ছে। পড়াশোনার পাশাপাশি শ্রাবণ ওর বাবার ব্যবসাও দেখছে।আর রোদেলা এবার এসএসসি দিল। অন্যদিকে আশরাফ সাহেব গ্রামে এসে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতার পেশা বেছে নেন। তারপর আনোয়ারা বেগমকে বিয়ে করেন। আশরাফ সাহেবের দুই মেয়ে। বড় মেয়ের নাম সন্ধ্যা আর ছোট মেয়ের নাম জারা। সন্ধ্যা এবার ইন্টারে পড়ে আর যারা ক্লাস এইটে।
পরিচয়পর্ব তো অনেক হলো এবার অল্পে ফেরা যাক ।
বেশ কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যা দিয়ে গাড়ি একটি বড় বাড়ির সামনে এসে দাড়ালো। গাড়ি থেকে নেমে সন্ধ্যা বেশ অবাক হলো। অবাক হওয়ারই কথা এমন বাড়িতো সন্ধ্যা শুধু সিনেমাতেই দেখেছে। বাড়ির সামনে কিছু অংশে ফুলের বাগান দেখে সন্ধ্যা আরো অবাক হয়ে গেল। বাগানের কাছে একটি দোলনা দেখতে পেল ও। সারা বাগানজুড়ে ফুটে আছে হরেক রকম ফুল যা দেখলে যে কারো মন মনটা আপনা আপনি ভালো হয়ে যাবে। বাগান পেরিয়ে সন্ধ্যা শ্রাবণের পিছু পিছু বাসার ভেতরে প্রবেশ করল।
রশিদ সাহেব তখন সোফায় বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। সকাল থেকে অনবরত বৃষ্টির কারণে আজ আর অফিসে যাননি তিনি। এমনিতেই এখন আর তেমন একটা অফিসে যেতে চান না ওনি। বেশিরভাগ সময়ই শ্রাবণই অফিস এ যায়। অন্যদিকে রাবেয়া বেগম তখন রান্নাঘরে সকালের নাস্তা তৈরি করেছিলেন। এমন সময় বাসার কলিং বেল বেজে উঠল তিনি বলেন,
–“শুনছো ওরা হয়তো চলে এসেছে তুমি একটু দরজাটা খুলে দাও না গো।”
–“ঠিক আছে। দাড়াও আমি দেখছি।”
রশিদ সাহেব কথাটি বলে হাত থেকে পত্রিকাটি রেখে দরজা খোলার জন্য চলে গেলেন।দরজা খুলতেই শ্রাবণ আগে ভিতরে ঢুকলো তারপর শ্রাবণের পিছু পিছু লাল বেনারসি পড়ে একটি মেয়ে ঢুকলো। রশিদ সাহেবের সন্ধ্যা কে চিনতে সময় লাগল না। এদিকে সন্ধ্যার রশিদ সাহেব কে চিনতে পেরে সালাম দিল,
–“আসসালামু আলাইকুম চাচা।”
–“ওয়ালাইকুমুস সালাম। তুমি আশরাফের মেয়ে?”
–“জি চাচা।”
রশিদ সাহেবের কথা শুনে রাবেয়া বেগম ও রান্না ঘর থেকে বের হয়ে আসলেন। রশিদ সাহেব কে এভাবে প্রশ্ন করতে দেখে বললেন,
–“তুমি কি মেয়েটাকে ভিতরে আসতে দেবে না নাকি? সেই কখন থেকে দেখছি ওকে দাঁড়িয়ে রেখেই কথা বলছো। এতদুর থেকে এসেছে মেয়েটা, একটু বিশ্রাম নিতে দাও। পরে ওসব কথা হবে।”
স্ত্রীর কথায় রশিদ সাহেবের খেয়াল হলো সত্যিই বড় বোকামি করে ফেলেছেন তিনি। মেয়েটা পরিস্থিতিত জানান তিনি। রশিদ সাহেব অনুতাপের স্বরে বললেন,
–“দেখেছ মা আমি একদম ভুলে গেছি। আসলে কি বলোতো বুড়ো হয়ে যাচ্ছি তো তাই সব ভুলে যাচ্ছি। তুমি কিছু মনে করো না।”
–“কি যে বলেন না আংকেল। আপনাকে সরি বলতে হবে না। আর তাছাড়া আপনি তো কোন ভুল করেননি।”
সন্ধ্যার কথা শুনে রশিদ সাহেব হেসে বললেন,
–“তোমার কথা শুনে খুশি হলাম। এখন তোমার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে একটু বিশ্রাম করো। এতক্ষণ জার্নি করে এলে তো, বিশ্রাম নিলে ভালো লাগবে।”
–“ঠিক আছে চাচা।”
মিসেস রাবেয়া বেগম সন্ধ্যা কে নিয়ে ওর ঘর দেখিয়ে দিল আর বলল,
–“তুমিতো মনে হয় কোন কাপড় আনো নি?”
সন্ধ্যা মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিল,
–“না আন্টি।”
–“তুমি একটু অপেক্ষা করো। আমি আমার মেয়ে জামা নিয়ে আসছি। দেখতো ওর জামা তোমার হবে কিনা?”
–“ঠিক আছে আন্টি।”
মিসেস রাবেয়া বেগম দ্রুত মেয়ের ঘরে গেলেন। মেয়ের ঘরে গিয়ে দেখেন মেয়েটার কানের ভেতর হেডফোন লাগিয়ে বেশ আরামসে গান শুনে চলেছে। মেয়ের এরূপ কাজ দেখে বেশ রেগে গেলেন তিনি। রাগীশ্বরে বললেন,
–“বলি গান শোনা বাদ দিয়ে কি আর কোন কাজ নেই তোর?”
হঠাৎ করে হেডফোন কেউ টান দেওয়ায় বেশ রাগ হয় রোদের। রাগী মুখ নিয়ে মাথা ঘুরিয়ে পেছন দিকে তাকায় ও কিন্তু মাকে দেখে সব রাগ পানি হয়ে যায় রোদের। মাকে দেখে বড্ড ভয় পায় রোদ। ভয়ে ভয়ে বলল,
–“এতক্ষণ পড়ছিলাম মা। ভালো লাগছিলো না তাই একটু গান শুনছিলাম।”
–“হয়েছে হয়েছে আর মিথ্যা কথা বলতে হবে না। তুই যে কি পড়ছিলি তার জানা হয়ে গেছে আমার।”
–“তুমি যে কি বল না মা। আমি কি তোমাকে মিথ্যে কথা বলতে পারি বল?”
–“যাইহোক শোন তোর এক সেট কাপড় দে তো।”
মায়ের এমন কথা শুনে রোদ চিন্তিত স্বরে বলল,
–“আমার কাপড় দিয়ে তুমি কি করবে মা? আর আমার কাপড় কি তোমার হবে নাকি?”
–“আরে বাবা আমি কেন তোর কাপড় পড়তে যাব?”
–“তো কার জন্য কাপড় চাচ্ছ তুমি?”
–“আরে তোর বাবার বন্ধু আশরাফ ভাই আছে না?”
–” হ্যা বাবার মুখে অনেকবার আংকেল এর নাম শুনেছি।”
–“হুম। ওনার বড় মেয়ের সন্ধান এসেছে আমাদের বাড়িতে। কিছুদিন থাকবে এখানে। ওর জন্যই প্রয়োজন। ভিজে কাপড়ে অনেকক্ষণ গুলো আছে মেয়েটা।”
–“ঠিক আছে মা । আমিও যাই তোমার সাথে সন্ধ্যা আপন ঘরে?”
–“তুই গিয়ে কি করবি? মেয়েটা অনেক দূর জার্নি করে এসেছি। এখন একটু বিশ্রাম নিক। তুই গিয়েই তো গল্প শুরু করে দিবি। এতে করে মেয়েটা আর বিশ্রাম নিতে পারবে না।”
–” আরে গল্প করবো না শুধু পরিচয় হয়ে আসবো।”
মিসেস রাবেয়া বেগম কিছুক্ষণ ভেবে বললেন,
–“ঠিক আছে চল।”
রোদ ওর আলমারি হতে একসেপ্ট কাপড় নিয়ে মায়ের সাথে গেল সন্ধ্যার রুমের দিকে। সন্ধ্যা তখন বিছানার এক কোণে বসে ছিল। ওনাদের দেখে উঠে দাঁড়ালো সন্ধ্যা। মিসেস রাবেয়া বেগম সন্ধ্যাকে কাপড় দিয়ে রোদকে দেখিয়ে বললেন,
–“এ হলো আমার মেয়ে রোদ। তোমার থেকে এক বছরের ছোট ও।”
রোদ সন্ধ্যার কাছে এগিয়ে এসে বলল,
–“কেমন আছো আপু?”
সন্ধ্যা মলিন মুখে উত্তর দিল,
–“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।”
সন্ধ্যা উত্তর দিয়ে মনে মনে ভাবতে লাগল আসলেই কি ভাল আছে ও নাকি ভালো থাকার অভিনয় করছে? আপাতত এর উত্তর সন্ধ্যার কাছে অজানা।
সন্ধ্যার মন খারাপ দেখে মিসেস রাবেয়া বেগম বললেন,
–“তুমি খুব ক্লান্ত সন্ধ্যা। ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নাও।”
কথাটি বলে রোদকে নিয়ে চলে গেলেন তিনি। মিসেস রাবেয়া বেগম আর রোদ চলে যাবার পর সন্ধ্যা ভাবতে লাগল,এই বাড়ির সকলেই খুব ভালো বেশ মিশুক। তবুও বাড়ির জন্য ওর মনটা কেমন যেন কু ডাকছে না জানি কি হলো ওদিকে। ভাবনা রাজ্য শেষ করে ফ্রেশ হতে গেল ও। ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল সন্ধ্যা। ক্লান্তিতে দুচোখের পাতা বুজে আসছে ওর। আর হয়তো বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারবে না। আর হয়তো কিছুসময়ের মধ্যেই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমাবে। আপাতত একটু শান্তির ঘুম চায় ও।যেখানে কোন দুশ্চিন্তা থাকবে না।
চলবে
(আজকের পর্বটা কিন্তু অনেক বড় করে দিয়েছি। তারপরও যদি কেউ বলেন যে আজকের পর্ব ছোট হয়েছে তাহলে কিন্তু আমি কান্না করব। গল্পটা কেমন হয়েছে জানাবেন আর ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ভাল থাকবেন সবাই। হ্যাপি রিডিং??)