শ্রাবনসন্ধ্যা পর্ব:-০৬

0
3354

#শ্রাবনসন্ধ্যা পর্ব:-০৬
#আমিনা আফরোজ
#

আজ নিহাল ও সন্ধ্যার বিয়ে। আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। এর মাঝেই দেখতে দেখতে কেটে গেছে চারটা দিন। বিয়েটা অবশ্য একপ্রকার জোর করেই হচ্ছে। তবে কারও কিছু করার নেই এখানে।সন্ধ্যা দোটানায় ভুগছে এখনও। নিহালকে সে এখনো মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। কেমন যেন একটা দ্বিধা কাজ করছে ওর মাঝে। তবে এর উত্তর সন্ধ্যার কাছে নেই। সন্ধ্যা একবার মনে মনে ভেবেই ছিল নেহাল কে সে না করে দিবে কিন্তু পরক্ষনেই পরিবারের কথা ভেবে চুপ করে রইলো। সন্ধ্যা খুব ভাল করেই জানে সন্ধ্যার একটা “না” কথা ওর পরিবারের জন্য কত বড় অভিশাপ হতে পারে।

সন্ধ্যা যখন ওর জীবনে হিসাব মিলাতে ব্যস্ত ঠিক তখনই হঠাৎ হন্ত-দন্ত হয়ে ওর ঘরে প্রবেশ করল ওর বাবা আশরাফ সাহেব। চোখে তার ব্যর্থতার ছায়া। তিনি বাবা হয়ে মেয়েকে রক্ষা করতে পারছেন না এ ব্যর্থতা তাকে যেন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। তবে তিনি একটা বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। এর ফলাফল চেয়ে খুব ভয়াবহ হবে তা তিনি জানেন, তবুও তার আদরের মেয়েকে ঐ লম্পটের হাতে তুলে দেবেন না তিনি। এজন্য তিনি যা করতে হয় করবেন। প্রয়োজন পড়লে সব বিপদ নিজের দিকে নেবেন তিনি তবুও মেয়ের গায়ে একটুকু বিপদের আঁচ ও লাগতে দেবেন না।

ঘরে ঢুকেই আশরাফ সাহেব সন্ধ্যাকে বললেন,

–“মা রে তুই এই নরক থাইকা পালিয়ে যা।”

–“কই যামু বাবা? যাওনের তো জায়গা নাই।”

–“তুই এখান থেকে ট্রেনে কইরা সোজা ঢাকা চইলা যাবি। আমার বন্ধু রশড আহ্মেদ তোর জন্য কমলাপুর রেলস্টেশনে দাঁড়াইয়া থাকবো। আমি সব ব্যবস্থা কইরা আইছি।”

–“কিন্তু বাবা আমি গেলে তোমাগোর কি হইব?”

–“কোন কিন্তু নয়। আমাগো যা হওয়ার হইবো। সেসব পরে দেখা যাইব আপাতত তুই পালিয়ে যা।”

বাবার অশ্রুসিক্ত নয়নে দিকে তাকিয়ে আর কোন কথা বলার সাহস পেলো না সন্ধ্যা।সন্ধ্যা গাঁয়ে বেনারসি শাড়ি জড়িয়েই বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়ল রেলস্টেশনের উদ্দেশ্যে। আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢেকে আছে। সেই সাথে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। বৃষ্টির পানিতে ভিজে যাচ্ছে সন্ধ্যার শরীর। সেদিকে কোন হুশ নেই। ওর শুধু একটাই ধারণা যত তাড়াতাড়ি ও এখান থেকে যেতে পারবে তত তাড়াতাড়ি ওর জন্য ভালো।

এদিকে সন্ধ্যার বাড়িতে নিহাল বর বেশে প্রবেশ করল। শেরওয়ানি পড়ে নেহাল কে আজ দারুন লাগছে। তবে বাড়িতে আসার পর থেকে কেমন যেন লাগছে নেহালের। এমন তো হবার কথা নয়। কেন যেন মনে হচ্ছে সন্ধ্যা কে ও হারিয়ে ফেলছে।ধুর এসব কি ভাবছে ও আর কিছুক্ষণ পরেই তো ও সন্ধ্যাকে সারা জীবনের জন্য পেয়ে যাবে। একবার সন্ধ্যাকে পেয়ে নিক সারা জীবন রানী করে রাখবে ওর ঘরে। নিজের মনে মনে কথাগুলো বলে মৃদু হেসে উঠল নেহাল। এ দিনটির জন্যই এত দিন অপেক্ষা করেছিল ও। আজ যেন অন্যরকম আত্মতৃপ্তি পাচ্ছে ও। এ যেন এক অন্যরকম অনুভুতি, যা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না ও।

নেহাল যখন নিজের ভাবনায় মত্ত ঠিক তখনি বাড়ির ভেতর থেকে হৈ-চৈ শোনা গেল। বাড়ির মহিলারা বাহিরে এসে চিৎকার করে জানিয়ে দিলো কনে পালিয়েছে।”কনে পালিয়েছে”কথাটি যেনো নিহালের কানে বারংবার প্রতিধ্বনি হতে লাগলো। এইটা যে অবিশ্বাস্য। সন্ধ্যার তো পালানোর কথা নয়। সন্ধ্যা তো তাকে কোন কিছু বলেনি। তবে কি ওর শ্যামলতা ওকে এখনো মেনে নিতে পারে নি? তাহলে কি ওর শ্যামলতা এখনো ওকে ঘৃণা করে? নিজের মনকেই বারংবার প্রশ্নগুলো করতে লাগলো ও। কিন্তু বারবার প্রশ্ন করেও কোন প্রকার উত্তর পেল না ও।এক সময় ক্রোধ আর ভালোবাসার মানুষকে না পাওয়ায় নেহাল হিতাহিত জ্ঞান হারালো। বদ্ধ উন্মাদের মত করতে লাগলো । হাতের কাছে যা পাচ্ছিল তাই ছুড়ে ফেলতে লাগলো। মাথা থেকে পাগড়ি ফেলে দিল তারপর দুহাতে মাথার চুলে হাত দিয়ে হাটু গেড়ে বসে পড়ল মাটিতে। ছেলের এরূপ অবস্থা দেখে সামাদ মিয়া ছুটে চলে গেলেন ছেলের কাছে। ছেলেকে খুব ভালোবাসেন তিনি। আজ পর্যন্ত ছেলের কোন সাধই অপূর্ন রাখেন নি । তাইতো সন্ধ্যাকে পছন্দ না করলেও ছেলের জন্য এই বিয়েতে রাজি হয়েছিলেন তিনি।

সামাদ মিয়া ছেলেকে বুকে জড়িয়ে বলতে লাগলেন,

–“আব্বা আপনি চিন্তা কইরেন না। আপনার সন্ধ্যারে আপনার কাছে ফিরাইয়া আইনা দিমু আমি।”

বাবা কে কাছে পেয়ে কেঁদে ফেলল নেহাল। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ছোট শিশুর মতো বলল,

–“আমার সন্ধ্যা কে এনে দাও বাবা‌ । আমার শ্যামলতাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। দেখো না ওরা এসব কি বলছে। তুমি বলো না ওরা মিথ্যা কথা বলছে। তুমিই বলো আমার শ্যামলতা কেন আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?”

নেহাল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবারো বলতে শুরু করল,

–“ওকে আমার কাছে এনে দাও না বাবা? দেখনা আমার কেমন নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি এখনই মারা যাব।”

সামাদ মিয়া নেহালের এমন পাগলামী দেখে কেঁদে ফেললেন। অনেক কষ্টে তিনি নিজের ছেলেকে সামলালেন। নিহার কে ওর বন্ধুদের কাছে রেখে সোজা গিয়ে দাঁড়ালেন আশরাফ সাহেবের সামনে। আশরাফ সাহেবের দিকে কটমটিয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

–“মেয়েকে কই পাঠিয়েছিস?”

–“আমি জানি না।”

–“তুই সব জানিস। তোর মেয়ে তোকে না বলে কোন কাজ করে না।”

–“আমি জানলেও বলবো না কোথায় গেছে আমার মেয়ে।”

আশরাফ সাহেবের এমন কথা সহ্য করতে না পেরে সামাদ মিয়া ওনাকে মারতে লাগলেন। আশরাফ সাহেব কে মারতে দেখে এগিয়ে আসলো নিহাল। বাবাকে থামিয়ে দিয়ে আশরাফ সাহেবকে বলল,

–“সন্ধ্যা যেখানে যাক না কেন ওকে আমি খুঁজে বের করবই ‌ তবে কাজটা মোটেও ভাল করে নি ও। এর জন্য ওকে শাস্তি পেতে হবে, খুব ভয়ঙ্কর শাস্তি পেতে হবে।”

এই কথা বলে একটা পৌশাচিক হাসি দিয়ে বাবাকে নিয়ে চলে গেল সন্ধ্যাকে খুঁজতে।

অন্যদিকে সন্ধ্যা গ্রামের সরু পথ দিয়ে প্রাণপণে দৌড়ে চলছে রেল স্টেশনের উদ্দেশ্যে। পিচ্ছিল রাস্তায় দৌড়ানোর ফলে বেশ কয়েকবার পড়ে গেছে ও। যার ফলে হাতে পায়ে কাদা লেগে একাকার ওর। যদিও বৃষ্টির পানিতে পরক্ষনে সেসব ধুয়ে যাচ্ছে। তবুও সেদিকে কোন খেয়াল নেই ওর। সন্ধ্যা বেশ কিছুক্ষণ পর লক্ষ্য করলো ওর পেছন পিছন একদল লোক আসছে। ভয়ে কেঁপে উঠল সন্ধ্যার বুক। মনে হতে লাগল এই বুঝি ধরা পরল নেহালের হাতে। তাই আরো জোরে দৌড়াতে লাগলো ও।

প্রায় মিনিট পনেরো দৌড়ানোর পর স্টেশনে এসে পৌঁছালো সন্ধ্যা। অনেকক্ষণ দৌড়ানোর জন্য হাঁপিয়ে উঠেছে ও। বৃষ্টির কারণে স্টেশনে লোকসমাগম তেমন নেই। পুরো স্টেশনই প্রায় ফাঁকা। সন্ধ্যা এদিক সেদিক তাকিয়ে এগিয়ে গেল চেন মাস্টারের দিকে। সন্ধ্যার কপাল নেহাতই ভালো ছিল আজ।চেনমাষ্টারের সাথে কথা বলে জানতে পারল দশ মিনিট পর একটা ট্রেন আছে ঢাকা যাওয়ার জন্য। সন্ধ্যা আর দেরি না করে ঝটপট টিকিট কিনে ট্রেনে ওঠে পড়ল। টিকিট পেতে বেশী সময় লাগেনি ওর। কিছুক্ষণ পর ট্রেন ছেড়ে দিল ঢাকার উদ্দেশ্যে আর সন্ধ্যাও এগিয়ে চলল ওর অজানা ভবিষ্যতের দিকে।

চলবে

(হয়তো নেহালের নিয়তিতে সন্ধ্যা ছিল না। হয়তো দুজনের নিয়তিতে অন্য কারো নাম লেখা আছে। আপনাদের কি মনে হয়? জানাবেন কিন্তু। ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আর যারা নীরব পাঠক আছেন তারা দয়া করে সাড়া দিবেন। আপনাদের সাড়া পেলে লেখার আগ্রহ বেড়ে যায়। ভালো থাকবেন সবাই। হ্যাপি রিডিং ??)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here