শ্রাবণসন্ধ্যা পর্ব:-০৮

0
2625

#শ্রাবণসন্ধ্যা পর্ব:-০৮
#আমিনা আফরোজ

ঘড়ির ঢং ঢং শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল সন্ধ্যার। টেবিল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল বেলা তখন বারোটা বাজে। সন্ধ্যা উঠে বসলো। তারপর কিছুক্ষন পর উঠে চলে গেল জানালার কাছে। থাই গ্লাস খুলে দেখে বাহিরে এখনও টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে। সকাল থেকে এখন অব্দি বার দুয়েক বৃষ্টি হয়েছে। আকাশ এখনও মেঘে ঢেকে আছে।আজ হয়তো আর সূর্য্যি মামার দেখা পাওয়া যাবে না। মেঘলা আকাশের সাথে ঝিরিঝিরি হাওয়া বইছে। আশেপাশে হয়তো কোথাও কদম ফুলের গাছ রয়েছে। দখিনা হাওয়ার সাথে তারই ঘ্রান গাচ্ছে সন্ধ্যা। কদমফুল সন্ধ্যার খুব প্রিয়। তার সাথে প্রিয় বৃষ্টিতে ভেজা। গ্রামে এই সময় সন্ধ্যারা দুই বোন একসাথে বৃষ্টিতে ভিজতো। বাড়ির কথা মনে হতেই ডুকরে কেঁদে উঠল ও। এমন সময় সন্ধ্যার ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে আসলো রোদ। সন্ধ্যাকে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওর কাছে চলে গেল ও। সন্ধ্যা তখনও বাহিরের পানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।ওর পাশে যে কেউ এসে দাঁড়িয়ে আছে তার কোন খেয়ালই নেই ওর। সন্ধ্যাতো এখনও ওর ভাবনার রাজ্যে বিভর। সন্ধ্যাকে এমন মন খারাপ করে থাকতে দেখে রোদ বলল,

–“ঘুম থেকে কখন উঠলে আপু?”

হঠাৎ কারো গলার আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠল সন্ধ্যা। কিন্তু পরক্ষনেই রোদকে দেখে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে হেসে বলল,

–“এইতো কিছুক্ষণ হলো।”

–“তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিলে আপু?”

–“তেমন কিছু না ।বৃষ্টির ছন্দপতন দেখছিলাম।”

–“বৃষ্টি তোমার কাছে কেমন লাগে আপু?”

–“বর্ষা মানেই স্নিগ্ধ পরিবেশ। আর স্নিগ্ধ পরিবেশ কার না ভালো লাগে বলো”

রোদ মৃদু হেসে বললো,

–“বৃষ্টির দিনে তোমার কি করতে ভালো লাগে?”

–“আকাশের দিকে চোখ বন্ধ করে তাকিয়ে দু-
হাত বাড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে। যখন বৃষ্টির ফোঁটাগুলো গায়ে লাগে তখন এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়।”

রোদের কাছে সন্ধ্যার কথাগুলো খুব ভালো লাগছে। তাই আরো কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল,

–“আর কি ভালো লাগে আপু?”

–“কদম ফুলের ঘ্রাণ।”

–“বাহ ।আপু সময় তো অনেক ভালো যাও ফ্রেশ হয়ে আসো, আজ বিকেলে আমরা ভাইয়ের সাথে শপিং এ যাবো।

–“কেন?”

–“বাহ রে তোমার জামা-কাপড় কিনতে হবে না বুঝি?”

–“ও আচ্ছা ঠিক আছে।”

রোজ আরো কিছুক্ষন গল্প করে তারপর বিদায় নিলো সন্ধ্যার থেকে। রোদ চলে যাবার পর সন্ধ্যা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আবার ও বাহিরের দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকালো। কিন্তু বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না। রোদের কথা মনে হতেই চটজলদি ফ্রেশ হয়ে এল।

দুপুর দুইটার দিকে সবাই খাবার টেবিলে চলে আসলো। সবাই একসাথেই খাবার খায় এটাই নিয়ম এ বাড়ির। তাই সন্ধ্যাকেও নিচে আসতে বলা হয়েছে। খাবার টেবিলে সবাই উপস্থিত শুধু সন্ধ্যা ছাড়া। একটু পর সন্ধ্যায় আসল। সন্ধ্যা আকাশী রংঙের থ্রি পিচ পড়েছে। সন্ধ্যার লম্বা ভেজা চুল বেয়ে এখনো পানি ঝরছে। দেখতে অনেকটা স্নিগ্ধ লাগছে ওকে। সন্ধ্যার মুখে এমন স্নিগ্ধতা দেখে শ্রাবণ দাঁড়িয়ে রইলো টেবিলের এক পাশে।শ্রাবনের কাছে এই মুহূর্তে সবকিছু যেন থেমে রয়েছে। ও কি করছে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। শুধু ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সন্ধ্যার দিকে। শ্রাবণের এমন কাণ্ড দেখে মুচকি হেসে একটু জোরেই কাশি দিল। রোদের কাশির শব্দে ঘোর কেটে গেল শ্রাবনের। একটু হেসে পাশের চেয়ারে বসে পড়ল ও। এদিকে রোদের এমন কান্ডে রাবেয়া বেগম বললেন,

–“কি হল তোর? ওভাবে কাশি দিলি কেন?”

–“কিছু না তো মা। গলায় কি যেন আটকে গেছিল তাই জোরে কাশি দিলাম।”

কথাটা বলেই রোদ ওর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিল আর শ্রাবন ওকে চোখ রাঙিয়ে শাসালো।

রোদের কথা শুনে মিসেস রাবেয়া বেগম বললেন,

–“কি জানি বাপু তোদের কাজ-কারবার কিছুই বুঝিনা আমি।”

এমন সময় সন্ধ্যা এসে দাঁড়ালো ওদের কাছে। সন্ধ্যাকে দেখে মিসেস রাবেয়া বেগম বললেন,

–” সন্ধ্যা তুমি এসে গেছো। দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো।”

সন্ধ্যা দেখল শ্রাবণের পাশের চেয়ার ছাড়া আর কোন চেয়ার ফাঁকা নেই। তাই অসস্তি হলেও শ্রাবণের পাশে গিয়ে বসল। এদিকে শ্রাবণেরও অসস্তি লাগছিল। সন্ধ্যা আসার পর থেকেই ওর সব এলোমেলো হয়ে গেছে। শ্রাবণ দ্রুত খাওয়া শেষ করে নিজের ঘরে চলে গেল তবে যাওয়ার আগে ওদের তৈরি হতে বলল 5 টার আগেই। সন্ধ্যার খাবার শেষ করে ওর ঘরে চলে আসলো। এতক্ষণ ওর মনে হচ্ছিল ওর দম বুঝি আটকে যাবে। এখন একটু স্বস্তি লাগছে ওর।

ঘরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিল সন্ধ্যা। বৃষ্টির দিনে এমনিতেই ঘুম পায়। তার ওপর দুপুরের খাওয়ার পর হলে তো আর কোন কথাই নেই। তবে সন্ধ্যা চোখে ঘুম নেই। ওর মন ছটফট করছে বাড়ির জন্য কিন্তু খোঁজ নেবার কোন পথ নেই ওর কাছে।

বেশ কিছুক্ষণ পর শ্রাবণ হাতের ফোন নিয়ে ওর রুম থেকে বেরিয়ে এলো। কালো রঙের শার্ট এ বেশ মানিয়েছে ও কে। ফর্সা শরীরে কালো রঙ যেন আরো বেশি ফুটে উঠেছে। কপালের ওপর কিছু চুল এসে পড়ায় আরো বেশি সুন্দর লাগছে ওকে। শ্রাবনের হাতে কালো রঙ্গের ঘড়িও রয়েছে, আর সাথে মুখে হাসি। এককথায় পারফেক্ট লাগছে ও কে। শ্রাবনকে দেখে রোদ বলে উঠলো,

–“তুমি কি আজ কোন বিয়ে বাড়িতে যাচ্ছো ভাইয়া?”

শ্রাবণ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

–“আমি বিয়ে বাড়িতে যাব কেন?”

–“এত সেজে গুজে এসেছ কেন?”

–“সাজলাম কোথায়?”

–“বাদ দাও, তাড়াতাড়ি চলো।”

শ্রাবণ একবার সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে বলল,

–“চল, তোদের তো আবার শপিং করতে অনেক সময় লাগে।”

রোদ মুখ ভেংচিয়ে বলল,

–“জানোই যখন তখন দেরী করছ কেন?”

শ্রাবণ আর কোন কথা না বলে গাড়িতে উঠে বসলো। রোদ-সন্ধ্যা দুজনেই পেছনের সিটে বসতে গেলে শ্রাবন বলে উঠলো,

–“আজব তোদের কি আমাকে ড্রাইভার বলে মনে হচ্ছে?”

–“কি অদ্ভুত কথা ।তোমাকে ড্রাইভার বলে মনে হবে কেন ভাইয়া?”

–“তাহলে দুজনে পিছনের সিটে বসছিস কেন?”

–“আমরা দুজন গল্প করতে করতে যাব তাই। তুমি তোমার মত গাড়ি চালাও।”

শ্রাবণ আর কোন কথা বলল না। চুপচাপ ড্রাইভিং এমন দিল ও। সাথে অবশ্য রোদ আর সন্ধ্যার গল্প শুনছিল। তবে একটা জিনিস খেয়াল করলো ও সন্ধ্যা খুব একটা কথা বলছে না, যা বলার রোদই সব বলছিল ,সন্ধ্যা শুধু দু-একটা প্রশ্ন উত্তর দিচ্ছিল। সন্ধ্যা সব সময় শান্ত স্বভাবের আর এখন তো আরো বেশি শান্ত হয়ে গেছে ও। শ্রাবণের কেন যে সন্ধ্যাকে এমন চুপচাপ দেখতে ভালো লাগে না। কিন্তু কেন তা জানে না ও? অদ্ভুত এক মায়া কাজ করে সন্ধ্যার ওপর ওর। এর কারণ জানা নেই শ্রাবনের।

বেশ কিছুক্ষণ পর শ্রাবনদের গাড়ি শপিংমলের সামনে এসে থামলো। রোদ আর সন্ধ্যা গাড়ি থেকে নামার পর শ্রাবণ গাড়ি পার্ক করতে গেল। গাড়ি পার্ক করে এসে রোদ ও সন্ধ্যাকে নিয়ে শপিং মলের ভেতরে চলে গেল। সন্ধ্যা এত বড় শপিংমল আগে কখনো দেখিনি তাই বিস্ময় হতবাক হয়ে চারিদিক দেখতে লাগলো।

শ্রাবণ ওদের দুজনকে প্রথমে ড্রেসের দোকান নিয়ে গেল। শ্রাবণ রোদকে বলল,

–“যা পছন্দ হয় তা নিয়ে নে আমি ওদিকে আছি।”

–“ঠিক আছে ভাইয়া।”

রোদ সন্ধ্যাকে নিয়ে একের পর এক ড্রেস দেখে চলেছে কিন্তু সন্ধ্যার এসব কিছুই পছন্দ হচ্ছে না। সন্ধ্যা সালোয়ার-কামিজ ছাড়া এসব টপস, জিন্স, টি-শার্ট পড়ে না। আবার ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলতেও পারছেনা ও। সন্ধ্যার অসস্তি শ্রাবণ দূর থেকে দেখেই বুঝতে পারল। তাই নিজেই পছন্দ করে বেশকিছু সালোয়ার-কামিজ এনে দিল সন্ধ্যার হাতে। শ্রাবনকে দেখে রোদ বলল,

–“তুমি কি করে জানলে সন্ধ্যা আপুর সালোয়ার কামিজ পছন্দ?”

–“আমি তো আর তোর মতো গাধী না তাই বুঝতে পারলাম।”

রোদ শ্রাবণের কথা শুনে মুখ ভার করে রইলো। দুই ভাই-বোনের এমন কাণ্ড দেখে সন্ধ্যাও হেসে বলল,

–“রোদ তুমি মন খারাপ করে থেকো না প্লিজ।আচ্ছা এক কাজ করো আমার একটা বোরকা লাগবে ।তুমি বরং আমার জন্য একটা বোরকা আর একটি হেজাব পছন্দ করে দাও।”

রোদ সন্ধ্যার কথা শুনে খুশি হয়ে বলল,

–“চলো আপু আমি তোমার জন্য বোরকা পছন্দ করে দিচ্ছি।”

রোদ সন্ধ্যার জন্য কালো রঙের একটি সুন্দর বোরকা পছন্দ করে দিল আর সাথে একটি হিজাব ও।নিজের জন্য কিছু সালোয়ার-কামিজ কিনল।

ড্রেস কেনার পর ওরা গেল জুতোর দোকানে। এখানেও শ্রাবন সন্ধ্যাকে জুতো পছন্দ করতে সাহায্য করল। টুকটাক সব শপিং শেষ হতে হতে প্রায় সন্ধ্যা পার হয়ে গেল। শ্রাবণ ঘড়িতে দেখল সন্ধ্যা সাতটা বাজে। শ্রাবণ বলল,

–“রোদ কফি খাবি?”

–” অবশ্যই ভাইয়া। আমাকে এখনই কফির কথা বলতে চাচ্ছিলাম।”

–“ঠিক আছে চল তবে।”

তিনজনে মিলে কফিশপে গেল। সেখানে বাধ সাধল আরেক বিপত্তি। কফিশপে ওদের সাথে নিহার দেখা হয়ে গেল। নিহার ভালো নাম মার্জিয়া খান নিহা।নিহার শ্রাবনে বাবা রশিদ সাহেবের বিজনেস পার্টনার ইমতিয়াজ খানের একমাত্র মেয়ে। ইমতিয়াজ খানের একমাত্র মেয়ে হওয়ার দরুন নিহা একটু বেপয়াড়া ধরনের। অনেক জেদি আর উশৃংখল। নিহার এই উশৃংখল স্বভাবের জন্য ওকে শ্রাবণ আর রোদ সহ্য করতে পারে না ওকে। তবুও বাবার বিসনেস পার্টনারের মেয়ে হিসেবে কথা বলতে হয়। অগত্যা অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিহাকে নিয়ে শ্রাবণ চলে গেল কফিশপের দিকে।

চলবে

(কেমন হয়েছে জানাবেন আর ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।যারা নীরব পাঠক আছেন তারা দয়া করে সাড়া দেবেন। আপনাদের সাড়া পেলে লেখার আগ্রহ বেড়ে যায়।আর “শ্রাবনসন্ধ্যা” গল্প নিয়ে আপনাদের কোন অভিযোগ থাকলে কমেন্ট এ জানাবেন। ভালো থাকবেন সবাই।হ্যাপি রিডিং ??)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here