শেষ বিকেলের প্রণয় পর্ব ১২

0
666
Made with LogoLicious Add Your Logo App

#শেষ_বিকেলের_প্রণয়
#আলো_ইসলাম
১২

– গিটার দেখে আসিফের ভ্রু কুচকে আসে। স্বাভাবিক চেহারাটা অস্বাভাবিকে পরিণত হয় একটু।
– এটা তো তাশরিফের গিটার, এখানে কেনো? কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করে আসিফ।

— তাশরিফ গান করবে তাই নিয়ে আসা এখানে। মমতা খানের সরল জবাব।
– তাশরিফ গান করে আবার? উত্তেজিত কন্ঠে বলে ফেলে আসিফ। ছুটি ভ্রু কুচকে বলে আবার মানে? আসিফ দমে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে বলে না মানে, ও তো গান ছেড়ে দিয়েছে তাই বললাম।

– হ্যাঁ, তাশরিফ আর গান করে না৷ ইনফ্যাক্ট এই গিটারও আর ছুঁয়ে দেখেনি। আজ অনেক দিন পর গিটারটা নিয়ে আসলাম যদি আজ অন্তত বলে তাই। মা এর ইচ্ছেতে গিটার নিয়ে আসা,আবির বলে।
ওহ! ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে আসিফ। তা তাশরিফ কে দেখছি না যে, ও কি বাসায় নেই?

– দুপুরে বেরিয়েছে কি কাজ আছে বলে। এখনো ফিরেনি৷ আমরা তো ওরই অপেক্ষা করছিলাম। তোমার কি খবর আসিফ৷ বেশ নাম ডাক করেছো কয় বছরে। আমার তাশরিফ টা যদি আজ এই জগতে থাকতো তাহলে ও অনেক ভালোবাসা পেতো মানুষের কিন্তু এখন! ওর জন্য শুধু ঘৃণা আছে মানুষের মনে। মমতা খান ভেঙে পড়েন কথাটা বলে।

— মন খারাপ করবেন না আন্টি সব ঠিক হয়ে যাবে। কেনো যে তাশরিফ এই কাজ করতে গেলো। ও তো ইলহামকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো তাহলে কেনো ওকে খু’ন করতে গেলো এটাই বুঝলাম না। আফসোস নিয়ে বলে আসিফ।

– আপনি শিওর যে, খু”ন টা তাশরিফ ভাইয়ায় করেছে? ছুটি বলে গম্ভীর কণ্ঠে। হকচকিয়ে উঠে আসিফ।
– না মানে, সবাই তো সেটাই জানে৷ আমি এর বাইরে কি আছে কিভাবে বলবো বলো! বাই দ্যা ওয়ে তুমি তো ছুটি তাই না? কথা ঘুরিয়ে বলে আসিফ৷.

– আমাকে চিনতে কষ্ট হচ্ছে বুঝি আপনার? কেন জানি আসিফকে ভালো লাগছে না ছুটির।

– আরে না না কি যে বলো। কত এসেছি আমি এখানে। তুমি তো সব সময় এখানেই থাকতে। আমরা একসাথে আড্ডাও দিয়েছি কত সব মনে আছে। এই বছর তিন ব্যস্তর জন্য আর আসা হয়ে উঠে না৷ প্রায় সময় দেশের বাইরে থাকি কি-না। লং টাইম পর দেশে আসলাম তাই ভাবলাম আন্টির সাথে আই মিন সবার সাথে দেখা করে আসি। তাশরিফের সাথেও কথা হয়না আর। হাসার চেষ্টা করে বলে আসিফ।
* এর মধ্যে নাস্তা নিয়ে আসে একজন। রোহান গিয়ে ছুটির পাশে দাঁড়ায়।

– আমার না কেনো জানি সন্দেহ হচ্ছে ভদ্রলোককে। কথাবার্তায় একটা সন্দেহের গন্ধ পাচ্ছি! রোহান বলে ফিসফিসিয়ে।
– হুম আমারও তাই মনে হচ্ছে। ছুটির কথায় রোহান প্রফুল্ল কন্ঠে বলে ওয়াও আমাদের কি মিল। আমরা একই চিন্তাধারায় আছি তাই না। ছুটি একটা ভ্রু উঁচিয়ে গম্ভীর লুক রাখলে রোহান চুপসে যায়।

– আচ্ছা উনাকে তো চিনলাম। আগে কখনো দেখিনি তো এখানে? আসিফ বলে ছায়াকে উদ্দেশ্য করে।

– আমার বোন ছায়া। ছুটি বলে সোজাসাপ্টা।

– ও আচ্ছা! এরপর রোহানের দিকে তাকিয়ে বলে তুমি রোহান তাই না?
– আপনি আমাকে চেনেন? অবাক হয়ে বলে রোহান।

– চিনবো না কেনো! তাশরিফের থেকে তোমার কথা শুনেছি অনেক। তোমার ছবিও দেখেছি। তাই চিনতে অসুবিধা হয়নি। তুমি যে রিসেন্টলি এডভোকেট হয়েছো এটাও জানি।

– আই সি! তার মানে আপনি আমার উপর পুরো স্টাডি করে এসেছেন। রোহানের কথায় আসিফ থতমত খেয়ে যায়৷ চা পান করছিলো সে সময় গলায় আটকে যায়।
– আস্তে সেলিব্রিটি সাহেব। দেখেশুনে পান করুন। ছুটির হেয়ালি কথা।

-এই আপু উনাকে বল না আমাকে একটা অটোগ্রাফ দিতে, ছায়া বলে। আবির তো নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।
– কেনো হ্যাংলামি করছিস ছায়া। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক। ছায়ার মুখটা মলিন হয়ে যায় ছুটির বকা খেয়ে।

– তুমি কি কিছু বলবে ছায়া? আসিফের কথায় ছোট ছোট চোখ করে তাকায় ছায়া। এরপর ছুটির দিকে তাকিয়ে চুপ মেরে থাকে।

— তোমার মা কেমন আছেন আসিফ? মমতা খানের কথায় আসিফ মুচকি হেসে বলে জ্বি আন্টি ভালো। আচ্ছা তাশরিফ কখন আসতে পারে?

– তা তো জানি না৷ ফোনও বন্ধ বলছে ওর। ছেলেটা আমার আর স্বাভাবিক নেই। যে হাসিখুশি, প্রানবন্ত ভাব ছিলো এখন সেটা নেই আর। আমার ছেলেটা আর আমার নেই। মমতা খান চোখ মুছতে মুছতে বলে।
মন খারাপ করবেন না আন্টি। কি বলবো বুঝতে পারছি না সত্যি। হঠাৎ এমন হয়ে যাবে সত্যি ভাবিনি৷ ব্রাইট একটা লাইফ ছিলো তাশরিফের। কেনো এমন করতে গেলো ও। তাছাড়া ইলহামও অনেক ভালো মেয়ে ছিলো। যেমন সুন্দরী তেমন ভালো ব্যবহার। আমি তো প্রথম দেখায় তার ফ্যান হয়ে গিয়েছিলাম। মেয়েটার এমন মৃ/ত্যু হবে সত্যি ভাবিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলে আসিফ। ছুটি আর রোহান শুধু শুনছে আসিফের কথাগুলো।

– তিন বছর আগে…..

– তাশরিফের ছোট থেকে স্বপ্ন ছিলো বড় গায়ক হওয়া। সময়ের ব্যবধানে সেটা বাস্তবায়ন হয়। একটা অনুষ্ঠানে অডিশন দিয়ে প্রথম স্থান দখল করে নেয় তাশরিফ আর সেকেন্ড পজিশনে থাকে আসিফ। আসিফ আর তাশরিফ কলেজ থেকে ভালো বন্ধু। তাশরিফ যেমন ভালো গান করে তেমন আসিফও। কিন্তু আসিফের তুলনায় তাশরিফের গানে স্কিল ছিলো অনেক ভালো। এরপর থেকে ভিন্ন স্টুডিও থেকে ডাক আসে তাশরিফের। দেশ বিদেশে গান গাওয়ার সুযোগ পাই। খুব অল্প সময়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠে তাশরিফ। তখন আসিফও গান নিয়ে ব্যস্ত থাকে৷ তবে সবার কাছে আগে তাশরিফ প্রায়োরিটি পেতো। তাশরিফের সিডিউল না পেলে এরপর আসিফকে ডাকা হতো। তাশরিফের ছোট থেকে এতিমখানায় যাওয়া অভ্যাস। এতিমখানার বাচ্চাদের অনেক ভালোবাসে সে। তাই প্রতি বছরের মতো সে বছরও তাশরিফ তার জন্মদিনে একটা এতিমখানায় যায়। গান করে, খাওয়া দাওয়া, বাচ্চাদের সাথে পুরো দিন কাটায় প্রতিবার তার জন্মদিনে।

— তাশরিফের ২৭ তম জন্মদিন ছিলো সে বার। তাশরিফ সে দিনটা এতিম বাচ্চাদের সাথে ভাগ করে নেওয়ার জন্য একটা এতিমখানায় যায় সবাইকে নিয়ে। সেখানে গিয়ে দেখা মিলে ইলহামের। ইলহামের খালা ওই এতিমখানায় থাকে বাচ্চাদের দেখাশোনা সাথে রান্নার কাজটা তিনি করেন। ইলহামও সাহায্য করে তাকে। ইলহামের একটা ভাই আছে নাম ইমরান। ইলহামের বাবা-মা অনেক আগেই মা’রা গেছেন। ইলহামের বাবা ছিলেন ট্যাংক চালক। একটা এক্সিডেন্ট তিনি মা;রা যান ইমরান জন্ম নেওয়ার এক বছরের মাথায়। এরপর ইলহামের মা দুই ছেলে-মেয়েকে মানুষ করে। ইমরানের যখন বয়স ৮ তখন ইলহামের মাও মারা যান ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে। সঠিক সময়ে চিকিৎসার অভাবে হারিয়ে যান তিনি। এরপর থেকে ইলহাম তার ভাইকে নিয়ে খালার সাথে থাকে। খালার যেহেতু কোনো ছেলে মেয়ে নাই তাই দুজনকে নিজের সন্তানের মতো স্নেহ ভালোবাসায় রাখে।

— তাশরিফ প্রথম যখন ইলহাম কে দেখে এতিমখানায় তখনই ভালো লেগে যায়। যাকে বলে “প্রথম দেখায় প্রেম”। ইলহাম দেখতে সুন্দরী আর লাজুক ছিলো ভীষণ। চেহারায় গভীর মায়া। যে মায়ায় তাশরিফ আবদ্ধ হয়ে যায়। ইলহামও তাশরিফের একজন ভক্ত ছিলো। তাই তাশরিফকে সামনে থেকে দেখতে পেয়ে অনেক খুশি হয়েছিলো সেদিন। কিন্তু ওই মানুষটাই যে তার জীবন সঙ্গি হয়ে যাবে এক সময় কল্পনাও করেনি।
– এরপর আস্তে আস্তে তাদের কথাবার্তা, দেখা সাক্ষাৎ হতে থাকে। তাশরিফ প্রায় সময় ওই এতিমখানায় যায় বাচ্চাদের জন্য চকলেট খাবার নিয়ে ইলহামকে দেখার জন্য। এক পর্যায়ে দুজনের প্রেমের সম্পর্ক হয়। যদিও প্রথমে ইলহাম আগাইনি। তাশরিফ এত বড় গায়ক তার মতো সামান্য একটা মেয়েকে ভালোবাসতে পারে ভেবে অবাক হয়েছিলো। ভেবেছিলো ক্ষণিকের আবেগ। কিন্তু তাশরিফের সত্যিকারের ভালোবাসার কাছে হার মানে ইলহাম। তাশরিফ একদিন ইলহাম কে তার বাড়িতে নিয়ে যায় হুট করে। এরপর সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। সেদিন ছুটিও উপস্থিত ছিলো সেখানে। মমতা খানও প্রথমে খুশি হতে পারেননি। কারণ তিনি মনে মনে তো ছুটিকে ঠিক করে রেখেছিলেন। কিন্তু তাশরিফ যে আরেকজন কে ভালোবাসবে ভাবেনি। মমতা খান একবার ভেবেছিলো ছুটির কথা তাশরিফকে বলবে। কিন্তু ছুটি যখন নিজ ইচ্ছেতে সরে যায় মমতা খান তখন নিজেকেও মানিয়ে নেয়। ছেলের আনন্দ খুশিতে তিনিও সামিল দেন।

— রাতে খাবার টা আজ এখানেই খেয়ে যাবে তুমি আসিফ। মমতা খানের কথায় আসিফ বলে না আন্টি আমাকে যেতে হবে। এখানে থেকে বেরিয়ে একটা জায়গায় যেতে হবে আবার। তাশরিফের সাথে তো দেখা হলো আবার নাহয় আসবো, সেদিন খেয়ে যাবো, তাশরিফ আসলে বলবেন আমার কথা। আসিফ উঠে দাঁড়ায় কথাগুলো বলে।

– এরপর আসিফ একটা ছোট নোটপ্যাড বের করে তাতে কিছু একটা লিখে ছায়ার দিকে বাড়িয়ে দেয়। ছায়া তো পুরাই শকড। আসিফ নিজ ইচ্ছেতে তাকে অটোগ্রাফ দিচ্ছে৷ হাসি মুখে নিয়ে নেয় ছায়া সেটা৷

— ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার গান গুলো অনেক ভালো লাগে আমার । ছায়া বলে মুখে চওড়া হাসি রেখে।
– তাহলে একদিন গানের আসর বসানো যাক কি বলো? আসিফের কথায় ছায়া অতি আবেগী কন্ঠে বলে সত্যি?

– ছায়া! ছুটির ধমকে দমে যায় ছায়া। আবিরও রেগে যায় এবার।

* বাড়াবাড়ির একটা সীমা আছে ছায়া! আবিরের কথায় আসিফ বলে ওকে বকছো কেনো। আমি সত্যি তোমাদের নিয়ে একদিন গান বলতে চাই যদি তোমরা চাও তো।
– সে পরে দেখা যাবে। তোমার মুল্যবান সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। আবির বলে।

তুই এখানে? তাশরিফ উপস্থিত হয় এর মধ্যে।

– তুই চলে এসেছিস। ভালোই হলো তোর সাথে দেখাটা হয়ে। তোর ফোন অফ পাচ্ছি তিনদিন ধরে তাই বাড়িতে চলে আসলাম দেখা করতে। মনে হচ্ছে খুব ব্যস্ত সময় যাচ্ছে তোর?

— তাশরিফের চোখ যায় গিটারে।
* এটা এখানে কেনো? উত্তেজিত কন্ঠে বলে তাশরিফ।
– শুনলাম তুই নাকি আবার গান করবি৷ কথাটা শুনে অনেক ভালো লাগলো। আন্টি তো সে আশায় তোর গিটার টা নিয়ে এসেছে। তাই না আন্টি। আসিফ বলে হেয়ালি নিয়ে।

– এই গিটার কে আনতে বলেছে তোমাদের। আমি গান করবো এটা কে বলেছে তোমাদের? দুদিন ভালো ব্যবহার করছি ভালো ভাবে কথা বলছি মানে এই নয় আমি আমার অস্বাভাবিক জীবন থেকে সরে এসেছি। আমি যেমন ছিলাম তেমনই আছি। কেনো আমাকে বিরক্ত করছো তোমরা। কেনো ভালো থাকতে দিচ্ছো না আমার মতো করে। চিৎকার করে বলে তাশরিফ। মমতা খানের চোখ ভরে আসে। ছুটি ছায়া তটস্থ হয়ে যায় তাশরিফ কে দেখে। সেই পুরনো তাশরিফকে দেখছে সবাই।

— শান্ত হো তাশরিফ। এত উত্তেজিত হলে হবে। আন্টি তোর গান মিস করে তাই একটা আবদার করে ফেলেছে৷ এতে রাগ করার কিছু নাই৷ তোর সাথে কথা আছে আমার, আমরা তোর ঘরে গিয়ে বসি?

– অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাশরিফ ঘরে যায় আসিফকে নিয়ে।

– ব্রো এমন রেগে গেলো কেনো হঠাৎ? রোহান বলে মলিন কন্ঠে।
– আমিও কিছু বুঝলাম না,আবির বলে।
– রানীমা কান্না করো না প্লিজ৷ জানো তো ভাইয়া কেমন। ছুটি বলে মমতা খান কে শান্ত করে।

— তোর বাড়িতে এমন একটা ফুল আছে আগে বলিস নি তো? আসিফের কথায় ভ্রু কুচকে বলে ফুল?

– ছায়া! সদ্য ফুটন্ত একটা গোলাপ। আসিফের কথাটা বলতে দেরি তাশরিফের কলার ধরতে দেরি হয়না আসিফের।

চলবে..
❌কপি করা নিষেধ ❌ভুলক্রুটি মাফ করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here