#শিশির_বিন্দু❤️
লামিয়া সুলতানা সিলভী ( লেখনীতে)
পর্বঃ২৩ ( অন্তিম পর্ব)
বিয়ে বাড়ি মানেই ধুমধাম তাও যদি দুটো বিয়ে একসাথে হয় তাহলে তো কথাই নেই! চারোদিকে হৈ চৈ এ বাড়ি মুখোরিত থাকে,, লোকজনের আনাগোনা, শোরগোল, গান-বাজনা সবকিছুই উপভোগ করার মতো! বিয়ে বাড়িতে সবার খুশীর বন্যা বয়ে যায়! কিন্তু বিয়ের কনে কি আদৌ খুশী হতে পারে? নাহ,, পারে না এর কারণ হতে পারে দুই রকম! প্রথমত কনের মনে যদি অন্য কারোর বসবাস থাকে তাহলে তো বিয়েটা বিরক্তি ছাড়া কিছু না,, আর দ্বিতীয়ত হতে পারে কনের মনের ভয়-ভীতি কারণ বিয়ের দিন তাকে চুপচাপ বসে থাকতে হয় হাজারো মানুষের ভীরে, ভয়-ভীতি কাজ করবেই মনের ভেতর! ছোট থেকে বেড়ে ওঠা পরিবারকে ছেড়ে যেতে হয় অন্য এক পরিবারে,, সেখানে নিজেকে মানিয়ে নিতে অনেকটা সময় লাগে! যদি স্বামী, শ্বশুর বাড়ির লোক ভালো হয় তাহলে হয়তো তাড়াতাড়ি নিজেকে মানিয়ে নেওয়া যায়, সবাইকে আপন করা যায়! কিন্তু যদি তারা ভালো না হয় তাহলে সারাজীবও আপন করা যায় না!
ইন্দুরও ঠিক তাই, ও বিয়ের পীড়িতে বসতে চলেছে ঠিকই কিন্তু তার মনে তো অন্য কারোর বসবাস! রুহানকে কি সে আপন করতে পারবে? রুহান ইন্দু-রোদের কথা হয়তো জানে কিন্তু এটা কি জানে, ইন্দু কতটা রোদকে ভালোবাসে? একটু পরেই ইন্দুর আর রুহানের বিয়ে,, রুহানের পরিবার থেকে শুধু রুহান, ওর মা, ওর একটা মামা, আর একটা চাচা এসেছে! এরা ব্যাতিত রুহানের পাশে দাঁড়ানোর মতো আর কেও নেই! ইন্দু বউ সেজে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে ওর রুমে,, আর ড্রয়িংরুমে রুহানের পরিবার সাথে ওর পরিবার আর শিশিরের পরিবার! ইন্দুর কাছেও অনেকেই বসে আছে, অনেক গল্প করছে, মজা করছে কিন্তু এতে ওর কোন মন নেই! ওর মনতো পড়ে আছে রোদের কাছে! আচ্ছা রোদ যদি জানতে পারে ওর ইন্দুরানী ওকে রেখে অন্য কারোর হয়ে যাচ্ছে সারা জীবনের মতো, তাহলে কি মেনে নিতে পারবে? ইন্দুর নিজেকে খুব অপরাধী লাগছে,, কিন্তু কি করবে সে? সে যে নিরুপায়!
বেশ কয়েকমাস আগে, ইন্দু সেদিন ভার্সিটি তে গিয়েছিলো ঐদিনের পরে থেকে ওর আর রোদের সম্পর্ক উলটো-পালোট হয়ে যায়! ইন্দু ক্লাস শেষে ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে আসার সময় মধ্যবয়স্ক একটা লোককে দেখতে পায়! অচেনা কেও ভেবে লোকটিকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে লাগলেই লোকটি ইন্দুকে ডেকে ওঠে আর সে তার পরিচয় দেয় সে হচ্ছে রোদের মামা! তার মেয়ে তিথির সাথেই রোদের বিয়ে ছোটবেলা থেকে ঠিক করে রেখেছে,, হুট করে ইন্দু রোদের জীবনে চলে আসায় রোদকে কোন মতেই রাজি করানো যাচ্ছে না, তার মেয়ের জামাই বানানোর জন্য! রোদের মা ও চায় তার মেয়েকেই ছোট ছেলের বউ বানাতে,, কিন্তু ইন্দু কেনো যায় ওদের মাঝে? ইন্দুকে অনেক শাসায় রোদের জীবন থেকে সরে যাওয়ার জন্য,, কিন্তু ইন্দু সাফসাফ জানিয়ে দেয় পৃথিবী উলটে গেলেও ও রোদকে ছাড়বে না! তখন সে ইন্দুকে ভয় দেখায়, সাথে এটাও বলে রোদকে মেরে ফেলবে! যদি ইন্দু রোদের জীবন থেকে চলে না যায়,, আর এগুলো কোন কথা যদি কাওকে জানায় তাহলে ওদের দুইজনেই ক্ষতি করে দিবে! কিন্তু ইন্দু প্রথমে এসব পাত্তা দেয় না,, আস্তে আস্তে সেই মামা সব কিছু বাস্তবেও পরিণত করতে থাকে আর তার যতার্থ প্রমাণও দেখায় ইন্দুকে! বেশ কিছুদিন হলো ইন্দুকেও যেমন গুন্ডারা ডিস্টার্ব করে,, তেমনি রোদকেও ওরা ঘিরে থাকে! প্রতি পদে পদে বিপদে ফালায় আর তা সব কিছু ইন্দুকে ভিডিও করে দেখায়! যেমন রোদের অফিসে ছন্দবেশে গিয়ে ওকে চোর বানিয়ে অফিস থেকে বের করে দেয়, অফিস থাকাকালীন সময়ে খাবারে বিষ দিতে চায়! আরো অনেক প্রমাণ দেখায়,, কিন্তু এতেও যখন ইন্দু দমে যায়নি শেষ মূহুর্তে রোদকে কিডন্যাপ করে ২ দিন আটকে রাখে,, আর যেদিন শুট করে মেরে ফেলবে তার ঠিক কিছুক্ষণ আগে ইন্দু ওদের অনুরোধ করে,, রোদের জীবন থেকে একেবারে চলে যাবে তাও যেনো ওর কোন ক্ষতি না করে ছেড়ে দেয়! তারপর ইন্দু ওকে সব জায়গা থেকে আবার ব্লক করে রাখে, যেনো রোদের সাথে কন্টাক্ট না হয়! ইন্দুর ফোন গুন্ডারা হ্যাক করে নেয় সাথে ওকেও ফলো করতে থাকে অনেকদিন! আস্তে আস্তে যখন দেখতে পায় সত্যি ইন্দু আর রোদের সাথে কন্টাক্ট রাখেনি তখন ওরাই পিছু ছেড়ে দেয়! আর রোদের মামাই ইন্দুকে বলে রুহানের সাথে বিয়েতে হ্যা বলতে! কারণ ইন্দুর এ টু জেট ইনফরমেশন মামার কাছে ছিলো! তাই রোদকে বাঁচাতেই ইন্দুর এতো অবহেলা!
ইন্দু এসব ভাবতে ভাবতে চোখ দুটো পানিতে ভরে ওঠে,, আজকের পর থেকে আর কখনো রোদকে নিজের বলে মনে হবে না! সে তখন অন্যকারোর সহধর্মিণী হয়ে যাবে,, আর রোদের কাছে চিরদিনের জন্য প্রতারক হয়ে ওঠবে ভাবতেই ওর বুক ফেটে কান্না চলে আসে! ওর এসব ভাবনার মাঝেই বিন্দু ওর রুমে চলে আসে!
বিন্দুঃ ইন্দু তুই ঠিক আছিস তো?
এই কথা বলতেই ইন্দু ওর বোনকে জরিয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে,, বিন্দুর বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে! ইন্দুর ঘরে উপস্থিত থাকা লোকজন ওদের দিকে তাকিয়ে আছে,, কান্নার আওয়াজ বাহির পর্যন্ত যায় না কারণ সেখানে মিউজিক বক্স বাজছে! কেও কেও জানে ইন্দুর এই আত্ননাদের কারণ আবার কেও কেও ভাবে বিয়ের দিনতো মেয়েরা এমনিতেই কাঁদে তাই হয়তো ইন্দু এভাবে কান্না করছে! বিন্দু ওকে শান্ত করার চেষ্ঠা করছে! বিন্দু তৃষাকে ডেকে বলে ইশাকে বাহিরে নিয়ে যেতে বঅলে,, ও একটু পর যাবে জানায়! বিন্দু মূলত ইশাকেই নিয়ে যেতে এই রুমে এসেছিলো কিন্তু এখানে ইন্দুকে এভাবে দেখে সবাই কে বের করে ইন্দুর কাছে বসে! ইন্দুকে জরিয়ে ধরে নিজেও চোখের পানি ফেলছে বোনের কান্নায়!
বিন্দুঃ ইন্দু, সোনা বোন আমার প্লিজ কাঁদিস না আর (কপালে চুমু দিয়ে)! আমার যে খুব কষ্ট হচ্ছে,, তোকে নিজ হাতে মানুষ করেছি, তোর কান্না সহ্য হচ্ছে না! জানিস, যেদিন শুনেছিলাম আমার একটা পুতুল বোন হবে সেদিন সারাবাড়ি মাথায় তুলেছিলাম! পুরো বাড়ি চর্কির মতো পাক খাচ্ছিলাম আর আমার পরী বোন হবে বলে বলে ঘুরেছিলাম,, আমার কান্ড দেখ আব্বু-আম্মুও সেদিন অনেক হেসেছিলো! তারপর যখন তোকে হসপিটালে প্রথম দেখতে পাই নার্সের হাতে ছোট একটা বেবী আমি দৌড়ে যাই তোকে কোলে নিতে, আর কাওকে দিবো না! আমি কোলে নিতে পারলেও কেও আমার কোলে দেওয়ার সাহস পায়নি,, তাও জাপ্টে জরিয়ে ধরেছিলাম! সেদিন কাওকে কোলে নিতে দেই নি এমনি কি খাবারও আমার কোলে বসিয়েই নানী খাইয়েছিলো তোকে! তারপর থেকে একটু একটু করে বড় করেছি তোকে আমি আর আম্মু মিলে! তোর চোখে কখনো পানি আসতে দেইনি,, আমি কিছু কেনার আগে তোর জন্য কিনতাম আর আজ তোর চোখে পানি যে আমাকে আরো বিষিতে তুলছে! তুই রোদের জন্য কষ্ট পেতি আমি কি পেতাম না? আমিও সবার আড়ালে তোদের জন্য কাঁদতাম,, কিন্তু আমার শ্বাশুড়ি কে তো চিনিসই আমি কি করে পারি আমার পরী বোনটাকে এই খাদে ফেলে দিতে? রোদের ওপর পুরো ভরসা আছে আমার কিন্তু মানুষের মন পাল্টাতে কতক্ষন? এই দেখনা আমার জীবন কি হয়ে গেলো,, কখনো কি ভেবেছিলাম আমার দুই টা বিয়ে হবে? তোর রুদ্র জিজু মারা যাবে? ভাগ্যে কি হয় কেও বলতে পারে না! রোদও আমার কাছে এসে অনেক কেঁদেছে সেদিন,, একটা ছেলে তখনই কাঁদে যখন তার খুব কাছের জনের কাছে আঘাতপ্রাপ্ত হয় বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়! সে যেই হোক না কেন, হতে পারে মা-বাবা, বউ-সন্তান, গার্লফ্রেন্ড বা অন্যকেও!
ইন্দুঃ ( থামিয়ে দিয়ে) আপু, রোদ আমাকে সারাজীবনের মতো ভুল বুঝবে! আমি এই প্রতারকের নাম নিয়ে সারাজীবন থাকবো কিভাবে?
বিন্দুঃ তুই কি আমাদের জন্যই রোদকে অবহেলা করছিস? (চোখের পানি মুছে দিয়ে)
ইন্দুঃ নাহ!
বিন্দুঃ তাহলে?( ইন্দুর নাকের নথ ঠিক করে)
তারপর ইন্দু ওকে সবটা বলে,, কারণ সে জানে রোদ একবার জন্য হলেও বিন্দুর কাছে ইন্দুর খোজ নিতে আসবে! তখন যেনো সবটা জানতে পারে রোদ,, ও প্রতারকর হিসেবে বাঁচতে চায় না! এতোদিন কাওকে বলেনি রোদের জন্যই কিন্তু আজকের পরে রোদ জানলেও ইন্দুকে আর কখনো পাবে না আর সাথে ওর জীবন সেফও থাকবে!
আজকে ইন্দুর বিয়ের সাথে ইশারও এংগেজমেন্ট! তাই দুই ফ্যামিলির লোক সব একসাথে জরো হয়েছে! তৃষা ইশাকে নিয়ে তিয়াশের পাশে বসায়! দুজনকে বেশ মানিয়েছে,, আজকে তিয়াশের আনন্দ কাওকে ভাগ দিবে না ও! তার প্রিয়তমাকে পাওয়ার একটা ধাপ তো অতিক্রম করলো বাকিগুলোও আস্তে আস্তে করবে! ইশা এবার ভার্সিটিতে ফার্স্ট ইয়ারে ওঠেছে আর তিয়াশ থার্ড ইয়ারে! ইশার উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট খুব ভালো হয়, তাই সে তার ইচ্ছানুযায়ী ইউএস (US) যেয়ে পড়তে চেয়েছিলো,, যা শুনে তিয়াশ মাথায় রক্ত ওঠে যায়! ও কিনা ইশাকে এক সেকেন্ডও আড়াল করতে দিতে চায় না আর সেই ইশা কিনা ওর কাছে থেকে চলে যাবে এক ভীনদেশে! তিয়াশ এটা শোনার পর রেগে গিয়ে নিষেধ করে! ইশা যখন বলে, “আমি কোথায় যাবো না যা সেটা তুমি বলার কে! এই রকম বাধা দিলে আমি তোমার সাথে আর কখনোই কন্টাক্ট রাখবো না!” সেদিন তিয়াশ নিজেকে কনট্রোল করতে পারে না,, ওর রুমের সবকিছু ভেঙে ফেলে আর কাচের জন্য ওর হাত-পা ও কিছু কিছু জায়গায় কেটে যায়! সাদা ফ্লোরে রক্তের ফোটা পড়ে অনেক জায়গায়,, কিন্তু ওর এদিকে কোন খেয়াল নেই! চোখ লাল হয়ে যায় দেখে মনে হবে রক্ত জোমে গেছে,, তিয়াশকে পুরো হিংস্র বাঘ লাগে! তিয়াশের মা ছুটে আসে শব্দ শুনে তারপর এসে ছেলের এই রকম অবস্থা দেখে সেন্সলেজ হয়ে যায়, তিয়াশই ওর মায়ের জ্ঞান ফেরায়! সেদিন তিয়াশের বাবা আশরাফ আহমেদ গ্রামে যায় তার কোন একটা কাজে, নাইলে ছেলেকে সেদিন সাইজ করে দিতো,, সে যত ভালো তত খারাপ! তিয়াশকে ওর মা জোর করে পাশের ক্লিনিকে নিয়ে যায় ড্রেসিং করাতে,, তার দুইদিন পর তিয়াশ ঠিক হলে ওকে জিজ্ঞেস করে এই রকম করার কারণ কি? ও কিছুতেই বলে না,, তাই বিন্দুকে দিয়ে ওর মা শোনায় তিয়াশের কি হয়েছে? আর তখনই বিন্দু জানতে পেরে তার শ্বাশুড়ি কে বলে, তার ছেলে ইশাকে ভালোবাসে, আর তাকে তিন মাসের মধ্যেই বিয়ে করতে চায়,, এটা শুনে সবাই অবাক! তিয়াশকে সবাই হাজার বুঝিয়েও কোন কাজ হয় না,, যে তৃষাকে রেখে ওরা ইশাকে কিভাবে দিবে! কিন্তু তিয়াশ মানতে নারায তাই অগত্যা শিশির গিয়ে ওর চাচাকে প্রস্তাব দেয়! ওর চাচা প্রথমে না করে দেয়,, পরে শিশির আর আশরাফ আহমেদের অনুরোধে রাজি হয়েছে তবে এখন এংগেজমেন্ট করিয়ে রাখবে,, তিয়াশের পড়া শেষ হলে তখন বিয়ে হবে! অবশেষে তিয়াশের জেদের কাছে সবাই হার মেনে তিয়াশ আর ইশার এংগেজমেন্টে আয়োজন করে!
এখানে ওরা ফ্যামিলি ছাড়া বাহিরের কোন এক্সট্রা লোক নেই,, জানাবেও না তন্দ্রাবতি! রোদ কোথা থেকে জেনে যাবে কে জানে! তাই বিয়ে ধুমধাম করে না দিয়ে হালকে ভাবেই অনুষ্ঠান করে শুধু বিয়ের ছোট অনুষ্ঠান দিবে,, হলুদের অনুষ্ঠানও করবে না!
সবাই অনেক খুশী থাকলেও তিনজন কিছুতেই থাকতে পারছে না, তিয়াশ-ইশা আর রুহান- ইন্দু কে দেখে! আর তারা হলো রুশা, নিশান্ত আর নীরা! যদিও নিশান্তের এতোদিন কিছু মনে হয়নি কিন্তু আজকে ইশার এংগেজমেন্ট দেখে কেমন যেনো লাগছে! আর রুশা তো প্রথম থেকেই তিয়াশের ওপর ক্রাশড ছিলো! এদিকে নীরাও তাই, রুহানকে অন্য জনের পাশে দেখতে ওর একটুও ভালো লাগছে না! সে তার প্রাণের প্রিয় ভাই নীলকে বলেছিলো,, কিন্তু নীল ওকে বুঝায় রুহানের বিয়ে ঠিক হয়েছে নাহলে যেভাবেই হোক ওর এই আবদারও নীল পূরণ করতো! বাবা মারা যাবার পর থেকে এই ভাইয়ের মাধ্যমেই সে বাবার আবদারগুলো পূরণ করে, ভেবেছিলো ভাই হয়তো এটাও করবে! কিন্তু বাস্তব তো বাস্তবই তাই নিজের খুশীকে মাটি চাপা দিয়ে তার পছন্দের মানুষটি কে অন্য কারোর হতে দেখতে এসেছে! যদিও আসার কোন ইচ্ছে ছিলো না কিন্তু ওর মামাতো বোন ইশার এংগেজমেন্ট তাই না চাইতেও চলে আসে এখানে!
____________________
সন্ধার দিকে ইশা আর তিয়াশের এংগেজমেন্টের অনুষ্ঠান শেষ হয় খুব ভালোভাবে! আজকে সবচেয়ে বেশি খুশী হয় অজান্তা,, বান্ধুবির এতো বড় একটা খুশীর দিন! ওকে দেখে মনে হচ্ছে ইশার চেয়ে ও ই বেশি খুশী,, বান্ধুবি বিয়ে বলে কথা! এংগেজমেন্টের পরে সবাই মিষ্ট মুখ করে!
রুহান আজকে ইন্দুকে দেখে পুরো বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে,, একটা মেয়ে এতো সুন্দর কিভাবে হয়? লাল বেনারসিতে পুরো লাল পরী লাগছে ইন্দুকে রুহানের কাছে! এই পরীটাই আর কিছুক্ষন পরে ওর নিজের পরী হয়ে যাবে! কিন্তু ভাগ্য কি সব সময় সবার সহায় হয়? আমরা তা ভাবি ওপর ওয়ালা তা নাও ভাবতে পারে,, ভাগ্যের চাকা তো একমাত্র আল্লাহ তায়ালার হাতেই! তাই হয়তো রুহানের ইচ্ছেটা আজ পূরণ হলো না,, লাল পরীটা তার দখলে আসলো না!
হঠাৎ করেই কলিং বেলের শব্দ বাজে,, সবাই আবারো খুশী হয় একটা আনন্দ যেতেই আরেকটা আনন্দ এসেছে! কাজি এসেছে ইন্দু আর রুহানের বিয়ে পড়াতে,, তাই শিশির গিয়ে নিজে মেইন ডোর খুলে দিলো! ড্রয়িং রুমের সাথেই মেইন ডোর ছিলো! কিন্তু সেখানে কাজির পরিবর্তে তিনজন দাড়িয়ে আছে,, তবে এরা কারা শিশির চেনেনা! শিশির না চিনলেও চেনে চেনা লাগছে হয়তো কোথাও দেখেছে! শিশিরের মনে পড়তেই রুদ্রা দৌড়ে এসে চাচ্চু চাচ্চু করে রোদের কোলে ওঠলো,, রুদ্রা যেনো এই সময়টারই অপেক্ষা করছিলো! উপস্থিত সবাই অবাক হলো রোদ আর তার বাবা-মা কে দেখে,, তাদের মাথায় আসলো না রোদকে এই খবর কে দিয়েছে? ইন্দু কি তাহলে দিয়েছে, ওকে দেখে তো মনে হলো না ও দিবে, তাহলে? রুদ্রাই বা এভাবে দৌড়ে গেলো কেনো? যেখানে সবাই অবাক সেখানে রুদ্রা দড়জা খোলার এক সেকেন্ডের মধ্যেই দৌড়ে গেলো কিভাবে? একেই কি তাহলে বলে রক্তের টান?
রুদ্রাঃ বাবাই সরো, আমরা ভেতরে যাবো! (রোদের কোলে থেকেই)
শিশির পথ ছেড়ে দাঁড়াতেই ওরা ভেতরে চলে আসে কিন্তু রোদের মা শিশিরকে দেখে ভ্রু কুঁচকে এক অদ্ভুত নযরে তাঁকিয়ে আছে! মহিলার মুখে মধ্যবয়স্কের ছাপ আছে কিন্তু এখনো অনেক সুন্দর দেখতে,, তবে তাকে দেখেই কিছুটা জল্লাদও লাগে! আর এদিকে রোদের মা শিশিরকে দেখে ভাবছে, এই সেই ছেলে যার জন্য ওর ছেলের মারা যাওয়ার ঠিক দুই বছরের মাথাতেই ছেলের বউ বিধবার নাম ঘুচে বিয়ের পিড়িতে বসলো! আর ছেলেটি কি দুনিয়ায় অন্য কোন মেয়ে পায়নি? তার ছেলের বিধবা বউকেই চোখে পড়লো? তার এতো বড় নাতনী থাকা সত্তেও মেয়ে সহই তার মাকে মেনে নিলো,, কি আযব দুনিয়া! বিন্দুর আগের শ্বাশুড়ি মানে মিসেস রণিতা মাহবুব ভেতরে গিয়েই বিন্দুকে জিজ্ঞেস করে..
রোদেলাঃ কেমন আছো বিন্দু? (যদিও জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে নেই, ভদ্রতার খাতিরে)
বিন্দু দুই বছর পর ওর শ্বশুর-শ্বাশুড়ি কে দেখে খুশী হবে নাকি দুঃখী হবে সেইটা নিয়ে ভাবছে! কেনো এসেছে এরা তা হয়তো বিন্দু ভালো করেই বুঝতে পারছে, ওর বোনের জীবনটাও এখন বিষিয়ে তুলবে এরা!
রোদ চোখ মুখ শক্ত করে রাগ আর অভিমান চোখে তাকিয়ে আছে ইন্দুর দিকে! তার প্রিয়তমা এতোটা ছলনাময়ী? সে এতোদিন ভুল মানুষ টিকে ভালোবেসেছে তাহলে? সে লাল বেনারসি পড়ে বউ সেজে বসে আছে, কিন্তু সেটা অন্য কারোর জন্য! যেটা একদিন ওর জন্য পড়বে কথা দিয়েছিলো,, তবে যার জন্যই পড়ুক ওকে তো নিজের করবেই! রোদ মনে মনে বলে, “যে কষ্ট তুমি আমাকে দিয়েছো চিন্তা করোনা ইন্দু রাণী,, তার চেয়েও দ্বিগুন কষ্ট তুমি পাবে! তোমার জন্য যেমন মরতেও পারি তেমন সবাইকে মারতেও পারি! তুমি আমাকে মামার জন্য ছেড়ে গিয়েছিলে তাইনা? সে উপচো টাকেই শেষ করে দিয়েছি! আর বাকি রইলো তোমার ছেড়ে যাওয়া সেই কষ্টও তুমি তিলে তিলে পাবে, ছটফট করবে কিন্তু আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা মাথাতেও আনবে না! তোমাকে ভালোবেসে যেমন নিজেকে শেষ করে দিতে পারবো, তুমি ছেড়ে যাওয়াতেও তেমন ক্ষত বিক্ষত করে দিতে পারবো,,, যতটা হার্ট আমি হয়েছি তার চেয়েও বেশি তুমি হবে! ভালোবাসি ভালোবাসবো তবে ক্ষমা করবো না, আর ইউ রেডি মিসেস মাহাবুব?”
ইন্দু ছলছল রোদের চোখে তাকিয়ে আছে! তার রোদ তাকে কি ভুল বুঝবে? সে কেনো এসেছে এখানে,, ইন্দু তো বিয়ে করতে পারবে না রোদকে, তাকে কোন মতেই মরতে দেখতে পারবে না! দূর থেকেই ভালোবাসবে সারাজীবন, তাও চায় রোদ ভালো থাকুক! কিন্তু ইন্দু কি জানে, রোদের ভালো থাকা মেডিসিন সে?
রোদের বাবা- মা এতোক্ষন ভেতরে গিয়ে ইন্দুর বাবা-মা, বিন্দু-শিশিরকে অনুরোধ করছিলো ইন্দুকে রোদের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য কিন্তু কিছুতেই তারা রাজিনা! রাফেজকেও ডেকে আনে এখানে, সবার বড় জামাই বলে কথা! কিছুক্ষন পরে রোদকেও ভেতরে ডাকা হয়,,,
বিন্দুঃ রোদ তুমি এমন কেনো করছো? তুমি তো এতোটা অবুঝ না,, আমি সব সময় তোমার বাহার করতাম! রুদ্রের চেয়ে তুমি বেশি বুঝদার,, তুমি বাবা- মায়ের সাথে এগুলো কেনো করেছো?
রোদঃ প্লিজ ভাবী আমাকে কোন জ্ঞান দিতে এসো না! তোমার নাটকে অনেক ভুলেছি,, যখন যা বলেছো শুনেছি কিন্তু আর না! তোমরা আমার সাথে বেইমানী করলে আমি কেনো পারবো না? তোমরা সবাই খুব ভালো, তোমার বোনতো আরো ভালো! ভালোই ভালোই বিয়ে দিলে দাও নাইলে ওঠায় নিয়ে যাবো! এতোদিন রোদের ভালোটা দেখেছো এখন দেখবে আমি কতটা সার্থপর, নিজের জন্য সব করতে পারি! এমনকি বাবা- মায়ের মাথায় বন্দুকও ঠেকাতে পারি! আমার কাজে যে বাধা দিতে আসবে তাকেই শেষ করে দিবো! আমি কাওকে হুমকি দিচ্ছি না,, যেটা সত্যি সেটাই বলছি দরকার পড়লে সব ধ্বংস করে দিবো ! তোমারা ভালোই ভালোই আমার সাথে বিয়ে দিবে নাকি তোমার বোনকে তুলে নিয়ে যাবো? সেটা নিশ্চই তোমাদের জন্য শোভনীয় হবে না! এখন ডিসিশন তোমরা নাও কি করবে!
সবার মুখেই চিন্তার ছাপ পড়ে যায়,, রুহানকে কি জবাব দিবে? আর তার পরিবারকেই বা কি বলবে শিশির! যেখানে শিশিরের ওপর এতো ভরসা তাদের, তাদের কিভাবে ঠকাবে! তখনি রুহান ভেতরে চলে আসে,, রোদের দিকে তাকিয়ে দেখে খুব শান্ত ভাবে তাকিয়ে আছে তবে ভিলেন ভিলেন ভাব এসেছে তার মাঝে!
রুহানঃ আমি আপনাদের সব কথাই শুনেছি, আমারও মনে হয় রোদের সাথেই ইন্দুর বিয়ে দিলে ভালো হবে! কারণ,,,( থামিয়ে দেয় রোদ)
রোদঃ হেই ইউ,, আমি আমার জিনিস নিতে এসেছি তোমার দয়া করা জিনিস না! তুমি বলবে আর সবাই তোমার কথায় আমার হাতে ইন্দুকে তুলে দিবে? নো ডিয়ার, আমি যা বলবো তাই হবে! এতে তোমার না আসলেও চলবে ইভেন্ট তোমার কেনো আমি আমার আর ইন্দুর মাঝে কারোর ইন্টারফেয়ার দেখতে চাই না! জাস্ট আপনাদের মান-সম্মান বাঁচাতে আপনাদের ডেকেছি আমার হাতে তুলে দিতে! নাইলে ওকে নিয়ে যাওয়া আমার এক সেকেন্ডেরও ব্যাপার না!
রুহানঃ হুম রোদ,, নিয়ে যাও ইন্দুকে! ও ভেতরে ভেতরে অনেক কষ্ট পাচ্ছে,, কেনো আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে আমি ঠিক জানিনা তবে ওকে দেখলে বোঝা ও তোমায় কতটা ভালোবাসে! তোমার জন্য সব করতে পারবে,, লাস্ট কয়েকমাস ছাড়া আগে তো ওর মুখে সব সময় তোমার নামই শুনেছি! প্লিজ সবাই না করবেন না,, ওদের এক করিয়ে দিন!
শিশিরঃ সরি রুহান..( রুহানের পিঠে হাত দিয়ে) আমি সত্যিই দুঃখীত,, এমন একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে জানলে কখনোই তোমাকে বিয়ের কথা বলতাম না!
রুহানঃ আরে স্যার না,, সমস্যা নেই আমিও তাই চাই! ইন্দু আমার ভালো ফ্রেন্ড ওর খুশীতেই আমার খুশী! আপনে শুধু আম্মুকে একটু বুঝান, বাকি সব আমি ম্যানেজ করছি!
এদিকে, বাহিরে সবাইকে জানানো হয়েছে রুহানের সাথে ইন্দুর না রোদের সাথেই ইন্দুর বিয়ে হবে! এটা শুনে নীল কিছু একটা ভেবে শিশিরকে আলাদা একটা রুমে ডাক দেয়,,
শিশিরঃ যা বলার তাড়াতাড়ি বল অনেক কাজ আছে!
নীলঃ ভাইয়া কিভাবে যে কথাটা বলবো, আর তুমি কিভাবে নিবে! মানে হচ্ছে, তোমার শালিকার সাথে যেহেতু রুহানের বিয়েটা হচ্ছেই না তাইলে আমাদের নীরার সাথে রুহানের বিয়ে দিলে কেমন হয়? মানে তুমি না চাইলে হবে না!
শিশিরঃ (অবাক হয়ে) সত্যি বলছিস? নীরা কি রাজি হবে? যদি এটা হয় তাহলে খুব ভালো হবে, আমি অপরাধ বোধ থেকে বাঁচবো! ফুপির সাথে আর নীরার সাথে কথা বলে আমাকে কুইক জানা!
নীলঃ আমি যা করবো মা তাতেই খুশী, আর নীরাকে নিয়ে ভেবো না ভাইয়া! ও রুহানকে পছন্দ করে, আমাকে অনেক আগেই বলেছিলো কিন্তু তোমার শালিকার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে জন্য আমি কথাটা আর বাহিরে আসতে দেই নি! কিন্তু রুহান? ওর বাসায় রাজি হবে?
শিশিরঃ রুহান আর মামুনীকে আমি যা বলবো তাই শুনবে! ধরতে গেলে আমিই ওদের গার্ডিয়েন,, আমি মামুনির সাথে কথা বলছি! তুই রিমিকে বল নীরা কে রেডি করে দিতে!
শিশির ড্রয়িংরুম থেকে নীলের মা কে ডাকে সবার আড়ালে,, তারপর তাকে নিয়ে বিন্দুর রুমে যায়! তাকে বিছানায় বসিয়ে তার কোলে মাথা রেখে মন খরাপ করে বলতে থাকে,,,
শিশিরঃ মামুনি আমি সরি,, আমি সত্যি জানতাম না এমন কিছু একটা ঘটবে নাইলে কখনো তোমাদের এভাবে নিয়ে আসতাম না! আমিতো তোমার ছেলে তাইনা? তোমাদের অসম্মান মানে আমারও অসম্মান, রুহানকে তো আমি ছোট ভাই মনে করি! নিহান যেদিন আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে সেদিন তুমি আমাকেই ছেলে মনে করো তাইনা!
মামুনিঃ হ্যা বাবা, তারও আগের থেকে তুই আমার ছেলে,, আমার তিন ছেলে! আর এসবে তোর দোষ নেই,, সম্পূর্ণ ভাগ্য! রুহানের ভাগ্যে হয়তো ইন্দু ছিলো না তাই ওরা এক হলোনা! আল্লাহ যা করে মঙলের জন্যই করে, এতে আমাদের কিছু করার নেই! ( মাথা হাতিয়ে দিয়ে)
শিশিরঃ একটা জিনিস চাইবো দিবে,, আমাকে ভুল বুঝবে নাতো?
মামুনিঃ মা কি কখনো ছেলেকে ভুল বোঝে? তুই আমাদের জন্য যা করেছিস, তোর ঋণ একটু হলেও যেনো শোধ করতে পারি! তোর মা অনেক ভাগ্যবতী, তোর মতো ছেলেকে জন্ম দিয়ে! আমি তোর আপন মা না হলেও তোকে নিয়ে আমার গর্ব হয়! যে ছেলে নিজের জীবন বাজি রেখে অন্যকে বাঁচায় তার মতো মানুষ হয়তো খুব কম আছে পৃথিবীতে! আমার নিজের ছেলেরাও হয়তো এতো বড় কাজ করতো না! বাচাতে না পারলেও, তোর জন্য এক বছর কাছে পেয়েছি তোর আংকেলকে!
শিশিরঃ মামুনি পুরোনো কথা তুলো না প্লিজ! আংকেল আর নিহানের জন্য আমারো অনেক কষ্ট হয়! আমি ওদেরকে রুহানের মাধ্যমে খুজে পাই!
মামুনীঃ তুই কি চাস বাবা বল?
শিশিরঃ আমার ফুপুর মেয়ে নীরা,, ওর সাথে রুহানের বিয়ে দেই! খুব ভালো মেয়ে, আর অনেক লক্ষীও! তোমাকেও ভালোবাসবে,, ওর ও বাবা নেই ৫ বছর আগে মারা গিয়েছে! রুহানও চেনে ওকে, তুমিও দেখেছো বাহিরে একটা নীল কালারের ড্রেস পড়ে ছিলো!
মামুনীঃ তোর যেটা ভালো মনে হয় কর,, আমি কি কখনো তোর কথায় দ্বিমত প্রকাশ করেছি? তুই তোর ভাইয়ের বিয়ে কার সাথে দিবি সেটা তুই ই ভালো জানিস!
শিশির খুশী হয়ে তার মামুনীকে একবার জরিয়ে ধরে বলে, বাহিরে চলো মামুনী! এখনই তোমার ছেলের বউ বানিয়ে দিচ্ছি! রুহানকে বলে আমি সব ম্যানেজ করে নিচ্ছি, তুমি কিছু ভেবো না!
অবশেষে রোদ-ইন্দু আর রুহান-নীরার বিয়ে হয়ে গেলো! আজকে দুই জুটি হওয়ার কথা ছিলো, সেখানে তিন জুটি হলো! আর রোদ জানিয়েছে, ও দুই মাসের মধ্যে ইন্দুকে নিয়ে আমেরিকায় সেটেল হয়ে যাবে,, সেখানে রোদ জব পেয়েছে! আর এতোদিন ওকে নিয়ে বান্দরবন থাকবে,, ওর বউয়ের আশেপাশেও ওর বাবা-মাকে ঘেষতে দিবে না,, আজকে রাতেই ইন্দুকে বান্দরবন নিয়ে যাবে! সেখানে রোদের এক ফ্রেন্ডের বাসা আর এখন ওদের জন্যও ফ্ল্যাট ঠিক করেছে! ওদের সংসারে শুধু ওরা ছাড়া আর কাওকে থাকতে দিবে না! ইন্দুকে ওর পরিবারের সবাই বিদায় দিতেই, নীরার বিদায়ের পালা আসে! নীরা তো অনেক খুশী, ওর ভাই ওর এই চাওয়াটাও পূরণ করতে পারলো! তবে এটা ভাবেনি, বোনের এংগেজমেন্টে এসে নিজেরও বিয়ে হয়ে যাবে!
____________________
রাত ১:০০ টার এর দিকে, সব কাজ শেষে বিন্দু রুমে এসে ফ্রেশ হয়! মেঘ-রুদ্রা ঘুমিয়ে গেছে কিছুক্ষন আগে,, বিন্দুও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাত-পায়ে লোশন মাখছিলো! এমন সময় শিশির এসে দড়জা লাগিয়ে ফ্রেশ হতে চলে যায়! একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়বে ওরা,, শিশির বেরিয়ে দেখে বিন্দু দাঁড়িয়ে চুলে বেনী গাঁথছিল! ও যেয়ে পেছন থেকে জরিয়ে ধরে, আর চুলগুলো খুলে দিয়ে চুলে মুখ গোঁজে!
বিন্দুঃ ছাড়ো!
শিশিরঃ নাহ!
বিন্দুঃ ছাড়তে বলছি!
শিশিরঃ নাহ বলছি!
বিন্দুঃ তুমি আমার সাথে কথা বলবে না!
শিশিরঃ (অবাক হয়ে) কেনো? কি করেছি আমি?
বিন্দুঃ তুমি আমায় লুকোয় সবকিছু!
শিশিরঃ আবার কি লুকালাম, সবই তো বলি!
বিন্দুঃ রুহানের বাবাকে তুমি কিভাবে বাঁচিয়েছো? রুহান আর মামুনী তোমার কাছে কিভাবে ঋণি এগুলো তুমি আমাকে বলোনি!
শিশিরঃ এই বিন্দু আজকে কি শ্যাম্পু দিয়েছো,, প্রতিদিন তোমার মাথা থেকে পঁচা স্মেল আসে আজকে সুন্দর স্মেল আসছে!
বিন্দু রেগে হাতের কুনই দিয়ে শিশিরের পেটে গুতো দেয়!
বিন্দুঃ আমার মাথা থেকে বাজে স্মেল আসে?
শিশিরঃ তোমার হাত নাকি লোহা? সবার বউয়ের হাত কি নরম তুলতুলে হয় আর আমার বউয়ের হাত শক্ত হাতুরি! আমার পেটে গেছে একদম! (বিন্দুকে ছেড়ে নিজের পেট ধরে)
বিন্দুঃ (রেগে কলার ধরে) তুমি সবার বউয়ের হাত ধরেছো? ফাযিল, তুমি আগের থেকেই এমন লুচু! (মারতে মারতে)
শিশিরঃ আহ, কি রণচণ্ডী বউরে বাবা আমার! স্বামীকে ধরে মারে, এ ঘোর অন্যায়!(আবার জরিয়ে ধরে)
বিন্দুঃ আমি কিছু বলেছিলাম,, তুমি এড়িয়ে যাচ্ছো কেনো? রুহানের বাবার কি হয়েছিলো? কিভাবে বাঁচিয়েছো? তখন মামুনীকে বলছিলে কিছু!
শিশিরঃ তুমি কি আমাদের কথা লুকিয়ে শুনেছো? ভেরি ব্যাড, বউ!
বিন্দুঃ শিশির ( রেগে যায়)
শিশিরঃ রাগ করবে না তো? তাইলে বলবো..
বিন্দুঃ হুম করবো না, বলো!
আসো ঘুমাতে ঘুমাতে বলি,, তারপর ওরা বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে! মেঘ-রুদ্রাকে এক পাশে দিয়ে ওরা দুজন একপাশে শুয়ে শিশির বলতে শুরু করে,,,
শিশিরঃ তখন ঠিক প্রায় আড়াই বছর আগে হবে, একদিন আংকেল ঢাকায় আসে একটা কাজে! ওইদিন রাতে আমার কাছেই ছিলো,, আংকেল আগের থেকেই অসুস্থ ছিলো! প্রায়ই তার রক্ত চেন্স করতে বাহিরের দেশে নেওয়া হতো, এতে নিহান যা ইনকাম করতো ওর আব্বুর পেছনেই শেষ হতো! রুহানের পড়াও তখন শেষ হয়নি, একা একা পুরো নিঃস্ব হয়ে যায় নিহান,, ওর ফ্যামিলির কেও ওকে সাহায্য করতো না! তবে আমি যথাসাধ্য চেষ্ঠা করেছি! যাই হোক,, সেদিন আমার কাছে ছিলো আংকেল তো মাঝরাতে তার এমন অবস্থা হয় তাকে হসপিটালে না নিলে বাচানো সম্ভব হতো না! তাই আমি সবাইকে জানানোর আগে তাকে নিয়ে আমি হসপিটালে যাই! আর হসপিটাল থেকে সাথে সাথে বলে তার কিডনি ড্যামেজ হয়ে গেছে কিছুদিন হলো,, আর তাকে বাঁচাতে হলে এমিডিয়েটলি কিডনি ট্রানস্ফার করতে হবে! আমি কি করবো, কিচ্ছু ভেবে পাই না, দিশেহারা হয়ে পড়ি! এই মুহুর্তে আমি কিডনি কোথায় পাবো, তারা আমকে ১০ মিনিট টাইম দেয়! নিহানদের বললেও ওদের পঞ্চগড় থেকে আসতে অনেক টাইম লাগবে,, তাই আমি কিছু না ভেবেই ডক্টরের সাথে মিট করো! আর বলি আমি দিবো, আমার জন্য যদি কোন মানুষ বেচে যায় আমার ক্ষতি কি? তারপর ডক্টরকে জানিয়ে দেই নিহানের ফ্যামিলিতে খবর দিতে আর আমি দেরী না করে অপেরেশন রুমে ঢুকে যাই! সেই যাত্রায় তাও আংকেল বেঁচে যায় কিন্তু তার ঠিক এক বছর পর আংকেলের ভেতরের সব নষ্ট হয়ে যায়,, এমনকি আমার ট্যানাসফার করা কিডনিও! শেষ রক্ষা আর হয়নি সেদিন!
বিন্দুঃ তারমানে তোমার এখনো এক কিডনিই আছো?
শিশিরঃ ( হেসে বিন্দুকে জরিয়ে বলে) নাহ,, আমার পাগল বন্ধু দিয়ে যায় মারা যাওয়ার আগে! ওর ও একটা প্রবলেমের জন্য মারা যায় আর সেটা আগেই জানতে পারে তাই আমাকে দিয়ে দেয়!
বিন্দুঃ তারমানে তোমার দুইবার অপরেশন হয়েছে? এই জন্যই তোমার পিঠের দিকে, কোমরের ওইখানে কাটার দাগ?
শিশিরঃ হুম,, এটা শুধু মেঘলা জানতো আর আজকে তোমাকে বললাম! প্লিজ তুমি কাওকে বলবে না,, মামুনী আর রুহান জানে যার জন্য রুহান আমাকে ছাড়েনি কখনো!
বিন্দুর বেশ অবাক হয় শিশিরের কথায়,, ওর স্বামীর এই ভালো গুনটা তো ওর জানা ছিলো না! শিশিরকে ও অনেক বছর ঘৃণা করেছে, কিন্তু আজকে সেই শিশিরের জন্যই ও গর্ববোধ করছে! মানুষের বিপদে যে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার মতো এতো বড় মনের মানুষ হয়তো খুব কম আছে! বিন্দুর চোখ থেকে গড়িয়ে দু ফোটা পানি পড়ে!
শিশিরঃ এই বিন্দুবালা তুমি কাঁদছো কেনো? তুমি রাগ করেছো? বিন্দু,, ওই,,
বিন্দু ঘুরে গিয়ে শিশিরকে জরিয়ে ধরে,, এতোদিনে এই প্রথম ও নিজে থেকে শিশিরের কাছে এসেছে! শিশির তো আজকে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছে, অবশেষে তার বিন্দুবালার মন হয়তো জয় করতে পেরেছে!
শিশিরঃ বিন্দু আজ একটা জিনিস চাইবো দিবে?
বিন্দুঃ কি?
শিশিরঃ আমি তোমাকে পরিপূর্ণ ভাবে পেতে চাই,, তুমি কি দিবে নিজেকে আমার কাছে বিলিয়ে!
বিন্দু কিছু না বলে মাথা নেড়ে হ্যা সম্মতি যায়,,শিশিরের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে!
________________________
সকাল সকাল শিশির বিন্দুকে ডেকে তুলে! বিন্দু বিরক্ত নিয়ে চোখ খুলতেই শিশির বলে..
শিশিরঃ ফ্রেশ হয়ে এসো, দুজন একসাথে নামায পড়বো! তারপর আমার একটা ইচ্ছে আছে সেটা হচ্ছে,, দুজন একসাথে মিলে শিশির_বিন্দু দেখবো! বাস্তবের শিশির_বিন্দু,, আমাদের নামের পরিপূর্ণতা লাভ পাবে এই শিশির_বিন্দু দেখলে! আর কথা নয় যাও তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো,, আমি ফ্রেশ হয়েছি!
বিন্দু কিছু না বলে ওঠে পড়ে,, ওরা নামায পড়ে দুজন বেড়িয়ে যায় শিশির_বিন্দুর খোজে! যাওয়ার আগে মেঘ-রুদ্রাকে অনেক আদর করে, বাসায় বলে যায় ওদের দেখতে! আজ ওদের বিয়ের এক বছর পেরিয়ে আরো কয়েকমাস মাস হয়েছে! বিন্দু হয়তো শিশিরকে মেনে নিয়েছে,, ওর তো কোন দোষ ছিলো না! যার দোষ ছিলো তাকে শাস্তি আল্লাহ নিজে দিয়েছে, আর কাকে দোষী করবে? বিন্দুও যেমন মেঘকে ভালোবাসে শিশিরও রুদ্রাকে ভালোবাসে! কালকে রুদ্রার দাদা-দাদীও রুদ্রাকে অনেক কাছে টেনে নিয়েছিলো! যতই হোক, রক্ত তো দাদা-দাদি বলে কথা, ওদেরও খারাপ লাগে রুদ্রার জন্য!
সূর্য ওঠার আগেই পত্র-পল্লব আর ঘাসের ওপর জমা হয় শিশির বিন্দু! সূর্যের আলোয় আবার শুকিয়েও যায় সেই শিশির! শিশির কোনো শীতল বস্তুর উপর জলীয় বাষ্প জমা হয়ে সৃষ্ট হয় বিন্দুর! একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় বাতাস একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত জলীয় বাষ্প ধারণ করতে পারে! তখন বাতাস আর জলীয়বাষ্প ধরে রাখতে পারে না এবং তা শীতল বস্তুর ওপর পানির কণা হিসেবে জমা হয়! এ পানির বিন্দু ফোটাগুলোই #শিশির_বিন্দু নামে পরিচিত! শীতের সকালে সবুজ পাতায় জমে থাকা শিশির বিন্দুগুলো একেকটা মুক্তোদানা হয়ে ঝড়ে! সবুজ ঘাসের ওপর জমে থাকা বিন্দু বিন্দু শিশির এই শীতের মধ্যে কুয়াশা জমাটবদ্ধভাবে মিশে শিশির হয়ে গিয়ে ঠাঁই নেয় প্রকৃতির অনিন্দ্য সুন্দর ঘাস নামক এক উপাদানের মাঝে! ঘাসের ডগায় বিন্দু বিন্দু শিশির জমে থাকা দৃশ্য দেখে ‘বিন্দু’ খুশীতে আত্নহারা! তার স্বামী তাকে এতো প্রকৃতির সুখ কেনো দেয়? যা নৈসর্গিক সৌন্দর্যের চিরন্তন জলজ-শোভা!
‘শিশির আর বিন্দু’ দুজনেই খালি পায়ে হাটছে বিন্দুর ফোটার শিশির ভেজা ঘাসের ওপর,, কি রোমান্সকর মূহুর্ত! জীবন কত সুন্দর,, এই ছোট্ট জীবনে যদি একটু ভালোভাবে বাঁচা যায় তাতে ক্ষতি কি? হঠাৎ করেই শিশির বিন্দুর হাতটি ধরে বিন্দুর পায়ের দিকে তাকিয়ে হাটছে আর বলছে—
” আজ আমি শিশির কণা হয়ে
সিদ্ধতা খুঁজি তোমার পদস্পর্শের
ছুঁয়ে দেখো ঘাসের ওপর আমার ভালোবাসা
শিশির কবিতা হয়ে ঝড়েছি তোমার ভোরের আশা!
খুব সকালে ঘাসের ওপর, লেপ্টে থাকা শিশিরবিন্দু
তোমার দেখার তৃষ্ণা নিয়ে, শেষ নিঃশ্বাস ছাড়ে রোদের কাছে!”
বিন্দু মিষ্টি হেসে শিশিরের বলার দিকে তাকিয়ে আছে! তার আজকে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে! বেঁচে থাকায় এতো সুখ কেনো? ওরা হয়তো আজীবন সুখী কপত-কপতী হয়েই থাকবে! ওরা ঘাসের ওপর বসে আছে, আর ঘাসের ওপর জমা শিশিরের ফোটা গুলো বিন্দু হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে! বিন্দু এমন পাগলামী দেখে শিশিরের সুমধুর কন্ঠে আবার ধ্বনিত হলো—
” বহু দিন ধরে, বহু ক্রশ দূরে
বহু ব্যয় করি, বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু!
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া,
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ঘাসের পাতার উপরে
একটি #শিশির_বিন্দু❤️
_______________সমাপ্ত_______________
[ আসসালামু ওয়ালাইকুম, কেমন আছে সবাই? আশা করি অবশ্যই ভালো আছেন! অবশেষে গল্পটা শেষ হলো,, আমার একটু ব্যাস্ততার কারণে খুব তাড়াতাড়িই শেষ করলাম! যারা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সাথে ছিলেন তাদের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ,, আর যারা পড়েননি আমি জোর করবো না ইচ্ছে হলে পড়ে নিবেন!
কয়েকটা প্রশ্ন ছিলো,, ভিলেন রোদকে কেমন লাগলো সবার? কোন জুটিটা বেশি ভালো ছিলো? শিশির-বিন্দু নাকি রোদ-ইন্দু আর নাকি তিয়াশ-ইশা? উত্তরে জানাবেন!
#শিশির_বিন্দু❤️ শেষ,, লাস্ট পার্ট তাই একটু বড় করে দিলাম! এই পর্বটাই গল্পের সব পর্ব থেকে বড় ছিলো,, ৪৫০০+ শব্দ আছে! গল্পটা কেমন হয়েছে জানতে চাইবো না! গল্পের থিমটা কেমন ছিল সেটা জানাবেন কারণ আপনাদের ভালো লাগলে আমি আবার শিশিরবিন্দু সিজন-২ লিখবো! তবে একটু সময় লাগবে কারণ আমার সামনে ডিসেম্বর থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা (অবশ্যই দোয়া করবেন),, এই জন্য গল্পটা তাড়াতাড়ি শেষ করে দেওয়া! পরীক্ষা শেষে আবার লিখবো ইনশাল্লাহ! এতোদিনের কষ্টের ফসল কেমন ছিলো আপনাদের কাছে জানতে চাইলাম, দয়া করে বলবেন! আল্লাহ হাফেজ❤️]