শিশির বিন্দু পর্ব ২১

0
518

#শিশির_বিন্দু❤️
লামিয়া সুলতানা সিলভী ( লেখনীতে)
পর্বঃ২১

শুভ্র মেঘের পিছু পিছু ছুটে যেতে কার না ইচ্ছে করে! মেঘের ভেলায় হারিয়ে যেতে, আকাশের মেঘদের সাথে কথা বলতে চায় না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর! কিন্তু কংক্রিটের এই শহরে মেঘেদের নাগাল পাওয়া দায়, তবে মেঘের রাজ্যে হারিয়ে যেতে এবং মেঘের ভেলায় ভেসে যেতে চাইলে আমাদের দেশেই আছে অপরূপ সৌন্দর্যে ঘেরা একটি স্থান! যেখানে শুধু মেঘের দেখাই পাওয়া যায় না বরং প্রকৃতির সকল অপরূপ মহিমার নাগালও পাওয়া যাবে একসাথে! আর সেটা হলো, মেঘের রাজ্য খ্যাত বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর জায়গাগুলোর মধ্যে অন্যতম সাজেক ভ্যালি! সাজেক ভ্যালিকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশী সৌন্দর্যে ঘেরা স্থান বলা হয় বটে,, আর বলা হবেই বা না কেনো প্রকৃতির সকল সৌন্দর্য যেন একস্থানে চলে এসেছে! সাজেক ভ্যালি সবচেয়ে সুন্দর হওয়ার পাশাপাশি, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়নও এটা!

শিশির অফিস থেকে চারদিনের ছুটি নিয়েছে ফ্যামিলি ট্যুরে যাবে বলে! কারণ হানিমুনে যাওয়ার কথা বললে বিন্দু কিছুতেই রাজি হতো বা, তাই সে তার কাজিন+বিন্দুর সব কাজিনদের নিয়ে চারদিনের একটা ফ্যামিলি ট্যুর দিবে,, মোটমাট ২০ জনের ট্যুর হবে! নীলের বিয়ে খেয়ে এসেছে প্রায় ৭/৮ মাস হয়ে গেছে,, শিশির আর বিন্দুর বিয়েও প্রায় ১ বছরের কাছাকাছি হবে! কিন্তু ওরা ঢাকা টু নারায়নগঞ্জ + কিশোরগঞ্জ ছাড়া আর কোথাও তেমন যায়নি! আর এখন শীতকাল তাই শিশির ভাবলো শীতের সাজেক অনেক সুন্দর হয়, যার কারণে এই প্লান করে! রুহানকেও সাথে নিয়েছে,, সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে মেঘের রাজ্যের উদ্দেশ্যে! শিশির আগেও অনেকবার গিয়েছিলো কিন্তু ওর ফ্যামিলির অনেকেই যায়নি আর বিন্দুও কখনো যায়নি তাই শিশির তার প্রিয়তমাকে মেঘ ছোঁয়াবে!

শিশির সেন্টমার্টিনের এসি বাস বুকিং করেছে! এই বাসেও দিব্বি খাগড়াছড়ি পর্যন্ত যাওয়া যাবে! পুরো বাসে ওদের সংখ্যাই বেশী! এই বাসে করেই তারা খাগড়াছড়ি পর্যন্ত যাবে! সবাই শিশিরের ডানমন্ডি ফ্লাটে এসে হাজির হয় ট্যুরে যাওয়ার একদিন আগেই! তারপর ডানমন্ডি থেকে গাবতলী যায়,, আর গাবতলী থেকেই বাসে ওঠে রাত ৯ টার দিকে! খাগড়াছড়ি পৌছাতে বেশ সময় লাগে ওদের,, পরেরদিন প্রায় সকাল ৭টা-৮টার খাগড়াছড়ি পৌছায়! খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকের দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার! আপাতত খাগড়াছড়িতে একটা হোটেলে ওঠে, সেখানে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে, তারপর ব্রেকফাস্ট করে দীঘিনালা হয়ে সাজেক যাবে আর তখন এর দূরত্ব হবে ৪৫-৫০ কিলোমিটার! দীঘিনালা থেকে সাজেক যাওয়ার পথে আর্মি ক্যাম্প পরে,, আর্মি ক্যাম্প অথবা ১০নং বাঘাইহাট পুলিশ ক্যাম্প থেকে সাজেক যাওয়ার অনুমতি নিতে হয়! আর্মি গণের পক্ষ থেকে গাড়িবহর দ্বারা পর্যটকদের গাড়িগুলোকে নিরাপত্তার সাথে সাজেক পৌছে দেয়া হয়! দিনের দুইটি নির্দিষ্ট সময় ব্যতীত আর্মি ক্যাম্পের পক্ষ হতে সাজেক যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয় না! পর্যটকদের সর্বাধিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যই এই নিয়ম অনুসরণ করা হয়! শিশিররা সকাল ১১টার আর্মি এস্করটে গাড়ি নিয়ে সাজেকের উদ্দেশে রওনা দিবে! তাই, ওদের হাতে চার ঘন্টা সময় থাকে, আর এই চার ঘন্টায় ওরা যাওয়ার পথে দিঘীনালা থেকে ৮কি.মি. দূরে দিঘীনালা-সাজেক রোডের পাশেই হাজাছড়া ঝর্ণা দেখতে যায়, মূল সড়ক থেকে ১০-১৫ মিনিট হাটলেই দেখতে পাওয়া যায় এই অপূর্ব ঝর্ণাটির! তৈদুছড়া নামে আরো একটি অসাধারণ ঝর্না রয়েছে দিঘীনালায়, তবে এটি দেখতে হলে আলাদা করে একদিন সময় রাখতে হবে! আবার, সাজেক যাওয়ার পথে বাঘাইহাটে হাজাছড়া ঝর্ণা অবস্থিত! অনেক পর্যটকগণ মূল রাস্তা হতে সামান্য ট্রেকিং করে গিয়ে ঝর্ণাটির সৌন্দর্য উপভোগ করে থাকেন! ওরা সবাই ঝর্ণা ঘুরে আর্মিদের ঠিক করা সাজেকগামী জিপ গাড়িগুলো ওঠে পড়ে! এই জিপগুলো স্থানীয়ভাবে এখানে “চাঁন্দের গাড়ি” নামে পরিচিত! শিশিররা এই জীপে করেই ২ দিন ঘুরবে,, কারণ ২ দিনের বেশী চাঁদের গাড়ি থাকে না! চাইলে অন্য গাড়ি নেওয়া যায়, তবে হেটে যাওয়ার আলাদা মজা আছে!

শিশিরঃ ( সবাইকে উদ্দেশ্যে করে) এটা হচ্ছে রুইলুই পাড়া” এখান থেকে সাজেকের শুরু হয়েছে! রুইলুইয়ে পৌঁছানোর আগেই কাসালং ব্রিজ আর কাসালং নদী পাড়ি দিতে হবে! আস্তে আস্তে সবই দেখতে পাবে!

নকশাঃ এটা অনেক উঁচু তাইনা শিশির?

শিশিরঃ জ্বি আপু,, রুইলুই পাড়া সমতলভূমি থেকে ১৮০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত! এ থেকেই সাজেকের মনোরম পাহাড়ের শুরু, রুইলুই পাড়া সাজেক ভ্যালির সবচেয়ে প্রবীণতম একটি গ্রাম! রুইলুই পাড়া থেকে অল্প দূরেই অবস্থিত সাজেক ভ্যালি! তবে সাজেক এবং রুইলুই পাড়ার মাঝে “কমলক ঝর্ণা” নামে একটি ঝর্ণা আছে,, কমলক ঝর্ণাটি স্থানীয়দের কাছে “পিদাম তৈসা ঝর্ণা অথবা সিকাম তৈসা ঝর্ণা” নামেও পরিচিত! এটি পর্যটকদের কাছে বেশি আকর্ষনীয় একটি ঝর্ণা!

রুশাঃ এর প্রতিষ্ঠ সাল কবে? আর কারা কারা থাকে জিজু?

শিশির বলার আগেই সিফাত বলে ওঠে…

সিফাতঃ এই রুইলুই প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৮৫ সালে! আর এর আদিবাসীদের মধ্যে লুসাই, পাংকুয়া এবং ত্রিপুরা উল্ল্যেখযোগ্য হলেও রুইলুই পাড়ার গোড়াপত্তন হয় লুসাইদের হাতেই! তাই, রুইলুই পাড়ার প্রধান লাল থাংগা লুসাই এখানে বসবাস করে! জনো, সাজেকের কলা আর কমলা বিখ্যাত! রাঙামাটির অনেকটা অংশ দেখে যায় সাজেক ভ্যালি থেকে! তাই সাজেক ভ্যালিকে বলা হয় “রাঙামাটির ছাদ”!

রুশাঃ ওহ…

শুরু হল সবার দীঘিনালা হতে ৩৪ কি.মি. দূরত্বের সাজেক যাত্রা! দিঘীনালা থেকে সাজেক রোডে নিরাপত্তা বাহিনীর চারটি ক্যাম্প পড়ে,, প্রতিটিতেই টীমের একজন সদস্য নেমে টীম সম্পর্কে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে হবে! আর সেই কাজটা করে শিশির!

সবাই প্রচন্ড ক্লান্ত ছিলো কিন্তু চাঁদের গাড়ী দিয়ে পাহাড়ি পথের যাত্রা শুরু হতেই সেই ক্লান্তি কোথায় যেন উবে গেল তা কেও টেরই পেলোনা! সবার একঘেয়েমি দূর হয়ে যায়, মনে হয় সাজেকে যাওয়ার যাত্রা সার্থক হয়েছে! আর চাঁদের গাড়ীর ড্রাইভার মামাদের ড্রাইভিং, শিরদাঁড়া দিয়ে ভয়ের উত্তেজনার পারদ উঠিয়ে দিবে! তবে এতে বিন্দু বেশ ভয়ে আছে মেঘকে নিয়ে, যদি মেঘের কিছু হয়ে যায়! ছোট বাচ্চাকে রেখেও আসা যেতো না আর এদিকে রুদ্রাও বেশ ভয়ে ইন্দুর বুকে সেঠিয়ে আছে! শিশির বিন্দুর অবস্থা দেখে মেঘকে কোলে নেয়, আর ওর পাশে দাড়িয়ে ওকে সাহস দেয়! তবে, বাকি সবাই পুরো ফার্স্ট এন্ড ফিউরিয়াস জনারের ড্রাইভিং উপভোগ করতে থাকে ড্রাইভারদের ড্রাইভিং এ! আর রাস্তায় যে সব ঢাল আছে, বাঁক আছে, খাড়া রাস্তা আছে সেই গুলা উপভোগের মাত্রা আরো একটু বাড়িয়ে দেয় সবাইকে! দিঘানালা থেকে সাজেক আসতে আড়াই ঘন্টা লাগে ওদের! বিন্দুরা পৌছায় দুপুর ৩ টের পরে, যেয়েই সোজা শিশিরের বুকিং করা রিসোর্টে ঢুকে পড়ে!

সাজেক ভ্যালির পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় রিসোর্ট হলো “মেঘপুঞ্জি রিসোর্ট”! এই রিসোর্টে ৪টি কটেজ আছে, যাদের নাম- পূর্বালা, তারাশা, মেঘলা ও রোদেলা! এই কটেজগুলো এমনভাবে বানানো হয়েছে যে পর্যটকরা সম্পূর্ণ আলাদাভাবে সাজেকের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে! প্রতিটি কটেজই একটি থেকে আরেকটি আলাদা! শিশির আগে থেকে চারটে কটেজই বুকিং করেছিলো! প্রতিটি কটেজে ১টি করে বড় বেড আর এক্সট্রা ফ্লোরিং বেড আছে! বড় বেডে ২-৩ জন করে থাকা যাবে আর ফ্লোরিং বেডে ১-২ জন করে থাকা যাবে,, এক কটেজে মোটামুটি ৪ জন করে থাকা যাবে! যেমন, শিশির, রাফেজ, নীল, রাফিন থাকবে রোদেলা কটেজে আর বিন্দু, নকশা, রিমি, নাদিয়া থাকবে পূর্বালা কটেজে! আর এদিকে বাকী মেয়েগুলো থাকবে তারাশা আর ছেলেগুলো মেঘলা কটেজে! মানে সব বিবাহিতরা থাকবে একসাথে,, ওরা পিচ্ছিদের মাঝে যেয়ে ওদের আড্ডা নষ্ট করবে না! শিশির সবাইকে রেস্ট নিতে দিয়ে খাবারের অর্ডার করতে চলে যায়! দেন, সবাই ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নেয় কিছুক্ষন! শিশির সবার কটেজে গিয়ে দেখে আসে সবাই ঠিক-ঠাক আছে কিনা! তারপর বিন্দুদের রুমে এসে দেখে মেঘকে নিয়ে বিন্দু ব্ল্যাঙ্কেটের নিচে ঘুমাচ্ছে,, এখানে এখন আর কেও নেই! তাই শিশির এই কটেজের ওয়াশরুমেই চলে গেলো ফ্রেশ হতে! ফ্রেশ হয়ে এসে বিন্দুর মাথার কাছে বসে, আর আসতে আসতে ডাকে—

শিশিরঃ বিন্দুবালা…( চুল হাতিয়ে)

শিশির এমন ভাবে হাতিয়ে দিচ্ছে বিন্দু ওঠা তো দূরে থাক আরো বেশী করে ঘুম পাচ্ছে!

শিশিরঃ বিন্দু ওঠো,, আমরা তো ঘুমোতে আসিনি এখানে, ঘুরতে এসেছি! চারদিন পর বাসায় গিয়ে আরামে ঘুমিয়ো!

বিন্দুঃ হুম..( ঘুমের তালেই)

শিশিরঃ একটু পর খাবার আসবে, খাবেনা? দেন আমরা হ্যালিপ্যাডে যাবো ৫টার দিকে! রেডি হতে হবে তো সোনা,, ওঠো প্লিজ!

তখনই রুদ্রা রুমে এসে চিল্লিয়ে ওর মাকে ডাকে,,,

রুদ্রাঃ মাম্মাম, তুমি ঘুমোচ্ছো? সবাই প্লান করছে কি ড্রেস পড়ে ঘুরতে যাবে আর আমি? আমি কি পড়বো!

বিন্দু তড়িঘড়ি করে ওঠে,,,

বিন্দুঃ কি হয়েছে?

রুদ্রাঃ আমাকে ড্রেস দাও, আমি একটু পরেই রেডি হবো!

বিন্দুঃ এখন কিসের ড্রেস? ফ্রেশ হয়েছো, খেয়েছো?

রুদ্রাঃ হ্যা, আমি ইন্দুমতীর কাছে ফ্রেশ হয়েছি! একটু পর খাবো,, তারপর বেরাতে যাবো! ( বিছানায় ওঠে মেঘের গালে চুমু দেয়)

বিন্দুঃ রুদ্রা সোনা, ভাই এখন ঘুমুচ্ছে,,, ঘুমোনো বেবীকে চুমু দিতে হয় না! আর তোমার শীত লাগছে না?এভাবে কিছু না পড়ে ঘুরছো কেনো!

শিশিরঃ এটা কিন্তু ঠিক না রুদ্রা,, তোমার ঠান্ডা লাগলে বাবাই কষ্ট পাবে তো! বিন্দু ওর সোয়েটার দাও! (রুদ্রাকে কোলে নিয়ে আদর করতে থাকে)

বিন্দু সোয়েটার শিশিরের হাতে দিতে ওকে বলে মেঘকে দেখতে তারপর ও যায় সবার সাথে দেখা করতে! প্রায় এক ঘন্টা পরে খাবার রেডি হয়ে গেলে তারাই খাবার দিয়ে যায় সবার কটেজে, ক্ষুধাও ছিলো সবার চরম,, সেই যে খাগড়াছড়ি তে সকালে খেয়েছিলো আর এখন বাজে চারটা! ভাত, গরুর মাংস, কলিজার সবজি ভাজি আর ডাল গোগ্রাসে সবাই বেশ আরামেই খেলো! বিকাল ৫ টার দিকে সবাই বেরিয়ে পড়লো সাজেক হেলিপ্যাডের উদ্দেশ্যে! অদ্ভুত উঁচু একটা জায়গা এখানে হেলিকপ্টার নামে, তাই এর নাম হেলিপ্যাড! সাজেকে দুটি হেলিপ্যাড আছে,, আরো আছে কিনা জানি নেই! ওদের কটেজ থেকে হেলিপ্যাড খুব বেশি দূরে না! হেলিপ্যাড থেকে সূর্যাস্ত দেখা সব পর্যটকদের টার্গেট থাকে! ওরা যাওয়ার কিছুক্ষন পরেই দেখতে পায়, সূর্যের রক্তিম লালচে আভার আলো আস্তে আস্তে নিভে যাচ্ছে আর চারদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে! হেলিপ্যাডে ওঠার পর বিন্দুর চোখে পড়ে একজন নারী ব্যাম্বু-টি বিক্রি করছেন! শিশিরকে জিজ্ঞেস করতেই সে বলে, এটা হচ্ছে “ব্যাম্বু টি” মানে বাঁশের চা! মূলত তেঁতুল দিয়ে তৈরি করা চা,, এটা এখানকার নামকরা যা ছোট বাঁশে পরিবেশন করা হয়! তৃষারা সবাই বলে চা পান করতে করতে সূর্যাস্ত দেখবে! তাই শিশির সবার জন্য ব্যাম্বু টি অর্ডার করে! বিন্দু এই প্রথম সাজেকে আসে,, ওর মনে হচ্ছে না আসলে হয়তো এই মূহূর্তগুলো কখনো স্মৃতির পাতায় সরণীয় হতোনা! একপাশে সূর্যাস্ত অন্য পাশে ভারতের সুউচ্চ পাহাড় আর ধীরে ধীরে জমতে শুরু করা মেঘ!

সন্ধ্যার দিকে এখানে আকাশ আর তারাদের সামিয়ানা দেখতে একদম অন্যরকম লাগে! সাজেকের ওই আকাশের দিকে সারা রাত তাকিয়ে থাকা যায়! এখানে অনেক গুলা গ্রুপ ফানুস ওড়াচ্ছিলো, এগুলো দেখতে দারুন লাগে! তাই, ইশা জেদ ধরে ওরাও ওড়াবে! শিশির-বিন্দুদের গ্রুপ থেকেও বেশ অনেক গুলোই ফানুস ওড়ে আশারের দিকে যায়! বিন্দু আবার ব্যাম্বু টি খেতে চায়,, এবার সন্ধ্যার তারাভরা আকাশ দেখতে দেখতে খাবে! সবাই ওর সাথে তাল মিলালো,, মৃদু হাওয়ায় চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সবার এমন অনুভূতি হয় মনে হয়, এটাই সাজেক ভ্রমণের সবচেয়ে বড় আনন্দ! আর যারা তারা দেখতে ভালোবাসে, তাদের জন্য হ্যালিপ্যাড সাজেক খুবই আদর্শ একটি জায়গা! যেমন আমাদের বিন্দু, তাইতো শিশির ওকে এখানে নিয়ে এলো! এমনকি যারা এখনও মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গা ছায়াপথ দেখেনি, তারাও সাজেক ভ্যালিতে এসে জীবনে প্রথমবারের মতো দেখতে পারবে, “মহাবিশ্বে আমাদের আশ্রয়স্থল আকাশ গঙ্গার”!

আজকেও সবাই একসাথে বসেছে অনেকদিন পর! অনেক রাত পর্যন্ত হ্যালিপ্যাডে আড্ডা দিবে স্থির করলো! সবাই গোল হয়ে বসেছে,, বিন্দু মেঘকে কোলে নিয়ে বসেছে! ওর একপাশে শিশির আরেক পাশে রুদ্রা তার পাশে ইন্দু.. ইন্দুর পর রিমি, নীল, নীরা, রাফান,নকশা,নাদিয়া, রিদম, রাফিন, রাফেজ, সিহাব,নিশান্ত,নিশা,রুশা,অজান্তা, ইশা,তৃষা, তিয়াশ, রুহান! এভাবে একজনের পর আরেকজন গোল হয়ে বসেছে সবাই,, আর সিফাত তার স্বভাব মতোই গিটারে টুং টুং শব্দ তুলছে! শিশির বলে ওঠে, সিফাত একটা গান ধরো! সিফাত তখন বলে ও একা গাইবে না, গাইলে সবাই একসাথে! সিফাত গিটার বাজিয়ে গায় আর বাকি সবাই তাল মিলিয়ে একসাথে গেয়ে ওঠে,,,

কথা হবে দেখা হবে,
প্রেমে প্রেমে মেলা হবে
কাছে আসা আসি আর হবে না..
চোখে চোখে কথা হবে,
ঠোঁটে ঠোঁটে নাড়া দেবে
ভালবাসা-বাসি আর হবে না..
শত রাত জাগা হবে,
থালে ভাত জমা রবে
খাওয়া দাওয়া কিছু মজা হবে না..
হুট করে ফিরে এসে,
লুট করে নিয়ে যাবে
এই মন ভেঙে যাবে জানো না..
আমার এই বাজে স্বভাব
কোনোদিন যাবেনা..
আমার এই বাজে স্বভাব
কোনোদিন যাবেনা!

ভুলভাল ভালবাসি,
কান্নায় কাছে আসি
ঘৃণা হয়ে চলে যাই থাকি না..
কথা বলি একাএকা,
সেধে এসে খেয়ে ছ্যাঁকা
কেনো গাল দাও আবার বুঝি না..
খুব কালো কোনো কোণে,
গান শোনাবো গোপনে
দেখো যেনো আর কেউ শোনে না..
গান গেয়ে চলে যাবো,
বদনাম হয়ে যাবো
সুনাম তোমার হবে হোক না..
আমার এই বাজে স্বভাব
কোনোদিন যাবেনা..
আমার এই বাজে স্বভাব
কোনোদিন যাবেনা!

যদি তুমি ভালোবাসো,
ভালো করে ভেবে এসো
খেলে ধরা কোনো খানে রবে না..
আমি ছুঁয়ে দিলে পরে,
অকালেই যাবে ঝরে
গলে যাবে যে বরফ গলে না..
আমি গলা বেচে খাবো,
কানের আশেপাশে রবো
ঠোঁটে ঠোঁটে রেখে কথা হবে না..
কারো একদিন হবো,
কারো একরাত হবো
এর বেশি কারো রুচি হবে না..
আমার এই বাজে স্বভাব
কোনোদিন যাবেনা..
আমার এই বাজে স্বভাব!

আজ অনেকদিন পরে ইন্দুর মনটা একটু ভালো হলো! কারণ অনেকদিন যাবৎ রোদের সাথে ওর কন্টাক্ট নেই ওর, ইন্দু ইচ্ছে করেই কন্টাক্ট রাখেনি! তবে এবার ওর বাড়ির লোকের বারণে না, ও নিজে থেকেই! সবাইকে এই ব্যাপারটা মাঝে মাঝে ভাবায়, ইন্দুর এতো পরিবর্তন কিভাবে হলো! রোদের সাথে বিন্দুর অনেকবারই কথা হয়েছে, যতবার কথা হয় ও শুনেছে রোদের অবস্থা খারাপ! বিন্দুর ডানমন্ডি ফ্ল্যাটেও দু- একবার এসেছে রোদ,, ওকে দেখে বিন্দুর মনে হয়েছে ও কোন বনমানুষ! বিন্দুরও অনেক খারাপ লেগেছে,, সেও তো একবার ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে পাগল হয়েছিলো! তাই সে বোঝে, ভুল জায়গায় নিজে পাগলামী করলেও লাভ হয় না! ইন্দু কেনো এমন করছে সেটা বিন্দু বা ওর ফ্যামিলির কেওই জানেনা হয়তো ওদের কথাই মেনে নিয়েছে! যে মেয়ে বলেছে, “ও মরে যাবে তাও রোদকে ছাড়বে না তার হঠাৎ কি হয়েছে?”

হঠাৎ করেই নিশান্ত বলে ওঠে,,

নিশান্তঃ রাফেজ ভাইয়া, তুমি কিন্তু তোমার আর নকশা আপুর প্রেম-কাহিনী অসমাপ্ত রেখেছিলে! বলেছো আবার একদিন সময় করে বলবো, তবে আজকে বলো!

সবাই নিশান্তের কথায় হ্যা সম্মতি জানায়,,

রাফেজঃ তোরা হঠাৎ আমাদের নিয়ে কেনো পড়লি?

রুশাঃ বলোনা জিজু,,

রাফেজঃ আচ্ছা তাইলে শোন, ওইদিনের ঠিক দুই দিন পর চট্টোগ্রামে চলে যাই! দীর্ঘ চার মাস আমাদের আর কোন সাক্ষাত নেই! আমার সব-সময় ভয় লাগতো, আমার শ্যামাঙ্গী কে হারিয়ে ফেলবো না তো! অনেক কষ্টে চার মাস পার করি,, তারপর পরীক্ষা শেষে যখন একবারে গ্রামে যাই, তখন রিমার সাথে আমি কন্টাক্ট করি! ওই বার প্রথম রিমার সাথে কথা বলতে হয়,, তাও তোদের আপুর জন্য! ওর কাছেই তোদের ফ্যামিলি ডিটেইলস জানতে পারি,, আর এটাও শুনি নকশাকে নাকি বিয়ে দিতে চেষ্টা করছে! আমি তখন দিশেহারা হয়ে পড়ি, কি করবো? আমার তো মাত্র স্টাডি কমপ্লিট হলো,, জবও পাইনি! তাও বাবার কাছে একটা অদ্ভুত জেদ করি আর তা হলো যেভাবেই হোক আমি এই মেয়েকে এখনই বিয়ে করবো! বাবা তো কোন মতেই রাজি ছিলো না,, দু’দিন বাড়িতে যাইনি! পরে আমার মা আমার বাবাকে বুঝিয়ে তোদের বাড়িতে বিয়ের প্রপোজাল পাঠায়! তোদের বড়ির সবাই রাজিও হয়ে যায়,, কারণ নকশা কে তো বিয়ে দিতোই! আর আগেই বলেছিলাম আমার বাবার প্রভাব ছিলো গ্রামে,, এমনকি নদীর ওপাড়ের গ্রামেও! তাই তারা আর না করেনি,, আমাকে ছাড়া এতো ভালো ছেলে পেতি তোদের আপুর জন্য?

বিন্দুঃ পেতাম না? আমার আপু কি কম সুন্দর নাকি! এই জন্যই তো আপনে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন,, আর বিয়ের জন্য ২ দিন বাড়িও ফিরে আসেননি!

উপস্থিত রাফেজ সহ সবাই হেসে ওঠে বিন্দুর কথায়!

সিফাতঃ আচ্ছা ভাইয়া আপনে নকশা আপুর সাথে কখনো কথা বলেন নি বিয়ের আগে?

রাফেজঃ অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু মহারানীর মন জয় করা এভারেস্ট জয় করার মতো! তাই পলিসি করে আগে বিয়ে করে নেই তারপর সেই এভারেস্ট জয় করেও ফেলি,, হা হা হা!

এভাবে সবাই একসাথে আড্ডা দিতে থাকে রাত ১০ টা পর্যন্ত! সাজেকের হ্যালিপ্যাডে এরকম আড্ডা দেওয়ার সুযোগ হয়তো সেভাবে আর কখনো হবেনা! জীবন কত সুন্দর তাইনা, প্রকৃতির মাঝে যদি নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া যায় তাহলে জীবন আরো সুন্দর হয়ে ওঠে! শীতের প্রকোপে আর বেশিক্ষণ থাকতে পারলো না কেও! তাই সবাই রিসোর্টে ফিরে যায়! সবাইকে রিসোর্টে পৌঁছে দিয়ে,, কিছুক্ষন বসে শিশির, রাফেজ আর নীল বের হলো,, তিন জন গিয়ে এক হোটেলে “ব্যাম্বু চিকেন” অর্ডার করলো! ঠান্ডার ভিতরে ঝাল মশলা বেশি দিয়ে গরম গরম ব্যাম্বু চিকেন ভালোই লাগে, নীল ঝাল বেশি খাবে তাই আগেই বলে দেয়! রাত ১১:৩০ এর দিকে আড্ডা দিয়ে সবার জন্য ব্যাম্বু চিকেন সাথে আরো খাবার নিয়ে রিসোর্টে ফিরলো ওরা!

#চলবে…

[ গল্প একদম শেষ পর্যায়☺️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here