শিশির বিন্দু পর্ব ২২

0
460

#শিশির_বিন্দু❤️
লামিয়া সুলতানা সিলভী ( লেখনীতে)
পর্বঃ২২

পাহাড়ের রাণী বা মেঘের স্বর্গ যাই বলি না কেনো,, সাজেক দেশের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা গুলোর মধ্যে অন্যতম! সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮০০ ফুট ওপরে পাহাড় আর মেঘদের খেলা যে কাওকে মুগ্ধ করবেই! সাজেকে সর্বত্র মেঘ, পাহাড় আর সবুজের দারুণ মিতালী দেখতে এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়! আগেই বলেছি, এখানে তিনটি হেলিপ্যাড আছে,,যা থেকে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের অপূর্ব দৃশ্য প্রত্যক্ষ করা যায় দারুণ ভাবে! চারপাশে মনোরম পাহাড় সারি, সান্নিধ্যে সবাইকে করে তুলবে চমৎকৃত! কখনো খুবই গরম, একটু পরেই হয়তো চারদিকে ঢেকে যায় মেঘের চাদরে এবং তারপরেই দেখা যায় বহঠাৎ বৃষ্টি! এই বৃষ্টির পরপরই আবারো ঘুরে একরাশ মেঘের দল সাজেক কে বানিয়ে দেয় সাদা উপত্যকা! ঠিক এমনই মনোমুগ্ধকর সাজেক ভ্যালির আবহাওয়া,, প্রাকৃতিক নিসর্গ আর তুলোর মত মেঘের পাহাড় থেকে পাহাড়ে উড়াউড়ির খেলা দেখতে সাজেক আদর্শ জায়গা!

সকালে ঠিক ৫ টার দিকে শিশির এসে বিন্দুর ফোনে কল দিয়ে ঘুম হতে ডেকে তুললো,, তার প্রিয়তমাকে এক অদ্ভুত ভিউ দেখাবে বলে! তখনও ভোরের আলো ফোটেনি ঠিক মতন! শিশির বিন্দুকে কটেজের বেলকোনিতে নিয়ে গেলো,, মেঘের উপরে ওদের কটেজ ছিলো! বিন্দু চোখ ডলতে ডলতে বাহিরে এসে দেখ মেঘে সব ঢেকে গেছে! বেলকোনিতে পা রাখতেই খুশীতে মন ভরে ওঠলো বিন্দুর! চারোদিকে অসংখ্য পাহাড়, একটার সাথে আরেকটা কেমন ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে! বিন্দু এটা দেখে পুরো বাকরুদ্ধ হয়ে যায়,, অনেক্ষন দাঁড়িয়ে গল্প করে এক জোড়া কপত-কপতী! ৫.৩০ এর দিকে যখন আলো ফুটতে শুরু হয় তখনকার ভিউ এর সাথে বিন্দুর দেখা গতকাল বিকেলে সাজেকের কোন মিল খুজে পায় না সে! এই সময়ে সাজেক তার আসল রূপ নিয়ে হাজির হয়েছে,, চারপাশে শুধু মেঘ আর মেঘ! চারপাশের পাহাড় গুলাও মেঘের চাদরে ঢেকে আছে! বিন্দুর ঠিক এই মুহুর্তে মনে হয়, পাহাড়গুলার উপরে মেঘের চাদরে বিছানো! এ যেনো অন্যরকম মেঘময় এক পৃথিবীর,, এখানে ক্ষণে ক্ষণে প্রকৃতি তার রূপ বদলায়! বিন্দুর চোখের পলকেই চারপাশ ঘোমটা টানে সাদাকালো মেঘে,, এ যেন মেঘের উপত্যকা, মেঘেদের রাজ্য আর নিজেকে মনে হচ্ছে মেঘের রাজ্যের বাসিন্দা! বিন্দু হয়তো মনের অজান্তেই খুঁজতে থাকে সাদা মেঘের পরি অথবা মেঘের মধ্যে পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় চড়ে ছুটে চলা রাজপুত্রকে! শিশির দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু তার বিন্দুবালার কান্ড দেখছে,, এই জন্যই তো ওকে ডেকে তুললো! তবে এগুলো দেখার অধিকার কি একমাএ তার বউয়ের? না, সবারই আছে তাইতো সবাইকে ডেকে তুলে! কারণ এখনো পুরোপুরি সূর্য উদয় হয়নি,, তাই শিশির ওদের সবাইকে নিয়ে সোজা দুই নম্বর হেলিপ্যাডে চলে যায়, এখান থেকে সূর্য উদয় দেখাবে বলে! এবারের দৃশ্যটা আরো অসাধারণ ও নৈসর্গিক,, ঐ দূর পাহাড়ের ঢালে শুভ্র মেঘ আর সবুজের মিলন এক অন্যরকম অনুভূতি তৈরী করে! সাজেকে সূর্যোদয়ের সময় সোনালি আভা সাদা মেঘের ওপর যখন ঠিকরে পড়ে, তখন অসাধারণ এক দৃশ্যের অবতারণা হয়! বিন্দুর চোখে পরে মেঘের সাদার সাথে অরণ্যের সবুজের এক অপরূপ সংমিশ্রণ! তিন তিনটি হেলিপ্যাড থাকায় সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অপরূপ সব সৌন্দর্য খুব সহজেই দেখা যায়! তাইতো কবির বলেন–

“সাঁঝের বেলা শেষে, নীল আকাশ জুড়ে ঝলঝল করে জ্বলে তারার দল!
মেঘলা আকাশ স্বপ্ন বুনে, নিয়ে এক চোখে রোদ আর অন্য চোখে জল!”

সূর্য উঠার কিছুক্ষন পরেই ওরা হেলিপ্যাডে আর বেশি দেরি করলো না! নিচে “ঝাড়ভোজ” পার্কে যাবে জন্য,, দেরি করলেও ঢোকা যাবে কিন্তু তখন ভীড় হয়ে যাবে! তাড়াতাড়ি গেলে ভালো করে সব দেখা যাবে+ ছোটগুলো ছবিও তুলতে পারবে! আর সাথে মেঘের অসাধারণ ভিউ তো আছেই,, ভালো ভালো কটেজ গুলা সব এই দিকেই মুখ করে করা! তাই বোঝাই যাচ্ছে কেমন ভিউ হতে পারে! এখানে কিছু সময় কাটিয়ে পুরা সাজেক টা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগে সবাই! পাহাড়ি তাজা ফরমালিনমুক্ত পেঁপে, কলা, আনারসও ওরা খায়!

যতদূর চোখ যায় ততদূর ছোট-বড় সবুজ পাহাড় দেখতে পায় সবাই! দৃষ্টি যেদিকে যায় সেদিকেই সবুজের সমুদ্র,, উপর থেকে দেখলে মনে হয় সবুজ সমুদ্র ঢেউ খেলার মতো মেঘ, প্রতিনিয়ত ছুটে চলছে এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত! আমার দেশ বাংলাদেশ এতো অপরূপ, তা সাজেক না থাকলে হয়তো বোঝাই যেতো না! বিন্দু মনে হঠাৎ করে প্রশ্ন উদয় হলো, মেঘ আর পাহাড়ের সৌন্দর্যে ঘেরা সাজেকের ইতিহাস কেমন ছিলো! তাই সে শিশিরকে জিজ্ঞেসও করে ফেলে..

শিশিরঃ সাজেকের সর্বোচ্চ চূড়া মানে কলাংক পাহাড়ে দাঁড়িয়ে যে মেঘকে স্পর্শ করতে পারবে সেই মেঘ কিন্তু কাচালং, মাচালং বা কর্ণফুলি সৃষ্ট মেঘ না! সেই মেঘ হলো আদিবাসী খুকি সম্প্রদায় চোখের জল গড়িয়ে পড়ে,, আকাশের শূণ্যতায় সৃষ্ট হওয়া কৃত্রিম মেঘ! সেই মেঘ জানিয়ে দেয়, কত মানুষের সপ্নের পাহাড় ভেঙে এখানে মনোরঞ্জন এর জন্য এসব গড়ে ওঠেছে!

আরো কিছুক্ষন পরে সেখান থেকে সবাই “সাজেক চিলেকোঠা” রেস্টুরেন্টে যায়! এখানে খাবার অর্ডার দিতে হলে অনলাইনে দিতে হয়,, আর পছন্দমতন প্যাকেজ গুলোও আগে থেকে বলে রাখতে হয়! তাই শিশির হ্যালিপ্যাডে থাকাকালীন অর্ডার করেছিলো,, শিশিরের অর্ডার করা প্যাকেজগুলোর মধ্যে ছিলো– ব্যাম্বু চিকেন, খুদের খিচুড়ি, বার্বিকিউ, হালা ভুনো আরো অনেক কিছু!

নাস্তা শেষ করে সবাই আবার রিসোর্টে ফিরে এলো,, তারপর রেডি হয়ে ১০ টার দিকে চাঁদের গাড়ি করে কংলাক পাহাড় জয় করতে যায়! অনেকে চাঁদের গাড়ীতেই করেই পাহাড়ের কাছে গিয়েই নামছে কিন্তু শিশির বলে এতে বেশি মজা নেই,, তবে এখন হেঁটেও যাওয়া সম্ভব না! ও একা হলে হেঁটেই যেতো কিন্তু এখানে অনেক বাচ্চারা আছে+ মেঘকে নিয়ে বিন্দু ওঠতেও পারবে না! এই সব পথ গুলা গাড়ি বা বাইকে যাওয়া মানেই অনেক কিছু মিস করা কিন্তু ওদের কিছু করার নেই! চাঁদের গাড়ি করেই সবাই কংলাক পাহাড়ে উঠা শুরু করে,, আস্তে আস্তে ওপরে ওঠে! তবে সবাই বেশি আশ্চর্য হয় পুরো মেঘ যেনো ওদের ঘিরে রেখেছে,, আর মেঘ এতোই ঘন যে পাশে কে দাঁড়িয়ে আছে তা বোঝা যাচ্ছে না! সাথে হালকা শীতল হীম করা বাতাস + গাড়ির বাতাস সবার বেশ ঠান্ডা লাগছে এমনিতেই এখন শীতকাল! কি মনোরম দৃশ্য সেটা, চারিপাশ মেঘে ঢাকা, বাতাসের ছন্দে মেঘ যেনো খেলা করছে! কংলাক পাহাড়ে ওঠার পরে মনে হলো,, এটাই হচ্ছে সাজেক! এতো সুন্দর আর যে পথ দিয়ে ওরা সাজেক এসেছিলো সেটাও দেখতে পাওয়া যায়! চারিদিকে পাহাড় গুলা তো আছেই,, সবাই কি খুশী মনে হচ্ছে এটা কি কোন স্বর্গ? সবার মন যেনো এক ধাক্কায় ভালো হয়ে যায়! শুরু হলো কলাংক পাহাড় যাত্রা! পাহাড়ে ওঠে ওরা চাঁদের গাড়ি ছেড়ে দেয়,, এখন বকিটুকু হেটেই যাবে!

কংলাক পাহাড় হচ্ছে সাজেকের সর্বোচ্চ চূড়া! এই চূড়ায় উঠতে উঠতে দেখতে পাওয়া যায় মিজোরাম সীমান্তের বড় বড় পাহাড় আর সবুজের মিতালি! আদিবাসীদের জীবনযাপন, চারদিকে মেঘের আনাগোনা কংলাকে যাওয়ার পথে মিজোরাম সীমান্তের বড় বড় পাহাড় এসবকিছু ওদের সবার দৃষ্টি কেড়ে নেয়! সবাই পাহাড়ের আঁকা-বাঁকা পথে ছুটে চলছে,, মাঝেমাঝে আবার থেমে যাচ্ছে! দুচোখ ভরে পাহাড়ের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য চাক্ষুষপাতে নিমজ্জিত করছে! ইন্দু, তৃষা, রুশা,নিশা, নীরা, ইশা আর অজান্তা রাস্তা ছেড়ে পাহাড়ের গা বেয়ে চড়তে শুরু করে! পাহাড়ি ফুলগুলো হাতে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে,, পাহাড় বেয়ে নামার পথে শিশির বিন্দুর হাত শুক্ত করে ধরে নামাচ্ছে আর মেঘকেও ও কোলে নেয়! এতোদিন সাজেকের উঁচু পাহাড় থেকে নিচের ভ্যালির জমানো মেঘের সৌন্দর্য দেখেছে আর আজ ওরা নিজেরাই নিচের দিকে অগ্রসর হচ্ছে! এসব পথেও সারাটা সকাল মেঘ ছিলো,, এই মেঘের পথ ধরেই সবাই এগিয়ে যাচ্ছে!

কংলাকের চূড়ায় উঠে চারপাশে তাকালে সত্যি সত্যি ভুলে যাওয়া যাবে,, কোনো যান্ত্রিক নগরে দূষিত বাতাস, শব্দ এবং কর্কট সমাজে জন্ম নেওয়া মানুষের কথা! আপনা-আপনি মন, প্রাণ, দেহ পুলকিত হবে এক বিশুদ্ধ চিন্তা এবং অনুভূতিতে! কংলাক পাহাড় থেকে রাঙামাটির সব পাহাড় ছোট লাগে, মনে হয় সারা রাঙামাটি একনজরে দেখার জন্য এটাই পারফেক্ট জায়গা! উপর থেকে যতই মসৃণ মনে হতো ততোই দূর্গম মনে হলো এই পথে হাটতে এসে,, অচেনা বুনো পরিবেশ টেকিং করে নিচে নামার সময় মিললো শীতল জলের ঝিরি পথ! অন্যসব ঝিরির মতো এটাও পাথরে ঠাসা! দীর্ঘ পথ পাহাড় বেয়ে নামার পর এমন ঝিরিটা সবার মধ্যে কিছুটা বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ করে দিলো! দু’টো পাহাড়ের মাঝে বয়ে যাওয়া ঝিরি পথ ধরে কিছুদূর হেঁটে গেলো সবাই! আরও সামনে ছোট বড় পাথর ডিঙিয়ে পানির স্রোত বয়ে যাচ্ছে উপর থেকে অনবরত! নিঃশব্দের পাহাড়জুরে ঝিরির এমন পথ চলা সত্যিকারের বন্য স্বাদ এমন এনে দেয় প্রকৃতিতে!

ঝিরিতে বিশ্রাম নিতে সবাই ব্যাস্ত,, তখন রুহান প্রাকৃতিক কিছু দৃশ্য ক্যামেরায় বন্দি করে আর সাথে সবার আড়ালে ইন্দুরও কিছু ছবি তুলে নেয়! এই কয়েকমাসে রুহান আর ইন্দুর সম্পর্ক অনেকটাই এগিয়েছে! ইন্দুর ক্ষেত্রে তা হয়তো বন্ধুত্ব কিন্তু রুহান রীতিমতো ইন্দুকে ভালোবাসে! ওদের বিয়েও ঠিক হয়েছে,, কিছুদিন পরেই ওদের বিয়ে!

এসবকিছু আর কেও খেয়াল না করলেও নীরা ঠিকই করেছে! সে রুহানকে ভালোবাসে কি না জানে না তবে ওর খুব পছন্দ রুহানকে! রুহানের সবকিছুই নীরাকে মুগ্ধ করে,, কথা বলা, হাটা-চলা, এটিটিউড সব! কিন্তু কোন লাভ নেই,, সে তার ওডবি কে নিয়ে দিব্বি আছে! কিছুদিন পরেই বিয়েও হয়ে যাবে ওদের, ভাবতেই নীরার খুব কষ্ট হয়! নীরার ইন্দুকে খুব পছন্দ, ইন্দু আসলেই অনেক ভালো ব্যাক্তিত্তের! বয়সেও নীরার থেকে অনেক বড় কিন্তু কেনো যেনো ইন্দুকে নীরা হিংসে করে,, হয়তো রুহানের জন্যই!

পাহাড় বেয়ে নামতেই বড় বড় পাহাড় ডিঙিয়ে সবার চোখ পড়ে ঝড়র্ণার দিকে,, কি অপরূপ সেই দৃশ্য! উচু পাহাড়ে খোজ বেয়ে উপর থেকে দুভাগে পড়ছে ঝর্ণা,, তীব্র শব্দ ঘিরে রেখেছে এই অচেনা পরিবেশ! সুনসান নীরব পাহাড়ের মধ্যে একমাত্র শব্দ যেনো এই জলের ধারা! অনবরত উপর থেকে বয়ে আসা এই পানির স্রোত বন্ধী করে নিলো সবার নজর! পানি হীম শীতল বলে এই শীতকালে পা ও ফেলতে ইচ্ছে হলো না কারোর, তবে শিশির বেশ উপভোগ করছে পানির স্রোত! কারণ সে আগের থেকেই জানে এখানে এমন হবে! কিছুক্ষন ঝর্ণার শব্দ উপভোগ করে ওরা কলাংক পাড়াতে যায়!

কংলক পাড়া সাজেকের সবচেয়ে শেষ গ্রাম! এই গ্রামটির প্রধানও লুসাই সম্প্রদায়! কংলক পাড়ার প্রধানের নাম চৌমিংথাই লুসাই! কংলাক পাড়াও সমতলভূমি হতে বেশ উপরে অবস্থিত,, তবে এর উচ্চতা মাপা হয়নি আজও! কংলাক পাড়া সাজেক ভ্যালির শেষপ্রান্তে অবস্থিত বলে এর উপর থেকে ভারতের লুসাই পাহাড়সহ অন্যান্য পাহাড়গুলো খুব সহজেই দেখা যায়! পাহাড়চূড়ার ছোট্ট গ্রামটিতে ত্রিপুরা ও লুসাই নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস,, জুম চাষ এ পাড়ার প্রধান খাদ্য ও উপার্জনের উৎস! বেশি চাষ হয় হলুদ, আদা ও কমলার! কংলাকে পানি সংকটও রয়েছে,, প্রতিটি বাড়িতেই চোখে পড়বে একাধিক ও বড় বড় পানির রিজার্ভার! বৃষ্টির জমানো পানিই এ পাড়ার পানির মূল উৎস! অধিবাসীরা ঘরের চালা থেকে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে রিজার্ভারে ধরে রাখেন আর এটা দৈনন্দিন কার্যাদি সম্পন্ন করেন!

কংলাক পাহাড়ের উপরেই কংলাক পাড়া অবস্থিত!সাজেক ভ্যালি মূলত রুইলুই পাড়া এবং কংলাক পাড়ার সমন্বয়ে গঠিত! চারদিকে পাহাড়, সবুজ আর মেঘের অকৃত্রিম মিতালী চোখে পড়ে! সাজেক ভ্রমণরত পর্যটকদের কাছে এটি এখন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে! রুইলুই পাড়া হতে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরত্বে এটি অবস্থিত! কলাঙ্ক পাহাড়ের মাথায় প্রায় ৩০টি বাড়ি নিয়ে গড়ে ওঠেছে এই গ্রামটি! এখানে প্রতিটি বাড়ীর সামনেই রয়েছে ফুলের বাগান,, ১৮০০ ফুট উচ্চতায় এই পাড়ায় রয়েছে পাংখোয়া আর ত্রিপুরা জনগোষ্ঠির প্রায় ৩০টি পরিবারের বসতি! ওই চূড়ায়ও স্থানীয় আদিবাসীদের দোকানের দেখা যায়,, চলে ভরপুর নাস্তা আর মনোরম সবুজ পাহাড় দেখার প্রতিযোগিতা!

রাফেহঃ আচ্ছা শিশির তুমি তো এখানে অনেক এসেছো, আমার জানামতে, এখানকার আগের আদিবাসীরা তো আগে জুম চাষ করতো তাইলে সাজেক কিভাবে হলো?

শিশিরঃ হ্যা, ৬০ টি পরিবারকে উচ্ছেদ করে কেড়ে নেওয়া হয়েছিলো তাদের বাপ-দাদার বংশ পরম্পরায় চাষ করে আসা একমাত্র সম্বল জুম চাষের পাহাড়গুলোকে,, আর আজ এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে এখন সাজেক! তবে ব্যাপারটা আমরা কখনো সেভাবে ভাবি নী,, সত্যি বলতে আমরা বাহিরের চাকচিক্যের প্রতি এতোটা মুগ্ধ হয়ে পড়ি যে এর ভেতরটা যাচাই করার প্রয়োজন মনে করি না! প্রশাসনের এই ব্যাপারটার প্রতি দৃষ্টি দেওয়া উচিত ছিলো,, এখানকার আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে সাজেকের সৌন্দর্য বাড়িয়ে লাভ নেই! সাজেকের আসল সৌন্দর্য এখানে বসবাসরত আদিবাসীদের মধ্যেই নিহিত! যাই হোক,, খুব ক্ষুদা লেগেছে চলো সবাই কিছু খেয়ে নেই! এখানে স্থানীয় “পানখাই পাড়া” একটা জায়গা আছে,, সেখানে গিয়ে নিজেদের ইচ্ছায় যা বলবো বানিয়ে দিবে!

শিশির তারপর সবাইকে নিয়ে পানখাই পাড়া নামক স্থানে গিয়ে খেয়ে আসে! এর পাশেই রয়েছে নিউজিল্যান্ড পাড়া,, তাই সেখানে খেতে গেলে এই স্থানটিও ঘুরে আসা যায়! তাছাড়া আদিবাসীদের সাথে বসে তাদের ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্বাদ নিতে চাইলে অবশ্যই রুইলুই ও কংলক পাড়ায় এখানে আসতে হবে! এখানে শিশির আগে থেকেই তাদের বলে দিলো, কি কি খাবে তারাই সবার পছন্দ মতো তৈরী করে দিলো খাবার! নাস্তা শেষ করে আবার চলে মনোরম সবুজ পাহাড় দেখার প্রতিযোগিতা!

ওরা সবাই রুইলুই আর কংলাক পাড়াতে পৌঁছেছে অনেক্ষন আগেই! রুইলুই পাহাড় আর কংলাক পাহাড় এই দুটি পাহাড়ে সমন্বয়েই সাজেক গঠিত! ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত রুইলুই পাড়ার উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৭২০ ফুট! আর ১৮০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত কংলাক পাহাড়-এ কংলাক পাড়া অবস্থিত! সাজেকে মূলত লুসাই ,পাংখোয়া এবং ত্রিপুরা আদিবাসী বসবাস করে! শিশির সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঘুরে নিয়ে আসে ওদের,, ইশারা গিয়ে অনেক ছবিও তোলে ওদের সাথে! ওদের সাথে আরো অনেক গল্পও করে!

শিশিরঃ বছরের নির্দিষ্ট সময়ে অনুষ্ঠিত আদিবাসীদের উৎসবের সময় তাদের সংস্কৃতির নানা উপকরণ পর্যটকরা উপভোগ করে! কিন্তু, র্দূভাগ্যবশত এখন কোন উৎসব নেই যে তোমরা দেখতে পারবে! সৃষ্টিকর্তা আমাদের অপার সৌন্দর্যে ভরা একটি দেশ দিয়েছেন,, আর তাই দেশের পর্যটনশিল্প আমরা দেখতে পারি! এদের প্রতি দায়িত্ববান এবং যত্নশীল হওয়া আমাদের দায়িত্ব! আমার মতে, মানুষের জীবনে জানার এবং অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার কোনো শেষ নেই!

নীলঃ সাজেকের কলা আর কমলাও বেশ বিখ্যাত!

শিশিরঃ হুম,, খাওয়াবো সবাইকে!

নিশাঃ জিজু এখন আমরা কোথায় যাচ্ছি? (শিশিরের দিকে তাকিয়ে)

শিশিরঃ এখন আমরা কলাংক পাড়ার শেষের দিকে যাবো! এখানে সাজেক বিজিবি ক্যাম্প অবস্থিত,, সাজেকের বিজিবি ক্যাম্প বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উঁচুতে অবস্থিত এই বিজিবি ক্যাম্পটি! বিজিবি সদস্যদের সুষ্ঠ পরিকল্পনায় , বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের দ্বারাই বর্তমান সাজেকের এই ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভম হয়েছে! বর্তমানে সাজেকে ভ্রমণরত পর্যটকদের জন্য প্রায় সকল ধরণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়! সারাবছরই সাজেক আসা যায়,, আর সাজেকে পাহাড়ধস বা রাস্তাধস এরকম কোন ঝুকি নেই!

নিশাঃ আমার এইটুকু একটা মাথায় তোমার বলা কোন কিছুই ঢুকলো না! (অবুঝের মতো ভাব নিয়ে)

নিশান্তঃ তুই যে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী,, এই জন্য তোর মাথায় কিছুই তো ঢোকে নাই!

সিফাতঃ আমার বউরে প্রতিবন্ধী বলার সাহস পাও কেমন সালাবাবু?

নিশান্তঃ ও তোর বউ কবে হল? ( ভ্রু কুঁচকে)

সিফাতঃ ওইযে বিন্দু আপুর বিয়ের পরের দিন থেকে! আরে মামা তোর মনে নেই? তুই আমারে শালা কইছিলি বাট সেইটা তো আর হলো না কারণ আমার ছোট ভাই আছে বলে,, এই জন্য আমিই তোরে সালা বানায় দিসি!

নিশান্ত গিয়ে সিফাতকে মারতে থাকে,,

নিশান্তঃ শালা তুই আমার বোনের দিকে নযর দিবি না! তোর নিজের গার্লফ্রেন্ড থাকতেও আমার বোনের দিকে নযর!

রুশাঃ নিশান্ত দাদা, সিফাত ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড কে?

নিশান্তঃ তোকে বলতে হবে?

নকশাঃ নিশান্ত, ভাই তুই এতো ভেজাল কেমনে লাগাস? কখনো ফ্রি থাকোস না?

নকশাঃ বড় আপু,,( মন খারাপ করার ভাব নিয়ে)

ইন্দুঃ নিশান্ত ভাইয়া, রুশা কিন্তু ঠিকই বলেছে? সিফাত ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড কে তাড়াতাড়ি বলো?

সিফাতঃ নিশান্ত তোরে তো আইজকা আমি মাইরা ভুত কইলামামু!

দুজনের ধস্তাধস্তি শুরু,, বিন্দুর চিৎকারে সবাই শান্ত হয়,,,

বিন্দুঃ দু’টোকেই পাহাড় থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিবো,, শয়তান দু’টো!

নিশান্তঃ বিন্দু আপু, সিফাত তোমার ফুপাতো ভাই আর আমি মামাতো ভাই তো সেই হিসেবমতো আমরা বেয়াই! ও আমাকে মারার সাহস পায় কেমনে বলোতো?

সিফাতঃ ওহ আচ্ছা,, আমি তোর বেয়াই হই তুই হোস না,, তুই আমারে মারসোছ কিল্লাই?

অজান্তাঃ সিফাত ভাইয়া, তোমার ল্যাংগুয়েজ আর ঠিক হলো না! ঢাকার মানুষ কি এভাবে কথা বলে?

সিফাতঃ দুই দিনের বৈরাগী ভাতেক কয় অন্য! থাপড়া দিয়া গাল ফাটায় দিমু তোর,, দাড়া আজকেই খালামুণিরে কল দিয়া তোরে শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর ব্যাবস্থা করতেছি!

তিয়াশঃ সিফাত ভাইয়া, ঠিক বলেছেন! দুই বান্ধুবীই সমান,, এইযে আমাদের পেত্নী ইশা এটারও একটা ব্যাবস্থা করতে হবে চাচ্চুকে বলে!

ইশাঃ আমি এখনো বাচ্চা,, হুহ আমার আগে তৃষা আপু!

নিশান্ত একবার ইশার দিকে তাকালো তবে কিছু বললো না,, নিশান্ত আর ইশাকে ডিস্টার্ব করে না! আর সেটা তিয়াশের জন্য! তিয়াশ একবার বলেছিলো না ইশাকে,, ও নিশান্তকে দেখে ছাড়বে! আর তিয়াশের যে রাগ, তিয়াশই কিছু একটা করেছে সবার অগোচরে তাই আর নিশান্ত ইশাকে ডিস্টার্ব করে না! আর এটাও জানিয়েছে ইশা শুধু তিয়াশের ওর দিকে তাকানোর অধিকার আর কারোর নেই!

শিশিরঃ এই সবাই চুপ,, আসল কথাই শোন হচ্ছে না! সিফাত তোমার গার্লফ্রেন্ড কে?

সিফাতঃ আরে না, জিজু তেমন কিছু না! ( ঘাড়ে হাত দিয়ে)

নিশান্ত ফট করেই বলে ওঠে,,

নিশান্তঃ পুষ্পা!

সবাই নিশান্তের দিকে চোখে স্থির করে সিফাতের দিকে তাকায়,,,

রাফেজঃ কোন পুষ্পা?

নিশান্তঃ ওইযে বিন্দু আপুদের দোতলার ভারাটে!

সিফাতঃ ভালো হলো না কিন্তু নিশান্ত! (রেগে)

ইন্দুঃ আমাদের পুষ্পা? ও মাই গড,, তুমি আমাদের আড়ালে এতোদূর?

ওরা কথা বলতে বলতে বিজিবি ক্যাম্পে এসে পৌছায়!

শিশিরঃ এই পাড়াটির পাশে বড় বড় কমলা বাগান আছে তাই এটিকে কমলাক পাড়া বলা হয়! পাহাড়ের নিচে কংলাক ঝর্ণা অবস্থিত এবং এই ঝর্নার নামানুসারেই এই পাহাড়ের নামকরণ করা হয়েছে কমলাক পাড়া!

রুদ্রাঃ আচ্ছা বাবাই, কলাংক পাড়ার অপর নামই কি কমলাক পারা?

শিশিরঃ আমার সোনাটা এততো বোঝে!( কোলে নিয়ে) হ্যা মাম্মা, কলাংক পাড়ার নামই কমলাক পাড়া! এটা নিয়ে তুমি তোমার ফ্রেন্ডদের সাথে গোসিপ করবে, ঠিক আছে! ওরা অনেক কিছু শিখবে তাহলে!

ওরা সবাই লুসাই পারাতে ঢূকে পড়ে,, সেখানে গিয়ে গ্রামে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পোশাক পড়ে! সারাদিন প্রচুর মজা করে সবাই! সাজেক গিয়ে ওদের মনে হচ্ছে, ঢাকায় আর কখনো না ফিরে এখানেই থেকে যাবে! এত সুন্দর রূপ বৈচিত্র্য,, যে কারো ভালো লাগবে এখানে! মেঘ, পাহাড় আর সবুজের সমারোহ! সন্ধার আগে দিয়ে ওরা রিসোর্টে ফিরে আসে! ওরা ফেরার পথে কলাংক পাহাড়ে দাঁড়িয়ে সূর্যোস্ত দেখতে পায়,, কি এক অপরূপ দৃশ্য ছিলো সেটা! শিশির ফেরার পথে সবার চাহিদামতো খাবার সন্ধানে নেমে পড়ে,, “ব্যাম্বু চিকেন রোল, চিকেন স্টিক, বিফ কাবাব” এগুলো কিনে রিসোর্টে ফেরে!
____________________________

তখন রাত প্রায় তিনটা বাজে,, চারদিকে সুনসান নীরবতা, কোনো যান্ত্রিকতা নেই! রিসোর্টের জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে আছে ইন্দু! অনেকটা অবাক করার মতো দৃশ্য,, যেখানে দিনের বেলায় বড় বড় গাছের মনে হচ্ছিল সবুজ ঘাসের চাদর, সেখানটা নদীর মতো দেখাচ্ছে! এক অদ্ভুত রকমের সুন্দর সৃষ্টি হয়ে আছে বাইরে,, সাথে অতিরিক্ত ঠান্ডাও বেশ ভালো লাগে ইন্দুর কাছে! কিন্তু এ ভালো লাগা সে কটেজে বসে দেখতে চায় না,, সেখানে উপস্থিত হয়ে দেখবে! কিন্তু কে নিয়ে যাবে? সারাদিনের প্রচুর ক্লান্ত নিয়ে সবাই মরার মতো ঘুমোচ্ছে, কিন্তু ওর চোখে ঘুম নেই! ওর মনের ক্ষতগুলো ওকে ঘুমাতে দিচ্ছে না, তবে সে এসব নিয়ে আর ভাবতে চায় না! তাই রুহানকে ফোন দিয়ে বলে ওদের কটেজে আসতে,, ওর সাথেই দেখবে প্রকৃতির অবনীতল!

কিছুক্ষণ পরেই রুহান এসে ওকে কটেজের বাহিরে নিয়ে যায়! এখানে একটা বসার বেঞ্চ আছে,, ওরা শীতে কুহু কুহু করছে তাও এই প্রকৃতির কাছে ওদের শীতকে দূর করে দিলো! দুই মানিব-মানবী বসে আছে চুপচাপ, অনেক্ষন পরে নিরাবতা ভেঙে রুহান বলে ওঠে…

রুহানঃ ইন্দু, তুমি সত্যি করে একটা কথা বলবে! তুমি কি আমাদের বিয়েতে রাজি? কারোর কথায় না তুমি নিজের মনকে প্রশ্ন করে দেখো, তোমার মন কি চায়? (ইন্দুর দিকে তাকিয়ে)

ইন্দুঃ ( কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে) হুম,, আমি মন থেকেই রাজি!

রুহানঃ কিন্তু তুমি তো রোদকে ভালোবাসো, তোমার পাগলামীগুলো আমি দেখেছিলাম! হটাৎ কি হলো? তোমাকে কি কেও বাধ্য করেছে আমাকে বিয়ে করতে?

ইন্দুঃ কেনো তুমি কি চাও? আমি তোমায় বিয়ে না করি?

রুহানঃ নাহ,, আমি তোমায় ভালোবাসি ইন্দু কিন্তু আমি চাইনা আমি যাকে ভালোবাসি, সে আমাকে ছেড়ে অন্য কারোর কথা ভাবুক! আমাদের বিয়ে হলে তুমি কিন্তু তখন রোদের কথা ভাবতেও পারবে না! আর যদি তুমি চাও আমি নিজে গিয়ে তোমাকে রোদের হাতে তুলে দিবো! ভালোবাসা মানেই শুধু পাওয়া না, ত্যাগের মাধ্যমেও ভালোবাসার প্রাপ্তি ঘটে!

ইন্দু কিছু বললো না,,,

রুহানঃ রোদ কি তোমায় হার্ট করেছে? বা ওর কোন কিছুতে তুমি অনেক কষ্ট পেয়েছো?

ইন্দুঃ নাহ,,,

রুহানঃ তাইলে কি হয়েছে? প্লিজ শেয়ার কর!

ইন্দুঃ তুমি প্লিজ এগুলো আমাকে জিজ্ঞেস করো না! আমি এখানে প্রকৃতি দেখতে এসেছি, কোন জ্ঞান শুনতে না! যদি রোদকে ছাড়া তোমার কিছু বলার থাকে, তাইলে সেটা বলো! ওর প্রসঙ্গ তুলো না!

রুহানঃ ওকে, এজ ইউর ওইশ!

এভাবে ওরা কটেজের বাহিরে বসেই পার করে দেয় অনেকটা সময়!

#চলবে…

[ইন্দুর সাথে কার মিল দেওয়া যায়? রোদ নাকি রুহান,, আপনাদের মন্তব্য জানাবেন! আগামী পর্বেই অন্তিম পর্ব দিবো]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here