শিশির বিন্দু পর্ব ২

0
853

#শিশির_বিন্দু❤️
লামিয়া সুলতানা সিলভী ( লেখনীতে)
পর্বঃ২

রাত ৯ টার দিকে বিন্দুর বিদায়ের পালা! এখন পর্যন্তও কেও কারোর মুখ দেখেনি! অর্কের সব কিছুই বিরক্ত লাগছে তাই গাড়িতে বসে আছে! অর্ক তো আসলে বিয়েটা করতেই চায়নি ওকে জোর করে মায়ের অসুস্থতার কথা বলে নিয়ে এসে বিয়ে দিলো! ওর মা বলেছিলো আমার যদি কিছু হয়ে যায় তার একমাএ কারণ থাকবি তুই, সারাজীবন অপরাধী হয়ে থাকবি আর তোর ছেলেরই বা দায়িত্ব কে নিবে এভাবে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়েটা রাজি করায় অর্কের মা!..

আর এইদিকে, বিন্দুর মা কান্নাকাটি করছে! বিন্দুও করছে,,তবে প্রথম বারের মতো না! পরিবার ছাড়া তো অনেকদিন থেকেছে! বিন্দুর বাবা গিয়ে বিন্দুকে অর্কের বাবা মানে আশরাফ আহমেদের হাতে তুলে দেয়,,অর্ককে অনেকবার ওর বাবা বাহিরে বের হতে বলেছিলো কিন্তু সে বের হয়নি যার কারণে বিন্দুকে তার শ্বশুর মাশাই মানে আশরাফ আহমেদের হাতে তুলে দেয়!..

বিন্দু যখন গাড়িতে উঠবে ঠিক সেই মুহুর্তেই রুদ্রা দৌড়ে আসে আর রুদ্রার পিছন পিছন ইন্দু,,,

রুদ্রাঃ মাম্মা,, তুমি কোথায় যাচ্ছো আমাকে রেখে! তুমি না বলেছিলে যেখানে যাবে আমাকে সাথে নিয়ে যাবে! তাহলে কেনো মাম্মা আমাকে রেখে যাচ্ছো?( কাঁদছিলো,,ওর মায়ের ওড়না ধরে)

ইন্দুঃ আম্মু দেখো রুদ্রা আমার কোন কথাই শুনছে না,, ওকে বললাম আমরা কালকে যাবো, আর রুদ্রাও একেবারের জন্য কালকে যাবে কিন্তু ও তো কোন কথাই শুনছ না! (ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে)

করিমঃ নানুভাই মা আজকে যাক আমরা সবাই কালকে যাবো তো! আজকে রাতে আমি, তুমি তোমার নানুআপি অনেক গল্প করবো! প্লিজ সোনা কেঁদোনা,, তোমার সবচেয়ে ফেবরিট চকলেট এনেছি তুমি খাবে তো! মাম্মার সাথে গেলে কিভাবে খাবে ওগুলো বলো!..

বিন্দুঃ আব্বু ওকে ছাড়ো আমি ওকে নিয়ে যাবো! রুদ্রাকে ছাড়া আমি যাচ্ছিনা কোথাও! ওর এমন কান্না দেখে আমি সার্থপরের মতো চলে যাবোনা?

তন্দ্রাঃ বিন্দু পাগলামি করিস না মা,,একটা রাতেরই ব্যাপার কালকে তো যাবেই! তাছাড়া নতুন শ্বশুর-বাড়ি কে কি ভাববে!..

বিন্দুঃ আম্মু প্লিজ,, অনেক ভেবেছো আমাদের কথা আর ভাবতে হবে না! তোমাদের কাছে আমি আর আমার মেয়ে বোঝা হয়েছিলাম জন্যই তো আমাদের বিদায় করছো এখন আর এতো দরদ কাওকে দেখাতে হবে না!..

তন্দ্রাঃ বিন্দু তুই এটা বলতে পারলি,,

রুদ্রাঃ মাম্মা ও মাম্মা তুমি কারো কথা শুনো না প্লিজ,, তুমি আমাকে নিয়ে চলো তোমার সাথে ! আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারিনা জানোই তো,, রাতও ঘুম হবে না আমার,, আমার মাম্মা যে আমার পাশে নেই! ইন্দুমতীর কাছেও আমি থাকবো না! আমি তো তোমার মেয়ে,আর কেও না বাসলেও তুমি তো আমাকে ভালোবাসো বলো,,আমাকে নিয়ে যাবে না তুমি?.( চোখ দিয়ে পানি পড়ছিলো)

বিন্দুও কাঁদছিলো,,

বিন্দুঃ হ্যা মাম্মা নিয়ে যাবো তো,,কে বলেছে আমার সোনাটা কে রেখে যাবো, মাম্মা সরি বলছি আর কখনো এমন ভুল হবে না বেটা..( কপালে চুমু দিয়ে)

এবার আশরাফ সাহেব মুখ খোলে,,, সে একটু চুপচাপ স্বভাবের মানুষ তাই বরাবরি চুপ থাকতে পছন্দ করে!..

আশরাফঃ দিদিভাই তুমি আমার কাছে আসো,, তুমি যাবে তো মাম্মার সাথে! কে বলেছে তোমাকে রেখে যাবে মাম্মা! বউমা, আমার দিদিভাইয়ের জামা-কাপড় গুছিয়ে আনতে বলো! ( রুদ্রার চোখ মুছে কোলে নিয়ে)

সবার মুখেই এবার হাসি ফোটে,, সবাই যেনো এতোক্ষণ এই কথাটারই অপেক্ষা করছিলো! ইন্দু দৌড়ে গিয়ে রুদ্রার লাগেজ গোছাতে লাগে! করিম সাহেব-তন্দ্রাবতি যাই বলুক রুদ্রাকে তারা যথেষ্ট ভালোবাসে কিন্তু মেয়ের নতুন শ্বশুর বাড়ি কে কি ভাববে তার জন্যই না করছিলো!..

আশরাফ আহমেদ এবার ছেলের দিকে তাঁকায়! ভেবেছিলো ছেলে রাগ করবে কিন্তু না অর্ক ওর বাবার দিকে তাকিয়ে হাসে ( যার অর্থ তার বাবা অনেক ভালো কাজ করেছে)!..

অর্ক এতোক্ষণ পুরোটা কাহিনী গাড়ির কাঁচ নামিয়ে দেখছিলো! অর্কের সামনেই পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে বিন্দু! বিদায়ের সময় এই প্রথম অর্ক তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে দেখে বিয়ের আগে দেখেন কিন্তু এবারও বিন্দুর ফেইস দেখে না! শুধু ব্যাক সাইড দেখে!..

বিন্দু ভাবছে,, এতকিছু হয়ে যাওয়ার পরেও এই ছেলেটা বের হচ্ছেনা কেনো গাড়ি থেকে! গাড়ি নিয়েই কবরে যাবে নাকি বেশি ভাব দেখায়,, ডাফার! আবার পরেক্ষনেই ভাবে যে ছেলে নিজের ছেলের মুখ দেখেনা, স্ত্রীর জন্য বাচ্চাকে ব্লেম করে তার থেকে এর বেশী কিই বা আশা করা যায়!..

বিন্দুর ভাবনার মাঝেই ইন্দু রুদ্রার লাকেজ গুছিয়ে নিয়ে আসে! সবার জরাজরিতে ইন্দুকেও যেতে হলো সাথে কারণ বিন্দু নতুন বউ, ছোটাছুটি করতে পারবে না রুদ্রার জন্য! তাই রুদ্রার জন্য ইন্দুকে নিয়ে যায় আশরাফ সাহেব জোর করেই!..

বিয়ের গাড়ির পেছনে বসেছে অর্ক, রুদ্রা, বিন্দু, ইন্দু আর সামনের সিটে মানে ডাইভারে পাশের সিটে বসেছে তিয়াশ (অর্কের ছোট ভাই)! ওদের উদ্দেশ্য পুরো শহর ঘুরে তারপর বাড়ি ফিরবে কারণ বিন্দুদের বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি খুব একটা দূরে নয় ( ভাড়া বাড়ি)! দুই/ তিনটা ফ্ল্যাটের পরেই,,হেটেই যাওয়া যায়, তিন থেকে চার মিনিট লাগবে! কিন্তু নতুন বউকে তো আর বিয়ের দিন হেটে শ্বশুর বাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে না!..

বিন্দুর শ্বশুরের সাথে তার মামা শশুর ছিলো, তারা দুই শালা-দুলাভাই হেটেই রোওনা দিয়েছে! আর বিয়েতে আত্নীয়-স্বজনরা অনেক আগেই চলে গিয়েছে! মেঘকে নিয়েও নাদিয়া আর অর্কের কাজিনরা আগেই চলে যায়! বেশি কেও আসেনি ঘরোয়া ভাবে বিয়ে জন্য,, শুধু এসেছিলো অর্কের দুই বন্ধু, অর্কের বাবা, মামা,খালু,চাচা, চাচাতো দুই বোন, তিয়াশ( ছোট ভাই), খালাতো ভাই,ভাইয়ের বউ আর তাদের ছেলে ( নাদিয়া, রিদম) এই মিলে মোট ১২/১৩ জন হবে!. সবাই আগেই চলে গিয়েছিলো শুধু যায়নি তিয়াশ,অর্ক, অর্কের বাবা আর ওর মামা!..

যাই হোক,,,রাত ৯ টার দিকে বিন্দু শ্বশুর বাড়িতে পা রাখে! বিন্দু-অর্ক পাশাপাশি আসলেও এখনো কেও কারোর ফেইস দেখেনি! দেখার ইচ্ছেও নেই কারোর মাঝে! বিন্দু শ্বশুর-বাড়িতে এসেছে,, অর্ক ওর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে তাও এক জনের কাছে অন্যজন অপরিচিত!..

নববধূ প্রথম দিন শ্বশুর বাড়ি আসলে কিছু রিচুয়েল থাকে যেটা শ্বাশুড়ি পালন করে থাকে! বউয়ের পাশে বরকেও থাকতে হয়! কিন্তু অর্ক সম্পূর্ণ ব্যাপার টা উপেক্ষা করে চলে গেলো নতুন বউকে ফেলে!..

লায়লাঃ অর্ক কোথায় যাচ্ছিস বাবা,,এদিকে আয় বউমা দাঁড়িয়ে আছে তো! অর্ক ( অর্কের মা)

অর্কঃ আমার ভালো লাগছে না মা আমি ফ্রেশ হবো!..

লায়লাঃ এটা কোন কথা হলো,, মেয়েটা কে কতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখবো!..

ততক্ষনে অর্কের কানে কথাটা পৌঁছায়নি,, ও ভেতরে চলে গেছে!..

শায়লাঃ থাক আপা,,আপনে বউকে একাই নিয়ম পালন করে ভেতরে নিয়ে যান! ভারী শাড়ি-গহনা পড়ে মেয়েটার মনে হয় কষ্ট হচ্ছে!..

নাদিয়াঃ আমিও থেকেছি মা,,আর তাছাড়া বিন্দুর তো এটা প্রথম বিয়ে না আগেও হয়েছে! (ওর শ্বাশুড়ি–শায়েলার দিকে তাকিয়ে)

শায়েলাঃ চুপ বউমা,, এতো বেশি কথা বলো কেন সব-সময়,,তুমি দাদুভাই কে নিয়ে ভেতরে যাও!..

নাদিয়াঃ যাব্বাবা, আমি খারাপ কিছু বলেছি নাকি? ( বিড়বিড় করে)

তখনি অর্কিতা (অর্কের বড় বোন) তৃষার ওয়াসঅ্যাপে ভিডিও কল দেয় জাপান থেকে! তৃষা হলো অর্কের চাচাতো বোন,,তৃষারা দুই বোন- বড়টা তৃষা আর ছোটটা ইশা!..

তৃষাঃ হ্যা আপি বলো কেমন আছো?

অর্কিতাঃ ভালোরে,,তোরা কেমন আছিস? অর্কের বউকে নিয়ে আসছিস?

তৃষাঃ হ্যা আপি, ওইতো জিআম্মা ভাবীকে বরণ করছে! জানো আপি ভাবী অনেক মিষ্টি দেখতে হয়েছে!..

অর্কিতাঃ ( মুচকি হেসে) আলহামদুলিল্লাহ,,, ব্যাক ক্যামেরা অন কর তো,, নতুন বউকে দেখি!..

তারপর অর্কিতা সব কিছুই ভিডিও কলে দেখতে থাকে! বিন্দুর শ্বাশুড়ি বিন্দুকে ঘরে তুলতে থাক এদিকে ওদের পরিচয় দেই,,,

আশরাফ আহমেদের তিন ছেলে-মেয়ে,, এক মেয়ে দুই ছেলে,,,

বড় মেয়ে–তিয়াশা আহমেদ অর্কিতা,, তার উচ্চ মাধ্যমিকের পরে বিয়ে হয়ে যায়! আর তারপর জাপানে গিয়ে বাকি পড়ালেখা কমপ্লিট করে! এখন সে তার মেয়ের স্কুলেই জব করে! তার স্বামী সন্তান নিয়ে জাপানের সিটিজেন!

তারপর মেঝো ছেলে–শিশির আহমেদ অর্ক,,অর্ক এমবিএ (MBA) কমপ্লিট করে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি ( North South University) থেকে আর বিবিএ (BBA) করে আইইউবি ( IUB) অর্থাৎ ঢাকার প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে! আর তারপর প্রাইভেট কোম্পানি তেই জব করে!

আর ছোটটা–তিয়াশ আহমেদ তূর্য,,সে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলোসফির দ্বিতীয় বর্ষের ছাএ! এখন করোনা তাই হল ছেড়ে চলে এসেছে নারায়নগঞ্জে!

গল্পে ফেরা যাক, বাকি পরিচয় আসতে আসতেই জানবেন,,,

সব নিয়ম শেষে বিন্দুকে ফ্রেশ হতে দেওয়া হয় আর সাথে ইন্দু রুদ্রাকেও! সবাই রাতে খেয়ে আড্ডা দিয়ে যে যার মতো ঘুমোতে চলে যায়! কিন্তু অর্ককে কেও খুজে পায় না,,সেই যে বউ নিয়ে এসে ফ্রেশ হয়ে বাহিরর চলে গেছে সহজে আর আসছেই না! প্রথম কয়েকবার আশরাফ সাহেব ফোন দিয়ে জেনেছে অর্কের আসতে দেরি হবে কিন্তু পরে আর তাকে ফোনেও খুঁজে পাওয়া যায়নি,,ফোন সুইট অফ করে রেখেছে! অর্কের বন্ধুদেরও পাত্তা নেই,,অর্কের কথা জানে না! নতুন বউওকে রেখে চলে গিয়েছে কি একটা অবস্থা! ইন্দু, রুদ্রা, অর্কের মা-বাবা আর তিয়াশ টেনশন করছে ড্রয়িংরুমে বসে!..

#চলবে…

[ আজকের পর্বটা একটু ছোট হয়ে গিয়েছে,,নেক্স পর্ব বড় করে দিবো ইনশাল্লাহ,, হ্যাপি রিডিং❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here