শিশির ধোয়া গোলাপ পর্ব ১

0
2572

বিয়ের আসরে কবুল বলে নিজের গাড়ি নিয়ে চলে গেল আদনান।বর কনে রেখে চলে যাওয়ায় পুরো বিয়ে বাড়ির সবাই হতভম্ব হয়ে আদনানের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো।আদনানের বাবা মোঃ আবরার চোধুরির আগে থেকে সবকিছু অবগত ছিলেন। তাই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে তিনি বলে উঠলেন, আদনানের ইমারজেন্সি একটা মিটিং থাকায় চলে যেতে হলো। তবে আমার ঘরের লক্ষীকে ঘরে তোলার জন্য আমি আছি , চিন্তিত হবার কিছু নেই।

– আবরার চৌধুরির কথায় সবাই শান্ত হলেও আরোহীর মনে খটকা লাগলো৷ সে প্রথম থেকেই খেয়াল করছে যখন তাকে দেখতে আসা হয়েছে তখনো শুধু মোঃ আবরার চোধুরি এসে দেখে গিয়েছেন। আবার আজকেও তিনি সবার শেষে এসে শুধু কবুল বলেই চলে গেলেন, তার কি এই বিয়েটা করার ইচ্ছা ছিলো না, কেউ কি তাকে ধরে বেধে বিয়ে করিয়েছে।কি এমন ব্যস্ততা যে তিনি আমাকে একবার দেখার ইচ্ছা করলো না, আমার তো তাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।ধুরো ভালো লাগে না, আমার কপালে নিশ্চয়ই কোনো ঢেঁড়স বা নিরামিষ রয়েছে।এখন আবার তাকে দেখার জন্য আমাকে রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

আরোহীর মা মিসেস শাহানা বেগম আরোহীর কাঁধে হাত রাখায় আরোহীর ভাবনার ছেদ ঘটে। মিসেস শাহানা বেগম মেয়ে কে জড়িয়ে ধরলেন,কারন তার একমাএ মেয়ে, যাকে ছেড়ে তিনি কখনো থাকেন নি আজ তার আদরের মেয়েটা চলে যাচ্ছে। আরোহীও খুব কান্না করছে। আরোহীর বাবা পিছন থেকে আরোহীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।আরোহী তার বাবা কে দেখেই জড়িয়ে কান্না করতে থাকে।

মোঃআবরার চোধুরি আরোহীর মাথায় হাত রেখে বললেন,কান্না করিস না মা। আমি তো তোর বাবার ই মতো।মেয়ের চোখের পানি আমি বাবা হয়ে কি করে সহ্য করব বল।

আরোহীর বাবা আরোহীর ডান হাতটা মোঃ আবরার চোধুরির হাতের মুঠোয় দিয়ে বললেন, আমার একমাএ মেয়েকে আমি আপনার হাতে তুলে দিলাম আজ থেকে আরোহীর ভালো মন্দ দেখার দায়িত্ব আপনার।

– আরোহী আমার ছেলের বউ না আমার মেয়ে হয়ে আমার বাসায় যাবে। আপনি চিন্তা করবেন না আজ থেকে ওর ভালো মন্দ দেখার দায়িত্ব আমার।

আরোহী কে আবরার চোধুরি একটা গাড়িতে বসিয়ে নিজেও বসলেন। গাড়ি তার আপন গতিতে চলছে। অনেক্ক্ষণ যাবৎ গাড়ি চলায় আর সারাদিন আরোহী কিছু না খাওয়ায় আরোহীর বড্ড ক্লান্ত লাগছে।তার উপর কান্না করায় চোখ ফুলে আছে।গাড়ির সিটে মাথা হেলিয়ে দিয়ে শুয়ে আছে, হঠাৎ গাড়ি থামায় মাথাটা ওঠিয়ে চারপাশে চোখ বুলিয়ে আরোহী অবাকের চরম পর্যায়ে চলে যায়।একবার মনে হলো সে কোনো সপ্ন দেখছে কিন্তু তার আবরার চোধুরির ডাক দিতেই বুঝলো, সে সপ্নে না বাস্তবেই এইসব দেখছে।

_____________________________________________

আদনান বিয়ের আসর থেকে সোজা গাড়ি নিয়ে নিজেদের ফার্ম হাউসে এসে এটা সেটা ভাঙতে লাগলো।হাতের কাছে যা পাচ্ছে তাই ছুঁড়ে মারছে।মেয়েদের প্রতি বিশ্বাস তো সেদিনই ওঠে গিয়েছে যেদিন ভালোবাসার মানুষটা তাকে একা করে দিয়ে চলে গেছে। সেদিন থেকেই ভালোবাসা, সম্পকের উপর থেকে বিশ্বাস উঠে গেছে।
আদনানের খুব করে মনে পড়ছে অতীতের কথাগুলো যেদিন ইফতি বলেছিলো,আমার পক্ষে এই রিলেশন কন্টিনিউ করা পসিবল না। দীর্ঘ চার বছরের সম্পর্ক যখন চার সেকেন্ডেই শেষ করে দিয়ে চলে যায় ইফতি। সেদিনের কথা ভাবতেই আদনানের চোখ থেকে দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। হাতের সামনে থাকা গ্লাসটা হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে আদনান।গ্লাস ভেঙে কাচের টুকরো গুলো হাতে বিধে গেল।হাত থেকে অনাবরাতো র*ক্ত ঝরছে সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই।হৃদয়ের যন্ত্রণা হাতের ক্ষতটা থেকে বেশি হওয়ায় উপলব্ধির ক্ষমতা যেন হারিয়ে ফেলেছে।ফোন সশব্দে বেজে ওঠায় আদনান ফোন স্কিনের দিকে একবার তাকিয়ে আবার অন্যমনস্ক হয়ে যায়।ফোন বেজেই চলেছে, বেজেই চলেছে সেদিকে আদনানের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
-বেশ কিছুক্ষণ পর একজন সার্ভেন্ট এসে বললো,স্যার বড় স্যার অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছে আপনাকে দ্রুত যেতে বলেছে।

বাবার অসুস্হতার কথা শুনে হুস ফিরে আদনানের। আদনানের মা মারা যাওয়ার পর থেকে আদনানের পুরো পৃথিবী তার বাবা।সবার কথা ফেলতে পারলেও বাবার কথা ফেলতে পারে না আদনান।
হাতের দিকে তাকিয়ে পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে হাতে পেঁচিয়ে নিলো। তারপর দ্রুত ফার্ম হাউস থেকে বেড়িয়ে নিজেই ড্রাইভ করে বাসায় এসে ঢুকতেই দেখে তার বাবা সোফায় মাথা নিচু করে স্হির হয়ে বসে আছে।

-বাবা কি হয়েছিলো তোমার?ডাক্তার কে আসতে বলেছো। নাকি আমি কি কল করে বলবো আসতে?

-তোমার কিছুই করতে হবে না। তুমি আমার ফোন কেন ধরনি?

-বাবা তুমি জানো আমার পক্ষে এটা মেনে নেওয়া কতোটা কষ্টের।

-তুমি যেন এই কষ্ট যন্ত্রণা থেকে বেড়িয়ে আসতে পারো তাই আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।আর মেয়েটার কি দোষ এখানে।আমরা মেয়েটাকে এখানে নিয়ে এসেছি।

-বাবা আমি চেষ্টা করবো মানিয়ে নিতে।

_____________________________________________

একজন সার্ভেন্ট আরোহী কে একটা রুমে এনে বসিয়ে দিয়ে গেল। আরোহী মনে মনে ভেবে ছিলো হয়তো চারদিক ফুলে সজ্জিত থাকবে। কিন্তু তার ভাবনায় ছেদ ঘটলো,সে ভেবছিলো কি আর হয়েছে কি।পুরো রুমে বড় বড় আসবাবপত্র রয়েছে তবে ফুলের কোনো চিটে ফোটাও নেই।এটা কি কোনো বাসরঘর নাকি কোনো মরুভূমি।সবকিছু খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে ব্যস্ত আরোহী। ঠিক তখনি দরজা খোলার শব্দ শুনে আরোহীর হার্টবিট দ্রুত ওঠা নামা করছে। সবকিছু কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। এ যেন এক অন্য রকম অনুভূতি। আরোহী একদম জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। ঠিক বরফের মতো জমে আছে যেন একটু নড়লেই তাকে শাস্তি পেতে হবে।চোখ তুলে তাকাবার শক্তি যেন নেই।তবে সে বেশ বুঝতে পেরেছে রুমে দ্বিতীয় কেউ আছে।আরোহী ভাবতে লাগলো, আচ্ছা সে কি এসেছে। একবার কি তাকিয়ে দেখবো। না তাকিয়ে দেখলে কোনো অপরাধ হয়ে যাবে। জানি না কেন যেন এই স্বামী নামক মানুষটাকে দেখার আগ্রহে আমার চোখজোড়া চাতক পাখির ন্যায় আকুল হয়ে আছে।আর খুব জানতে ইচ্ছে করছে কি এমন ব্যস্ততার জন্য সে আমাকে একবার না দেখেই চলে গিয়েছে।তবে আমার ভাবনার এক বালতি পানি ঢেলে আদনান কাবাট থেকে টিশার্ট আর ট্রাওজার নিয়ে ওয়াসরুমে চলে গেল। আরোহী অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে।আদনান ওয়াসরুম থেকে বের হয়ে মাথা মুছতে মুছতে বলল,তুমি এখনো জেগে আছো যে,,ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পরো।আরোহী কে কিছু বলতে না দিয়ে আদনান বিছানায় একপাশে শুয়ে পড়ল।আরোহী ঘোমটা ওঠিয়ে দেখলো আদনান ওপাশ ফিরে শুয়ে আছে।আরোহীর মনটা নিমিষেই খারাপ হয়ে যায়। প্রত্যেক মেয়েরা তার বাসার রাত নিয়ে কতো কিছু ভেবে রাখে। সবার মতো আরোহীও ভেবে রেখেছিল অনেক কিছু।তার নাম পরিচয় কিছুই যেন জানার আগ্রহ নেই এই মানুষটার। আরোহী ভেবে নিলো হয়তো সারাদিন ব্যস্ত থাকায় মানুষটি ক্লান্ত তাই শুয়ে পড়েছে।অবাদ্ধ মন তো কতো কিছুই ভেবে চলেছে। কিন্তু আরোহী ফ্রেশ হবে কি করে কারন তার লাকেছ কোথায় রাখা আছে তার জানা নেই।তাই ফ্রেশ না হয়েই শুয়ে পড়ল।

সকালে সূর্যি মামার হালকা প্রখর আলো চোখে পড়তেই আড়মোড়া ভেঙে আরোহী পিটপিট করে তাকায়। হঠাৎ মনে পড়লো সে তো তার বাসায় না। পাশে তাকাতেই দেখে আরোহী দেখলো তার স্বামী নামক মানুষটিও নেই। ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই আরোহি থমকে যায় কারন বেলা ১০ টা বাজে। তড়িঘড়ি করে উঠতে যাবে ঠিক তখনি পিছনে কারো গলার আওয়াজে পা দুটি আপনা আপনি থেমে যায়।
তার সামনে দাড়িয়ে আছে এক সুদর্শন পুরুষ। ব্লাক টিশার্ট পড়া, সাথে ব্লাক ট্রাউজার। চুল থেকে মুক্তোর দানার মতো পানি মেঝেতে পড়ছে। কোনো ছেলে কে যে এতো সুন্দর লাগে হয়তো এই মানুষটাকে না দেখলে আরোহী বুঝতো না। গতকাল রাতে ওপাশ ফিরে শুয়ে থাকায় চেহারা দেখতে পারেনি আরোহী।

– এই মেয়ে তুমি রাতে চেঞ্জ করে ঘুমোও নি কেন?

– আদনানের কথায় আরোহীর ঘোর কাটে। সে মাথাটা নিচু করে বলে, আমার লাকেছ কোথায় ছিলো আমি জানি না। তাই চেঞ্জ করতে পারিনি।

আদনান একজন সার্ভেন্ট কে ডাক দিয়ে বললো, তোমরা এতো টা কেয়ারলেস কেন?ম্যামের জিনিস পএ দিয়ে যাও, কুইক।

-একজন সার্ভেন্ট, সরি স্যার!এখনি দিচ্ছি।

একজন সার্ভেন্ট আরোহী কে তার সবকিছু বুঝিয়ে দিলো। আরোহী একটা জামদানী শাড়ি নিয়ে চেঞ্জ করতে চলে গেল।চেঞ্জ করে নিচে আসতেই দেখে মোঃ আবরার চোধুরি সোফায় বসে আছেন,আরোহী কে দেখেই ওঠে বললেন,সকাল সকাল মেয়ের হাতের চা খাবো বলে বসে আছি।

– আঙ্কেল, সরি একটু দেরি হয়ে গেল।তবে কাল থেকে ঠিক সময় মতো চা পেয়ে যাবেন।

– আমি কিন্তু খুব রাগ করেছি তবে সেটা চায়ের জন্য না। আচ্ছা মা আমি কি তোমার বাবা হতে পারি না? আমাকে কি বাবা ডাকা যায় না।

– আচ্ছা, বাবা।আপনি বসুন আমি চা নিয়ে আসছি।

আরোহী এক চাপ চা বানিয়ে নিয়ে আবরার চৌধুরী কে দিতেই তিনি এক গাল হেসে চা খেতে লাগলেন।

-আদি কোথায় মা? ( আবরার চোধুরি আদনান কে আদি বলে ডাকে )

– রেডি হচ্ছে দেখে এসেছি।
আরোহী কথাটা বলে পিছনে তাকিয়ে দেখে আদনান নিচে নামছে।আদনান আবরার চোধুরির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যেতে নিলেই আরোহী গিয়ে সামনে দাড়ায়।

অথঃপর…….

#চলবে

#শিশির_ধোয়া_গোলাপ

#ইভান_ডালী

#সূচনা পর্ব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here