লারিসা পর্ব ১২

0
465

গল্প : লারিসা | পর্ব : বারো

সেদিন অনেক রাত অবধি জেগে থাকল লারিসা। ছেলেটাকে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাতে দেখে তারও ঘুম পাচ্ছিল। কিন্তু সে ঘুমাবে না। সে দেখবে, সে ছেলেটাকে বদলে যেতে দেখবে। তার সেই অদ্ভুত ভয়ঙ্কর চেহারা দেখবে।

কিন্তু অবাক করার মতো বিষয় হলো, রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে গেল ছেলেটা এক মুহূর্তের জন্যও অন্যরকম হয়নি। যেরকম ছিল সেরকমই আছে। ভোরের আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে বিছানায় যায় লারিসা। মনে মনে হাসে আর ভাবে, সেদিন মাতাল অবস্থায় কীসব ভুলভাল দেখেছিল সে! ভেবেছিল সত্যিই ছেলেটা গভীর রাতে মানুষ থেকে অন্যকিছু হয়ে যায়। কিন্তু আজ তার ভুল ভাঙলো। আনমনে হাসতে হাসতে সে ভাবে, ধুর! এমনটা কখনো সম্ভব? এতটা দিন সে শুধু শুধু ছেলেটাকে দৈত্য ভেবেছে!

কিন্তু আসল সত্য অন্যকিছু।
লারিসা তা টের পায়নি।

ছেলেটা বোধহয় একটু বোকা স্বভাবের। আর বোকা ছেলেদের সাথেই মেয়েরা বন্ধুত্ব করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। লারিসার ক্ষেত্রেও তা-ই হলো। খুব সহজে ছেলেটার বন্ধু হয়ে গেল সে। তবে শ্রেফ বন্ধু। এর বেশি কিছু নয়। এভাবে প্রায় তিনমাস চলল। এরপর, একদিন, এক বিকেলে কোনো এক পর্যটক, অল্পবয়সি একটা মেয়ে শপে এসেছিল। তার টেবিলে এক কাপ কফি নিয়ে দেয় লি রি। কফি খেয়ে যাবার সময় সেই ফরেনার মেয়েটা কিছু টাকা টিপস্ দিয়ে যায় এবং খুশি হয়ে লি রি’কে জড়িয়ে ধরে তার গালে একটা চুমু দেয়। সেই দৃশ্য দেখে কেন এত রাগ লেগেছিল তা লারিসা জানে না। কী কারণে যেন তার গায়ে আগুন ধরে গিয়েছিল। সে দ্রুত ছুটে এসে লি রি’র গালে একটা চড় বসিয়ে দেয়। এখানে লি রি কী দোষ করেছে তা লারিসার জানা নেই। বিনা কারণে চড় মারায় কিছুক্ষণ পর নিজের ভুল বুঝতে পেরে পাপবোধ হচ্ছিল লারিসার। রাতে শপ বন্ধ করে বাড়িতে যাবার আগে সে লি রি’র মুখোমুখি দাঁড়ায়। ছেলেটার চোখের উপর চোখ রেখে বলে, “আপনাকে চড় মেরেছি এজন্য স্যরি বলব না। এরপর আর কোনোদিন যদি কোনো মেয়ে আপনাকে স্পর্শ করে তাহলে আমি আপনার গলা টিপে মেরে ফেলব। খুন করে ফেলব আপনাকে।”

রাতে ঘুম আসছিল না। সে শুধু শুধু ছেলেটাকে চড় মেরেছে।

একসময় বিছানা ছেড়ে উঠে যায় লি রি’র ঘরে। ঘুমন্ত মানুষটার গালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, “দুঃখিত, আমি অজান্তেই আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি।” তারপর লি রি’র বুকের ভেতরে ঢুকে যায়। ঘুমন্ত ছেলেটার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে, গায়ের গন্ধ শুঁকে, ছেলেটার বুকের ভেতরে মুখ গুঁজে ছোটোছোটো নিঃশ্বাস ফেলে আর ভাবে, কেমন করে সে এই ছেলেটার মায়ায় পড়ে গেল? কেমন করে পারল এমন উদ্ভট একটা ছেলেকে ভালোবাসতে?

প্রথম ভালোবাসা কারোর জীবনেই আগাম বার্তা দিয়ে আসে না। অজান্তে গর্তে পড়ে যাওয়ার মতোই আচমকা মায়ায় পড়ে যায় মানুষ। লারিসাও অজান্তেই ছেলেটাকে ভালোবেসে ফেলল। কবে, কখন, কীভাবে সে ছেলেটার প্রেমে পড়ল। আর কেমন করে সেই অনুভূতি এতটা তীব্র হতে লাগল তা সে একদমই জানে না। তবে দিনদিন ছেলেটার প্রতি টান বেড়েই যাচ্ছিল তা সে ঠিকই বুঝতে পারছিল। লি রি কেমন মানুষ। জাগতিক কোনো বিষয়ই তাকে স্পর্শ করে না। পৃথিবীর সবকিছুর ব্যাপারেই সে নির্লিপ্ত। লারিসার ব্যাপারেও। তাদের ভালোবাসার ব্যাপারেও। লি রি কখনো তার ভালোবাসা প্রকাশ করেনি। তবে আসল সত্যি এই যে, সে নিজেও লারিসার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। ব্যাপারটা সে তখনই টের পেল, যখন একটা লোক লারিসাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলো। তখন লি রি’র ইচ্ছে করছিল, এক ঘুসি মেরে লোকটার নাক ফাটিয়ে দেয়। শুধু লারিসার কথা ভেবে সে ওসব করেনি। যদিও লারিসা সঙ্গে সঙ্গে লোকটার প্রস্তাব নাকচ করে দেয়।

তারপর একদিন, এক বৃষ্টিমুখর দিনে চার্চে গিয়ে বিয়ে করে নেয় তারা। রাতে লারিসাকে কোলে নিয়ে বসে থাকে লি রি। ঘরে নয়, খোলা আকাশের নিচে। টানা তিন ঘন্টা বৃষ্টির পর পরিষ্কার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে নবদম্পতি। মেয়েটি চুপ। ছেলেটি ফিসফিস করে বলে, “আজকের রাতটা আমার জন্য স্পেশাল।”

লারিসা কোনো কথা বলে না। সে ভাবে, আজ তাদের বিয়ে হয়েছে তাই এই রাত লি রি’র কাছে স্পেশাল। কিন্তু আসল সত্য হলো এই যে, আজ, অর্থাৎ উনিশে মে লি রি’র জন্মদিন। বহু বছর আগে মে মাসের উনিশ তারিখে জন্মেছিল সে। কিন্তু এই মে মাসের উনিশ তারিখ আরো একটি কারণে স্পেশাল। সেই কারণটা লি রি নিজেও জানে না। সে জানে না যে, প্রতিবছর মে মাসের উনিশ তারিখ গভীর রাতে সে মানুষ থেকে পশু হয়ে যায়। একজন সাধারণ মানুষ থেকে হয়ে উঠে এক আজব পশু, যা সমস্ত পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই।

ছোটোবেলায় বাসর রাতকে বাঁশের রাত ভাবতাম। তখন মনে হতো, হয়তো বাঁশ দিয়ে নকশা করে ঘর সাজানো হয় নতুন বর-কনের উদ্দেশ্যে। সেই ঘরে তারা ঘুমায় তাই বাঁশের রাত। বড়ো হতে হতে জেনেছি, আদতে সেটা বাঁশের রাত নয়, বাসর রাত। এই রাতের সাথে বাঁশের কোনো সম্পর্ক নেই। সেইসাথে আরো অনেক কিছুই জেনেছি সেসব বলা যাবে না। যাকগে, ওসব বিষয়ে ক্লাস নেওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। আসল কথা হলো, বিয়ের রাতে, অর্থাৎ বাসর রাতে খোলা আকাশের নিচে বসে চাঁদ দেখতে দেখতে রাতটা যখন মাঝ বরাবর চলে এসেছে তখন লারিসার চোখের কোলে ভর করেছে মৃদু ঘুম। সে আলগোছে মাথাটা রেখে দেয় লি রি’র কোলে। হয়তো একটু আদরও চেয়েছিল। চাওয়াটাই তো স্বাভাবিক, না কি?

কিন্তু লি রি আজব এক ক্যারেক্টার। সে আস্তে করে লারিসার মাথাটা নিজের কোলের উপর থেকে সরিয়ে বালির উপর রেখে দিলো। একটু দূরে সরে গিয়ে নির্বোধের মতো বসে রইল। তারপর বোধহয় বেশি সময় অতিবাহিত হয়নি, সে নিজেও বালির উপর জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে পড়ল।

গভীর রাত। চারপাশে তখন মৃদু হাওয়া বইছিল। উত্তর দিকে প্রায় বিশ হাত দূরের ওই নাম না জানা ইয়া বড়ো গাছটা হঠাৎই ঝাঁকানি দিয়ে উঠলো। তারপরই শুরু হলো পরিবর্তন। শুরু হলো তুমুল হাওয়া। বালিগুলোও যেন আন্দোলন করে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। প্যাঁচার মতো একটা পাখি তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে খুব দ্রুত ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে গেল লি রি’র মাথার উপর দিয়ে। দূরে, অনেক দূরে সমুদ্রের তলদেশ থেকে একটা তীব্র ঢেউ উঠে এল কিনারায়। এখান থেকে শতশত গজ দূরে বালির উপর পড়ে পড়ে ঘুমুচ্ছে ওরা।

মে মাসের উনিশ তারিখ।
এই দিনেই লি রি এক ঘন্টার জন্য পশু হয়ে যায়।
আজও হলো। রাত যখন ঠিক তিনটা, তখনই শুরু হলো পরিবর্তন। লি রি’র হাত, পা, মুখ, গলা, বুক, পিঠ দিয়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করল ঘন কালো লম্বা লম্বা লোম। পিঠের মেরুদণ্ডের উপরের মাংস-চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে এল তিন তিনটি শিং। হাতের নখগুলো হয়ে গেল হিংস্র পশুর মতো লম্বা এবং ধারালো। চোখের মণি সোনালি রঙের হয়ে স্বর্ণের মতো জ্বলজ্বল করে উঠল।

চলবে
মো. ইয়াছিন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here