লারিসা পর্ব ১৩

0
450

গল্প : লারিসা | পর্ব : তেরো

ইতোমধ্যে সাধুদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে।
লি রি যে রাতে পালিয়ে যায়, সেই রাতে যখন অসংখ্য নেকড়ে এসেছিল, সেই নেকড়েগুলোর একটি বাচ্চাকে মেরে ফেলেছিল সাধুদের একজন। সে অবশ্য শাস্তিও পেয়েছে। রাতটা পেরিয়ে যাবার আগেই তাকে তুলে নিয়ে গেছে নেকড়ের দল।
এরপর লি রি পালিয়ে আসার পর আরো অনেক ঘটনা ঘটে গেছে।

প্রতি রাতেই মানুষ নিখোঁজ হতে শুরু করেছিল তখন। একের পর এক। একের পর এক।
ওরা ভেবে কূল পাচ্ছিল না, এত মানুষ যাচ্ছে কোথায়? হঠাৎ এভাবে মানুষ নাই হয়ে যাওয়ার পেছনে কারণটা কী?

পনেরো দিনে মোট আঠারোজন লোক নিখোঁজ হওয়ার পর বসতিতে নেমে এল আতঙ্কের ছায়া। কেউ রাতে ঘর থেকে বেরোয়-ই না এমনকি দিনের আলোয়ও একলা বেরোতে ভয় পায়। দিশ না পেয়ে ওরা একটা নিয়ম চালু করল। নিয়মটা হলো এই, প্রতি রাতে দু’জন লোক মশাল হাতে নিয়ে বসতি পাহারা দেবে। পরবর্তী রাতে আরো দু’জন। এভাবে পালাক্রমে সবাইকে পাহারা দিতে হবে।

প্রথম রাতে যে দু’জন পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিল, রাত পোহালে ওদের মশাল পাওয়া গেল ঠিকই। কিন্তু ওদেরকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। তাই পরবর্তী রাতে যারা পাহারা দেওয়ার কথা, ওদের একজন ভয়ে বসতি ছেড়ে পালিয়ে গেল। বাকি যে একজন ছিল, সে আতঙ্কে নিজেই নিজের গায়ে মশালের আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করে ফেলল। এভাবে আতঙ্ক নিয়ে বেঁচে থাকার চাইতে নাকি মরে যাওয়াই ভালো‌!

তৃতীয় রাতে যারা পাহারা দেবে ওদের একজনের নাম ছিল রোবান। ওর সঙ্গে অ্যাথিন। রোবান বয়স্ক লোক তবে গায়ের জোরে সে এখনও তাগড়া যুবক। অপরদিকে অ্যাথিন রোবানের নাতির বয়সি। মাত্র তেইশ বছরের যুবক। ছেলেটা রোবানের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। রোবান শুকনো ডালপালা জড়ো করে আগুনে ফেলছিল। তার মনে ভয় নেই। আতঙ্ক নেই। বিস্ময় নেই। যেন পৃথিবীর কোনোকিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারে না।

হঠাৎ কী কারণে যেন পূব দিকের ওই অন্ধকার পথের দিকে এগিয়ে যায় অ্যাথিন। তার হাতে মশালটা নিভুনিভু আলো দিচ্ছে। সেটা উঁচু করে একটু দূরের দৃশ্য দেখদে চায় সে। কিন্তু অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না বলে আরো এক পা এগিয়ে যায়। তারপর আরো এক পা। আবারো। এভাবে কয়েক পা এগিয়ে চলার পর হঠাৎ থমকে যায়। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে বাতাসে কান পেতে রাখে সে। দূরে, প্রায় ত্রিশ হাত দূরে আগুন জ্বালাচ্ছে রোবান। শুকনো-ভেজা পাতা জ্বলতে জ্বলতে মটমট করে ফুটছে। সেই শব্দও স্পষ্ট শুনতে পেল অ্যাথিন। সেইসাথে আরো একটা আওয়াজ কানে বাজল। ক্ষুধার্ত সিংহ রেগে থাকলে তার গলা দিয়ে যেমন আওয়াজ বেরোয়, ঠিক তেমনি একটা আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পায় অ্যাথিন। শুনতে পায় একটা ভয়ঙ্কর প্রাণীর সতর্ক নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ। প্রাণীটা বোধহয় ডান দিকে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে ছিল। এখন আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে।

তারপর, মাত্র কয়েক সেকেন্ডের পেরিয়ে যাওয়ার আগেই অন্ধকারে অসংখ্য চোখ দেখা গেল। পিতলের মতো চোখ। গা কালো হওয়ায় অন্ধকারের সাথে মিশে গেছে। শুধু চোখ দেখা যাচ্ছে। অ্যাথিন এবার পরিষ্কার দেখতে পেল। দেখল একেবারে নিঃশব্দে সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে আসছে অসংখ্য নেকড়ে! ওরা এক পা তুলে তো আরেক পা আস্তে করে মাটিতে নামিয়ে রাখে। তবে দৃষ্টি নিচু হয় না। একদৃষ্টে চেয়ে থাকে অ্যাথিনের চোখের দিকে। অ্যাথিন চোখ নামিয়ে নিলেই উড়ে এসে ঘাড়ে থাবা বসিয়ে দেবে।

রোবান প্রস্তত ছিল।
সে জানত এমন কিছু হবে। এবং এজন্য সে যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। চারিদিকে ফাঁদ পাতা শেষ। চারপাশে পেতে রাখা হয়েছে অসংখ্য তির-ধনুক। সবগুলোর নিয়ন্ত্রণ রোবানের হাতে। একটিমাত্র দড়ি। সেটা টেনে দিলেই ধনুকগুলো থেকে একের পর এক তির ছুটে যাবে।

অ্যাথিনকে সে টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছে। ইচ্ছে করেই অ্যাথিনের হাত একটু কেটে ফেলেছে এবং পূব দিকে একটা ঢিল ছুড়েছে যাতে ওদিকে শব্দ হয় এবং শব্দটা কীসের তা দেখার জন্য অ্যাথিন ওদিকে যায়।

সবকিছু প্ল্যানমাফিক হলো।
অ্যাথিন সত্যি সত্যি ওদিকে গেল এবং তার রক্তের গন্ধে নেকড়েগুলো ছুটে এল তার সামনে। রোবান আড়াল থেকে দেখছিল দৃশ্যটা। অ্যাথিন আর নেকড়েগুলো যখন মুখোমুখি, ঠিক তখনি দড়ি টেনে দেয় রোবান। সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে শুরু হয় তিরবর্ষণ। বৃষ্টি মতো ছুটে যায় অসংখ্য তির। মুহূর্তের মধ্যেই অগণিদ বিষাক্ত তির বিঁধে যায় অ্যাথিনের গায়ে। অ্যাথিন ধপাস করে পড়ে যায়। নেকড়েগুলো যে যার মতো পালাতে গিয়ে বেশিরভাগ তিরবিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে ছটফট করতে লাগল। কিছু নেকড়ে মৃত্যু যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মারা গেল। তবে কয়েকটি নেকড়ে পালিয়েও গেল।

অ্যাথিনের জন্য খারাপ লাগছিল রোবানের। কিন্তু কাউকে না কাউকে মরতেই হত। তা না হলে এতগুলো নেকড়ে একসাথে শেষ করা যেত না।

অ্যাথিন এতিম ছেলে। তাই তার অপমৃত্যু নিয়ে কথা বলার মতো কেউ নেই। নিশ্চিন্ত মনে ঘরে ফিরে যায় রোবান। নেকড়েগুলো আজ রাতে আর আসবে না।

পরদিন সকালে তিরবিদ্ধ অসংখ্য মৃত নেকড়ে পাওয়া গেলেও অ্যাথিনের লাশ পাওয়া গেল না। কেউ জানতেও পারল না যে, অ্যাথিনের মৃত্যুও নেকড়েগুলোর মতো বিষাক্ত তিরের কারণে হয়েছে। কেউ বুঝতেও পারল না কিছু। কারণ, লোকজন দেখে ফেলার আগেই লাশটা তুলে নিয়ে দূরে কোথাও মাটির নিচে পুঁতে ফেলেছিল রোবান।

সেদিন কয়েক ঘন্টার মধ্যে পুরো গ্রাম ফাঁকা হয়ে যায়। কারণ ততক্ষণে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়ে গেছে। এতগুলো নেকড়ে একসঙ্গে মেরে ফেলায় ওরা ক্ষিপ্ত হয়ে বদলা নিতে আসবে। আজকেই আসবে। শুধু রাত হবার বাকি!

অন্ধকার মিলিয়ে যাবার আগে আগে বসতির শেষ মানুষ অর্থাৎ রোবানও সেখান থেকে পালিয়ে যায়। তবে পালিয়ে বেড়ানো তার ইচ্ছে নয়। সে শুধু অপেক্ষা করার জন্য দূরে সরে গিয়েছিল। সে জানত, সে ভালো করেই জানত, ঠিক এক বছর পর উনিশে মে গভীর রাতে একটা বিরল দৃশ্য দেখা যাবে। সেই অতি চমকপ্রদ দৃশ্যটা আজকের আগে কেউ দেখেনি। শুধু রোবান দেখেছে। প্রায় কুড়ি বছর আগে এক রাতে জঙ্গলের মাঝ বরাবর ধ্যানে বসেছিল সে। ঠিক তখনই অদ্ভুত সব আওয়াজ পেয়ে ছুটে গিয়েছিল একটা জায়গায়। যেখান থেকে লি রি’কে কুড়িয়ে পাওয়া গিয়েছিল ঠিক সেই জায়গায়। রোবান আড়াল থেকে দেখছিল, সেই জায়গায় শত শত নেকড়ের জড়ো হয়ে নিজেদের মধ্যে কী যেন কথা বলছিল! এসবের কিছুই বুঝতে পারেনি রোবান। এরপর থেকে প্রতিবছর উনিশে মে গভীর রাতে সে চলে যেত জঙ্গলের ওই জায়গায়। দেখত, শত শত নেকড়ে একসঙ্গে জড়ো হয়েছে এবং নিজেদের মধ্যে কী যেন কথা বলছে!

ভোর হবার আগে ওরা চুপিসারে সাধুদের বসতিতে যেত। চারপাশে ঘোরাফেরা করত। আলো ফুটবার আগে আবার হারিয়েও যেত। কিন্তু এই উনিশে মে তারিখে কী এমন রহস্য লুকিয়ে আছে যার জন্য নেকড়েরা এমন করে তা এখনও আবিষ্কার করতে পারেনি রোবান। তবে এবার বসতি থেকে পালিয়ে যাবার সময় সে ঠিক করে নিয়েছিল যা কিছুই হয়ে যাক না কেন, উনিশে মে গভীর রাতে জঙ্গলের ওই জায়গায় সে যাবেই যাবে। এতে যদি মৃত্যু হয় হোক।

আজ রাত বারোটার পর মে মাসের উনিশ তারিখ হয়েছে।
রোবান নিজের গায়ে পেট্রোল ঢেলে এসেছে যাতে নেকড়ের খুব কাছে চলে গেলেও ওরা রক্ত গন্ধ কিংবা মানুষের গায়ের গন্ধ টের না পায়।

অন্ধকার আঁকাবাঁকা পথ। লতাপাতা ছোটোবড়ো গাছের আঁড়াল দিয়ে অতি সন্তর্পণে এগিয়ে যায় রোবান। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখে এবারও একদল নেকড়ে সেই একই জায়গায় জড়ো হয়েছে! প্রতিবছরের মতোই। কিন্তু একটা জায়গায় পরিবর্তন হয়েছে। তা হলো, নেকড়েগুলো আজ বসতির দিকে যাচ্ছে না। বরং উল্টো পথ ধরে চলে যাচ্ছে অন্য কোথাও। গত কুড়ি বছরের অভিজ্ঞতায় এই প্রথম এমনটা দেখল রোবান। কৌতূহল এবং আগ্রহে কোনোকিছু না ভেবে নেকড়েগুলোর পিছু নেয় সে।

চলবে
মো. ইয়াছিন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here