লারিসা পর্ব ১১

0
458

গল্প : লারিসা | পর্ব : এগারো

ছেলেটার মুখের কাছে গিয়ে গন্ধ শুঁকে লারিসা। কেরোসিনের ভকভকে গন্ধ বেরোচ্ছে তার মুখ থেকে। কী অদ্ভুত! ছেলেটা কেরোসিন খেয়ে ফেলেনি তো আবার?

লারিসা ভেবে পায় না এই অদ্ভুত ছেলেটা কীভাবে তার ঘরে এল। নিশ্চিন্ত মনে লারিসার বিছানায় পড়ে ঘুমাচ্ছে সে। এখন দেখতে তাকে মানুষের মতোই মনে হচ্ছে। কিন্তু লারিসা জানে, এই ছেলেটা মানুষ নয়, অন্য কিছু! লারিসা এটাও জানে যে, এই ছেলেটা গভীর রাতে মানুষ থেকে অন্য একটা প্রাণী হয়ে যায়। তার গায়ে লম্বা পশম গজায়, হাতের নখ বড়ো বড়ো হয়, পিঠে হাতির দাঁতের মতো শিং বেরোয় আর… এসব সে গতকাল রাতে দেখেছে। কিন্তু তখন সে নেশনয় বুুঁদ ছিল। তাই তার একটু সন্দেহ হচ্ছিল। আসলেই কি ছেলেটা গভীর রাতে ওরকম হয়ে যায়? না কি নেশা করার ফলে সে ভুলভাল দেখছিল?

ব্যাপারটা দ্বিতীয়বার দেখার জন্য চেয়ার পেতে বসে থাকে লারিসা। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ওই ছেলের দিকে। এভাবে কতক্ষণ কেটে যায় তা সে জানে না। রাত বাড়ার সাথে সাথে চোখদু’টো লেগে আসতে থাকে তার। সে কোনোমতে নিজেকে জাগিয়ে রাখে। কিন্তু একসময় একেবারে চোখ বন্ধ হয়ে যায় তার। এরপর প্রায় বিশ মিনিট পর, যখন সে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গিয়েছিল, পৃথিবীর সবকিছু থেকে নির্লিপ্ত অবস্থায় একটা শীতল হাতের স্পর্শ পেয়ে ঘুম ভেঙে যায় তার। আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে দেখে, সেই ছেলেটার হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছে। তার মুখ শুকনো এবং ভীত। লারিসা কিছু বলতে যাবে তার আগেই ছেলেটা তার মুখ চেপে ধরে বলে, “চেঁচাবেন না। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।”

মেরে ফেলবে? কারা? প্রশ্নটা করতে পারে না লারিসা। কারণ তার মুখে হাত চেপে ধরে রেখেছে ছেলেটা। সে লারিসাকে টেনে নিয়ে যায় জানালার কাছে। আড়ালে দাঁড়িয়ে সে আঙুলের ইশারায় বাইরের দিকটা দেখিয়ে দেয়। বাইরে, ঘর থেকে প্রায় বিশ হাত দূরে অসংখ্য লোক দাঁড়িয়ে। ওরা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। ছেলেটা ভীত গলায় বলে, “ওরা আমার গ্রামের লোক। আমাকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছে। আমাকে ওদের হাত থেকে বাঁচান। আমাকে রক্ষা করুন। বিনিময়ে আপনি যা চাইবেন তা-ই দিব।”

লারিসা সাতপাঁচ ভাবে না। এতগুলো লোককে নিজের চোখে দেখতে পেয়ে ছেলেটার কথা বিশ্বাস করে নেয় সে। নিজের মুখ ছাড়িয়ে নিয়ে নিচু আওয়াজে বলে, “ওরা কি ঘরের ভেতরে খুঁজবে?”

প্রশ্ন শুনে ছেলেটার মুখ আরো শুকিয়ে যায়। সে বলে, “একবার যখন এখানে এসেছে, ঘরের বিন্দুমাত্র অংশ ছাড়বে না।”

লারিসা ভেবে পায় না কোথায় ছেলেটাকে লুকিয়ে রাখবে। এদিকে লোকগুলো দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে। লারিসা ভাবছিল। ততক্ষণে একজন সাধু কৌশলে বাইরে থেকে দরজা খুলে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে ঢুকে গেল দু’জন। তাদের পেছনে আরো একজন। সাবধানে, খুবই সতর্ক হয়ে এগোতে শুরু করল ওরা। হলঘরটা তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখল। তারপর গেল শোবার ঘরে, ওই ঘরে কেউ থাকে না। লারিসার ঘরের দরজায় যখন চলে এসেছে তখনও লারিসা সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি কোথায় ছেলেটাকে লুকিয়ে রাখবে। শেষমেশ, এই ঘরের দরজা যখন খুলেই যাচ্ছিল, আরকিছু ভেবে না পেয়ে চটজলদি একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে লারিসা। ছেলেটাকে হেঁচকা টান দিয়ে বিছানায় নিয়ে যায়। সে নিজেও শুয়ে পড়ে। তারপর নিজেদেরকে এক চাদরে ঢেকে দেয়। পুরো দেহ না, বুক পর্যন্ত। কিন্তু এতে ছেলেটার মুখ দেখা যাবে এবং ওরা ছেলেটাকে চিনে ফেলবে।

লারিসা ছেলেটাকে নিচের দিকে ঠেলে দেয়। ছেলেটার মাথা লারিসার বুকের কাছে। একেবারে মিশে যায় দু’জন। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেয় যে, চাদরের নিচে দু’টো মানুষ আছে। যে কেউ বলবে একজন শুয়ে আছে। কিন্তু এমন অবস্থায় লারিসার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। অসহ্য লাগছিল। ঘৃণা হচ্ছিল। একটা অপরিচিত লোক…

কিন্তু তখনই তার মনে হয়, মানুষটা নিজের জীবন চেয়েছে। বাঁচতে চেয়েছে। এমন দুর্দিনে লারিসা নাহয় এটুকু সহ্য করল!

লোকগুলো ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়লে ছেলেটাকে শক্ত করে চেপে রাখে লারিসা। ওদের একজন এসে লারিসার চেহারা দেখে নিয়ে অপরজনকে ইশারায় বলে, এখানে নেই। অনেক সময় নিয়ে নিঃশব্দে পুরো ঘরে তল্লাশি চালায় তারা। সব খুঁজলেও লারিসার গায়ের উপর থেকে চাদর সরিয়ে দেখে না। ওরা ভাবে একজন শুয়ে আছে। আসলে দু’জন!

বাকি রাতটা আর ঘুমায় না তারা। লোকগুলো চলে গেলেও আতঙ্ক থেকে যায়। আতঙ্ক নিয়ে বসে থাকে ছেলেটা। অন্যদিকে লারিসার বুকের ভেতর তীব্র ঢেউ। এই প্রথম সে কোনো পুরুষ মানুষের সংস্পর্শে এল। তাও এতটা! এত গভীর স্পর্শ! এত কাছে!

পরদিন ছেলেটা দূরে কোথাও চলে যায়। আর দেখা হয় না। প্রথম কয়েক সপ্তাহ খুব মনে পড়ত ছেলেটার কথা। তারপর ধীরে ধীরে লারিসাও ভুলে যেতে থাকে। একা জীবনটা আবারো উপভোগ করতে শুরু করে সে। কিন্তু নিয়তি বলতে একটা বিষয় আছে। নিয়তিতে যদি লেখা থাকে ছেলেটার সাথে আবার দেখা হবে তাহলে যত যা-ই হয়ে যাক না কেন, দেখাটা হবেই। এবং হলোও। তা-ও ছত্রিশ কিলোমিটার দূরে একটা জায়গায়। সেখান থেকে একটা চিঠি এসেছিল লারিসার নামে। তার দূরের এক আত্মীয় চিঠিতে লিখেছিলেন, “যত দ্রুত সম্ভব আমার সাথে দেখা করো।”

এই এক লাইনের লেখা পড়ে লারিসা ভেবেই নিয়েছিল সে যাবে না। কিন্তু যত সময় যাচ্ছিল ততই যেন কথাটা চিন্তায় ফেলে দিচ্ছিল তাকে। কী এমন হতে পারে যার জন্য এত জরুরি তলব? সেটা কি ফোন করে বলা যেত না? চিঠি দিয়ে কাছে ডাকার কোনো মানে হয়?

সেখানে ছুটে গেলে মাঝবয়সি এক ভদ্রমহিলা লারিসাকে ভেতরের ঘরে নিয়ে যান। বসতে দেন। এক কাপ কফি ধরিয়ে দিয়ে কোনোরূপ ভনিতা না করে সহজ গলায় বলেন, “মাসখানেক আগে কার অ্যাক্সিডেন্টে তোমার মা মারা গেছেন।”

কথাটা শুনতেই যেন বুকের ভেতর ঝড় বয়ে যায় লারিসার। মা কাছে না থাকলেও বেঁচে ছিলেন। লারিসা এতদিন মা’কে ঘৃণা করত। কিন্তু এখন সে অনুধাবন করতে পারছে, সেটা আসলে ঘৃণা ছিল না, ছিল অভিমান। মায়ের উপর রেগে থাকলেও ভেতরে ভেতরে সে মা’কে অনেক বেশি ভালোবাসত।

“বাবা জানে?” আচমকা বলে উঠে লারিসা। ভদ্রমহিলা শুকনো গলায় বলেন, “তোমার বাবা নিজে এই খবরটা দিয়েছে। ওদের ডিভোর্স হয়ে গেলেও ওরা একজন আরেকজনকে ভালোবাসত। দেখা করত। আমার এখানেও আসত মাঝেমাঝে। তোমার কথা বলত। তুমি দূরে থাকো বলে ওদের কষ্টের সীমা ছিল না। কিন্তু ওরা নিজেদের সম্পর্ক ছিঁড়ে দিয়ে যে পাপ করেছে, সেটার প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যই হয়তো কখনো তোমাকে দেখতে যায়নি। শুধু দূর থেকে চোখের চল ফেলেছে।” দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি আবার বলেন, “ওরা দু’জনেই তোমাকে খুব ভালোবাসত।”

লারিসা যখন চলে আসছিল, তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ওদিকে শীত পড়েছে খুব। সবাই ভারী জামাকাপড় গায়ে দিয়ে আছে৷ রাস্তায় যত পথচারী দেখা গেল সবাই শীতে আড়ষ্ট। শুধু একটা মানুষ পাতলা গেঞ্জি গায়ে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে! একমাথা এলোমেলো চুল, হ্যাংলা দেহের ছেলেটা একটা বাচ্চা মেয়ের হাত থেকে চকোলেট ছিনিয়ে নিচ্ছিল। লারিসা দ্রুত গিয়ে বাধা দিয়ে বলে, “একটা বাচ্চার হাত থেকে চকোলেট ছিনিয়ে নিচ্ছেন, লজ্জা করে না আপনার?”

ছেলেটা হা করে তাকায় লারিসার দিকে। তখন, ঠিক তখন বিস্ময়ে লারিসা নিজেও হা করে তাকিয়ে থাকে৷ কারণ সেই ছেলেটা, যে কিনা প্রচন্ড ঠান্ডায় পাতলা গেঞ্জি পরে আছে, সে-ই লি রি! লারিসা কাঁপাকণ্ঠে বলে উঠে, “আপনি!”

এরপর অনেক কথা হয়। এককাপ কফি শেয়ার করে ওরা। কফি শেষ হতে হতে ছেলেটার নাম জেনে নেয় লারিসা৷ তারপর কৌতূহলবশত টুকটাক প্রশ্ন করে, প্রশ্ন উঠে সেই মানুষগুলোর, যারা ওইদিন রাতে লি রি’কে খুঁজতে এসেছিল। লি রি সব বলে। তার জন্ম জঙ্গলে। জন্মের পরদিন ভোরবেলা গ্রামবাসীরা তাকে খুঁজে পায়। সেখান থেকে তাকে নিয়ে যায় একটা ঘরে। সেই ঘরেই তার বেড়ে উঠা। সেই ঘর থেকে সে কখনো বেরোতে পারেনি। কিন্তু একদিন, একটি মেয়েকে তার ঘরে পাঠানো হলো আত্মাশুদ্ধির জন্য। আত্মাশুদ্ধি! শুনে আশ্চর্য হয় লারিসা। এর পেছনে যে জঘন্য ব্যাপার লুকিয়ে আছে সেটা পরিষ্কার করে বলে লি রি। তারপর সে পালিয়ে এসেছে। কিন্তু পালানোর সময় শত শত নেকড়েরা তাকে সাহায্য করেছে সেই কথা ইচ্ছে করেই বলে না লি রি।

লারিসা সবকিছু বিশ্বাস করে নিলেও একটা বিষয়ে খটকা লাগে তার। সেটা হলো, কোনো মানুষ তার জন্মের কথা বলতে পারবে? জন্মের একদিন পর তার সাথে কী হয়েছিল সেসব কোনোদিন মনে করতে পারবে? নিশ্চয়ই না! কিন্তু লি রি বলছে, তার স্পষ্ট মনে আছে, তাকে জঙ্গল থেকে কুড়িয়ে নিয়েছিল লোকজন। শোনা কথা নয়, সে নিজ চোখে দেখেছে এবং তার স্পষ্ট মনে আছে।

লি রি আরো জানায়, এখানে সে বেশ কিছুদিন ধরে আছে। রাস্তায় থাকে, রাস্তায় ঘুমায় আর ভিক্ষা করে খায়। কিন্তু এখানে কেউ সহজে ভিক্ষা দেয় না। খেলা দেখাতে হয়। লি রি নানান রকম ভেলকি দেখিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করে। কিন্তু গতকাল একটা ভিক্ষুক গ্যাং তাকে বেধড়ক পিটিয়েছে এবং বলেছে, সে যেন আর এই এলাকায় ভিক্ষা না করে। বলতে বলতে শরীরের আঘাতপ্রাপ্ত স্থান দেখায় লি রি। লারিসা দুঃখ পেয়ে বলে, “কিন্তু আপনি ভিক্ষা করেন কেন?”

“ভিক্ষা না করলে খাব কী?”

“খাবারের জন্য? আমি যদি আপনাকে খাবার দেই? প্রতিদিন!”

“আপনি দেবেন? কিন্তু কেন দেবেন?”

“আপনি আমার কাজ করে দেবেন, তাই। আমার শপে চাকরি করবেন। বিনিময়ে থাকা, খাওয়া। হবে না?”

এতদিনে লি রি অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। মানুষের সাথে মিশতে শিখেছে। তাই ইতস্তত করে রাজি হয়ে যায় সে। কিন্তু একটা ভয়ও থেকে যায়। সাধুরা যদি খবর পেয়ে যায়? যদি ওরা আবার চলে আসে?

লারিসা সাহস দেয়। ওরা এতদিন পর আর খুঁজতে আসবে না। আর কখনো জানবেও না।

চলবে
মো. ইয়াছিন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here