রঙ বেরঙের জীবন পর্ব ১৫

0
270

#রঙ_বেরঙের_জীবন
পর্ব (১৫)
#নুশরাত_জাহান_মিষ্টি

জীবন কেটে যাচ্ছে রঙ বেরঙে। জীবন কখন রঙে, কখন বেরঙে কেটে যাচ্ছে সেটা উপলব্ধি করতে পারছে না রাত্রী৷ অনুভূতিগুলো কেমন জানো হয়ে গেছে। সহজভাবে সে মনের কোনে ধরা দিচ্ছে না।

তবে সাংসারিক জীবনে অসুখী নয় রাত্রী। বেশ কাটছে! শান্ত পরিবার যথেষ্ট ভালো। সেই সাথে শান্তও খারাপ না! শান্ত রাত্রীকে বেশ সময় দিচ্ছে। বাড়িতে থাকলে সবটা সময় রাত্রীকে খুশি রাখার চেষ্টা করে।

আজ শান্ত রাত্রীকে নিয়ে ব্যস্ত শহরটা ঘুরতে বেড়োবে বলে ঠিক করেছে। শান্তর উদ্দেশ্য রাত্রীকে খুশি করা হলেও, রাত্রী শান্তর খুশির জন্যই তার সাথে যাচ্ছে। শান্ত জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে প্রবেশ করে, শান্তকে যে কষ্টটা দিচ্ছে। সেই কষ্টের বিনিময়ে এটুকু খুশি শান্ত পেতেই পারে।

শান্ত রাত্রীকে নিয়ে একটি পার্কে বসলো। হাতে ঝালমুড়ি। দু’জনে নিরবে ঝালমুড়ি খাচ্ছে আর জীবনের হিসাব মেলাচ্ছে।

শান্ত হঠাৎ করে একটি কাজ করে ফেললো। শান্ত রাত্রীর গালে আস্তে করে ঠোঁট ছোয়ালো। রাত্রী বিষ্ময়ীত নয়নে শান্তর দিকে তাকালো।
শান্ত এখনি কি করলো বুঝতে পেরে মাথানত করে ফেললো! অপ্রস্তুত হয়ে বললো,” আ আমি দুঃখিত রাত। আমি এটা….”।
” ঠিক আছে”।
রাত্রীর কথায় অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো শান্ত৷ শান্ত তাকাতেই রাত্রী অন্যদিকে তাকালো। শান্ত এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না রাত্রী ব্যপারটা স্বাভাবিকভাবে নিলো, যেখানে শান্ত নিজেই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছে না।

শান্তর মন হঠাৎ করে স্বার্থপর হয়ে গেলো। স্বার্থপর মনটা বলে উঠলো,” খুব কি ক্ষতি হবে রুপ যদি কখনো ফিরে না আসে”?

এটুকু ভেবে পুনরায় স্বার্থপর মনটা বললো,” রুপ ফিরে না আসলে হয়তো রাত আমারে জীবনে মেনে নিবে। আমার সাথে জীবনটা রাঙিয়ে তুলবে”।

স্বার্থপর মনটাকে চুপ করাতে গিয়েই চুপ করাতে পারছে না শান্ত। স্বার্থপর হয়ে সে বারবার বলে চলেছে,” রুপ না ফিরলে সত্যি কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে”?
_____________

রুমটা বেশ বড়সড়। রুমের লাইটটি মিদু জ্বলছে। পাখাটাও ধীরে ধীরে ঘুরছে। সেই রুমের বিছানায় জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে রুপ। “রুপের কথা ছাড়া ভালো লাগে না তাই ওরে নিয়া আসলাম মনুরা”।

রুপের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি রুপের মুখশ্রীতে পলকহীনভাবে তাকিয়ে আছে। ক’টা দিনেই ছেলেটির চেহারায় বেশ পরিবর্তন এসেছে৷ চোখের নিচে কালি পড়েছে, মুখটি শুকিয়ে গেছে। শুধু একটি জিনিস রয়ে গেছে ছেলেটির মধ্যে। তা হলো হাঁসি। প্রথম দিন থেকে এ পর্যন্ত ছেলেটির মুখের হাঁসি কখনো কান্নায় বদলায়নি। ঔষধ যার হাঁসি কেড়ে নিতে পারেনি, তার হাঁসি যে সহজে বিলীন হওয়ার নয় সেটা মেয়েটি বেশ ভালোভাবে বুঝতে পেরেছে। হয়তো সবসময় হাঁসি-খুশি থাকা ছেলেটির মুখ থেকে হাঁসিটি তাকে ছেড়ে যেতে চায়নি, তাই তো হুশ না থাকলেও হাঁসিটা তার সঙ্গ দেয়। অজ্ঞান থাকার সময়ও ছেলেটির মুখশ্রী হাস্যোজ্জ্বল হয়ে ছিলো।

রুপ এবং মেয়েটির মাঝে নিরবতাকে রুপ ভেঙে দিয়ে বললো,” ঔষধ যহন দিবেন তহন মুখের পানে চাইয়া না থাইকা দিয়া দেন”।
মেয়েটি মলিন হাসলো তারপর বললো,” তোমারে আর ঔষধ দেওয়া হবে না”।
” ক্যান? এত দয়া আমার উপরে আইলো কেমনে”?
” দয়া নয়। তোমারে ঔষধ দেওয়া হইতো শুধু শরীর দূর্বল করার জন্য। বর্তমানে তুমি অনেক দূর্বল, তাই চাইলেও পালাতে পারবে না”।
” আমি পালাইয়া গেলে এহন কি লাভ হইবো”?
মেয়েটি বললো,” তা জানো না বুঝি”।
” আমি তো তেমন লাভ দেখতেছি না”।
” কেন তুমি চাও না এখান থেকে পালিয়ে আগের সুন্দর জীবনে ফিরে যেতে”?
রুপ হাঁসলো। প্রানভরে হাঁসলো। হাঁসতে হাঁসতে বললো,” সুন্দর জীবনডা কি সত্যি পাওন যাইবো”?

” কেন রাতকে ফিরে পেতে চাও না”?
রুপ পুনরায় হাঁসলো। হাঁসিমাখা মুখে কিছুটা কষ্টের ছাপ ফুটিয়ে তুলে বললো,” অধিকার যে নাই”।
মেয়েটি অবাক হলো। যাকে ভালোবাসে তার উপর অধিকার নেই বলছে। মেয়েটির বিষ্ময় কাটাতে রুপ বললো,” রাতের উপর এহন যার অধিকার আছে, সেই মানুষটা শান্ত”।

মেয়েটি বিষ্ময় নিয়ে বললো,” শান্ত”?
” হ। আমনেই তো কইলেন রাতের বিয়া শান্তর সাথে হইছে। যহন তাগো বিয়া হইয়া গেছে তহন আমি তাগো মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি। দু’জনের মানুষের মধ্যে তৃতীয় মানুষের কোন অধিকার থাকে না”।
মেয়েটি এবার রুপের মুখশ্রীতে তাকিয়ে হাঁসলো। কেন জানি তার হাঁসি চলে এলো!

রুপ খুশিমনে বললো,” শান্ত রাতরে মেলা ভালোবাসে। রাত শান্তর কাছে খুশি থাকবো। কাকী আম্মা হয়তো রাতের খুশি চায় নাই, তাই এমন করলো। তয় আমি জানি শান্ত রাতরে মেলা খুশি রাখবো”।

” তো তোমারে এখন ছেড়ে দিলে তুমি রাতের কাছে যাবা না”?
” রাতের মুখে হাঁসি থাকলে যাইবো। যাইয়া শুধু বলবো ভালো থেইকো রাত, মেলা ভালো”।
” রাতের মুখে হাঁসি না থাকলে….”?
” অপেক্ষা করবো, শান্ত কবে রাতের মুখে হাঁসি ফুটিয়ে তুলবো। শান্তর সাথে যেইদিন রাত ভালো থাকবো। সেইদিন যাইবো তাগো সাথে দেখা করতে”।
মেয়েটি হাঁসি ধরে রেখে বললো,” তোমার চিন্তা-ধারা খুব ভালো রুপ। তবে কিছু কিছু সময় স্বার্থপর হতে হয়। তাই বলছি দ্বিতীয়বার রাতরে ফিরে পাওয়ার সুযোগ পেলে তোমার তারে আপন করে নেওয়া উচিত”।

রুপ এবার কিছুটা শব্দ করে হাঁসলো। তারপর বললো,” দু’জনের মানুষের সংসারে ডোকাটা ঠিক না। যে মানুষডা প্রথমবারে আমার হইলো না তারে দ্বিতীয়বার কারো থেইকা কাউড়া আনা আমার জন্য সঠিক না।
হয়তো সে আমার লাইগা ছিলো না তাই তো তারে নিজের কইরা পাইলাম না”।

একটু থেমে রুপ পুনরায় বললো,” তয় পরজন্ম বইলা যদি কিছু সত্যি থাইকা থাকে তবে সে জন্মে আমি পুনরায় রাতের পিছু নিবো। তার ভালোবাসার ভেলায় ডুব দিবো”।

” তোমারে কিছু বলার নাই রুপ। তবে এটুকু বলবো পরজন্ম নিয়েই ভাবো কারন এ জন্মে দ্বিতীয়বার রাতের কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়তো তুমি পাবে না”।
রুপ কিছু না বলে শুধু হাঁসলো।
____________

শান্ত এবং রাত দু’জন রাস্তা দিয়ে পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছিলো। দু’জনেই নিরব। নিরবতায় শান্ত আনন্দ খুঁজে পেলো। কারন নিরবতার মাঝে তার হৃদয়ে এক অন্যরকম অনুভূতির জন্ম নিলো। যেই অনুভূতিতে কোন বিষাদ নেই। আছে শুধু আনন্দ। হঠাৎ রাত্রীর ‘আহ’ শব্দে পাশ ফিরে তাকালো শান্ত। সাথে সাথে গিয়ে রাতের হাত ধরলো। কি হয়েছে বোঝার জন্য নিচের দিকে তাকালো! রাস্তার ইটের ছোট্ট অংশ সাথে পায়ে লেগেছে রাত্রী। আঙুলটা কেটে গেছে, রক্তও পড়ছে। শান্ত হাঁটু-গেড়ে বসলো। রাত্রীর পা ধরে পকেট থেকে রুমালটি বের করে আঙুলটা বেঁধে দিলো। রাত্রী চুপচাপ শান্তর দিকে তাকিয়ে রইলো।
পরে শান্ত যেটা করলো তার জন্য রাত্রী প্রস্তুত ছিলো না। শান্ত বসা থেকে দাঁড়িয়ে রাত্রীকে কোলে তুলে নিলো। রাত্রী হতভম্ব হয়ে গেলো। কিছু মূহুর্তের জন্য মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো। যখন মাথা কাজ করতে শুরু গেলো তখন কোল থেকে নামার জন্য রাত্রী ছটফট করতে লাগলো। শান্তকে গাড়ি নিতে বললো। কিন্তু শান্ত নাছোড়বান্দা, সে যখন রাত্রী ইচ্ছায় হেঁটে বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো তখন হেঁটেই যাবে। রাত্রী না হাঁটতে পারে তো কি হয়েছে, শান্ত তো পারে। এতেই হবে!
রাত্রী বিষ্ময় নিয়ে পুরোটা রাস্তা শান্তর মুখশ্রীতে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। রাত্রীর তাকিয়ে থাকা বুঝতে পারলেও, না বোঝার ভান করে এগিয়ে গেলো শান্ত।

রহিমা বেগমের শরীরটা কিছুদিন যাবত ঠিক যাচ্ছে না। তার অসুস্থতার খবর পেয়ে পলাশ শহর থেকে ফিরে এলো। পলাশের নিজের আব্বার প্রতি বিশ্বাস নেই। তার ধারনা তার আব্বা আম্মার অসুস্থতাও তাকে ফেলে রাখবে। পলাশের ধারণায় ভুল নেই, কারন সে যেভাবে তার আব্বাকে চিনেছে সেখান থেকে এই ধারনাটা জন্ম নেওয়া কোন অংশেই ভুল নয়।
পলাশ এসে রহিমা বেগমের কপালে হাত দিলো। দেখলো জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। মাথার কাছে পাত্রতে পানি, সাথে ভেজা কাপড়, দেখতে পেয়ে পলাশ বুঝলো কেউ রহিমা বেগমের মাথায় জলপট্টি দিয়েছে। কিন্তু কে দিলো! রফিক সাহেব! এত ভালো মানুষ সে কবে থেকে হলো! পলাশ বুঝতে পারলো না। রহিমা বেগমের ঔষধ পত্র খুঁজতে গিয়ে পলাশ খাটের এক কোনায় একটি কাগজ দেখতে পায়। কাগজটি বিছানার তলায় লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো হয়তো, তবে কাগজটির একটি কোনা বের হয়ে আছে। কাগজটি বের করবে কি করবে না ভেবে পলাশ কাগজটি বের করেই নিলো। পলাশ এবার কাগজের ভাজ খোলাটা ঠিক হবে কিনা সেটা নিয়ে দ্বিধায় পড়লো। জরুরি কাগজ ও হতে পারে ভেবে পলাশ কাগজটি খুললো। কাগজটি খুলে পলাশ থ মেরে বসে পড়লো।

এরমাঝে রফিক সাহেব চলে এলেন। হাতে তার ঔষধ। সম্ভবত ঔষধ আনতেই গিয়েছিলেন। রফিক সাহেবের মুখশ্রীতে এক পলক তাকিয়ে পলাশ অন্যঘরে চলে গেলো। কাগজটি এখনো তার হাতে। কাগজটি চোখ বুলিয়ে অস্পষ্টসুরে পলাশ বলে উঠলো,” আম্মা”।

চলবে,
[ভুলক্রুটি ক্ষমা করবেন ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here