রঙ বেরঙের জীবন পর্ব ১৪

0
315

#রঙ_বেরঙের_জীবন
পর্ব (১৪)
#নুশরাত_জাহান_মিষ্টি

বধু বেসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাত্রী। শান্ত ভিতরে গিয়েছে বেশ কিছুক্ষন হলো। ভিতরে কি হলো! হলো না! সে সম্পর্কে কিছুই জানে না রাত্রী! বেশ অনেকটা সময় পর শান্ত এলো। শান্তর সাথে একজন মহিলা সম্ভবত শান্তর মা বরণ ডালা নিয়ে এলো। কোন বাক্য বিতরণ ছাড়াই শান্তর মা শান্তর স্ত্রীকে বরণ করে ঘরে তুলে নিলেন। রাত্রী চুপচাপ ঘরের ভিতর প্রবেশ করলো। এবার শান্তর মা রাত্রীকে জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নিলেন এবং বললেন,” নাম কি তোমার”?
রাত্রী প্রশ্নটি শুনে প্রথমে শান্তর দিকে দৃষ্টি দিলো, শান্ত ইশারায় জবাব দিতে বললো। রাত্রী আস্তে করে বললো,” রাত্রী”।
শুকনো মুখে শান্তর মা বললেন,” ভালো। আমি কে জানো”?
রাত্রী না সূচক মাথা নাড়ালো। শান্তর মা একটু হাঁসার চেষ্টা করে বললেন,” আমি শান্তর মা। শান্ত এবং সৌমি(শান্তর বোন) এদের নিয়ে আমার সংসার। আজ থেকে সেই সংসারে তুমিও একজন হয়ে গেলে”।

এরপর মহিলা শান্ত সম্পর্কে নানা ধরনের কথা বললেন। শান্তর বাবা সম্পর্কেও বললেন। এক পর্যায়ে বললেন,” তিনি চলে যাওয়ার পর শান্তই আমার ভরসা। শান্ত না থাকলে আমি এতটা স্বাভাবিক থাকতে পারতাম না”।
রাত্রী বুঝতে পারলো শান্তর বাবা বেঁচে নেই। শান্তর মা বেশকিছু কথা বললো। রাত্রী শুধু নিরবে শুনে যাচ্ছিলো। বেশ কিছুটা সময় পর তিনি রাত্রীকে শান্তর ঘরে নিয়ে গেলেন এবং বললেন,” গল্প করতে করতে ভুলেই গেছিলাম তোমার এখন জামা-কাপড় বদলে একটু বিশ্রাম নেওয়া উচিত”।
একটু থেমে পুনরায় বললেন,” আমি এমনি। কথা শুরু করলে আর থামার নাম নেই”।

শান্তর মায়ের সম্মতি পেয়ে রাত্রী পোশাক বদলে বিছানায় শুয়ে রইলো। তারও মনে হচ্ছে এই সময়টা বিশ্রাম নেওয়ার৷ শান্ত বাসায় নেই। রাত্রীর সাথে মাকে গল্প করতে দেখে সে কোথাও একটা চলে গেছে।

শান্ত বাসায় আসতে আসতে রাত্রী ঘুমিয়ে পড়েছে। শান্ত রুমে ডুকে রাত্রীকে ঘুমাতে দেখে কিছুক্ষন তার মুখশ্রীতে তাকিয়ে রইলো। একবার ভাবলো তাকে ডাকবে। পরক্ষনেই বললো,” না থাক। একটু বিশ্রাম নিক”।
রাত্রীর ঘুম ভাঙতে ভাঙতে সন্ধ্যায় গড়ালো। ঘুম থেকে জেগে সে অবাক হলো। সন্ধ্যা হয়ে গেছে এখনো কেউ তাকে ডাকেনি। মনেমনে বেশ লজ্জা পেলো। জলদি করে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে বসার ঘরে চলে এলো। বসার ঘরে আসতেই একটি মেয়ে এসে রাত্রীকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর বললো,” জানো ভাবী আমি সেই কখন থেকে তোমারে দেখার জন্য উদ্ধিগ্ন হয়ে আছি”।
একটু থেমে পুনরায় বললো,” কিন্তু এই বাদর(শান্ত) বললো তুমি ঘুমাচ্ছো এখন বিরক্ত করা যাবে না”।
রাত্রী লজ্জায় কিছু বলতে পারলো না। শান্তর মা রাত্রীকে দেখে বললো,” উঠে পড়েছো। চলো নাস্তা করে নেও। সৌমি ভাবীকে নিয়ে নাস্তা করতে আসো”।
” হ্যাঁ মা”।
সৌমি রাত্রীকে নিয়ে বসালো। তারপর চায়ের কাপ এগিয়ে দিলো। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও শাশুড়ী কথায় চা হাতে নিলো। শান্ত এতক্ষন যাবত রাত্রীর মুখশ্রীতে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। রাত্রীর অনিচ্ছা বুঝতে পেরে বললো,” ভালো না লাগলে রেখে দেও। যা খেতে ইচ্ছে করছে সেটার নাম বলো আমি এনে দিচ্ছি”।
রাত্রী এবার মুখ খুললো। খুব আস্তে করে বললো,” আমি এখন কিছু খাবো না”।
শান্ত কিছু বলতে নিলে তার মা বললো,” তোমাদের সবাইকে আমার কিছু বলার আছে”?

শান্ত মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,” হ্যাঁ মা বলো”?
” আমার ছেলের বিয়ে এভাবে হুট করে হওয়ায় আমি প্রথমে মনোখুন্ন হয়েছিলাম। তবে যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে। যেটা বলছিলাম আগামী পরশুদিন আমি আমার কিছু অতিথিদের শান্তর বৌ দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছি। ছোট করে বৌভাতটা করতে চাচ্ছিলাম আর কি! তোমরা তোমাদের বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানালে জানতে পারো”।
একটু থেমে পুনরায় বললো,” এটাই বলার ছিলো”।
শান্ত দ্বিমত পোষণ করে বললো,” মা এসবের কি প্রয়োজন? এত আত্নীয় স্বজনের মধ্যে রাত বিরক্তবোধ করবে”?

” আমি আমার কথা জানালাম। তোমার মতামত চায়নি। বিয়ে নিজের ইচ্ছায় করেছো, এখন যেটা হবে সেটা আমার ইচ্ছায়”।
শান্ত কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই শান্তর মা বললেন,” কিছু শুনতে চাচ্ছি না। আগামী পরশুদিনের জন্য তৈরি থেকো”।

আর কেউ খুশি নাহলেও সৌমি বেশ খুশি হয়েছে। এই সুযোগে তার সব বন্ধুদের বাসায় আসতে বলবে। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে খবরটি পেয়ে কিছুটা মন খারাপ হয়েছিলো তার। ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেলো অথচ সে কোন আনন্দ করতে পারলো না! এখন সেই খারাপ লাগাটা রইলো না। সৌমি নাচতে নাচতে অনুষ্ঠানে কোন পোশাক পড়বে তা বের করতে চলে গেলো।

শান্ত রাত্রীর দিকে তাকিয়ে তার মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করে চলেছে। রাত্রী আদো কি চায়! রাত্রী শান্তর দিকে তাকিয়ে সম্মতিসূচক ইশারা করলো। তাদের কাছে এটা অভিনয় হলেও বাকিদের কাছে তো তা নয়। তারা নিজেরা খুশি নয় বলে যে অন্যদের খুশি কেড়ে নেবে তা তো হয় না।

রাতের বেলা,
রাত্রী এবং শান্ত বিছানার এপার-ওপারে বসে আছে। দু’জনেই নিরব। নিরবতা ভেঙে রাত্রী বললো,” রুপের শহরে কোন আত্নীয় আছে কিনা খোঁজ নিবে শান্ত”?
শান্ত একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,” নিয়েছি। রুপের শহরে তেমন কোন পরিচিত মানুষ নেই। এক বন্ধু ছিলো কিন্তু তার বাসায় যায় নি”।
” এসব খোঁজ কখন নিলে”?
” সেটা না জানাই থাক। তোমার যেটা প্রয়োজন সেটা তো করেছি। আমি চেষ্টা করবো খুব তাড়াতাড়ি রুপের কাছে পৌঁছানোর”?

রাত্রী নিরব হয়ে গেলো। রাত্রীকে চুপ থাকতে দেখে শান্ত বললো,” রুপ যদি ভালো চাকরি নিয়ে তোমার কাছে আসে। তবে কি তুমি তাকে বিয়ে করে সংসার করবে রাত”?
রাত্রী চোখ বন্ধ করে ফেললো। মনেমনে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। রুপ ফিরে আসলে সে কি করবে তার জানা নেই! নিজের জন্য সে শান্তর জীবন নষ্ট করছে নয়তো! শান্তর জীবন নষ্ট করে সে কি রুপের কাছে ফিরতে পারবে! রুপ ফিরে আসলে কেমন হবে তাদের তিনজনের গল্পটা। শান্ত যে তাকে ভালোবাসে সেটা তো তার অজানা নয়। মেয়ে মানুষের একটা বিশেষ গুন থাকে, তাদের দিকে তাকিয়ে থাকা পুরুষ মানুষের দৃষ্টি থেকে তারা বুঝতে পারে কোনটা ভালোবাসার আর কোনটা লালসার!
রহিমা বেগমের কষ্টের জীবনে কিছুটা শান্তি দিতে সে কি ভুল করলো! শান্তর জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে তার মা এবং বোনের জীবন। এতগুলো মানুষের জীবন নিয়ে খেলাটা কি ঠিক হচ্ছে!

রাত্রীকে নিরব দেখে শান্ত চুপচাপ নিচে বিছানা করে ঘুমিয়ে পড়লো। রাত্রী দেখেও কিছু বললো না। বলতে চাইছিলো কিন্তু কোন এক অদৃশ্য শক্তি তাকে বলতে বাঁধা দিচ্ছে।

_______
দুটো দিন শাশুড়ী এবং সৌমির সাথে ভালোই কাটলো। যতটুকু বোঝা গেলো শান্তর পরিবার খুব ভালো।
আজ সকাল থেকে বাড়িতে হৈ-হুল্লোড়। শান্তর মায়ের, শান্তর এবং সৌমির বন্ধু-বান্ধব সবাই আসা শুরু করে দিয়েছে। রাত্রীকে সকাল বেলাই তৈরি করে বসার ঘরে বসিয়ে রাখা হয়েছে। সে চেয়েছিলো শান্তর মায়ের সাথে হাতে হাতে কাজ করতে কিন্তু শান্তর মা তা একদমি হতে দেয়নি৷ তার এক কথা চুপচাপ সেখানে বসে থাকবে। সৌমি এসে মাঝেমাঝে গল্প করে যাচ্ছে। একেক সময় একেক বন্ধুর সাথে আলাপ করাচ্ছে।
গ্রাম থেকে রাত্রীর পরিবারও চলে এলো। রাত্রী সবার সাথে কুশল বিনিময় করলো। রহিমা বেগম রাত্রীর সাথে বেশ আলাপ জমালেন। শান্তর পরিবার কেমন থেকে শুরু করে রাত্রীর প্রতি শান্তর ব্যবহার সবকিছুর খোঁজ নিলেন।

অন্যদিকে পলাশ গিয়ে শান্তকে জড়িয়ে ধরলো। শান্ত খুশি হয়ে পলাশকে জড়িয়ে ধরলো। পলাশ মুখে হাঁসি রেখে বললো,” সেদিন তুই বলেছিলি না ভাগ্য থাকলে হবে। হয়তো ভাগ্য তোর সাথে ছিলো তাই রাত তোর হলো”।
বিনিময়ে শান্ত মুচকি হাঁসলো। মনেমনে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,” সত্যি কি হলো? যদি রুপ ফিরে আসে তখন তো চলে যাবে”?
শান্ত সাবধানে পলাশকে জিজ্ঞেস করলো,” রুপের কোন খোঁজ পাওয়া গেলো”?
” না। রুপের পরিবার বেশ চিন্তিত। তবে আমার মনে হয় কাপুরষটার খোঁজ না পাওয়া গেলেই ভালো। যে নিজের বিয়ের দিন চলে যেতে পারে তার মতো কা……”
শান্ত বলতে না দিয়ে বললো,” দয়া করে থাম ভাই। রুপ এমন নয়৷ আর কেউ জানুক আর না জানুক আমি জানি রুপের ভালোবাসায় কোন খাঁদ নাই”।
রাত্রী পলাশের সাথে কথা বলতে আসছিলো। ওদের দু’জনের কথা শুনে থমকে দাঁড়ালো। রাত্রী মনে হলো এখানে থাকা তার ঠিক নয়। তাই সে পুনরায় পূর্বের স্থানে ফিরে গেলো।
শান্তর অনেক বন্ধু এসেছে। রাত্রীর সাথে শান্ত তাদের পরিচয় করিয়ে দিলো। রাত্রী মুখে হাঁসি ফোটানোর চেষ্টা করে সবার সাথেই পরিচিত হলো।
অনুষ্ঠান ভালোই চলছিলো। হঠাৎ রাত্রীর কানের কাছে কেউ একজন আস্তে করে বললো,” রুপের তোমার সাহায্যের প্রয়োজন”?

রাত্রী চমকে পিছন ঘুরে তাকালো। কিন্তু কেউ নেই! রাত্রী আশেপাশে তাকালো। একটি মেয়ের পিছন দেখা যাচ্ছে। যার গায়ে সবুজ শাড়ী। অতিথিদের মধ্যে সবুজ শাড়ি পরিহিত বেশ কিছুজন এসেছিলো। তাই রাত্রী বুঝতে পারলো না এ কে ছিলো! রাত্রী বিষ্ময় নিয়ে শান্তকে তাদের রুমে আলাদা ডাকলো। শান্ত রাত্রীর সাড়া পেয়ে রুমে চলে এলো। শান্ত আসতেই রাত্রী খুব বিষ্ময় নিয়ে বললো,” শান্ত রুপ ভালো নেই”।
শান্ত চমকে উঠলো। রাত্রী বাক্যটি বলে কান্নায় ভেঙে পড়লো। শান্ত রাত্রীকে বোঝানোর চেষ্টা করলো। কিছু সময় পর রাত্রী স্বাভাবিক হলেই শান্ত প্রশ্ন করলো,” রুপ ভালো নেই মানে? তুমি রুপের ব্যপারে কি জানতে পেরেছো? কেন এমন বললে”?
” আমি জানি না। একজন বললো….”।
” কি”?
বিষ্ময় নিয়ে শান্ত রাত্রীর দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো,” সে কি ছিলো তোমাদের বাসার কেউ”?
” না। এটা একটা অপরিচিত কন্ঠ ছিলো”।

” এটা কিভাবে সম্ভব? এখানে রুপের ব্যাপারে তোমার পরিবার ছাড়া কেউ জানে না? যারা এখানে আসে সবাই আমাদের আত্নীয় কিন্তু তারা রুপের সম্পর্কে কিভাবে জানবে”?
রাত্রী বেশ ভাবনায় পড়ে গেলো। শান্তও গভীর ভাবনায় পড়লো। আচ্ছা এটা রাত্রীর মনের ভুল নয়তো। হতে পারে রুপের কথা চিন্তা করতে করতে ভুল শুনেছে! শান্ত বেশ আস্তে বললো,” আমার মনে হয় এটা তোমার ভ্রম। তবুও আমি চেষ্টা করবো অনুষ্ঠানে রুপের সম্পর্কে জানে এমন কেউ আছে কিনা”!
ভ্রম। এটা রাত্রীর ভ্রম! সবুজ শাড়ি পরিহিত পিছন দিক দেখা মেয়েটির কথা রাত্রী শান্তকে বললো না। কারণ রাত্রী নিশ্চিত নয় সে ছিলো কিনা! শান্ত অনুষ্ঠানের সবার দিকে দৃষ্টি রাখলো। কারো মধ্যে অস্বীভাবিক কিছু চোখে পড়ছে না।

রাত্রীও নিজেকে সামলে অনুষ্ঠানে ফিরে আসলো। রাত্রী অনুষ্ঠানে থাকলেও তার ভাবনা জুড়ে শুধু একটাই বাক্যা,” রুপের তোমার সাহায্যের প্রয়োজন”।

চলবে,
[ভুলক্রুটি ক্ষমা করবেন। বিয়েতে আছি তবুও যে দিলাম তার জন্য সুন্দর সুন্দর কমেন্ট কইরা আমার মনটা ভালো কইরা দেন]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here