রক্তের বন্ধন
Part_19
যদি বুকটা চিঁড়ে দেখাতে পারতাম তাহলে বুঝতে কতটা ভালবাসি তোমায়! প্লিজ আর কত কষ্ট দিবে আমায়? তুমি আমাকে একবেলা খেতে দিয়ো। আমি তোমার কাছে স্বামীর অধিকারো চাইবো না। শুধু রাইসার মুখে মা ডাকটা শুনতে চাই।
– বাবা দেখ কাঁদছে। বাবা তুমি না আমার বাবা ক্ষমা করে দাও না। বাবা আমার মমকে ক্ষমা করে দাও!
– কথাকে পায়ে থেকে তুলে যখনি বুকে নিতে যাবো। তখনি, জুথি দৌঁড়ে রুমে আসল। ভাইয়া ‘ আমার স্বামী অবস্থা খুব খারাপ। জুথির সাথে সাথে ডাক্তার ও রুমে ঢুকল।
– মিঃ রাজ আপনি আসেন আমাদের সাথে।
– ডাক্তার রুমে নিয়ে গিয়ে যা বলল তা শুনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আপনার অপারেশন আজই করতে হবে। তবে আপনি যে কিডনী ডুনেট করবেন এতে আপনার জীবন ও চলে যেতে পারে। কারণ আপনার একটা কিডনীর অবস্থা ভালো না। তবে সমস্যা হওয়ার সম্ভবনা কম। তাই আপনার ইচ্ছা আপনি কিডনী দিবেন কি না? আজ রাতে অপারেশন হবে।কারণ মিসেস জুথির স্বামীর অবস্থা ভালো না।
– হুম ডাক্তার সাহেব। কিডনী যে আমাকে দিতেই হবে। জুথির জন্যই যে আমার করিজার টুকরার অপারেশন হয়েছে! আর আমি চাই না ভাই হয়ে বোনকে বিধবা বানাতে। জুথি যে আমায় ভাইয়া বলে ডেকেছে। আপনি সব রেডি করেন। আমি রাইসার কাছেই আছি।
– ধন্যবাদ রাজ। সত্যি আপনি মহান!
– আমি ডাক্তারের রুম থেকে বের হয়ে। রাইসার বেডে এসে পড়লাম। আমার কলিজার টুকরাটা ঘুমাচ্ছে। মনে হচ্ছে একটা প্রজাপতি ফুলের ওপর বসে আছে। রাইসার মাথায় কথার বুকে । রাইসা ঘুমিয়ে আছে পরম যত্নে। কথাও রাইসাকে বুকে নিয়ে প্রশান্তির ঘুম পাচ্ছে। বিকেলবেলা অসময়ে ঘুম!
– হঠাৎ সাথি কোথায় থেকে যেন আসলো!
এসেই আমার হাতে একটা কাগজ তুলে দিল!
– এই নাও রাজ, আমার এপারমেন্ট লেটার। আগামী সপ্তাহ থেকে অফিসে জয়েন্ট করতে বলেছে। আবেদনটা করে রেখেছিলাম হয়ে গেছে। হঠাৎ সাথি বেডের দিকে তাকাতেই চুপসে গেল। তার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। শুধু চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।
– কি হল সাথি কাদঁছো কেন?
– রাজ আমার মেয়ে। আমার মেয়েকে আমি কারো হতে দিব না। তুমি আমার বুকে ফিরিয়ে দাও!
রাইসা কথার বুকে । রাইসাকে তার মায়ের কুল থেকে সরানোর কোন অধিকার যে আমার নেই! কোন বাবাই পারে না, তার মায়ের বুক থেকে তার মেয়েকে সরিয়ে ফেলতে। এদিকে সাথি কেঁদেই চলছে। আমি সাথির চোখটা মুছে রাইসার কপালে চোখ রাখতেই। রাইসা মিটিমিটি করে চোখ খুলল। চোখ খুলেই দেখে, রাইসাকে কথা তার বুকের সাথে জড়িয়ে রেখেছে। কথার হাতটা রাইসা সরাতে গেলেই কথা জেগে ওঠে। বাবাই তুমি কোথায় ছিলে? আর আপনি ছাড়ছেন না কেন। দেখছেন না আমার বাবাই আসছে বাবাইয়ের কুলে যাবো।
– মারে তোর বাবাইয়ের কুলেই যাবি তোর মাঢের কুলে আসবি না। তোর মায়ের বুকটা যে কষ্টে ফেটে যাচ্ছে। ( সাথি)
– তুমি একদম কেঁদো না মম। তোমার কুলেও যাবো। এই বলে দৌঁড়ে সাথির কুলে গিয়ে উঠল রাইসা।
– সাথি রাইসাকে কুলে নিয়ে গালে – মুখে চুপু দিতেই জড়িয়ে ধরল রাইসা।
– কথা অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে। কি বলবে সে ভাষা পাচ্ছে না। কথার বুকের ভেতরটা ধুমড়ে -মুচড়ে যাচ্ছে। এত কষ্ট কেন হচ্ছে।
চোখ থেকে এমনিতেই পানি আসছে। হঠাৎ কথা যা করল! তা দেখার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। কথা সাথির পায়ে ধরে বলল’ জানো সাথি জীবনে মাকে মা বলে ডাকতে পারিনি। বাবা ছিল সারাদিন টাকার পিছনে ছুটতো। আমার কোন বোন নেই। আজ থেকে তুমি আমার বোন। তোমার কাছে এই ভিক্ষারী বোনটা তার কলিজার টুকরাটাকে ভিক্ষা চাই। দিবে তোমার বোনকে?যতক্ষণ না তুমি আমার মেয়েকে ভিক্ষা না দিবে ততক্ষণ আমি তোমার পা ছাড়বো না।
– কথার এমন কান্ড দেখে নিজের চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারলাম না। নিজের অগোচরে চোখে পানি এসে গেল। মন চাচ্ছে দু’টো থাপ্পর কথাকে দিয়ে বুকে টেনে নেই। আজ মনে হচ্ছে কথা সত্যিই রাইসাকে ভীষণ ভালবাসে।
– আপু কি করছ তুমি? বোন ডেকেছো। তবে কেন বোনের পায়ে পড়েছো উঠো বলছি।
– কথা উঠে দাঁড়াতেই, সাথি বলতে লাগলঃ – জানু আপু, তুমি তো বাবার অর্থ সম্পর্দের মাঝে বড় হয়েছে। আর আমি কুঁড়ে ঘরে। জীবন কী জিনিষ তখনি চিনতে পেয়েছি যখন ক্লাস ফ্লরে থাকতে বাবা মারা যায়। মায়ের কাছেই বড় হয়েছি। দিনে একবেলা খেয়ে স্কুলে পড়েছি। ছাএী ভালো ছিলাম তার সুবাধে স্যারেরাও সহযোগীতা করেছে। তবে কি জানেন আমার মাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। যে গ্রামে থাকতাম সে গ্রামের মাতবর একটা চরিএহীন ছেলে। মাকে বাজে প্রস্তাব করায় রাজি না হওয়াই কলঙ্ক দিয়ে বাপের ভিটা থেকে বের করে দেয়। এসে পড়ি ইট – বালি- সিমেন্টে গড়া এ শহরে কত কষ্ট করে লেখাপড়া করে আপনার কোম্পানীতে জব পাই। আর তার থেকেই একটু একটু করে রাজকে চিনে নেয়।
জানেন আমার বিয়ে হয়ে যেত। কিন্তু বিয়ের দিন বরপক্ষ কোন না কোন ভাবে যেন যাই আমি মা হতে পারব না। সে জন্য বিয়েটা ভেঙে যায়। আর আপনি যে রাজের প্রতি যে অবিচার করেছেন তা সত্ত্বেএ পাগলের মতো রাজ আপনাকে ভালোবাসতো। জানি না, অল্প অল্প পরিচয়ে কখন যে আমার হৃদয়ে রাজকে বসিয়ে ফেলেছিতা জানি না। আর রাইসার রক্তমাখা মুখটা এখনো আমার চোখে ভেসে ওঠে। জানেন আপু রাজকে আমি নিজের স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেছি সেদিনই, যেদিন মা – রাজের হাতে আমাকে তুলে দিয়েই মারা যায়। আর আমি রাইসাকে সেদিন থেকেই নিজের জীবনের একটা অংশ করে নেয়। এখন আপনি যেহেতু আমার বোন ডেকেছেন। তাই আপনি রাজ আর কথাকে নিতে পারেন একশর্তে ।
– কি শর্ত? টাকা লাগবে? আমার যতটাকা আছে সব নিয়ে যাও। তবুও আমার মেয়ে আর স্বামীর জীবন থেকে সরে যাও।
– বাহ! আপু। এই আপনার ভালবাসা। আপনার কাছে আপনার গরীব বোনটা টাকা চাই না । পাশেই ফলকাটা ছুরি নিয়ে, কথার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল’ আপু এটা দিয়ে আমায় খুন করে তুমি রাজ আর রাইসাকে নিয়ে যাও। আর কোন বাঁধা থাকবে না।
– এই সাথি কি করছো?
– কই কিছু করিনি। শুধু বুঝাতে চেয়েছি আমি তোমায় ভালবাসি। নিজের থেকেও বেশি। আর রাইসা তো আমার অক্সিজেন।
– সাথির মুখে এমন কথা শুনে কথা হাঁটুগেড়ে ফ্লরে বসে পড়ল।
– কথার চিৎকার দিয়ে কান্না করতে ইচ্ছে করছে কি এমন অপরাধ করেছে। তার জন্য আল্লাহ তাকে এতবড় শাস্তি দিচ্ছে। সেও যে রাজকে ছাড়া বাঁচবে না।
– বাবাই দেখ মম কান্না করছে।
– রাইসার কথায়, কথা এবার শব্দ করেই কেঁদে দিল।
-মম তুমি ছেড়ে দাও তো ওই মম কাঁদছে। সাথি রাইসাকে ছাড়ছে না, রাইসা এক প্রকার জোর করেই, সাথির কুল থেকে নেমেই রাইসা দৌড়ে কথার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়! কথা কাঁদছে।
– রাইসা ছোট্ট হাতে কথার চোখের পানি মুছে দিচ্ছে আর বলছে’ মম তুমি কেঁদো না। এ ভাবে কেউ কাঁদে। তুমি কাঁদবে না কেমন? আমি তোমায় চকলেট কিনে দিব কেমন? কি হলো কাও কাঁদছো?
– কথা হাও-মাও করে কেঁদে দিয়ে রাইসাকে জড়িয়ে ধরল। মারে তোর মম অভাগী সে জন্য কাঁদে। তোর বাবাকে যে তোর মম কষ্ট দিয়েছে।
– মম তুমি কেঁদো না বাবা অনেক ভালো । তোমার সাথে রাগ করে থাকতে পারবে না। দাঁড়াও আমি বাবাইকে বলছি।
– বাবাই মমকে ক্ষমা করে দাও। দেখ না মম কাঁদছে।
– জানি না রাইসাকে কি বলব! কারণ আমি আর এই বুকে কথাকে টেনে নিতে পারছি না । বারবার মাকে আগুনে পুড়িয়ে মারার কথা মরে পড়ছে। মনে পড়ছে, বাবার করুণ মৃত্যুর কথা। মনে পড়ছে অফিসে সবার সামনে কথা আর আকাশ মিলে চরিএহীন বানিয়ে লাথি দিয়ে বের করে দেওয়ার কথা।
– সাথি কেন জানি আমার চোখের ভাষা বুঝতে পারে। সাথি এসে রাইসাকে কুলে নিল। কথা এখনো হাটুগেড়ে বসে অাছে।
– মিস কথা আপনি চলে যান প্লিজ। আমি আর পারছি না।
– কেন আমি কি এতই খারাপ যে আমাকে ক্ষমা করা যায় না?
– ক্ষমা সে তো কভেই করে দিয়েছি।
– তাহলে কেন বুকে টেনে নিচ্ছ না। হ্যাঁ আমি যা করেছি তোমার সাথে সেটা ভুল না অন্যায়। তবে একটাবারো কি ভাবো না, তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি কি কি করছি। বাবার – অর্থবিত্ত রেখে তোমার হাতটি ধরে একটা শাড়িতে বাবার বাড়ি ছেড়েছি। তোমাকে ডির্ভোস দেওয়ার পরও প্রতিরাতে তোমার কথা মনে করে কেঁদেছি। কাউকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করিনি। জীবনে দ্বিতীয় কোন পুরুষের স্পর্শ নেয়নি। কি করতে বলো? যদি পারো এ চাকু দিয়ে বুকটা ছিড়ে দেখ। কলিজাতেও তোমার নাম পাবে। কি করবো আমি, মা ছাড়া বড় হয়েছি । তাই নিজেকেই ঠিকমতো বুঝতে পারিনি। আমার মাথায় হাত রেখে বলতো পৃথিবীর কোন মেয়ে তার স্বামীকে পতিতালয়ে যেতে দেখে মুখ বুঝে সহ্য করবে? আর আমি তো ছিলাম অন্তসত্ত্বা। তোমার ভালবাসার ফসল গর্ভে ধারণ করেছিলাম। তুমি তো সত্যিটা বলো নি আমায় তবে কেন বুকে টেনে নিচ্ছো না? এই দেখ প্রতিটা মুহূর্তে তোমার এই ছবি বুকে নিয়ে থাকি আমি। কথাটা বলে ‘ গলা থেকে লকেট খুলে আমার হাতে দিল। লকেটের মাঝে আমার আর কথার ছবি। লকেট টা আমি দিয়েছিলাম কলেজে থাকাকালীন। কথাকে বলেছিলাম যতদিন তোমার কাছে এই লকেট থাকবে মনে করবে ততক্ষণ আমি তোমার বুকেই আছি ।
– কি হলো? কিছু মনে পড়ছে? তুমি এই লকেট দিয়ে আমাকে বলেছিলে, যতক্ষণ এ লকেট থাকবে ততক্ষন তুমি আমার বুকেই থাকবে তবে কেন আজ দূরে সরিয়ে দিচ্ছো?
– কেন তাহলে শুনবেন?
– তাহলে শুনেন! যার বাবার জন্য আজ আমি ইয়াতিম। যার বাবা আমার মাকে পুড়িয়ে মেরেছে। তার মেয়েকে কি করে বুকে টেনে নেয়।
– কথা কাঁদছে কিছু বলতে পারছে না। আমি যে কথার কান্না মাখা মুখটা দেখতে পারি না। জানি না কি করবো। অপারেশন থেকে যদি না ফিরি। কথাকে বুকে টেনে নিতে গিয়েও বাবা মায়ের খুনের কথা বলতাম।
– কি হলো আপনি আমার চোখের সামনে থেকে চলে যান কোন খুনীর মেয়েকে দেখতে চাই না।
– হঠাৎ নার্স এসে বলল’ মিঃ রাজ, আপনার অপারেশন হবে। এখনি আসেন।
– কথা যেন কথাটা শুনার জন্য একদম প্রস্তুত ছিল না ।
– আমি রাইসাকে বুকের সাথে জড়িয়ে গালে – মুখে চুমু দিয়ে বিছানায় শুয়ে দিয়ে যখনি বের হতে যাবো।
– পিছন থেকে হাতটা টেনে ধরল রাইসা বাবা তুসি কোথায় যাচ্ছো? তুমি যেয়ো না, আমার না ভয় করে।
– মা তোমার জন্য আইসক্রিম নিয়ে আসতে যাচ্ছি।
– আমার আইসক্রিম লাগবে না। তুমি যেয়ো না বাবাই।
– হাতটা একপ্রকার জোর করেই ছাড়িয়ে নিলাম। রাইসা কাঁদছে। কিন্তু আমার পিছনে তাকালে যে চলবে না।