যদিও_অসময়ে_এসেছো_তুমি ৫

0
693

#যদিও_অসময়ে_এসেছো_তুমি

#লেখিকা_সুমাইয়া সেহরিন সুইটি

পর্ব-৫

প্রায় দু’ঘন্টা ধরে চেষ্টার পরও যখন সাফরানের ঘুম আসলো না। তখন সাফরান অযথা আর শুয়ে না থেকে বাইক নিয়ে স্নিগ্ধার বাড়ির দিকে চললো। মানুষের মন বড়ই অশান্ত। যতোই নিজেকে জ্ঞান দিক,যতোই বুঝাক,মন বেচারা তার প্রিয় মানুষের কাছে ছুটে যাবেই।সাফরান জানেনা সাফরান কী করবে। শুধু জানে সাফরানের দুই নয়ন স্নিগ্ধা কে দেখার জন্যে অস্থির হয়ে আছে।আর কতো বেধে রাখবে নিজের মনকে,আর কতো অশ্রু ঝরাবে লুকিয়ে।সাফরান জানে না।সত্যিই জানে না।সাফরান স্নিগ্ধার ব্যাল্কনির সামনে দাড়িয়ে। এখন রাত ৩ঃ৪০ বাজছে।এতো রাতে স্নিগ্ধা জেগে নিশ্চয় থাকবে না।স্নিগ্ধার রুমের ড্রিম লাইটের আলো দেখা যাচ্ছে।সাফরান ব্যল্কনি দিয়ে উঠে স্নিগ্ধার রুমে প্রবেশ করলো। স্নিগ্ধা ঘুমিয়ে আছে।সাফরান ধীরে ধীরে স্নিগ্ধার পাশে বসলো।এই শীতের রাতেও মেয়েটা ফ্যান চালিয়ে শুয়েছে,কম্বল পর্যন্ত গায়ে দেয় নাই।সাফরান পাশে রাখা কম্বল টা স্নিগ্ধার গায়ে দিয়ে দেয়।সাফরান পলকহীন চোখে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে আছে। এই মুখটা আজ সারাদিন কতো মিস করেছে সাফরান।সাফরান নিজের চোখের পানি কন্ট্রোল করতে পারছে না।সাফরানের চোখের পানি স্নিগ্ধার মুখে এসে পরতেই স্নিগ্ধা হালকা নড়ে উঠলো।সাফরান ভেবেছে স্নিগ্ধা হয়তো জেগে যাবে।কিন্ত না স্নিগ্ধা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সাফরান লক্ষ্য করলো স্নিগ্ধা চুল ছাড়া রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছে। এলোমেলো চুলগুলো স্নিগ্ধার মুখের উপর পরছে।চুল গুলোকে পরম যত্নে সরিয়ে দিয়ে পাশে রাখা হেয়ার ক্লীপ দিয়ে স্নিগ্ধার চুল বেধে দিলো সাফরান।এখন বেশ গুছালো দেখাচ্ছে স্নিগ্ধা কে।মেয়েদের ঘুমন্ত চেহারা এতো মায়াবী হয় কী করে।সাফরান স্নিগ্ধার মুখের কাছে ঝুকে পরে। নিজের অজান্তেই সাফরানের দৃষ্টি গুলো স্নিগ্ধার গোলাপি ঠোঁটের উপর পরছে।সাফরান স্নিগ্ধার ঠোঁটের কাছে তার ঠোঁট নিয়ে আসে।হঠাৎ স্নিগ্ধার মোবাইলে একটা মেসেজ আসতেই সাফরান বাস্তবে ফিরে আসে।নিজেকে সামলে নিয়ে সাফরান স্নিগ্ধার মোবাইল’টা হাতে নেয়।কিন্তু মোবাইলে পিন লক দেওয়া আছে।তাই মেসেজ’টা দেখতে পারছে না সাফরান।মোবাইলটা পাশে রেখে সাফরান উঠে যেতে যাবে ঠিক তখনি স্নিগ্ধা সাফরানের হাত ধরে ফেলে।সাফরান বিষ্ময় চোখে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে আছে। স্নিগ্ধা ঘুমের ঘোরেই সাফরানের হাত জড়িয়ে ধরে আছে।সাফরান স্নিগ্ধার পাশে বসলো।সকালের আযান দেওয়ার সময় সাফরানের ধ্যান ভাংলো।সাফরানের ফুপি আতিয়া রহমান নামাযের জন্য উঠেছে,ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সাফরান দ্রুত ব্যল্কনি দিয়ে নেমে গেলো।তারপর বাইক নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
সাফরান চলে যেতেই হঠাৎ স্নিগ্ধার ঘুম ভেঙে গেলো।ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠে। ব্যল্কনি তে গেলো স্নিগ্ধা। সকাল হয়ে গেছে।ভোরের এই দৃশ্যটা স্নিগ্ধার অনেক পছন্দের। কিন্ত আলসেমির জন্যে সকালে উঠতে পারে না। স্নিগ্ধা চুল বাধার জন্য মাথায় হাত দিতেই অবাক হয়ে গেলো।তারপর আয়নার সামনে গিয়ে দাড়ালো। স্নিগ্ধার স্পষ্ট মনে আছে স্নিগ্ধা চুল খোলা রেখে ঘুমিয়েছিলো।রাহাতের সাথে ভিডিও কলে কথা বলার সময় রাহাত বলেছিলো,রাহাতের কাছে স্নিগ্ধা কে চুল খোলা অবস্থায় বেশি ভালো লাগে।আর এজন্যই স্নিগ্ধা চুল খোলা রেখেছিলো। স্নিগ্ধা মাথা চুলকে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে থাকে।

–আরেহ ধূর হয়তো। ঘুমের মধ্যেই চুল বেধেছি,,,,

স্নিগ্ধা ওয়াশরুমে গিয়ে অজু করে আসে। তারপর নামায পড়ে নেয়।

কফিশপে স্নিগ্ধা ও রাহাত বসে আছে।রাহাত অপলক দৃষ্টিতে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে।

—আচ্ছা রাহাত,তুমি কতোটা ভালোবাসো আমাকে?

—ভালোবাসা তো কখনো পরিমাপ করা যায় না স্নিগ্ধা। তবে বুঝে নেও যতোটা ভালোবাসলে কেউ বেচে থাকার কারণ খুজে পায়।

—তার মানে তুমি আমাকে ভালোবাসার আগে বেচে থাকার কারণ খুজে পাও নাই?

—না,নিশ্বাস আছে বলেই বেচে ছিলাম কিন্তু এখন তো তোমাকে পেয়ে আমার অনন্ত কাল বাচার ইচ্ছা হচ্ছে।

স্নিগ্ধা রাহাতের কথায় মুগ্ধ হয়ে যায়।বেশ গুছিয়ে কথা বলে রাহাত,,স্নিগ্ধা আবারো বললো “কখনো ছেড়ে যাবে না তো?”

—ছেড়ে গেলে তো দুনিয়া থেকেই বিদায় নিতে হবে।

রাহাত স্নিগ্ধার হাত ধরে, হাতে একটা হালকা চুমু একে দেয়।তারপর বলে “হারাতে চাই না কখনো স্নিগ্ধা তোমাকে,এই হাত ধরেছি মরার আগ মুহূর্ত ধরে রাখবো পাশে থাকবো,দেখে নিও।

—আমিও তোমাকে কখনো ছেড়ে যাবো না।এক্সামের পরেই আমরা বিয়ে করে নিবো রাহাত।

রাহাত ও স্নিগ্ধা দুজন দুজনার হাত ধরে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। আর তাদের দিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে সাফরান।নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না।অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে সাফরান স্নিগ্ধার ও রাহাতের সামনে আসলো।সাফরান কে দেখেই স্নিগ্ধা রাহাতের হাত ছেড়ে দিলো।আর রাহাত বিরক্তিভরা চোখে সাফরান কে একবার দেখলো। রাহাত সাফরান কে চিনে।স্নিগ্ধার মামাতো ভাই।আগেও কয়েকবার বাইকে করে স্নিগ্ধা কে কলেজে দিয়ে গেছে। ভদ্রতার খাতিরেই রাহাত সাফরান কে সালাম জানালো কিন্তু সাফরান যেন রাহাতের কথা শুনলো ও না।আগুন চোখে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে আর স্নিগ্ধা ভয় ও লজ্জায় চোখ নিচে করে রাখছে।কী বলবে স্নিগ্ধা সাফরান ভাইয়া কে।অনেক্ক্ষণ থেকে নিশ্চয় তাদের লক্ষ্যে করছিলো।সাফরান ভারী কন্ঠে স্নিগ্ধা কে বললো ” What’s going on Snigdha? কলেজে যাওয়ার নাম করে এখানে একটা ছেলের হাত ধরে বসে আছিস?

—ভা,ভাই য়া,,,

—চুপ।আর তুমি কে?

—আমি স্নিগ্ধার।বয়ফ্রেন্ড।

সাফরান রাহাতের কথা শুনে স্নিগ্ধার দিকে তাকায়।ভয়ে স্নিগ্ধার গলা শুকিয়ে আসছে।রাহাত সব সত্য বলে দিবে এটা বুঝতে পারে নাই স্নিগ্ধা।
সাফরান রাহাতের কলার ধরে দাত চুবিয়ে বললো ” কী বলছিস তুই?”

—যা সত্যি তাই বললাম।আর তুমি এতো হাইপার হচ্চো কেনো।তুমি স্নিগ্ধা কে নিজের বোনের মতো ট্রিট করছো ইটস গুড বাট তোমার বুঝতে হবে ওর একটা পারসনাল লাইফ আছে।

সাফরান রাহাতের কথা গুলো আর নিতে পারলো না হাত উচিয়ে রাহাত’কে ঘুষি দেওয়ার জন্যে উদ্দ্যত হলো আর তখনি স্নিগ্ধা সাফরান কে বাধা দিলো।

—ভাইয়া প্লীজ ছেড়ে দাও ওকে।প্লীজ।

সাফরান রাগ কন্ট্রোল করে স্নিগ্ধার দিকে ফিরলো তারপর স্নিগ্ধার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। কিন্তু স্নিগ্ধা এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো।

—ছাড়ো আমাকে।আমি তোমার সাথে যাবো না।

—-কী বললি,,,

—যা শুনলে,আবারও বলছি।আমি তোমার সাথে যাবো না।প্লীজ ভাইয়া এবার তো মুক্তি দাও আমাকে।একটু শান্তি দাও।একটু নিজের মতো থাকতে দাও।আমি কোনো বাচ্ছা মেয়ে না।যে আমার পিছনে সব সময় পাহারা দিবা।মামাতো ভাই মামাতো ভাইয়ের মতো থাকো।কেনো জীবন’টা বিষিয়ে তুলেছো।সেই ছোট থেকে দেখছি।তোমার নিজস্ব কোনো জীবন নাই তাই বলে কী আমাদের থাকবে না? প্লীজ ভাইয়া লিভ আস এল্যোন।

স্নিগ্ধা ডুকরে কেদে উঠলো।কিন্তু সাফরান নিঃশব্দে কাঁদছে। চোখে পানি টলোমলো করছে। স্নিগ্ধার বলা প্রতিটা কথা সাফরানের কানে ক্রমাগত বাজছে এখনো।সাফরান ক্যাফে থেকে বের হয়ে গেলো।

কিন্তু সাফরান ঠিক মতো হাটতে পারছে না।স্নিগ্ধার বলা প্রতিটা কথা সাফরানের বুকের ব্যাথা বাড়িয়ে দিয়েছে।সাফরান বুকে হাত দিয়ে বাইকে গিয়ে বসলো।তারপর বাইকে স্টার্ট দিলো।

স্নিগ্ধা সাফরানকে তাহলে কখনোই বুঝতে পারে নাই।স্নিগ্ধার মনে এতো ঘৃণা সাফরানের জন্য আজ জানলো সাফরান। দুই দিনের একটা ছেলের জন্যে স্নিগ্ধা আজ তাকে এতো টা কথা শুনিয়ে দিয়েছে। সাফরান স্নিগ্ধার বলা কথা গুলো ভাবছে আর বাইক চালাচ্ছে।হঠাৎ আচমকাই সাফরানের বাইকের সাথে একটা কারের ধাক্কা লাগে আর সাথে সাথেই সাফরান ছিটকে রাস্তার মধ্যে পড়ে। কপাল ফেটে রক্ত ঝড়ছে।সাফরান ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় এতোক্ষণে রাস্তায় অনেক মানুষ চলে এসেছে।সাফরান মাথায় হাত দিয়ে সবাইকে চলে যেতে বললো।তারপর বাইকে গিয়ে বাইকের গতি কমিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলো।পথে ফার্মেসী তে গিয়ে মাথা ব্যান্ডেজ করিয়ে নিলো।এই অবস্থায় বাড়ির সবাই দেখলে অস্থির হয়ে যাবে।

———————

ব্যল্কনি তে দাঁড়িয়ে কফি মগে চুমুক দিতে দিতে স্নিগ্ধা সাফরানের কথা ভাবতে লাগলো।আজ এক সপ্তাহ হয়ে গেলো কিন্তু সাফরান ভাইয়া একবার ও এলো না।এই সাত দিনে স্নিগ্ধা রাহাতের সাথে ঘুড়েছে অনেক।সাফরান ভাইয়াকে এতো কথা বলাটা উচিৎ হয় নাই।স্নিগ্ধার চোখ ভিজে আসলো।সেদিনই প্রথম সাফরান ভাইয়া কথা না বলে স্নিগ্ধার এতো কঠিন কঠিন কথা শুনছিলো।স্নিগ্ধা সাফরানের নাম্বারে কল দেয়।কিন্তু নাম্বার বন্ধ।স্নিগ্ধা অনেকটা চিন্তার মধ্যে পরে যায়।সাফরান ভাইয়ার নাম্বার তো কখনো বন্ধ থাকে না।তাহলে,,,,স্নিগ্ধা আতিয়া আহমেদ কে যেয়ে বললো চলো মামা বাড়িতে যাবো।

—-এখন

— হ্যা
—আচ্ছা তুই রেডি হয়ে নে।

স্নিগ্ধা বোরকা ও নেকাব পরে।এখন রেডি হতে অনেক সময় লাগবে।স্নিগ্ধা ও আতিয়া আহমেদ একটা রিক্সা নিয়ে সাফরানদের বাড়িতে আসে।বাড়িতে এসে স্নিগ্ধা অনেক অবাক হয়ে যায় সাফরানকে দেখে।ঘর থেকে একদমই বের হয়নি যতোক্ষণ স্নিগ্ধা ছিলো।সাফরানের এক্সিডেন্ট সম্পর্কে স্নিগ্ধা সাহিল ও রাফিয়া আহমেদ এর কাছে জানতে পারে।স্নিগ্ধা বুঝতে পারে এক্সিডেন্ট এর জন্য স্নিগ্ধাই দায়ী।স্নিগ্ধা কয়েকবারই সাফরানের রুমের সামনে গিয়েছে।কিন্তু সাফরানের সাথে কথা বলার সাহস পায় নাই। স্নিগ্ধা তার মাকে নিয়ে বাড়িতে যাবে বলে।স্নিগ্ধা ভেবেছে বাড়িতে যাওয়ার কথা শুনে হয়তো সাফরান তাদের দিয়ে আসতে চাইবে, কিন্তু সাফরান সাহিল কে বলে বাড়িতে রেখে আসতে। স্নিগ্ধা সাফরানের ব্যবহারে তাজ্জব লেগে যায়।বুকের ভেতরটা হঠাৎ ব্যাথা করতে থাকে স্নিগ্ধা নিজের ইগো এক দিকে রেখে সাফরানকে ডাক দেয়।

—ভাইয়া,,দরজা খুলো।

সাফরান রুমের ভিতর থেকেই বলে, “কিছু বলবি?”

—হ্যা কিছু কথা ছিলো।

সাফরান দরজা খুলে স্নিগ্ধা কে আসতে বলে।

—কী বলবি বল।

—সরি।

—সরি ফর হোয়াট?

–সেদিন ক্যাফেতে তোমাকে যা বলেছি।তার জন্য সরি।

—আমার মনে নেই কিছু।

—আমার এতোকিছু বলা ঠিক হয় নাই।

—দেখ তুই যা বলছিস তোর দৃষ্টিকোন থেকে বলেছিস।আমি কিছু মনে করি নাই।তোর জীবন, তোর সিদ্ধান্ত তবে এই ছোট জীবনে যা সিদ্ধান্ত নিবি তা নিয়ে ১০ বার ভাব্বি তাহলে এই ছোট জীবনে কখনো দুঃখ কষ্ট আসবে না।

—ভাইয়া,,,

—আমার দোকানের হিসাব দেখতে হবে পরে কথা বলছি তোর সাথে।
সাফরান ল্যাপটপে মনোযোগ দিলো।স্নিগ্ধা অশ্রুসিক্ত নয়নে সাফরানের দিকে তাকিয়ে আছে।

(চলবে)

গল্পটা কেমন লাগছে কমেন্টস করে জানাবেন?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here