মোনালিসা
মৌমিতা_দত্ত
পর্ব ৩
ঘড়ির কাঁটায় বেলা একটা। রেঁস্তোরার বাইরে প্রায় মিনিট পাঁচেক ধরে অপেক্ষারত রাজীব।
রেঁস্তোরার ঠিক বিপরীত ফুটপাতে লাল রঙের চাদরে মস্তিষ্ক আবৃত করে দন্ডায়মান কৃষ্ণচূড়া গাছটা। মাঝে মাঝে বইতে থাকা মৃদু হাওয়ার আলোড়নে গাছটির মাথা দুলিয়ে ওঠা দেখে মনে হতেই পারে সদ্য বিবাহিতা কোনো যুবতী লাল বেনারসির ঘোমটার আড়াল থেকে তার নবরূপ প্রত্যক্ষ করে লজ্জায় মাথা নত করছে। সময়টা ফাল্গুন মাস । তাই সূর্যের রুদ্র রূপও কিছুটা শান্ত। বাতাসে হালকা শীতের আমেজ এখনও বিদ্যমান। প্রকৃতির এক মেঘলা প্রেমিক রূপের দর্শন এই সময়টায় পাওয়া যায়।
কিন্তু, বিপরীতে থাকা রাজীবের মনে এই উপভোগ্য দিনটিকে তার জীবনের চরম পরিহাসের মুহূর্ত বলে মনে থাকে।
তাই কিছুক্ষণ বিপরীতে থাকা গাছটির দিকে তাকিয়ে আনমনে অপেক্ষারত অবস্থায়ই পকেট থেকে একটা গোল্ড ফ্লেক বের করে ধরায় সে।
দু- তিন টান দেওয়ার পর আচমকা চেনা গলার আওয়াজে পিছু ফিরে দেখে আবীর দাঁড়িয়ে।
নিজ স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে আবীর বলে ওঠে , “কীরে, কাউন্টার দে। একা একাই সিগারেট টানছিস। কী ব্যাপার?”
নানাবিধ চিন্তায় মেজাজটা এমনিই একটু বিগড়ে ছিল রাজীবের। তাই সিগারেটটা আবীরের দিকে এগিয়ে দিয়ে সে বলে ওঠে, “একা একা টানছি মানে! তোর কী মনে হয়! কার সাথে সিগারেট টানবো এই সময় ?”
চুপচাপ স্বভাবের রাজীবের ব্যবহারের আকস্মিক পরিবর্তন লক্ষ্য করে কিছুটা অবাক হয়ে আবীর বলে ওঠে, “কুল ব্রো । আমি তো বলতে চাইছিলাম ….তোর তো এখন তোর বউয়ের সাথে থাকা উচিত। তা না, তুই একা একা সিগারেট টানছিস!”
“হোয়াট? তুই কী করে জানলি? আমি তো তোকে কিছু জানাইনি ?”
একসাথে এতো প্রশ্ন পর পর আসতে থাকায় পকেট থেকে সন্তর্পণে নিজের মোবাইলটা বের করে আবীর । তারপর সিগারেটে শেষ সুখটান দেওয়ার পর শূন্যে ধোঁয়ার রিং ছেড়ে সিগারেটটা ছুঁড়ে দূরে ফেলে বলে ওঠে, “এটা কে কী বলে জানিস! স্মার্ট ফোন। তাই এদেশ হোক বিদেশ যেখানেই থাকি তুই খবর না দিলে জানতে পারবো না তোর বিয়ের কথা , এটা ভাবা তোর ভুল।
এক মিনিট তোকে একটা জিনিস দেখাচ্ছি দেখ। ” এইবলে ফোন হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ খুট খুট করার পর , রাজীবের হাতে ফোনটা হাতে ধরিয়ে বলে ওঠে, “দেখ!”
রাজীব তাকিয়ে দেখে তার বিয়ের একটা ছবি আবীরের ফোনে। ফটোটা দেখামাত্র তার মনে প্রথম প্রশ্ন জাগে, ‘সে তো বিয়েতে কোনো ফটো তুললেও তা কোথাও দেয়নি। তাহলে আবীর এ ফটো পেলো কোথায়?’
রাজীবকে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকতে দেখে এবার তার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে আবীর একটা তুড়ি মারতেই রাজীব চমকে ওঠে। রাজীবের চমকে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বুঝে নিয়ে আবীর বলে ওঠে, “আরেহ দূর, তুই সত্যি! এখনো স্মার্ট হতে পারলি না।
এটা রোহিনী দি ফেসবুকে দিয়েছে । সেখান থেকেই আমি জানতে পেয়েছি।”
একথা শোনামাত্র রাগে সর্বাঙ্গে সেই শীতের আমেজেও ফোস্কা পড়ার উপক্রম হয় রাজীবের। কোনরকমে দাঁতে দাঁত চিপে সে ভাবে – তার বিয়ে দিয়েও ক্ষান্ত হয়নি তার দিদি, সর্বত্র প্রচারও সেরে ফেলেছে।
“আজ তাহলে তোর বিয়ের অনারে খাওয়াচ্ছিস তো! আর কবে আলাপ করাচ্ছিস তোর বউয়ের সাথে?”
এই কথায় ভাবনায় ছেদ পড়ার সাথে সাথে বিড় বিড় করে রাজীব নিজের মনেই বলে ওঠে, “বিয়ের খাওয়া নয়তো ,আমার শ্রাদ্ধের খাওয়া খেতে ডেকেছি।”
“কিছু বললি?”
আবীরের এই প্রশ্নে জোর করে মুখে হাসি এনে রাজীব বলে ওঠে, “নাহ। আয় ভেতরে বসে তোর সাথে কথা বলি।জরুরি কিছু কথা আছে তোর সাথে। ” এইবলে এসি রেঁস্তোরার কাঁচের দরজা খুলে ঢুকে যায় সে। আর তাকে অনুসরণ করে তার পিছু পিছু ভেতরে ঢোকে আবীর।
অপরদিকে, দক্ষিণ কলকাতার ইঁটের পাঁজরে ,কংক্রিট ভীতের উপর বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট বড় নানান কাঠামো বাড়িগুলোর মধ্যে “আশ্রিত” নামের দোতলা বাড়ির উত্তরের জানালার ধারে দাঁড়িয়ে সে বাড়ির নতুন আশ্রিতা মোনালিসা।
ঘন্টা খানেক আগে বাড়ি প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে। আত্মীয় স্বজন একে একে সবাই বিদায় নিয়েছে। আত্মীয় শূন্য বাড়িতে আশ্রিতা লিসা যেদিকেই তাকায় তার বিস্ময়ে তাক লেগে যায়।
গ্রামের বাড়িতে থাকাকালীন তার সবথেকে প্রিয় ছিল দোতলার দক্ষিণে থাকা তার বাবা – মার ঘরটা।
দিনান্তে একবার সেই ঘরের জানলায় গিয়ে যখন সে দাঁড়াতো। আর মন খারাপ উজাড় করে দিতো চোখের জলে তখন যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজে ছেয়ে থাকা বাগানের দিক থেকে আম , জাম , নারকেল গাছগুলো মাথা দুলিয়ে তাকে জানান দিতো – সারাদিন বেঁচে থাকার জন্য যে কথার কন্টক যন্ত্রণা তাকে পেতে হয়, তারা তা ভুলিয়ে দেবে। আবারও একমুঠো টাটকা অক্সিজেন উপহার দিয়ে তাকে প্রাণ ভরে যন্ত্রণা ভুলে বেঁচে ওঠার অনুপ্রেরণা জোগাতো।
কিন্তু, শহরে জানালা দিয়ে যেদিকেই সে তাকাচ্ছে খালি বাড়ি আর বাড়ি চোখে পড়ছে।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর জানালার কাছ থেকে সরে আসে সে।
তার এই বাইশ বছরের জীবনে এই প্রথম জীবন তাকে সময় দিয়েছে । গ্রামে থাকতে সারাদিন জেঠিমার সাথে কাজ করে সময় কেটে যেত । কিন্তু, এখানে সময় কাটবে কীভাবে! জোজো থাকলে গল্প করে, মজা করে সময় কেটে যেতো ঠিক।
এইসব চিন্তা ভাবনা যখন তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে তখন কিছু একটা ভেবে নিয়ে কাগজ ,পেন নিয়ে এসে অতি উৎসাহের সাথে সোফায় বসে সে এবং মনে মনে স্থির
করে এবার থেকে প্রতিদিন নিজেকে একটা করে চিঠি লিখবে সে এবং জোজো কেও।
আজ শুরুটা জোজোকে চিঠি লিখেই করবে।
যেই ভাবা সেই কাজ। সাদা কাগজে লেখা শুরু –
জোজো,
জানিস শহর একদম ভালো নয়। আমি যে বাড়িতে থাকি অনেক বড় বাড়ি। আশেপাশের বাড়িগুলোও অনেক বড় । কিন্তু কোথাও কোনো গাছপালা নেই। বড় বড় বাড়ির ফাঁক ফোকর থেকে যে দু – একটা গাছ উঁকি ঝুঁকি মারছে তাদের দেখলে কী মনে হয় জানিস?
মনে হয় যেন সদ্য নেড়া মাথায় দু – একটা চুল গজিয়েছে।
এখানকার মানুষরা কথা বলতে জানেনা। সবাই কেমন অদ্ভুত ব্যবহার করে। পাশের বাড়ির কাউকে জানালা দিয়ে দেখে হাসলে জানালা বন্ধ করে দেয়।
যাইহোক এ বাড়িতে রঙিন মাছ আছে অ্যাকোয়ারিয়ামে । কমলা, লাল , কালো কতো রঙ বেরঙের । তুই থাকলে ভীষণ খুশি হতিস। আমি ওদের কয়েকটা নাম ঠিক করেছি । কাল তোকে জানাবো।
লিসা
এরপর জোজোকে লেখা কাগজের উপর আজকের তারিখ বড় বড় করে লিখে কাগজটা চার ভাঁজ করে রেখে দেয় সে।
তারপর আর একখানা কাগজ নিয়ে নিজেকে চিঠি লিখতে শুরু করে সে।
যদিও সে জানে নিজের জন্য বা নিজের মনের কথা পাতায় বন্দি করে অনেকেই রাখে । তাকে ডায়েরি লেখা বলে।
আজ অবধি হয়তো নিজেকে চিঠি কেউ লেখেনি। কিন্তু, সে লিখবে।নাহ, ব্যতিক্রমী কোনো ভাবনা চিন্তা থেকে নয়। বরং সে মনে করে যে মনের খোঁজ রাখার মত একটি মনও নেই ,তখন সেই মনকে বেঁচে থাকার তাগিদে নিজের খোঁজ নিজেকেই নিতে হয়। নিজের ভালো লাগাগুলো কালির আঁচড়ে বাঁচিয়ে রাখতে হয়।
তাই এই সিদ্ধান্ত।
অগত্যা যেমন ভাবা তেমন কাজ।
আমি লিসা ,
জীবনের জ্ঞানত আবির্ভাবের সময় থেকে আজ জীবনের নতুন সূচনার দ্বারে দাঁড়িয়েও আমি একা। অবশ্য এ একাকীত্ব আমার দুর্বলতা নয় আমার মনের জোর ।
আমার বিয়ে হয়েছে তিনদিন হলো। কিন্তু, আমার জীবনের বর্তমান মালিক অর্থাৎ আমার স্বামী বিয়ের প্রথম দিন থেকেই অন্য পথগামী।
তাতে কোনো আক্ষেপ বা দুঃখ নেই। কারণ, অপরিচিত কারোর কোনো ব্যবহারই আমার ভালো লাগেনা। বরং এ অনেক ভালো হল – আমি ভালোবাসা থেকে সহস্র যোজন দূ্রে বাস করতেই পছন্দ করি। তাই প্রাপ্তির আগেই কিছু হারিয়ে গেলে তাতে দুঃখ থাকে না।
বাইশ বছরের মধ্যে এই প্রথম অনেকটা সময় আমি আমার জন্য পাচ্ছি। যার সূচনা আজ থেকে হল।
আগামী দিনগুলোতে ইঁটের শহরে মনকে ইঁটের মতো শক্ত করে আরও ভালো থাকবো আশাকরি।
———————–
এই কাগজটিকেও চার ভাঁজ করে সযত্নে আজকের তারিখ উল্লেখ করতে করতে আচমকা তার নজর যায় জানালার কাছে ।
সেদিকে তাকিয়ে দেখে জানালার গ্রিলের উপর একজোড়া চড়ুই পাখি বসে নিজেদের মধ্যে ঘাড় উঁচিয়ে কোলাহলে মত্ত। এক সময় ঘাড় উঁচিয়ে ঝগড়া করতে একটা পাখি চুপ করে যায়, তখন অন্য আর একটা পাখি আরও কিছুক্ষণ ঝগড়া করার পর পাখি দুটো এক সময় উড়ে চলে যায়।
পাখিদের ঝগড়া দেখে অচিরেই মনে জেঠিমা আর জেঠুর মুখটা ভেসে উঠতেই খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে লিসা।
তারপর একসময় উঠে নিজের বাক্সের মধ্যে থেকে ছোট একটা ব্যাগ বের করে তার ভেতর চিঠিগুলো রেখে দেয় সে।
( চলবে…… )