মোনালিসা পর্ব ২

0
1968

মোনালিসা
মৌমিতা_দত্ত
পর্ব ২

একটা মৃদু শব্দের ক্রমাগত আওয়াজে ঘুম চোখেই একরাশ বিরক্তি নিয়ে লিসা বলে ওঠে, “উফ্ জেঠিমা একটু আওয়াজটা বন্ধ করোনা। আমি উঠছি।”
এইবলে পাশ ফিরে শুতে গেলে জানালার ফাঁক দিয়ে অযাচিত অতিথির ন‍্যায় আগত সূর্যরশ্মির আলো চোখে পড়ে তার। আর সেই আলোর রেখা চোখে পড়া মাত্র কপালে বিরক্তির ভাঁজ ফুটে ওঠার সাথে সাথেই চোখ মেলে তাকিয়েই সে ধরফর করে বিছানায় উঠে বসে।
এতক্ষণে খেয়াল হয় তার যে সে তো এখন বিবাহিত। এখন থেকে এই অজানা পরিবেশই তার ঠিকানা।
ঘুম ভাঙার সাথে সাথে ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বেশ লজ্জিত হয়ে পড়ে সে । ঘড়ির কাঁটার সময় জানান দিচ্ছে বেলা আটটা বাজে। তার গ্রামের বাড়িতে মোরগ ডাকার সাথে সাথে যে মেয়ের ঘুম ভেঙে যেত, সে কিনা বেলা আটটা বেজে গেছে এখনো বিছানা ছাড়েনি। একথা ভাবলেই তার নিজের ভীষণ লজ্জা লাগছে।
বিয়ে বাড়ি ভর্তি মানুষজন কী ভাবছে ! কে জানে!
এসব ভাবনার মাঝেই হঠাৎ করে তার গতকাল রাতের বরের আচরণের দৃশ‍্য চোখের সামনে ফুটে উঠতেই সে নিজের মনকে এইবলে সান্ত্বনা দেয় যে, ‘সে তো আর ইচ্ছা করে দেরী করে ওঠেনি। যত দোষ তার বরের। সে যদি গতকাল রাতে অত দেরী করে না ফিরতো , তাহলে তাকেও আর জেগে থাকতে হতো না। যত দোষ তার বরের।’
এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলার পর তার মনে পড়ে যায়, ‘নিজের বাড়িতে সে রাত নটার মধ‍্যে ঘুমিয়ে পড়তো। আর এখানে!
অবশ‍্য জেঠিমা বলেই দিয়েছে – এখন থেকে এটাই তার নিজের বাড়ি।’
এসব ভাবতে ভাবতেই তার মনে হয়, কত সহজে একটি মেয়ের ঠিকানা বদল হয়ে যায়। মনের কথা বোঝার আগেই মেয়েদের পর করে দেওয়া হয়। আবার রিতী নীতির দোহাই দিয়ে মেয়েদেরকেই মানিয়ে নেওয়ার শিক্ষা কতো সহজে শেখানো হয়।
যাইহোক এ অবধি সবার মনের ইচ্ছার পূরণ সে করে এসেছে। তাই এবার থেকে মানিয়ে নেওয়া শব্দটা নিজের মনের স্বার্থে একমাত্র সে ব‍্যবহার করবে।
তাই আজ যদি কোনো অযৌক্তিক কথা তাকে শুনতে হয়, তাহলে গতকাল রাতের আসল সত‍্যিটা সে প্রকাশ করে দেবে।

এসব ভাবনার মাঝে আবারও হওয়া আওয়াজে চেয়ে দেখে তার ঘরের ভেজানো দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কেউ কড়া নাড়ছে।
কিছুটা অস্বস্তিবোধ নিয়েই উঠে ভেজানো দরজা খোলামাত্র চেয়ে দেখে – হাসি হাসি মুখ করে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তার একমাত্র ননদ রোহিনী।

আপাদমস্তক তাকে একবার ভালো করে দেখে নিয়েই মুখ টিপে হেসে তার হাত ধরে ঘরের ভেতর ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয় রোহিনী।
ঘরে ঢুকেই এলেমেলো ভাবে ছড়িয়ে থাকা ফুল, গুটিয়ে থাকা বিছানার চাদর সব দিকে এক মুহূর্তে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিয়ে বিছানার এক পাশে নিজে বসে পড়ে এবং ইশারায় লিসাকে বসতে বলে।
লিসা বিছানায় বসামাত্র তার হাত দুটো চেপে ধরে রোহিনী বলে ওঠে, “তা হ‍্যাঁ রে, কী জাদু করলি রে আমার ভাইটার উপর যে সকাল হতেই বাবু লজ্জায় লাল হয়ে আগেই কেটে পড়লো । বল?”

সব সত‍্যি কথা ঠোঁটের কাছে এসেও কোন জাদুবলে যেন আটকে গেল লিসার। সে শুধু সলজ্জ ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে রইলো।

সলজ্জ ভাবে মাথা নিচু করে লিসাকে বসে থাকতে দেখে রোহিনী নিজেই বলে ওঠে, “থাক তোকে আর লজ্জা পেতে হবেনা। আর আমাকে কিছু বলতেও হবেনা।
তোর ঘেঁটে যাওয়া সিঁদুর, ব্লাশার, এগুলোই আমাকে আমার উত্তর দিয়ে দিয়েছে।”
এইবলে উঠে দাঁড়িয়ে লিসার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার হাত দুটো চেপে ধরে রোহিনী বলতে থাকে, “সব আত্মীয় স্বজন একটু পরেই চলে যাবে। বাড়িও ফাঁকা হয়ে যাবে।
আর আমার দুপুরের ফ্লাইট আমাকেও ফিরে যেতে হবে । কিন্তু , তার আগে তোকে কথা দিতে হবে তুই আমার ভাইকে ভালো রাখবি। কোনোদিন ওর সাথ ছাড়বি না।”

আকস্মিক এইরকম কথা শোনার জন‍্য প্রস্তুত ছিলোনা লিসা। তবুও কথার প্রেক্ষিতে প্রাথমিক ভাবে চুপ থাকে সে। কারণ, তার আর তার বরের সর্ম্পক যে কতটা উর্বর সে শুধু তার মনই জানে। তাই রোহিনীর করুণ চাহুনির দিকে তাকিয়ে সে বলে ওঠে, ” এটুকু বলতে পারি দিদি, আমার জন‍্য তোমার ভাইয়ের কোনোদিন কোনো অসুবিধা হবে না। সে সবসময় ভালো থাকবে।”

এই আশ্বাস টুকু পেয়ে চোখ ছলছল করে ওঠে রোহিনীর । মুহূর্তের মধ‍্যে নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলে ওঠে, “আমি জানি । আমার মন বলছে তোরা ভীষণ ভালো থাকবি।
আসলে বাবা – মা মারা যাওয়ার দু’বছরের মাথায় আমার বিয়ে হয়ে যায়। আমি বিদেশে চলে যাই। তখন থেকে জীবনের সব সমস্যাগুলোর সাথে ভাই একাই মোকাবিলা করে চলেছে। কোনোদিন কোনো কষ্টের কথা মুখ ফুটে বলতে পারেনা। শুধু মুখ বুজে সহ‍্য করে পাথরের মত ।
ও ভীষণ চাপা স্বভাবের তো, তাই আমার ভীষণ চিন্তা হয় ওকে নিয়ে! কিন্তু, আজ আমি নিশ্চিন্ত।
নে এবার তুই ও ফ্রেশ হয়ে নে। আমি তোকে পুরো বাড়িটার কোথায় কী আছে! সবটুকু দেখিয়ে দিই।” এইবলে হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় রোহিনী।

আর ঘর থেকে বেরিয়েই ডাইনিং রুমে রাখা রাজীবের একটা ফোটোর দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে ওঠে, “দেখিস ভাই, তুই খুব সুখী হবি। তোর এতোদিনের জমানো ব‍্যথা ধীরে ধীরে লাঘব হবে এইবার।”
তারপর আরও একবার মোনালিসার ঘরের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে ওঠে, “যে মানুষ নিজেও যন্ত্রণার মধ‍্যেই অনেকখানি সময় কাটিয়েছে ,সেই পারবে তোর যন্ত্রণা বুঝতে। মোনালিসাই তোর জীবনের হারানো প্রাপ্তি। আমি ভুল করিনি সঠিক মানুষ চিনতে। তোরা সুখী হবি, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।” কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকার পর পাশের ঘরের দিকে পা বাড়ায় সে।

রোহিনী বেরিয়ে যাওয়ার পর মোনালিসা ওয়াশরুমে ঢুকে শাওয়ারের নিচে দাঁড়ায়। অবাধ‍্য জল নিজ ছন্দে ঝরতে ঝরতে তার গাল,চিবুক, শরীর সব ভিজিয়ে দিতে থাকে। গতকাল রাতের সাজ জলের বেগের কাছে আত্মসমর্পণ করে হারিয়ে ফেলতে থাকে তার সকল রঙ। কৃত্রিম রঙ যত ধুয়ে যেতে থাকে, ততই স্পষ্ট হতে থাকে আসল মোনালিসার রূপ।
ওয়াশরুমের মার্বেল ফ্লোরে যখন সব রঙ অন্তিম দর্শন দিয়ে হারিয়ে যেতে থাকে। তখন শাওয়ারের অবাধ‍্য জলরাশির সাথে মোনালিসার চোখের জল মিশেও একাকার হয়ে যায়।
আর তখন রোহিনীর বলা শেষ কথাগুলো মনে করে সে মনে মনে বলে ওঠে, “দিদি , জীবনে সবার যন্ত্রণা থাকে। তোমার ভাইয়ের কথা তুমি বলতে পারছো, আমার মনের কষ্টের কথা বলার মত কেউ নেই।
আমার জীবনে কোনো স্বপ্ন নেই। যতবার যে স্বপ্নের কথা ভেবেছি তা কৃত্রিম রঙের মতোই কিছুক্ষণ শোভিত হয়ে চোখের জলে ধুয়ে মুছে অদৃশ‍্য হয়ে গেছে।
আমার জীবনের যন্ত্রণার মোকাবিলাও আমি একাই করে চলেছি।”

অপরদিকে, বাড়ি থেকে মিনিট পাঁচেক দূরে থাকা লেকের একদম শেষ প্রান্তে অযত্নে গজিয়ে ওঠা আগাছার থেকে কিছুটা দূরে একপাশে চুপচাপ বসে রাজীব।
পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখেই আর লোক চর্চার বিষয় হওয়ার থেকে নিজেকে বিরত রাখতেই , বিয়ের জন‍্য অফিস থেকে কয়েক দিনের ছুটি নেওয়া আছে তার।
কিন্তু, যে বিয়েটা সে কোনোদিন মন থেকে মানতেই পারবে না তার জন‍্য ছুটি নিয়ে বাড়িতে থাকা যে কতোটা যন্ত্রণাদায়ক তা শুধু তার মনই জানে।
অশান্ত হাওয়া মাঝে মাঝেই লেকের জলকে টলিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে। সেদিকে একমনে তাকিয়ে থাকলেও তার মন তখন অন‍্য ভাবনায় মগ্ন।
এতো লোকজন, আনন্দ এসবের কোনোকিছুরই যে তার আর প্রয়োজন নেই।
অপেক্ষা আর উপেক্ষা যার জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সে যে কী করে অন‍্যের দায়ভার নিজের কাঁধে নিয়ে জীবনে এগোবে এ কথা ভাবলেই তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে।
এমন সময় তার ফোনটা হঠাৎ বেজে ওঠে । ফোনটা বের করে সে তাকিয়ে দেখে স্ক্রিনে নাম ভেসে উঠছে আবীর।
আবীরই তার একমাত্র বন্ধু যার সাথে জীবনের অনেক কিছু সে শেয়ার করে এসেছে।
বিগত কয়েক বছর আবীর দেশের বাইরে থাকায় সেভাবে কথা হয়ে ওঠেনা।
তাই ফোনে আবীরের নাম দেখা মাত্র ফোনটা রিসিভ করে সে। আর ফোন রিসিভ করা মাত্র আবীর বলে ওঠে ,সে গতকাল কলকাতায় ফিরেছে।
একথা জানামাত্র কিছুক্ষণ স্বাভাবিক কথপোকথনের পর দুপুরে পাশের রেঁস্তোরায় আবীরকে দেখা করার কথা বলে রাজীব।
তারপর শান্ত মনে ফোন রেখে মনে মনে সে ভাবে – এবার নিশ্চয়ই কোনো পথ পাওয়া যাবে।

(চলবে……)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here