মোনালিসা পর্ব ১

0
2353

মোনালিসা
মৌমিতা_দত্ত
পর্ব ১

টান টান একটা উত্তেজনা নিয়ে সাজানো বিছানার একপাশে জড়ো হয়ে বসে আছে লিসা মানে মোনালিসা।
মাঝে মাঝে ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে, না জানি আজ রাতে কী হয়! এই চিন্তায়।
বাইশ বছরের মেয়ের জীবনের এক অন‍্য অধ‍্যায়ের সূচনা আজ। অন‍্যের পরিচয়ে নিজেকে পরিচিত করা, অন‍্যের ঠিকানাকে নিজের ঠিকানা বানিয়ে নেওয়া, অন‍্যের মতামতকে শিরোধার্য করে প্রতি পদক্ষেপে চলার সূচনা আজ থেকে। আজ তার ফুলশয‍্যা। এসব ভাবনার মাঝেই সামনের সাদা রঙের দেওয়ালের উপরের দিকে থাকা হলুদ রঙের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে, ঘড়ির সময় বলছে রাত্রি ১টা ।
এতক্ষণে জেঠিমা, জোজো সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে তাদের বাড়িতে (বাপের বাড়িতে)। এখন তো ওদের সবার মাঝরাত। গ্রামের বাড়িতে থাকলে সেও এতক্ষণে জোজোকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকতো। জোজোর কথা মনে হতেই মনটা খারাপ হয়ে যায় নিমেষে।

তার বিদায়ের সময় জোজোর কান্না আর হাত চেপে ধরে বলা,” লিসা আমাকে ছেড়ে যাসনা।”
কথাগুলো মনে পড়তেই চোখের কোণও চিকচিক করে ওঠে আবার।
জোজো হল তার জেঠুর একমাত্র ছেলে, বয়স বছর বারো হবে।
এখানে বলে রাখি , আসলে বছর বারো আগে মোনালিসার বাবা শ্রী বিনয় রায় এবং মা শ্রীমতি মধুলীনা দেবীর আকস্মিক মৃত্যুর পরই তার জেঠু শ্রী বিদ‍্যুৎ রায় বিবাহ করেন কনক দেবীকে।
এতো বেশি বয়সে বিদ্যুৎ বাবুর বিয়ের কারণ ছিল দুটি – একদিকে তার ভাইয়ের একমাত্র মেয়ে মাতৃ স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়ে নিজেকে যাতে অনাথ না মনে করে আর অপরদিকে শূন‍্য সংসারের হেঁসেলের দায়িত্ব।
সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেও অতি অল্পদিনেই কনক দেবীর স্বরূপের পরিচয় তিনি পেয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন ফুল ভ্রমে তিনি আসলে ক‍্যাকটাস নিয়ে এসেছেন নিজ বাড়িতে।
যখন তিনি টের পেলেন তখন তার আর কিছু করার ছিলনা।

তাই মোনালিসার ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখেই একপ্রকার অনিচ্ছা সত্ত্বেও সুপাত্র পাওয়াতে তিনি আর দ্বিধাবোধ করেননি, বয়স অল্প হলেও মোনালিসার বিয়ে তিনি দিয়ে দেন রাজীবের সাথে।

বাড়ির কথা ভাবতে ভাবতেই কষ্টগুলো দলা পাকিয়ে গলার কাছে এসে যেন আটকে যেতে থাকে ।
ক্রমে মনের অস্থিরতা এবং গলার হারের চাপে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসার জোগাড় হয় তার।

এক সময় মনে হয়, সমস্ত গয়নাগাঁটি খুলে ফেলে নিশ্চিন্তে একটু ঘুমিয়ে নেবে । পরক্ষণেই জেঠিমার সাবধান বাণী মনে পড়ে যায়, “শোন লিসা নিজের স্বরূপ দেখিয়ে শ্বশুর বাড়ির লোককে অস্থির করবিনা। তারা যদি জানতে পারে তুই ল‍্যাজবিহীন হনুমান ভিন্ন আর কিছু নোস, তাহলে বিয়ের পরদিনই বাড়ি ফেরত দিয়ে যাবে। তাই, ভদ্রবাড়ির বউদের ন‍্যায় আচরণ করবি। আর তা না হলে , একবার যদি তোকে এ বাড়িতে তারা ফেরত দিয়ে যায় – তাহলে আমি তোকে আর এ বাড়িতে ঠাঁই দেবোনা বলে দিলাম। কথাটা মাথায় থাকে যেন।”

জেঠিমার সাবধান বাণীর পরেই হঠাৎ বাবার মুখটা ভেসে ওঠে তার চোখের সামনে।
এবার বালিশের নীচ থেকে বাবার ফটোটা বের করা মাত্র চোখের ধারা যেন দ্বিগুণ মাত্রায় ঝরতে থাকে তার।
বছর বারো আগে যেদিন শেষবারের মতো বাবার সাথে তার দেখা হয়েছিল সেদিনটার কথা মনে পড়ে যায়।
সেদিন শেষবারের মতো বাবা কোলে তুলে নিয়ে বলেছিল তাকে, ‘লিসা মা আমার একদম মন খারাপ করবে না। আমি এখুনি যাবো আর তোমার মা কে নিয়ে তোমার কাছে চলে আসবো। প্রমিস মা । তুমি লক্ষী মেয়ে হয়ে জেঠুর কাছে থেকো। দুষ্টুমি করোনো।’
সেদিনের সেই বাবার চলে যাওয়া যে চিরতরে চলে যাওয়া হবে তা সে কখনোই ভাবেনি!
আজও সেই দিনটার কথা মনে পড়লেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে তার।
সেই সময় কতরাত , কতদিন অপেক্ষা করতে করতে সে ঘুমিয়ে পড়েছে, তা সে নিজেও জানেনা।
শেষবারে দেওয়া কথা তার বাবা রাখতে পারেনি ঠিকই কিন্তু সে বাবাকে দেওয়া কথা রেখেছে। আর কোনোদিন দুষ্টুমি করেনি।
তাইতো প্রথম প্রথম বাবা – মা’র জামাকাপড় কে আঁকড়ে ধরে ভাবার চেষ্টা করেছে বাবা – মা তার সাথেই আছে।
বাবার কথা মনে হতেই সব সাবধান বাণী উপেক্ষা করে চেনা নিয়মে চোখ বেয়ে জলধারা নেমে এসে গালের গোলাপি ব্লাশার ধুয়ে তার চিবুক বেয়ে ঝরে পড়তে থাকে।
এরকম কষ্ট তার আগেও হয়েছে কিন্তু আজকের কষ্টের মাত্রাটা একটু বেশিই।
জ্ঞানত তাকে অপেক্ষা করেই কাটাতে হয়েছে এ অবধি প্রতিটি দিন।
কখনো বাবার জন‍্য, কখনো মা- এর জন‍্য, কখনো জেঠিমার মুখ থেকে নির্গত দুটি স্নেহের বাক‍্য শোনার জন‍্য, আর আজ নিজের স্বামীর জন‍্য।

আজ অবধি কেউ কখনো তার জন‍্য অপেক্ষা করেনি। সবাই শুধু কথা দিয়ে, তাকে ফাঁকি দিয়েছে।
জেঠু সারাজীবন তাকে মেয়ের মতো নিজের কাছে যত্নে আগলে রাখবে বলেও রাখেনি।
বাবা ফিরবে বলেও ফেরেনি।
আর আজ দায়সারাভাবে এমন একজন অপরিচিত মানুষের হাতে তাকে তুলে দেওয়া হল – যার মনের এবং মনুষ্যত্বের পরিচয় কেমন হবে? তার পূর্বাভাস এখনি পেয়ে গেছে সে।

এখনো রাজীবের পাত্তা নেই।

এবার বিছানার মাঝে ছেটানো গোলাপের পাপড়ি গুলোর দিকে তাকিয়ে মনটা খারাপ হয়ে যায় বছর বাইশের তন্বীর।
মনে মনে ভাবে, গোলাপের পাপড়ি গুলোরও তার মতনই অবস্থা নিজের ছিন্নভিন্ন করা পাপড়ির টুকরো গুলো অন‍্যের মনোরঞ্জনের জন‍্য শোভিত হচ্ছে । ফুলের নিজ সত্তা বিসর্জিত তবুও অন‍্যের শোভিত শয‍্যায় ভালোবাসার শয‍্যাসঙ্গী সে ছিন্নভিন্ন পাপড়ি নিয়ে।

এসব ভাবনার মাঝেই তার একটু তন্দ্রাভাব এসেছে। বসে বসেই চোখ বন্ধ হয়ে এসেছে আর ঠিক সেই সময়ই দরজার আওয়াজে চমকে উঠে তাকানো মাত্রই সে দেখে – দরজার কাছে তার স্বামী রাজীব দাঁড়িয়ে দরজা বন্ধ করতে ব‍্যস্ত।
রাজীব কে দেখামাত্রই তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসে।
দরজা বন্ধ করে একটু টাল খেতে খেতে রাজীব যত বিছানার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে ততই যেন ভয়ে, আতঙ্কে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হতে থাকে তার।
বিছানার চাদরটাকে খামচে ধরে মনে মনে প্রমাদ গুণতে থাকে লিসা। না জানি, এখন কী অপেক্ষা করছে এখন তার জন‍্য!
রাজীব বিছানার একদম কাছাকাছি এসে বিছানায় বসামাত্র তীব্র এক ঝাঁঝালো গন্ধে গা পাক দিতে থাকে লিসার। ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা মনে করে তার কপালে বিন্দু বিন্দু জলকণা ফুটে ওঠে।
এইবুঝি হাত ধরে টান দেবে ! এই বুঝি জোর করে তাকে চুম্বন করবে! এইসব ভাবতে ভাবতে ভয় , আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে নেয় সে।

বেশ কিছুক্ষণ পাথরের মূর্তির মতো চোখ বন্ধ করে বসে থাকার পর অপরপক্ষের কাছ থেকে কোনোরূপ অযাচিত আক্রমণের আঘাত না আসায় সাহসে ভর করে চোখ খোলামাত্র চেয়ে দেখে তার সামনে রাখা বালিশে মাথা দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে রাজীব।
এবার কপালের ঘাম মুছে টেবিলে রাখা জলের গ্লাস থেকে পুরো জলটা পান করার পর সামনের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ঘড়িতে রাত ৩.১০ বাজে।

এ যাত্রায় ফাঁড়া কেটে গেছে মনে করে অতিসন্তর্পণে গয়না গাটি খুলে রাজীবের পাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়ে লিসা।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here