মেঘ বৃষ্টি রোদ, পর্ব:১৬

0
591

❤#মেঘ_বৃষ্টি_রোদ
#ষোড়শ_পর্ব❤
সৌমিক ঠিকানাটা ফোনে বারবার করে দেখছে, মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে বহুবার। কিন্তু নাহ্, সেই যেমন ছিল, তেমনটাই রইল সব। এতটুকু পরিবর্তন হলনা কোথাও। ওটা দাদার ফ্ল্যাটের ঠিকানাই, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু দাদার ফ্ল্যাটে পর্ণা কী করতে গেছে? কোনো সম্ভাবনার কথাই মাথাতে আসছেনা, এই মুহূর্তে। পর্ণা তো ফোনও তুলছেনা, কোনো বিপদ আপদ হল নাকি! দাদা ঠিক আছে তো? কোনো কিছুর উত্তরই পুরোপুরি সঠিক ভাবে না পেয়ে,বাইকের স্পিডটা আরো একটু বাড়িয়ে দিল সৌমিক, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দাদার ফ্ল্যাটে পৌঁছাতে হবে, ঘটনা আসলে কী, সেটা নিজের চোখে দেখা না অবধি শান্তি নেই।

পর্ণা সেই তখন থেকে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে দেখে, সৌমাভ পরিস্থিতি টা একটু সহজ করার জন্য, কফিকাপটা টেবিলে রেখে বলল,

-” পর্ণা, টেক ইট। আমি তেমন পারিনা এসব বানাতে, তবে তোমার বান্ধবীর নাকি খুব ভালো লাগে এটা, এখন তুমি খেয়ে দেখো, সত্যিই ভালো কিনা ”

-” হুম, থ্যাংক ইউ স্যার”

-” উঁহু স্যার নয়, সৌমাভদা বলে ডাকতে পারো, আমাকে এখন। এই মুহূর্তে, আমি তোমার স্যার নই। তার কারণটা আশাকরি জেনে গেছ অলরেডি, তৃণা বলেছে নিশ্চয়, তাই তো?”

-‘হুমম বলেছে, আসলে একটু, অস্বস্তি লাগছে। মানে বুঝতেই তো পারছেন”

-” হুম পারছি, আমার নিজেরও যে খুব স্বস্তি হচ্ছে তাও, তো নয়। তোমার বান্ধবীকেই বরং জিজ্ঞেস করে নাও। ”

কথাটা বলেই, পাশে বসে থাকা তৃণার দিকে তাকালো সৌমাভ। তৃণা তখন দুষ্টুমিষ্টি চোখে তাকিয়ে রয়েছে ওদের দুজনের দিকেই। ওর চোখের দৃষ্টি যেন অদৃশ্যভাবে সৌমাভকে ইশারা করতে লাগল, যে এবারে কথা গুলো বলে ফেলা হোক। কিন্তু সোফায় বসে সৌমাভর মনের অস্বস্তিটা সে ধরতে পারলনা। আর পর্ণা তো ভিতরে ভিতরে রীতিমত ঘামতে লাগল, সৌমিকের আসার অপেক্ষায়।
সৌমাভ অস্বস্তিটা দূর করার জন্য, সামান্য কেশে নিয়ে বলল,

-” হুমম, তো যেটা বলছিলাম। আজকে তৃণা তোমাকে এইজন্যই ডেকেছে এখানে, আমাদের সম্পর্কটা নিয়ে বলবে বলে। আমিও সে ব্যাপারেই বলব তোমাকে, যে আমরা অনেকদিন থেকেই সম্পর্কে রয়েছি। আর এই কথাটা আমিই বারণ করেছিলাম কাউকে বলতে, সে কারণেই তৃণা তোমাকে কিছু বলেনি এতদিন। আসলে বুঝতেই পারছ, এই কথাটা জানাজানি হলে, কলেজে বেকার বিভিন্ন জন বিভিন্ন কথা বলবে। তার থেকে যতটা এড়িয়ে চলা যায় আর কি’

-” হ্যাঁ বুঝতে পারছি, আপনি চিন্তা করবেন না, আমি এ ব্যাপারে কাউকে কিছুই বলব না। কারণ আপনার আগে থেকেও, তৃণা আমার বান্ধবী। ওর ভালোমন্দের ব্যাপারটাও আমি নিশ্চয়ই মাথায় রাখব। ওর কোনো ক্ষতি হোক, আমি কখনোই চাইব না”

-” হুমম, সেতো অবশ্যই। বেশ, তাহলে যেটা বলার বলা হয়ে গেল। নাও কফিটা খাও এবার, ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে”

ওদের কথাবার্তার মাঝখানেই তৃণা এবার একটু নড়েচড়ে বসল, ওকে দেখে মনে হল, একটা ভীষণ বড়োসড়ো কিছু বক্তব্য আছে। সৌমাভ কফির কাপটা হাতে তুলে নিয়ে, ভ্রু টা কুঁচকে তৃণার দিকে তাকিয়ে বলল,

-” এতো এক্সাইটেড হওয়ার কী আছে, যা বলার বলে ফেলুন। আজ তো আপনারই দিন”

-” আরেহ্ একটা কথা তো আমি ভুলেই গিয়েছিলাম, পর্ণা আজ নিজেও একটা চমকের কথা বলছিল, মানে ওর সাথে কারো সম্পর্ক আছে, এই ব্যাপারে। অথচ এতক্ষণ কথায় কথায় সেটা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। এক্ষুণি মনে পড়ল, আমার। এই পর্ণা বল, তুই বলেছিলি না? ”

পাশে বসে থাকা পর্ণার হাতে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে তৃণা বলে উঠল কথাটা। সৌমাভও ব্যাপারটা শুনে উৎসাহী হয়ে তাকালো পর্ণার দিকে, হালকা মজার সুরে ও বলল,

-” ওহ, রিয়েলি? বাহ্, ভালো তো, তাহলে তোমার বয়ফ্রেন্ডকে এখানে আসতে বলো, আমার কোনো অসুবিধা নেই, আর এটা নিয়ে সংকোচ বোধেরও কিছু নেই। ইটস নরমাল”

-‘হ্যাঁ ওকে বলেছি আমি আসতে, হয়তো চলেও আসবে এতক্ষণে, কিন্তু ও আসার পরে কী হবে আমি জানিনা।”

-” কী হবে মানে?”

পর্ণার কথার ধরনটা ঠিক বুঝতে পারলনা সৌমাভ বা তৃণা কেউই। তৃণা খুব ভালোভাবে পর্ণার মুখে দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল, যেন চাপা একটা অস্বস্তি কাজ করছে মেয়েটার মধ্যে। এতক্ষণ সে ভাবছিল, হয়তো সৌমাভকে দেখে অস্বস্তিতে পড়ে গেছে পর্ণা, তাই চোখ মুখ ওরকম শুকনো দেখাচ্ছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ব্যাপারটা আরো অন্যরকম। ভেতরে আরো কিছু যেন ঘটনার গন্ধ পাচ্ছে সে… কিন্তু ঘটনাটা যে আসলে কী সেটা আন্দাজ কিছুতেই করা যাচ্ছে না ….
তবে খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না, ওধের কাউকেই। পর্ণা তৃণার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই ফ্ল্যাটের ডোরবেলটা বেজে উঠল সশব্দে। আওয়াজ টা শুনেই তৃণা চোখেমুখে একরাশ খুশি নিয়ে সৌমাভর দিকে তাকিয়ে বলল,

-” আমি গিয়ে দেখি??”

-” হুমমম যাও, বাট দেখে নেবে আগে কে আছে বাইরে”

-” আরে হ্যাঁ, আমি জানি।”

কথা বলতে বলতেই বেশ উৎসুক মনোভাব নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল তৃণা। ওর যাওয়ার পথের দিকে একভাবে তাকিয়েই রইল সৌমাভ। মেয়েটা এই ক’দিনেই এই ফ্ল্যাটের সব ঘরের প্রতিটা কোণ, প্রতিটা অংশ নিজের অধিকার দিয়ে আঁকড়ে নিয়েছে। এখানে এলেই, একদম নিজের ঘরের মতো করে চলাফেরা করে তৃণা, সৌমাভর প্রতিটা জিনিসেই হস্তক্ষেপ ওর। আর তৃণার এসব কাজ, এসব অনুভূতিগুলো ভীষণ ভাবে উপভোগ করে সৌমাভ। কখনো কিছুতে বিরক্ত বা বাধা না দেওয়ারই চেষ্টা করে।কারণ এতদিন এই ফাঁকা ফ্ল্যাটে নিঃসঙ্গ ভাবে থাকো থাকতে গাম্ভীর্যের যে চাদর আড়াল করে রেখেছিল, তা যেন আজকাল একটু একটু খুলতে শুরু করেছে। তৃণা ফ্ল্যাটে না থাকলেও ওর অস্তিত্ব, ওর কথাবার্তা, চঞ্চলতা এগুলো বেশ ভালো ভাবেই অনুভব করতে পারে সৌমাভ, আজকাল এটুকুই যেন ভীষণ রকমের অভ্যেস হয়ে গেছে প্রতিদিনের জীবনে।

************
দরজাটা খুলেই চমকে উঠল তৃণা, চমকের জন্য প্রস্তুতি তো ছিলই মনের মধ্যে। তা বলে, সেটা যে এইভাবে আসবে তার জন্য একেবারেই তৈরী ছিলনা তৃণা। অবাক গলায় সে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সৌমিকের দিকে তাকিয়ে বলল,

-” তুমি,!!?”

-” হ্যাঁ আমারও তো একই প্রশ্ন, তুই এখানে?”

-” আমার তো এখানেই থাকার কথা, তোমাকে কে ডেকেছে ? মানে এটা তোমার দাদার বাড়ি জানি, সেই হিসেবেই কি এসেছ? আসলে আমরা আরো একজনের অপেক্ষা করছি তো সেই জন্য”

-” আমাকে, আমাকে পর্ণা ডেকেছে। ও কি এখানে আছে? মানে আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা, ও তোকেও ডেকেছে?কিন্তু দাদার এখানে, কেন?”

-” পর্ণা, আমাকে ডাকেনি, আমি পর্ণাকে ডেকেছি। আর তুমি তো পুরো সব বিষয় জানোনা, তাই হয়তো বুঝতে পারছনা। কিন্তু পর্ণা তোমাকে ডেকেছে মানে? এটাও বুঝলাম না, ও তারমানে তোমার সাথে,….মাই গড! সিরিয়াসলি?”

-” সৌমিক, তুই??”
ওদের কথাবার্তার মাঝখানেই কখন সৌমাভ পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে তৃণা বুঝতেও পারেনি। গলার আওয়াজটা শুনে পিছনে ফিরে, সেও সৌমাভর মতো অবাক গলাতেই বলল,

-” হ্যাঁ, আমিও তো সেটাই বুঝতে পারছিনা।”

-” আচ্ছা বাদ দাও, ও ভেতরে আসুক আগে, আয় ভেতরে আয়। এসে সব কথা খুলে বল”

ঘরের ভেতরে ঢুকে, ওরা তিনজনেই প্রথমে পর্ণার দিকে তাকালো। এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, যে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। কে আগে, কী কথা শুরু করবে ভেবে পেলনা। একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে ঘরের ভিতরে। ভীষণ অস্বস্তিকর পরিবেশটা কাটানোর জন্য সৌমিকই প্রথম কথা বলে উঠল,

-” আচ্ছা, পর্ণা তুমি আমাকে সবটা খুলে বলো আগে, মানে, তৃণা আর দাদা এখানে আছে, তুমিও ওকে ডাকোনি , ও নাকি তোমাকে ডেকেছে, কী হচ্ছে কিচ্ছু মাথায় ঢুকছে না, বলো আমাকে,”

-” তোমার দাদা আর তৃণা একে অপরকে ভালোবাসে, এবং ওরা রিলেশনশিপে রয়েছে। এটাই ব্যাপার,”

শান্ত, শীতল, নির্জীব গলায় কথাটা বলল পর্ণা। আর বলার সাথে সাথেই সৌমিক যেন ভীষণরকম একটা ধাক্কা খেল। দাদা কারোর সাথে প্রেম করে, এটাই তো বিশ্বাসযোগ্য নয় তার কাছে। আর সেখানে মেয়েটা তৃণা??? যাকে নিয়ে এতদিন এত কথা ভেবেছে, সে, এমনকি পর্ণা নিজেও। ব্যাপারটা হজম করতে বেশ কিছুটা সময় লেগে গেল সৌমিকের। পাশে সৌমাভর দিকে আড়চোখে একবার তাকালো সে, দেখল দাদাও ওর দিকে একই ভাবে চেয়ে আছে। বাইরের কেউ এখানে উপস্থিত থাকলে নির্ঘাত হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে যেত তার। কিন্তু এই মুহূর্তে ওদের কারোর সেই হাসিটা আসছেনা। সৌমিক এবার বিড়বিড় করে সৌমাভর দিকে তাকিয়েই বলল,

-” আমি আর পর্ণাও এখন রিলেশনশিপে আছি, এই কথাটাই ও তৃণাকে জানাতে চেয়েছিল। সে জন্যই এখানে আসা। কিন্তু এতকিছু হয়ে যাবে বুঝতে পারিনি,সত্যি ”

-” আমিও বুঝতে পারিনি, মানে আমরাও না”

এতক্ষণ পরে শান্ত গলায় সৌমাভ কথা বলল। তৃণাও ওর কথায় সায় দিয়ে মাথাটা নাড়াল। তবে ও আর নিজের শান্তভাবটা বজায় রাখতে পারলনা। তাড়াতাড়ি করে হেঁটে, ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে তৃণা একটু জোরগলাতেই বলল এবার,

-” ওকে ওকে, অনেক অবাক হওয়া হয়ে গেছে। তাহলে ব্যাপারটা এটা দাঁড়ালো, সম্পর্কগুলো হল এইরকম- আমি আর সৌমাভ, এবং ওদিকে পর্ণা আর সৌমিক। তাই তো?? দুই ভাই, দুই বন্ধু…. দারুণ কিন্তু! আমার তো ভীষণ মজা লাগছে, কিন্তু পর্ণা আর সৌমিক, তোরা ডুবে ডুবে জল খেতে এতদূর কী করে পৌঁছালি, সেটা খুলে বলবি??”

-” ঠিক যেভাবে তোরা পৌঁছেছিস।”

পর্ণা হেসে ফেলল কথাটা বলেই। আর সবার সামনে সেটা শুনে তৃণা একটু লজ্জা পেয়ে আড়চোখে একবার সৌমাভর দিকে তাকালো। সৌমাভ তখন অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল, বলে সেটা খেয়াল করল না। তবে এতক্ষণ পরে, ওরা প্রত্যেকেই সেই হাসিতে যোগ দিল সমানভাবে। ঘরের জমাট বাঁধা পরিস্থিতিটা ধীরে ধীরে সহজ হতে শুরু হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পর্ণা, সৌমিক আর তৃণা সোফায় বসে তুমুল উৎসাহে নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করে দিল। সৌমাভ আর কথা না বাড়িয়ে আরো কয়েক কাপ কফি বানানোর জন্য কিচেনে দিকে পা বাড়ালো। আর ঠিক তখনই ওর ফোনটা বেজে উঠল সশব্দে। পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখতেই এতক্ষণের আনন্দটা পুরোপুরি যেন থমকে গেল সৌমাভর। ও দেখল, মৌলি ইতিমধ্যেই এগারোটা মেসেজ করেছে ওকে, শেষে উত্তর না পেয়ে এখন ফোন করেছে। কী ব্যাপার? এতদিন পরে, সব কিছু মিটে যাওয়ার পরেও, আবার কেন ফোন করেছে মৌলি? সৌমিভ তো ওকে বলেছিল, কেবলমাত্র শুধু বন্ধু হয়ে থাকতে পারলে, তবেই কখনো যোগাযোগ করতে। তবে কি সেই জন্যই ফোন করছে ও, এই অল্প সময়েই এত সুবুদ্ধি হয়ে গেল ওর? ভারী অদ্ভুত! কিছুটা আড়ালে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করল সৌমাভ। মৌলি কিছু বলার আগেই, ফিসফিস করে ও বলল,

-” হুম বল, ফোন করেছিস কেন?”

-” কেন করতে পারিনা?”

-” হ্যাঁ পারিস, কিন্তু তবু জিজ্ঞেস করছি, কী কারণে ফোন করেছিস?”

-” ভালো আছিস?”

-” হুম, আছি, তুই??”

-” হ্যাঁ আমিও ভালো। তারপর বল, কেমন চলছে সব?”

-” ভালো”
সংক্ষেপে জবাব দিল সৌমাভ। কিন্তু ওদের ফোনের কথাবার্তার মাঝখানেই পেছনে কখন যে তৃণা এসে দাঁড়িয়েছে, সেটা সৌমাভ বুঝতেও পারলনা। ও জানতেও পারলনা, আবার নতুন করে কী ঝড় আসতে চলেছে তাদের সম্পর্কে।
(ক্রমশ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here