মেঘ বৃষ্টি রোদ, পর্ব:১৫

0
488

❤#মেঘ_বৃষ্টি_রোদ
#পঞ্চদশ_পর্ব❤
দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ কেটে গেছে। আজকে সোমবার, সপ্তাহের প্রথম দিন, সমস্ত ব্যস্ততায় ভরা দিন গুলির মধ্যে অন্যতম একটি দিন এটা। তবে হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও, তৃণার মনটা আজকে বেশ খুশি খুশি আছে। বিকেলবেলার প্ল্যানটার কথা মাথায় আসলেই ওর মন বারবার ভালো হয়ে যাচ্ছে। পর্ণা যে আজ কী পরিমাণ অবাক হয়ে যাবে, সেটা কল্পনা করলেই হাসি পাচ্ছে। বিকেলে কলেজের শেষে, সৌমাভই ওকে ড্রপ করে দেবে বলেছিল। আর তখনই নিজের প্ল্যানের কথাটা তৃণা সৌমাভকে জানিয়েছিল, তাও আবার ভীষণ ভয়ে ভয়ে। কারণ ওদের সম্পর্কের কথাটা সৌমাভ কাউকে জানাতে বারণ করেছিল। অনেক কষ্টে, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ওকে রাজি করিয়েছে তৃণা। প্রথমে তো, ওর কথাটা শুনেই, এককথায় না করে দিয়েছিল সৌমাভ, রাগী গলায় বলে উঠেছিল,

-” এতটুকু ধৈর্য্য নেই?? আমি তো বলেছি, তুমি পাস আউট করো, তারপর সবাইকে জানিও,তর সইছে না?”

-” না, তর সইছেনা, হয়েছে? আরে বাবা, আমি তো সবাইকে বলছিনা, শুধু পর্ণাকে বলব। ব্যস”

-” হুমম, প্রথমে, পর্ণা ….তারপর বাকিরা একে একে, বাকি সবাই। তাই তো?”

-” পর্ণা ওরকম মেয়ে নয়, যেমনটা আপনি ভাবছেন, ও কাউকেই বলবেনা।”

-” এইইই তুমি প্লিজ এখানে, আপনি আপনি করা বন্ধ করো আমাকে, নিজেকে কাকু কাকু লাগে, উফফ”

মৃদু বিরক্তিতে জোরে বলে ওঠে সৌমাভ। তবে তৃণা এখন আর ওর চোখরাঙানিতে, ভয় পায় না। ধীরে ধীরে সম্পর্কের বাঁধনে, রাগ-অভিমান গুলো অভ্যাসে পরিণত হতে চলেছে যেন। আর বিশেষ করে, কলেজের বাইরে এইসব ধমক-বকাঝকা হলে তো একদমই ভয় পায় না তৃণা। সে উল্টে সৌমাভর গম্ভীর গলার আওয়াজ শুনে, আরো বেশি করে বলতে শুরু করল…..

-” বেশ করব, আপনি বলব, একশবার বলব। শান্তি? তাহলে আমার কথা মানতে হবে, পর্ণার সামনে স্বীকার করতে হবে, যে আমাদের মধ্যে সম্পর্ক শুরু হয়েছে। রাজি? যদি রাজি হও,তাহলেই তুমি করে কথা বলব। ক্লিয়ার হয়েছে আমার শর্তটা?”

-” তৃণা তুমি একটা কাজ করো, তুমি নিজেই বরং পর্ণাকে সবটা জানিয়ে দাও, তাহলেই তো ঝামেলা মিটে যায়, তা না করে আমাকে কেন এসবের মধ্যে জড়াচ্ছ?”

-” এটা ঝামেলা? ওকে। তারমানে, আমিও ঝামেলা ? আমাকে সবার সামনে স্বীকার করতে সমস্যা? তাই তো?”

-” তুমি কি কোনো কথা সহজভাবে নিতে পারোনা? আমি কি সেসব বলেছি? অদ্ভুত তো! কথায় কথায় এরকম করতে ভালোলাগে?”

বিরক্তিতে গলার স্বর পরিবর্তন হয়ে এল সৌমাভর। তৃণা কেন বুঝতে চাইছেনা, যে এই ব্যাপারটা একদিন খুব বেশী বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। সেদিন কলেজ চত্বরে ঐ ছেলেগুলো ওভাবে ওদের দেখার পর থেকেই, যথেষ্ট সতর্ক হয়ে চলে সৌমাভ। তৃণাকে কীভাবে বোঝাবে ও, যে সম্পর্ক স্বীকার করে নেওয়ার ব্যাপারে কোনো সমস্যা নেই, সমস্যাটা হলো মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির। কলেজে ওদেরকে এভাবে একসাথে দেখলে, কতরকম গল্প যে তৈরী হবে, তার কোনো ধারণাই নেই। আর সত্যি কথা বলতে কি, সম্পর্ককে সবার সামনে প্রকাশ করাটাও বেশ অপছন্দের সৌমাভর। কিন্তু সে কথা তৃণাকে কে বোঝাবে! মেয়েটা এত অবুঝ…..
বাস্তবিক তাইই হল। সৌমাভর কথাটা শুনে, তৃণা একেবারে রেগেমেগে লাল হয়ে উত্তর দিল,

-” হ্যাঁ ভালোলাগে। ওকে, বলতে হবেনা। কিচ্ছু বলতে হবেনা, আমি রাখছি। টাটা”

-” আরেহ্, ওয়েট ওয়েট। আমি বলব। আজকেই বলব, হ্যাপি?? উফফফ, তুমি এত কেন অবুঝ তৃণা?”

-” জানিনা, ব্যস। হুমমম খুশি, আমি খুশি। তাহলে কখন আসবে আজকে, আর কোথায় আসবে?”

-” আমার ফ্ল্যাটেই চলে আসো, এই উইকটা যা ধকল গেছে, ভীষণ টায়ার্ড আমি। তোমরাই আসো। আর হ্যাঁ, কী কী বলতে হবে সেটা বলে দাও, মুখস্থ করে নিই।”

-” উফফ, তুমি কি পাগল? একটা কথা বলবে, সাধারণ কথা, তাতেও সমস্যা? তোমার মন থেকে ইচ্ছে না হলে বলো না, আমি কি জোর করেছি?”

-” এত জোর করার পরেও, বলছো জোর করছ না? অদ্ভুত কথাবার্তা !যাই হোক, বাদ দাও, কখন আসবে টাইমটা বলো। আর সাবধানে আসবে, কেমন?”

গলার সুরটা একটু নরম করে, এবার কথাটা বলল সৌমাভ। কারণ খুব বেশী রাগানো যাবেনা কোনোমতেই এখন তৃণাকে। অতিরিক্ত রেগে গেলে, আবার মানিয়ে নেওয়ার ভীষণ সমস্যা! তার থেকে যতটা নিরাপদ থাকা যায়, নিজের জায়গায়।…..

সকালবেলার এই বিশেষ ঘটনাটাই ঘটেছে আপাতত। আর তারপর থেকেই, তৃণা অপেক্ষা করিয়াছে বিকেল বেলার। পর্ণাকে ফোন করে বলেও দিয়েছে, বিকালে বেরোনোর কথা। এখন শুধু ঘটনাটা চোখের সামনে ঘটার, পালা। তবে এতকিছুর মধ্যেও একটা কথা তৃণার মাথায় ঢুকছে না, যে পর্ণা ওকে আজ আবার উল্টে কী সারপ্রাইজ দিতে চলেছে। কারণ ফোনে যখন ওর সাথে কথাবার্তা হচ্ছিল, তৃণার মতো পর্ণা ও কিছু একটা ব্যাপার নিয়ে বেশ উৎসাহী, এটা বেশ বোঝা যাচ্ছিল। পর্ণা আবার সাথে করে কাকে আনবেও, বলল। তাকে দেখলে নাকি চমক দেওয়ার আগে তৃণা নিজেই চমকে যাবে। কিন্তু ব্যাপারটা যে আসলে কী, সেটাই মাথায় ঢুকছে না তৃণার। ওরা দু’জন বান্ধবী ধীরে ধীরে, কবে যে একে অপরের থেকে এভাবে দূরে চলে যাচ্ছে,তা কেউ টেরই পায়নি। জীবনের কিছু কিছু এমন মূহুর্ত আসে যখন, কিছু ঘটনার জন্য পর সম্পর্ক গুলোতে ভীষণ অন্যরকম প্রভাব পড়ে। ইচ্ছে না থাকলেও, সরে যেতে দূরে। আর তখন দু’পক্ষই প্রচন্ডরকম নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে……

**************
পর্ণা বারবার হাতঘড়িটার দিকে তাকাচ্ছে। চোখেমুখে ভীষণ একটা ব্যস্ততার ছাপ। যেন ক্রমাগত কারো অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত সে। তৃণা ওর এই তাড়াহুড়ো দেখে চোখমুখ কুঁচকে বিরক্ত হয়ে বলল,

-” এই, কে আসবে সেটা কি বলবি? তখন থেকে একটা কথা জিজ্ঞেস করে যাচ্ছি। বলবি কি?”

-” আরে দাঁড়া, সারপ্রাইজ তুই একা দিবি?? আমিও দেব। আর তুই যেটা বলতে চলেছিস, সেটা কিছু হলেও আমরা বুঝতে পেরেছি, তবু দেখতে চাই শেষ অবধি ব্যাপারটা। তাই আসলাম তোর সাথে।”

-” কী!! এই এক মিনিট, আমরা মানে? তুই আর কে? তুই প্রেম করছিস কারো সাথে? সিরিয়াসলি? আর আমাকে বলিসনি?”

-” সে তুইও বলেছিস কি আমাকে? বল সত্যি করে”

পর্ণার জেরার সামনে আর কোনো উত্তর দিতে না পেরে মাথাটা সামান্য নীচু করে নেয় তৃণা। সত্যিই ওর সবটা অনেক আগেই বলা উচিত ছিল পর্ণাকে। আসলে পরিস্থিতি এমন হয়ে গিয়েছিল, যে নিজেই সম্পর্কের সমীকরণ নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছিল সে। তাছাড়া, সৌমাভর কাউকে এসব নিয়ে বলা নিয়ে আপত্তির জন্যও ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনায় যাওয়া হয়নি। এখন এই মুহূর্তে নিজের কৃতকার্যের জন্য, একটু খারাপই লাগতে শুরু করল। তৃণার মুখটা দেখে ওর অবস্থাটা বুঝতে পেরে, পর্ণা সামান্য হেসে বলল,

-” আচ্ছা ছাড়, বাবা। আর কষ্ট পেতে হবেনা, এদিকে তাকা। তাকা বলছি,”

-” হুমম বল। ”

-” রাগ করলি?”

পর্ণার বলা এই ছোট্ট কথাতেই যেন অনূভূতির সব
বাঁধ ভেঙে গেল তৃণার। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়েই ও কাঁদো-কাঁদো চোখে পর্ণাকে সজোরে জড়িয়ে ধরল। আকস্মিক এরকম ঘটনায় পর্ণা প্রায় পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নিল। তৃণার এই পাগলামি গুলোর সাথে পর্ণা অনেক আগেই পরিচিত ছিল। এসব নতুন কিছু নয়। কিন্তু এতদিন পরে, হঠাৎ এরকম হওয়াতে পর্ণা নিজেও নিজের আবেগ আটকে রাখতে পারলনা। ওদের দুজনের মধ্যেকার এতদিনের দূরত্বগুলো ধীরে ধীরে কমে আসতে লাগল। ভালোবাসা-প্রেম যে কেবল প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে আবদ্ধ নয়, সব সম্পর্কের উর্ধ্বে বন্ধুত্ব যে একটা বড়ো গুরুত্ব বহন করে, তা আরো একবার প্রমাণ হয়ে গেল……..

***********
সৌমাভর ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, বেল প্রেস করে অপেক্ষা করতে লাগল পর্ণা আর আর তৃণা। পর্ণা এখনও ঠিকঠাক বুঝতে পারছেনা ব্যাপারটা। কার বাড়ি এটা? তৃণার সাথে ওর সম্পর্কটা এতদূর এগিয়ে গেছে? এই বাড়ির লোকেশন টা সে সৌমিককে পাঠিয়ে দিয়েছে ইতিমধ্যে। ছেলেটা এমন কুঁড়ে ,যে এইমাত্র বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। আসতে আসতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে, আদৌ চিনতে পারবে তো বাড়িটা? বিভিন্ন রকম চিন্তা পর্ণার মাথায় ভিড় করে এল। সৌমিকের সাথে ওর সবে শুরু হওয়ার সম্পর্কটার কথা জানতে পারলে, তৃণা যে কী প্রতিক্রিয়া দেবে, সেটা কল্পনাও করতে পারছেনা সে।
অথচ ভাগ্যের কী ফের, ওরা দুজনের কেউ, অথবা সৌমিক এবং সৌমাভ-এই দুই ভাইও জানেনা, একে অপরের থেকে ঠিক কী ধরনের চমকের অপেক্ষা করছে ওরা। এই মুহূর্তে শুধু সময় কাটার অপেক্ষা ….

খানিকক্ষণ পরে, ফ্ল্যাটের দরজা ঠেলে যে মানুষটা সামনে এসে দাঁড়ালো, তাকে দেখেই সামান্য আঁতকে উঠে পর্ণা বুঝতে পারল, এতক্ষণ ধরে কী চমকের কথা বলে যাচ্ছিল তৃণা। আর তার সাথে এটাও বুঝতে পারল, সৌমিক অর্থাৎ স্যারের ভাই একটু পরে এখানে এসে পৌঁছালে কী কান্ডটা হবে…..। তৃণার সাথে সৌমাভর সম্পর্ক হলেও, এই মুহূর্তে পর্ণার সম্পর্কে তিনি তো স্যারই হন, সুতরাং ক্লাসের মতই যথাসম্ভব বিনয়ের সাথে পর্ণা বলল ,

-‘আ-আপনি! ভালো আছেন স্যার?”

-“হুমম, ভালো আছি, তোমার ভেতরে এসে বসো।”

তৃণার দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে কথাটা বলল সৌমাভ। মেয়েটার চোখে মুখে মুচকি হাসির সাথে দুষ্টুমি এখনো লেগে আছে। প্রেমিকাদের এই এক গুণ, যত গম্ভীর, রাগীই হোক না কেন ভালোবাসার মানুষটা, তারা নিজেদের জেদের কাছে বেচারা প্রেমিকদের হার মানতে বাধ্য করবেই। ঠিক যেমনটা আজকে, এই মুহূর্তে হচ্ছে। তৃণার মুখে এখন যুদ্ধজয়ের হাসি। হাসতে হাসতেই ও খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঘরের ভিতরে ঢুকে সোফায় গিয়ে বসে পড়ল। টেবিলে রাখা জলের গ্লাসটা থেকে ঢকঢক করে খানিকটা জল খেয়ে, পকেট থেকে ফোন বের করে কিছু একটা করতে শুরু করল। সৌমাভও বিশেষ কথা না বাড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে কিছু আনতে গেল। আর এদিকে সোফায় বসে বসে, এসির মধ্যেও ঘামতে শুরু করল পর্ণা। সৌমিক ঠিকানাটা চিনতে তো পেরেই যাবে , কিন্তু তা সত্ত্বেও যদি চলে আসে এখানে? স্যারের ভাইয়ের সাথে ও সম্পর্ক শুরু করছে , ব্যাপারটা ভাবলেই কীরকম কটা অস্বস্তি হচ্ছে মনের ভিতরে…
(ক্রমশ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here