মেঘ বৃষ্টি রোদ, পর্ব:১৭

0
514

❤#মেঘ_বৃষ্টি_রোদ
#সপ্তদশ_পর্ব❤
সৌমাভ যতই চেষ্টা করতে লাগল, কোনোরকমে কথা শেষ করে ফোনটা রাখতে….ওপাশ থেকে মৌলি তত বেশি করে বিভিন্ন কথার জালে ওকে জড়িয়ে ফেলতে লাগল। প্রেমের সম্পর্কের বাইরেও যে বন্ধুত্বটা ছিল, সেটার রেশ ধরেই বেশি বাধা দিতে পারছিল না ও। মৌলি আপাতত এখন এমন কোনো খারাপ, বা উল্টোপাল্টা কথাও বলছেনা, যে সেটার অজুহাত দেখিয়ে ফোনটা রেখে দেওয়া যায়। অনেকক্ষণ এটা সেটা সাধারণ কথা বলার মৌলি হঠাৎই সেই প্রসঙ্গ টায় কথা বলে বসল, যেটার আশঙ্কা এতক্ষণ ধরে করছিল সৌমাভ। বেশ অন্যরকম একটা, হাসিখুশি গলাতেই মৌলি বলল,

-” তারপর বল, তোর গার্লেফ্রন্ড কেমন আছে? কী যেন নাম,ওহ হ্যাঁ তৃণা”

-” ভালো আছে। আর তুই কি আর কিছু বলবি, মানে দরকারি কিছু? আমি একটু ব্যস্ত আছি আসলে, তাই”

-” হুমম দরকারি কথা তো বলব বলেই ফোন করেছি। আচ্ছা তুই তৃণার কাছে আমাদের সম্পর্কটার ব্যাপারে পুরোপুরি ক্লিয়ার তো? মানে যা যা হয়েছে, আমাদের মধ্যে সবটা খুলে ওকে বলেছিস তো? নাকি আসল কথাগুলো চেপে গিয়েছিস?”

-” আসল কথা মানে? তোর আমার মধ্যে এমন কিছু কি সত্যিই আছে, যেটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, কাউকে বলার মত?”

-” তোর আমার মোবাইল চ্যাট গুলো মনে আছে? মানে, আমাকে আই লাভ ইউ বলা, বা আমাদের পাশাপাশি তোলা ছবি, একসাথে ঘুরতে যাওয়া, এগুলো???”

কথাটা বলার পরের, মুহুর্তের মধ্যেই গলার স্বর পরিবর্তন হয়ে গেল মৌলির । এতক্ষণের সহজ, হাসিখুশি কন্ঠস্বরটার উষ্ণতা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে যেন। সৌমাভ মনে মনে প্রমাদ গুনল। সে বেশ বুঝতে পারছে, ঠিক কোনদিকে প্রসঙ্গ নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে মৌলি। কিন্তু এর প্রতিবাদ না করলে আরো বেশি করে চেপে বসবে মেয়েটা,তাই ওকে এতটুকু সুযোগ দিলে চলবেনা। মৌলির কথার উত্তরে সৌমাভ জোরালো গলাতেই বলল,

-” তোকে ভালোবাসার চেষ্টা করেছিলাম আমি, তাই কথাগুলো বলেছি। বা আর যা যা কিছু বললি, তবে এগুলো প্রত্যেকটার পিছনেই তোর জোর ছিল, কোনোটাই স্বতস্ফূর্ত ভাবে আমি করিনি। আর তুই সেই মুহূর্তে আমাকে এমন ভাবে বুঝেয়েছিলিস, যে আমি… যাই হোক বাদ দে দোষ তো আমার অবশ্যই ছিল, আবার বোঝা উচিত ছিল, যে ভালোবাসা ব্যাপারটা নিজে থেকেই হয়, যখন ভাগ্যে থাকে। জোর করে, কারোর কথায় হয়না। আর ঠিক সেটারই চেষ্টা করেছিলাম আমি। বুঝেছিস?”

-” সে যাই হোক না কেন, আমার এসব কথা শুনে আর লাভ নেই। তুই আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিস, সুতরাং আমি তোকে আর তৃণাকে যে ভীষণ সুখী একটা জীবন উপভোগ করতে দেব, এমনটা ভাবিসনা। আমি সিনেমার হিরোইন নই, যে ঐসব আত্মত্যাগ-ট্যাগ করব। তুই আমার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে দেখ একবার, কী ফিল করছিস? এতগুলো বছর ধরে আমি তোকে পছন্দ করতাম, ভালোবাসতাম।কত চেষ্টা করেছি, তোকে নিজের করে তোলার জন্য….কিন্তু পারিনি কিছুতেই। আর যখন আবশেষে,…অবশেষে তুই আমার কথায় রাজি হলি, আমাকে ভালোবাসার চেষ্টা করলি, ঠিক তখনই কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসল, ঐ মেয়েটা?? এটা কি সত্যি মেনে নেওয়া যায়? সৌমাভ, তুই বোঝা আমাকে, বল”

-” আমি বুঝতে পারছি, তুই কষ্ট পাচ্ছিস। কিন্তু আমি তোকে কখনো ভালোবাসতে পারিনি, এতগুলো বছর ধরে কেবল বন্ধুই ভেবেছি। আর শেষে এসে, মত পরিবর্তন করার কথা যখন ভেবেছি, যখন থেকে ছোটমার কথায়, বিয়ের কথাবার্তায় রাজি হতে বাধ্য হয়েছি, তখনই ঐ ভুলটা আমি করে বসি, নিজেকে প্রশ্ন না করেই, তোকে হ্যাঁ বলে দিই। তুইও আশা করে ফেলিস অনেকটা, আর সেটা আমি পূরণ করতে পারিনা। ব্যাপারটা এটাই। আমি তোকে ঠকাই নি, এটা বোঝ। তবু বলছি, আই অ্যাম সরি, তোকে কষ্ট দেওয়ার জন্য ”

ফোনের ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ আর কোনো কথাবার্তার শুনতে পাওয়া গেলনা। একটা ফোঁপানির শব্দ, কেবল অস্পষ্ট ভাবে আসতে লাগল। সৌমাভ বুঝতে পারল মৌলি কাঁদছে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে, খুব স্বাভাবিক ভাবেই ও একটু খারাপ খারাপ লাগা গলায় বলল,

-” মৌলি প্লিজ কাঁদিস না। ঘটনাটা মেনে নে, যত তাড়াতাড়ি এটা মানতে পারবি ততই ভালো। তাহলে আমিও শান্তি পাব। প্লিজ”

-” তুই, তুই একবার বল, যে আমাকে এতটুকু ভালো কখনো বাসিসনি?মানে আমি যদি এখন ধর হঠাৎ মরে গেলাম, তাও তোর একটুও কষ্ট হবেনা?? বল? তখন কি আমার কাছে আসবি? নাকি তৃণার কাছেই থেকে যাবি?”

-” এগুলো কী ধরনের কথাবার্তা মৌলি? তুই যথেষ্ট ম্যাচিওর আমি জানতাম, আর সেখানে এখন….”

-” আমার কথার উত্তর দে আগে, বল…যেটা জিজ্ঞেস করলাম, বল”

-” হ্যাঁ তখন আমি, তোর কাছেই যাব, তৃণার কাছে না। শান্তি? আর তোর প্রতিও আমার ভালোবাসা অবশ্যই আছে, কিন্তু সেটা অন্যর…..”

-” ব্যস ! আর কিচ্ছু বলবি না তুই। আমি শুধু এটুকুই শুনতে চাই, যে তুই আমাকে ভালোবাসিস। ব্যস, আর কিচ্ছু না। তবে একটা কথা, আমি কিন্তু একটু পরেই তৃণার ফোনে তোর আর আমার চ্যাটের স্ক্রিনশট গুলো পাঠাচ্ছি, ওকে? ও সবটা দেখুক, বুঝুক। তারপর নাহয়, তোদের সম্পর্ক টা ভাঙলে, আবার আমার কাছে ফিরে আসিস। ইউ আর ওয়েলকাম, ফর এনিটাইম। কেমন?”

পাগলের মতো অদ্ভুত ভাবে, কথাগুলো বলে হঠাৎ করেই ফোনটা কেটে দিল মৌলি। সৌমাভ স্পষ্ট বুঝতে পারল নতুন আরো একটা ঝামেলা আসতে চলেছে তার জীবনে। ঠিক এই মুহূর্তে ওর মনে হতে লাগল, এসব প্রেম ভালোবাসা ব্যাপারটাই আসলে সবথেকে ঝামেলার জিনিস। এত কষ্ট, এত দুশ্চিন্তা, ঝগড়াঝাঁটি, ঝামেলা- এসব কিছু প্রত্যেকে জানে, বোঝে। আর তারপরেও মানুষ প্রেমে পড়ে, ইচ্ছে করে নিজের হাতে নিজের জীবনের সমস্যা বয়ে আনে। আসলে সর্বোপরি বোধহয় মানুষ ঐ সমস্যা গুলোকেই ভালোবাসে, তার সমস্যা কে ভালোবাসতে বাসতে, নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে আমরা সবশেষে ঐ উল্টোদিকের পুরো মানুষটাকেই ভালোবেসে ফেলি। আর এত বেশি ভালোবেসে ফেলি যে, সমস্যা ছাড়া বেঁচে থাকতে তখন ভীষণ দমবন্ধ লাগে নিজের, বড্ড একা লাগে।

কিন্তু তখনও চমক বাকি ছিল আরো কিছু সৌমাভর জন্য, ও বিভিন্ন কথা ভাবতে ভাবতে আনমনে পিছনে ফিরতেই বিস্মিত হয়ে দেখে, ফ্রিজের পাশে, তার থেকে সামান্য একটু দূরত্বে তৃণা দাঁড়িয়ে আছে। লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করলেও, ওর চোখে যে জল….তা বুঝতে অসুবিধা হলনা সৌমাভর। তবে কি এতক্ষণ ওর বলা সব কথা শুনে ফেলেছে তৃণা? একাপাশের কেবল তার কথাগুলোই শুনলে, ওকে কী পরিমাণ ভুল তৃণা বুঝবে, সেটা ভাবতেই অস্বস্তি শুরু হয়ে গেল সৌমাভর। অবশ্য আরেকটা সম্ভাবনাও মাথায় এল ওর, সেটা হল, মৌলি আবার সত্যিইঐ ছবিগুলো তৃণাকে পাঠায়নি তো? ছবিগুলোর মধ্যে খারাপ, ভীষণ উল্টোপাল্টা কোত্থাও কিছু নেই, কিন্তু তবুও ভুল বোঝার জন্য তা যথেষ্ট…
বিশেষ করে, তৃণা এতটাই ইমম্যাচিওর, ওকে কোনো কথা বোঝাতে হবে ভাবলেই ভয় লাগে সৌমাভর।

অনেকক্ষণ দুজনে চুপচাপ থাকার , তৃণা একদৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে খুব ধীরে ধীরে বলল,

-” তোমার কথা শেষ হয়েছে? সরি, আমি এভাবে আড়াল থেকে তোমার পার্সোনাল কথা শুনলাম বলে, কিন্তু যেখানে আমার পার্সোনাল ম্যাটার জড়িয়ে আছে, সেখানে বোধহয় এটুকু করা খুব বেশী অপরাধ নয়, তাই না??”

-” তুমি ব্যাপারটা ভুল বুঝছ তৃণা। আমি এক্সপ্লেইন করছি ওয়েট।”

-” তার আর কোনো দরকার নেই, যেটা শোনার ছিল আমি পরিস্কার ভাবে শুনেছি সেগুলো। আর এই চ্যাট গুলো? দেখো এগুলোর দিকে একবার। এত ব্যাপার তো আমি জানতামই না। তুমি বলেছিলে, মৌলিদি তোমাকে প্রপোজ করেছিল, এবং তারপর তুমি কয়েকদিন কথা বলে আর এগোওনি। কিন্তু এখানে এগুলো তো অন্য কথা বলছে। তোমরা বিয়ের কথা অবধি চলে গিয়েছিলে, আর বলছ কিছুই হয়নি??”

-” আমি জাস্ট একটা চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আস্তে আস্তে বুঝতে পারছিলাম, যে সম্ভব না আমার পক্ষে ঐ সম্পর্কটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তাই, এসব কথা হয়েছিল, তোমাকে তো এসব কথা আগেও বলেছি, তাই না? তাহলে আবার কেন, এই প্রসঙ্গ উঠছে?”

-” উঠছে, কারণ তুমি একটু আগে নিজের মুখে বললে, যে তুমি আমার কাছে না গিয়ে মৌলিদির কাছেই যাবে, এবং তুমি ওকে এখনো ভালোবাসো। আর আমি তোমাদের মাঝখানে কাঁটা হয়ে গিয়েছি তাই না?”

-” তৃণা জাস্ট শাট আপ। অনেকক্ষণ ধরে তোমার ফালতু বকবক শুনছি আমি, আর একটাও কথা বলবে না। তুমি বুঝতেই যখন চাওনা, তাহলে আমি তোমাকে বোঝাতেও পারব না। আমার পার্সোনাল লাইফ, ডিসিশনের একটা কিছুও আমি তোমাকে বলতে বাধ্য নই। ক্লিয়ার? বুঝেছ?”

-” কেন জানতে পারি?”

-” ইউ ডোন্ট ডিজার্ভ ইট। সেইজন্য। যাও এবার এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে, ভিতরে যাও, প্লিজ। আমার চোখের সামনে আর দাঁড়িও না।”

বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে গেল সৌমিভর। আর কোনো উপায় বোধহয় ছিলনা এই মুহূর্তে ওর কাছে, তৃণার সাথে এইরকম ব্যবহার করা ছাড়া। আর সহ্য করতে পারছিল না সৌমাভ, এতদিক থেকে আসা চাপগুলো। কোনো দোষ না করে, কাউকে নিজের অবস্থান টা বোঝানো যে কতটা, কষ্টের, বিশেষ করে সেই ভুল বোঝার মানুষটা যখন নিজের খুব কাছের কেউ হয়। এমনিতেই সৌমাভর অল্পতেই খুব ছোটো ছোটো কারণে রেগে যাওয়ার অভ্যেস, আর এই মুহূর্তে এত ঘটনার মধ্যে তো ও নিজের মেজাজ আর কিছুতেই ধরে রাখতে পারলনা।

যেভাবে চিৎকার করে সৌমাভ কথাটা বলল, তৃণা সত্যি এতটা খারাপ ব্যবহার আশা করেনি। আচমকা চিৎকার শুনে, ও রীতিমত চমকে উঠল। চোখের এতক্ষণ অল্প জমা হয়ে থাকা জলটা এবার নিঃশব্দে অঝোর ধারায় গড়িয়ে পড়ল দু’গাল বেয়ে। আজ সকাল থেকে যেটুকু আনন্দ-উত্তেজনা জমা ছিল মনে, তা এক নিমেষেই যেন টুকরো টুকরো হয়ে গেল। সারাক্ষণ হাসিখুশি থাকার জীবনের মাঝে হঠাৎ এত এত কষ্টের ভিড় ঠিকমত সহ্য করতে পারলনা তৃণা। সম্পর্ক শুরুর প্রথমদিন থেকে এই একটাই সমস্যা ওদের কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। অবশ্য তৃণা এখন এটাই বুঝতে পারছেনা, যে সমস্যাটা মৌলিদি, নাকি আসলে ও নিজেই। বিভিন্ন চিন্তা-ভাবনার জালে জর্জরিত হয়ে নিজেকে আর সামলে রাখতে পারল না তৃণা। চোখের সামনে, হঠাৎ করেই যেন প্রতিটা জিনিস কেমন চক্কর দিয়ে উঠল। সাদা ধোঁয়ার মত কয়েকটা স্তরে ঢাকা পড়ে গেল আশেপাশের সমস্ত জিনিস। মাটিতে পড়ে যাওয়ার আগেই সম্বল হিসেবে তৃণা পাশের ফ্রিজটাকে স্পর্শ করতে গেল, কিন্তু পারলনা। শরীরটা যেন হঠাৎ করেই ভীষণ হালকা হয়ে গেছে, চোখ পুরোপুরি বন্ধ করার আগে, অস্পষ্ট ভাবে তৃণা দেখল সামনে থেকে কেউ একজন তার হাতটা বাড়িয়ে দিচ্ছে ওর দিকে। ব্যস আর কিছু মনে নেই এরপর ওর। ধীরে ধীরে, সব চুপচাপ, ভীষণরকম নিস্তব্ধ হয়ে গেল চারপাশটা। মেঝেতে সজোরে পড়ে যাওয়ার আগেই, একটা বলিষ্ঠ হাত আঁকড়ে নিল ওকে, জ্ঞানহীন অবস্থাতেও যেন, সেই আশ্রয়ে নিজেকে বড়ো নিরাপদ মনে হল তৃণার……

**************

ভেতরের ঘরে অনেকক্ষণ ধরেই একা একা বসে রয়েছে সৌমিক আর পর্ণা। প্রথমে ওরা কিছুক্ষণ তো একে অপরের সাথে কোনো কথাই বলতে পারেনি। ধীরে ধীরে বিস্ময়ের ঘোর কাটার পর, এখন টুকটাক কথা শুরু করতে পেরেছে তাও। সৌমিকের একদিকে ভালোই হয়েছে, এই কথাটা কখনও না কখনো তো বাড়িতে জানাতেই হত, সেই কাজটা এবার না হয় দাদা-ই করে দেবে। এমনিতেই মায়ের কাছে দাদা বেশি আদরের, তার নিজের থেকেও বেশি। তাই কোনো সমস্যা হওয়ার নেই। আর সবথেকে বড়ো কথা, তৃণাকে অন্য কোনো মানুষের সাথে দেখলে যতটা কষ্ট পাবে ভেবেছিল সৌমিক,ততটা সত্যিই পায়নি সে। পর্ণা কথাগুলো খুব একটা ভুল বলেনি তাহলে। দাদার মতো একজন গম্ভীর মানুষের সাথে তৃণার মতো এরকম চঞ্চল, ছটফটে একটা মেয়ের সম্পর্ক যে শুরু হতে পারে এটা ভেবেই বারবার অবাক হয়ে যাচ্ছে সৌমিক। তবে,এটা ছাড়াও আরো একটা ব্যাপার ভীষণরকম ভাবাচ্ছে ওকে- সেদিন সেই দিদির জন্মদিনে, মানে তৃণাকে আর পর্ণাকে দেখার প্রথমদিনটার মনে পড়লেই এই ভাবনাটা মাথায় আসে সৌমিকের। প্রথম প্রথম সে নিজেকে ভাগ্যবান মনে এটা ভেবে যে, ভাগ্যিস সেদিন তৃণা এসেছিল ওখানে। সেইদিনে সত্যিই পর্ণাকে ভালোভাবে লক্ষ্যই করেনি ও। তৃণাকে বাইরে থেকে দেখেই ওকে পছন্দ করে ফেলেছিল সৌমিক, কিন্তু এখন মনে হয় ভাগ্যিস পর্ণা তৃণা বান্ধবী ছিল, তাই তো পরিচয়টা এভাবে হতে পারল। মানুষ একবার কারো রূপকে অগ্রাহ্য করে একেবারে সরাসরি তার ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়লে, তার কথার, কন্ঠস্বরের প্রেমে পড়লে সেই প্রেমকে নির্দ্বিধায় ভালোবাসা বলে অহংকার করা যায়, সেই প্রেমের বাঁধন ছিঁড়ে যাওয়া একটু কষ্টকরই বৈকি। আড়চোখে মানে বসে থাকা পর্ণার দিকে একবার তাকালো সৌমিক, ভীষণরকম একটা যেন মুগ্ধতা, সাধারণত্ব আছে মেয়েটার চোখের মধ্যে, যেটা বারবার আটকে দেয় ওর চোখের দৃষ্টি, ওর সমস্ত চাওয়া পাওয়া….. মূহুর্তের মধ্যে সৌমিকের মনে পড়ে গেল ওদের এই সম্পর্কটা শুরু হওয়ার কথাগুলো, কীভাবে এই কয়েকদিনের পরিচয়ের পথটা পেরিয়ে নিজের মনের কথাটা সৌমিক নিজে থেকেই বলেছে পর্ণাকে ……….

(কয়েক সপ্তাহ আগে)

তৃণার প্রতি সৌমিকের, অনুভূতিগুলো প্রায় তখন ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে। ও বেশ বুঝতে পারছিল, তৃণাকে ওর কেবলই পছন্দ ছিল এর থেকে আর বেশি কিছু নয়। কারণ সত্যি কখনো এমন কিছু সৌমিকের মনের মধ্যে আসেনি, যে তৃণাকে ছাড়া ওর একদমই চলবেনা। আর পর্ণা তো বলেই দিয়েছে যে, আর যাই হোক অপশন হিসেবে কাউকে পছন্দ করা যায়, কিন্তু ভালোবাসা যায় না, শেষদিন অবধি ভালোবেসে যাওয়া সম্ভব হয়না। কেন না জানি, ক্রমশ পর্ণার সাথে সৌমিকের কথা বলার সময়সীমাটা বেড়েই চলেছিল। কলেজেও সৌমিকের মেয়ে বন্ধু নেহাত কমই নেই, কিন্তু তবু পর্ণার মধ্যে আলাদা এমন কিছু ছিল যার জন্য বারবার কথা বললেও কোনো বিরক্তি বা ক্লান্তি আসে না মনে। তবে পর্ণা যে ওকে মনে মনে পছন্দ করে এই বড়ো সত্যি টা যেদিন বুঝতে পেরেছিল সৌমিক, সেদিন থেকেই যেন অন্য একটা চোখে দেখতে শুরু করেছিল ও পর্ণাকে। আর তারপর তো ধীরে ধীরে সেই অন্যরকম ভাবনাটা ভালোবাসার রূপ নিতে বেশি দেরী করেনি। ব্যাপারটা ঘটেছিল ভীষণ আচমকাই …..

প্রতিদিন বিকেলে একে অপরকে ফোন করাটা তখন একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে সৌমিক-পর্ণা দু’জনেরই। তো সেরকমই একদিন বিকেলে সৌমিক ফোন করে পর্ণাকে, ঘড়িতে তখন পাঁচটা বেজে দশ মিনিট। ঘুম চোখে একটা বিরক্তি সাথে না দেখেই ফোনটা রিসিভ করে পর্ণা। বিরক্তির কারণ ছিল অসময়ে ঘুম ভেঙে যাওয়া। অবশ্য ফোন রিসিভ করে সৌমিকের গলার আওয়াজটা কানে আসতেই ঘুমের ঘোরটা অনেকটাই কেটে গিয়েছিল পর্ণার। তাড়াতাড়ি করে ও উত্তরে বলল,

-” হুমম, বলো। সরি আসলে ঘুমোচ্ছিলাম, তাই একটু দেরী হল ফোন ধরতে’

-” আরেহ্, নো প্রবলেম, সরি তো আমার বলা উচিত তোমাকে, এভাবে ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম। পরে ফোন করব কি??”

-” না না, আমি উঠেই পড়তাম একটু পরে ।বলো, কী করছ??”

-” এই বসে আছি, তুমি তো শুয়েই আছো নিশ্চয়”

-” হুম, তা আমি কি ঘোড়া নাকি? যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমোবো?’

-” হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ! তুমিও না। যাক গে,বাদ দাও, হঠাৎ করেই আমার একটা কথা মনে হল আমার, আমরা এতদিন কথা বলছি, আমি আমার এত কথা তোমাকে বলে ফেললাম। অথচ তুমি কিছুই বলো না, এটা কেন?”

-” কারণ বলে কোনো লাভ নেই তাই”

-” কেন লাভ নেই, কাকে পছন্দ করো তুমি, সেটা তো বলো, আমি চিনে গেলে কি অনর্থ হয়ে যাবে নাকি?”

-” হুমম তা হবে খানিকটা”

-” ওকে, কাকে পছন্দ তার নামটা বলো, আজ বলতেই হবে, বলো”

-” সৌমিক, আর কিছু শুনতে চাও?”

ওদের কথোপকথনটা হঠাৎ করেই থেমে গেল। সৌমিক বুঝতে পারলনা,পর্ণা মজা করে কথাটা বলল নাকি, আসলেই বলল। কে না জানি, আচমকাই সৌমিকের মনে হল, মজা নয়…..সত্যি সত্যি মন থেকেই কথাটা বলতে পর্ণা। একটা মেয়ে এতদিন ধরে তাকে সমস্ত দিক থেকে সাপোর্ট করে এসেছে,ওর পাশে থেকেছে, সেটা কি এমনি এমনিই? শুধুই বন্ধুত্ব? নাকি আরো কিছু??

(ক্রমশ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here