মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং পর্ব ১

0
2347

সদ্য এসএসসি পাশ করা মেঘ অনেকটা উঠতি বয়সের আবেগে পড়েই শুভ্রকে ভালোবেসে ফেলে।কিন্তু এই ভালোবাসা যে একসময় তার গলার কাঁটা হয়ে যাবে সে ভাবতে পারেনি।আজ শুভ্রর সাথে দীর্ঘ তিন বছরের সম্পর্কের ইতি টানতে যাচ্ছে সে।অশ্রু তার চোখের সামনের পৃথিবীটাকে বারবার ঝাপসা ঘোলাটে করে দিচ্ছে। এমন সময় মেঘের ব্যাগে থাকা ফোনটা কেঁপে ওঠে।ফোনের স্ক্রিনে স্পষ্ট লেখা ”Cat eyes”
ধুসর বর্ণের চোখের জন্য মেঘ শুভ্রকে মজা করে ভালোবেসে “বিড়াল চোখা শুভ্র” বলে ডাকতো।কে জানতো আজ সব স্মৃতি হয়ে যাবে।রাত জেগে কথা বলা,দুষ্টুমিষ্টি ঝগড়া,মান-অভিমান শুভ্রের রাগ ভাঙানো আজ সবই অতীত হয়ে যাবে। মেঘ চোখের জল মুছে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

এরই মধ্যে শুভ্র আবার মেঘকে ফোন দেয়।কিন্তু মেঘ এইবারও শুভ্রের ফোন রিসিভ করে না।সে করবেও না আর শুভ্রের ফোন রিসিভ। শুভ্রের মায়াভরা কন্ঠ যদি মেঘকে দুর্বল করে দেয়!এই জন্যই সে শুভ্রের ফোন রিসিভ করবে না।

মেঘ পৌঁছে যায় সেই রাস্তায়।যেখান থেকে তাদের পথচলা শুরু।মেঘের বাবা-মা খুব কড়া ছিলো।প্রাইভেট বা স্কুল থেকে ফিরতে একটু দেরি হলেই তার জবাবদিহি করতে হতো মেঘকে।তাই প্রাইভেট শেষে যতটা পথ হেঁটে যাওয়া যায় ততটা পথেই মেঘ শুভ্রের সাথে আসতো।তাও মাসে একবার কি দুবার।শুভ্রের সাথে কাটানো সেই কিছু মুহুর্তও মেঘের কাছে ছিলো আকাশছোঁয়া।
গিয়ে দেখে শুভ্র সেই কৃষ্ণচূড়া গাছটার তলে দাঁড়িয়ে আসে।হ্যাঁ, সেই কৃষ্ণচূড়া গাছ যে গাছের ছায়ায় শুভ্র আর মেঘ প্রথম পাশাপাশি একসাথে দাঁড়ায়।মেঘকে দেখেই শুভ্র উঠে দাঁড়ায়।চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। একরাশ বিরক্তি নিয়ে শুভ্র মেঘকে বলে,,,

-কতবার ফোন দিয়েছি হিসাব আছে?ফোন রিসিভ করলে না কেন?

মেঘ শুভ্রের কথার জবাব দেয় না।শুভ্র আবার জিজ্ঞাসা করে,,,

-মেঘ!আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি তোমায়।

মেঘ এইবারও চুপ।শুভ্র এবার রেগেই যায়।কড়া গলায় বলে,,,

-ঢং করো ঢং?Listen Megh! আমি তোমায় এর আগেও বলেছি আমার সাথে একদম ঢং করতে আসবে না।
-আচ্ছা আসবো না।আর কখনো তোমার সাথে ঢং করতে আসবো না।

শীতল কন্ঠে বলে মেঘ।কেমন যেন তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে।যার কারণে আজ শুভ্রের কাছে আসা সে কারণটা বারবার মেঘের গলায় আটকে যাচ্ছে।চোখের পানি যেন বাধা মানতে চাইছে না।বারবার গলাটা ভারি হয়ে আসছে।দীর্ঘক্ষণ মেঘ চুপ করে থাকার কারণে শুভ্র মেঘের ওপর অনেকটা বিরক্ত হয়ে যায়।চোখে,মুখে,কন্ঠে তীব্র বিরক্তি নিয়ে বলে,,,

-আমার কাজ আছে মেঘ।যা বলার তাড়াতাড়ি বলো।

ইদানীং শুভ্র খুব বেশিই বিজি মেঘের কাছে।কখনো তার মেঘের জন্য সময় হয়ে উঠে না।আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।আজকের পর থেকে মেঘ আর কখনো শুভ্রের বিরক্তি বা সময় নষ্টের কারণ হবে না।মেঘ দীর্ঘশ্বাস ফেলে।সে কিভাবে শুরু করবে বুঝে উঠতে পারে না।দম বন্ধ হয়ে যায়।অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সে বলেই ফেলে শুভ্রকে কথাটা,,,

-শুভ্র আই থিং আমাদের রিলেশনটা আর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না।
-What do you mean Megh?
-আজ থেকে তোমার আমার পথ আলাদা।

মেঘের কথায় শুভ্র রেগে যায়।তাহলে কি ওর ধারণাই ঠিক?শুভ্র শুধুই মেঘের টাইম পাস ছিলো?শুভ্র রাগান্বিত কন্ঠে বলে,,,

-জানতাম আমি তোমার টাইমপাস মেঘ।সময় থাকতে বলে দিয়েছো ভালো হয়েছে।শান্তকে নিয়ে সুখে থাকো।

মেঘ আর কিছু বলে না।শুভ্রর কথাগুলো মেঘের হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করছে।কি জোরালোই না কথার আঘাত!মেঘ আর এক মুহুর্তও দাঁড়ায় না।চোখের জল মুছতে মুছতে চলে আসে সেখান থেকে।মানুষ কত সহজেই ভুল বুঝতে পারে না?শান্ত মেঘের শুধু খালাতো ভাই আর ক্লোজ ফ্রেন্ড।এর বাইরে মেঘ শান্তর মধ্যে কোনো আলাদা সম্পর্ক নেই।আর শুভ্র এই সামান্য সম্পর্কটাকেই নেগেটিভলি ভাবে কত দুর নিয়ে গেলো! চোখের জল মুছতে মুছতে মেঘ তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়।সময় বদলায়, মানুষ বদলায়।ভাবতেই অবাক লাগে এই মানুষটাই একসময় মেঘের প্রতি কত কেয়ারিং ছিলো।

একসময়,বিশেষ করে ছোটবেলায় ডিসেম্বর মাসটা খুব আনন্দের ছিলো।বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই শীতের লম্বা ছুটি পড়ে যাওয়া।পড়াশোনা নেই,শুধু ঘুরো আর মজা করো।কিন্তু এখন! বছরের শেষের দুটোমাসই খুব ভয়ে কাটে।কোনো রকমে এই অক্টোবর নভেম্বর মাস পার করতে পারলে বাঁচি।খেয়াল করলে দেখা যাবে এই মাসগুলোতেই অনেক সম্পর্কের বিচ্ছেদ হয়।হোক তা বন্ধুত্ব কিংবা প্রেম ভালোবাসার!সারাটা বছর যাদের সাথে আপনার খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো।নিয়মিত যোগাযোগ হতো।এই নভেম্বর,ডিসেম্বর মাসেই তাদের সাথে আপনার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে।যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাবে।ক্লিয়ার হয়ে যাবে ভালোবেসে দেওয়া নিকনেইমগুলো।আইডি গুলো ইনবক্সের তলানিতে কিংবা ব্লকলিস্টে অনাদরে পরে থাকবে।
উনিশের এই ডিসেম্বরেই শুরু হয়েছিলো শুভ্র মেঘের পথচলা।একুশের ডিসেম্বরেই আলাদা হয়ে গেলো তাদের পথ।

বাসায় গিয়ে মেঘ সোজা ওয়াশরুমে চলে যায়।লম্বা শাওয়ার নেয়।অসময়ে মেয়েকে এমন লম্বা শাওয়ার নিতে দেখে মিসেস মিতু অবাক না হয়ে পারেন না।যে মেয়েকে মেরে বেঁধেও গোসলে পাঠানো যেতো না সেই মেয়ে আজকে ঠান্ডার মধ্যে দেড়ঘন্টা ধরে গোসল করছে!

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে মেঘ দেখে মিসেস মিতু টেবিল গুছাচ্ছেন।টেবিলের ওপরই বড্ড অনাদরে পরে ছিলো মেঘের ডায়েরিটা।যার মধ্যে লিপিবদ্ধ করা মেঘের ভালো লাগা-খারাপ লাগা মুহুর্ত গুলো।মিসেস মিতু ডায়েরীটা খুলে পড়তে যাবেন, ঠিক সেই সময় মেঘ ডায়েরিটা চিলের মতো ছো মেরে মিসেস মিতুর হাত থেকে নিয়ে যায়।ঘটনার আকষ্মিকতায় মিসেস মিতুও ভুত দেখার মতো চমকে যান।
মাকে দেখে মেঘ কৃত্রিম হাসি দিয়ে বলে,,,

-আম্মু তুমি?
-ডায়েরীটা নিলি কেন?
-এ..এ..এমনি।

তোতলাতে তোতলাতে বলে মেঘ।মিসেস মিতু মেয়ের দিকে সন্দীহান দৃষ্টিতে তাকান,,,

-তোকে তো মেরে বেঁধেও গোসলে পাঠানো যায় না।কিন্তু আজ হঠাৎ এমন ওয়েদারে গোসল করলি যে?
-দেখো না কেমন বৃষ্টি হয়েছে?আসার সময় রাস্তার জমে থাকা বৃষ্টির পানি গায়ে ছিটে এসেছিলো।তাই গোসল করলাম।

মিসেস মিতু আর কিছু বলেন না।মা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই মেঘ ঠাস করে দরজা আটকে দেয়।দরজা আটকানোর শব্দ শুনে মিসেস মিতু পেছন ঘুরে তাকান।ইদানীং মেয়েটা বড়ই অদ্ভুত আচরণ করছে।কি হয়েছে মেয়েটার আল্লাহই জানেন।

অনেক কষ্টে মায়ের সামনে নিজের চোখের পানিকে আটকে রেখেছিলো।এখন সে প্রাণ ভরে কাঁদবে।


-এই মেঘ দরজা খোল।

শান্তর ডাকে ঘুম ভাঙে মেঘের।কাঁদতে কাঁদতে কখন যে চোখটা লেগে গেছে বুঝতেই পারেনি মেঘ।উঠে গিয়ে চোখ কোচলাতে কোচলাতে দরজা খোলে মেঘ।মেঘকে এই অবস্থায় দেখে শান্ত মেঘকে বলে,,

-ঘুমাচ্ছিলি?
-নাহ,ঘাস কাটছিলাম।

অনেকটা বিরক্তি নিয়েই বলে মেঘ।মেঘের মুখে অশ্রুর দাগ দেখে শান্তর মনে সন্দেহ জাগে।নাক লাল,আর চোখ ফোলা দেখে শান্ত নিশ্চিত হয়ে যায় যে মেঘ কান্না করেছে।

-তুই কান্না করেছিলি নাকি?
-কান্না করতে যাবো কেন?
-চোখ মুখ এইরকম?
-ঘুমিয়ে পড়েছিলাম না?তাই হয়তো ঘুমের জন্য চোখ মুখ অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে।তুই বস আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।

কিছুক্ষণ বাদে মেঘ ফ্রেশ হয়ে বের হয়।

-শুনলাম এই ঠান্ডায় অসময়ে গোসল করেছিস?জ্বর আসে যদি!
-আসলে আসুক তোর কি?

হাত খোঁপা করতে করতে বলে মেঘ।শান্ত খানিকটা বিষন্ন হয়।মেঘ কি শান্তর অনুভূতি গুলো বুঝতে পারে নাকি বুঝেও না বুঝার ভান করে খানিকক্ষণ বাদে শান্ত নিজেকে সামলে বলে,,,

-ফুচকা খাবি?
-মুড নেই রে।সাথে শরীরও টানছে না।
-তুই তো এমন মুড অফ করে থাকার মেয়ে নস।কি হয়েছে?

মেঘ শান্তর কথার জবাব দেয় না।শীতল কন্ঠে বলে,,

-ছাদে যাবি?
-যাওয়া যেতে পারে!পাশের বিল্ডিংয়ে কার যেন হলুদ হচ্ছে ছাদে।অনেক সুন্দরীরা আছে সেখানে।গিয়ে একটু তাদের নাচ দেখে আসা যেতে পারে।

মেঘ শান্তর কথার কোনো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন দেখে না।একসময় প্রচুর কথা বলতো মেঘ।কিন্তু এখন প্রয়োজনের বেশি কথা বলাটা মেঘের নিজের কাছেই বাড়াবাড়ি আর বিরক্ত লাগে।

চলবে,,,ইনশাআল্লাহ

#মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং
#লুৎফুন্নাহার_আজমীন(#কন্ঠ)
#পার্ট১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here