#মায়া
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-০৭:
শুভ্রা রোকেয়া হোসেনকে ফোন দিয়ে জানায় সে শিশির আর শেফাকে নিয়ে বাসায় আসবে। রোকেয়া হোসেন মেয়ে আসবে শুনে অনেক খুশি হলেন। তারপর শুভ্রা ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিলো।
এদিকে সীমান্তের দোকান থেকে ইমারজেন্সি কল আসায় সে বেরিয়ে পড়লো বাসা থেকে। যাওয়ার আগে জানিয়ে দিলো বিকেলে এসে তাদের নিয়ে যাবে।
দুপুরের রান্না-বান্না শেষ করার পর সামনের সোফায় এসে বসলো শুভ্রা৷
বৃদ্ধ চাচাটির গত রাতে খুন হয়েছিলো, এমনকি এই বাড়ির লোকেদেরও খুন করা হয়েছে। এই কথাগুলো যতোবার শুভ্রার মনে পড়ছে ততোবার খুব অদ্ভুত লাগছে তার। কি এমন শত্রুতা ছিলো এই বাড়ির লোকদের সাথে, যে একেবারে সবাইকে একসাথে খুন করে ফেলেছে? আর গতকাল রাতে চাচাটিকেও? চাচাটির কোনো শত্রু থাকতে পারে, এটি শুভ্রা বিশ্বাসই করতে পারছে না।
এই মুহূর্তে শুভ্রার ভয় পাওয়া উচিত। কিন্তু তার ভয়ের পরিবর্তে মায়া লাগছে যারা খুন হয়েছে তাদের জন্য। চাচাটির মুখ ভেসে আসছে বার বার। তার অনেক ইচ্ছে ছিলো চাচাটিকে এক বেলা খাওয়ানোর। কিন্তু দুপুরে সীমান্ত না থাকায় আর সুযোগ হয় নি। আর সারাদিন এই উদ্ভট বাড়িটির আতংকে থাকতে থাকতে শুভ্রা চাচাটির সাথে একটু ভালো করে কথাও বলতে পারে নি।
শিশির মায়ের কাছে এসে বলল,
শিশির: মা, তুমি না আমার জন্য কেক বানাবে বলেছিলে?
শিশিরের কথা শুনে শুভ্রার সেই ঘর আর সিন্দুকের কথা মনে পড়ে গেলো। সেই ঘরেই রেখে এসেছিলো কেক বানানোর প্যাকেটটি।
শুভ্রা: আচ্ছা, বাবা। নানুর বাসায় যাবো আজকে। সেখানেই বানাবো। মনে ছিলো না তো। তুমি যাও গোসল করে আসো। ভাত খাবে না? তোমার বাবা এসেই আমাদের নিয়ে যাবেন।
শিশির: আচ্ছা মা।
শুভ্রা মনে মনে ভাবছে,
শুভ্রা: সেই সিন্দুকে কিছু না কিছু আছে। এই বাড়িতে যারা থাকতো, তাদের সম্পর্কেও জানা যাবে।
শুভ্রা আর কিছু না ভেবে আবার সেই ঘরটিতে এলো। ঘরে ঢুকেই শুভ্রা অবাক। গতকাল সিন্দুকটি যেখানে রেখেছে সেখানে নেই।
গতকাল শিশিরের চিৎকার শুনে শুভ্রা সিন্দুকটি রেখেই দৌঁড় দিয়েছিলো। তাহলে এক রাতে সিন্দুকটির স্থান পরিবর্তন কিভাবে হলো? আর কে করলো এই স্থানান্তর?
সীমান্তের ঘুম একেবারে সকালেই ভেঙেছিলো। আর বাড়িতে যতোক্ষণ ছিলো, তার চোখের সামনেই ছিলো। আর সীমান্ত কখনো এ কাজ করবেও না। শিশির আর শেফা? না তাদের দ্বারাও সম্ভব না। আর শিশির এমনটি করলে অবশ্যই সিন্দুকটি নিয়ে কোনো না কোনো প্রশ্ন করতো। অন্যদিকে শেফার তো এতোটুকু শক্তি আর বুদ্ধি নেই যে সিন্দুকটি সরাতে পারবে বা সরাতে হবে তা মাথায় আসবে। তবে কি এই বাড়িতে তারা ছাড়াও অন্য কেউ থাকে?
শুভ্রা আবার খাটের নিচে ঝুঁকে দেখলো সিন্দুকটি নিচে আছে কিনা।
সিন্দুকটি খাটের নিচে ঠিক সেভাবেই আছে যেভাবে সে প্রথম দেখেছিলো। সে টেনে আবার বের করলো সিন্দুকটি। তারপর চাবি খোঁজার জন্য পাশের আলমারিটি খুলে দেখলো চাবিটি সেখানে আছে কিনা। কিন্তু শুভ্রা আরো অবাক হলো কারণ গতকাল যেখানে চাবিগুলো ছিলো ঠিক সেখানেই আছে কাগজে মোড়ানো অবস্থায়।
শুভ্রা ভাবছে,
তবে কি গতকাল সবকিছুই মিথ্যে ছিলো, নাকি আজকে যা দেখছে তা মিথ্যে?
শুভ্রা: না, গতকাল কিছুই মিথ্যে ছিলো না। যা হয়েছিলো সব সত্য। এই ভয়ংকর সত্যটা মেনে না নিলে আমার বাচ্চাদের ক্ষতি হবে, আমার আর সীমান্তের ক্ষতি হবে। যা আমি কখনো মেনে নেবো না।
শুভ্রা সিন্দুকটি আবার খুললো। কাঠের এলবামটি আগের স্থানেই আছে। সেটি হাতে নিয়ে আবার পরের পাতা উল্টিয়ে দেখলো একটি ফ্যামিলি ফটো।
শুভ্রা: অনেকগুলো মানুষ ছিলো এই বাড়িতে! এতোগুলো সদস্যের মধ্যে কি একজনও বেঁচে নেই?
শুভ্রা পরের ছবিটি দেখলো একজন বৃদ্ধ লোক আর বৃদ্ধ মহিলা। তার পাশে একটি মেয়ে। পরের পাতায় সেই মেয়েটির সাথে দুইজন পুরুষ। ছবিটি দেখে বোঝা যাচ্ছে তারা ভাই-বোন হবে। কারণ তাদের চেহারা অনেকটা একই। ধীরে ধীরে সব ছবিই দেখছে।
হঠাৎ একটি ছবি দেখে শুভ্রা অবাক হলো। ছবিটি নষ্ট করা হয়েছে। ছবিটি দেখেই বুঝা যাচ্ছে ছবিটি ইচ্ছে করেই নষ্ট করা হয়েছে। কিন্তু কেন?
ছবিটি এলবাম থেকে বের করে ভালোভাবে দেখলো। যার ছবি নষ্ট করা হয়েছে সে নিশ্চয়ই একটি মেয়ে। মুখের দিকটা নষ্ট করলেও ছবির নিচের অংশে জামা দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটি কোনো মেয়েরই ছবি।
পরের পাতায় আরো অনেক ছবি নষ্ট করা হয়েছে। কিন্তু ভাবনার বিষয় হচ্ছে, শুধু একজনের ছবিই নষ্ট করা হয়েছে। বাকীদের ছবি এখনো অক্ষত আছে।
এই এলবামের ছবিগুলো দেখে শুভ্রা বুঝতে পারছে এই বাড়িতে মোট পনেরো জন সদস্য ছিলো। হয়তো এর বাইরেও থাকতে পারে। কিন্তু এই পনেরো জন্যের মধ্যে শুধু একটি মেয়ের ছবিই নষ্ট করা হয়েছে।
শুভ্রার মন বার বার একটি প্রশ্নই করছে।
শুভ্রা: কিন্তু কেন? শুধু এই মেয়েটির ছবি নষ্ট করার কারণ কি?
এলবামটি পাশে রেখে শুভ্রা সিন্দুকটি ভালোভাবে দেখলো। একটি বিশাল বড়ো ম্যাপ খুঁজে পায় সে। শুভ্রা ম্যাপটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। দেখতে এই বাড়ির নকশা মনে হচ্ছে।
কি মনে করে শুভ্রা মোবাইল বের করে একটি ছবি তুলে নিলো। সিন্দুকটিতে অলংকারের অনেক বক্স আছে৷ সাথে আরেকটি জিনিস দেখে সে অবাক হয়েছে, সেটি হলো লাল রঙের বেনারসি শাড়ি। শাড়িটি এতো চমৎকার যে, শুভ্রার খুব লোভ হচ্ছিলো শাড়িটি নেওয়ার। কিন্তু তবুও সে নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করলো।
অলংকারের বক্সে সে খুব সুন্দর কাজ করা গহনা দেখতে পেলো, যার মধ্যে খুব সুন্দর তিনটি চেইনও আছে। চেইনগুলো সব একই ডিজাইনের। চেইন আর তার সাথে থাকা লকেটটি শুভ্রার কাছে খুব পরিচিত মনে হচ্ছে।
শুভ্রা ভাবছে,
কোথাও তো দেখেছি এই লকেটটি। নয়তো এতো পরিচিত মনে হওয়ার তো কথা না।
শুভ্রা: হয়তো আমি একটু বেশিই ভাবছি এসব নিয়ে।
শুভ্রা সিন্দুকটি তালা বন্ধ করে আবার আগের জায়গায় রেখে দিলো। সাথে চাবিগুলোও আলমারিতে উঠিয়ে রাখলো।
বিকেলে সীমান্ত বাসায় ফিরলে তারা রেডি হয়ে নেয় যাওয়ার জন্য। সন্ধ্যার মধ্যে তারা রোকেয়া হোসেনের বাসায় পৌঁছে যায়।
সীমান্ত শুভ্রাকে গেইটের সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে যেতে নিলে শুভ্রা বলল,
শুভ্রা: ওই বাড়িতে যেও না একা একা। তুমি না হয় এখানে চলে এসো।
সীমান্ত: এতোগুলো মানুষ এখানে থাকা সম্ভব না শুভ্রা।
শুভ্রা: তুমি কি রাতে দোকানে থাকবে?
সীমান্ত: আজ তো নাইট ডিউটি পড়েছে। আজ রাতে দোকানেই থাকবো।
শুভ্রা: সীমান্ত, ওই বাড়িতে যেও না আর। রাতে কাজ শেষ হয়ে গেলে এখানে চলে এসো। মেঝেতে ঘুমাবো, কিন্তু ওই বাড়িতে না।
সীমান্ত: তুমি কি ভয় পাচ্ছো?
শুভ্রা: যদি ভয় মনে করো, তবে ভয়ই। তবুও যাবে না তুমি ওখানে।
সীমান্ত: আচ্ছা। রাতে কাজ শেষ হলে তোমাকে ফোন দেবো। আর চিন্তা করো না। আমি নতুন বাসা খুঁজবো কাল থেকে। আজও কয়েকটা দেখেছি।
শুভ্রা: টিনের ঘর হলেও চলবে আমার। তুমি শুধু এমন বাসা দেখো যেখানে আশেপাশে যথেষ্ট মানুষ আছে।
সীমান্ত চলে গেলে শুভ্রা তাকিয়ে থাকে তার যাওয়ার পানে।
আকাশ পানে তাকিয়ে শুভ্রা বলল,
শুভ্রা: আমি কখনো কারো ক্ষতি করি নি। আমার ছোট্ট পরিবারটিও রক্ষা করো মালিক।
কলিংবেলের শব্দ পেয়ে দরজা খুলে মেয়ে আর নাতি-নাতনীদের দেখে রোকেয়া হোসেন এক গাল হাসলেন।
রোকেয়া: আমার শিশু, শেফু কেমন আছে?
তারা দুজনেই নানুকে সালাম দিয়ে বলল, ভালো আছি।
রোকেয়া শেফাকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। শুভ্রাও শিশিরের সাথে সাথে ঘরে ঢুকলো। তারা কথা বলতে বলতে এতোটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো যে তাদের চোখেই পড়ে নি, শুভ্রার ঠিক পেছন পেছন একটি ছায়াও প্রবেশ করেছে বাসায়। যেই ছায়াটি অনেকটা মহিলা আকৃতির। সাদা ধোঁয়ার মতো ছায়াটি উড়ছে ঘরে ঘরে। কিন্তু কারো চোখেই পড়ছে না। কিন্তু এতোটা দৃষ্টিগোচর হওয়ার মতোও ছিলো না। হয়তো তাদের চোখেই ধুলো পড়ে আছে, তাই দেখতে পায় নি।
চলবে–
#মায়া
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-০৮:
-নদী, এই নদী ধর কেউ ওকে….আরে পালিয়ে যাচ্ছে যে….. নদী……
-এতোরাগ কেন তোর? বাড়ি ফিরে আয়….. বড্ড খালি খালি লাগছে বাড়িটি….
-নদীপ্পি তুমি কেন চলে গেছো? ভালো লাগছে না আর। নদীপ্পি…..আমায় এখন কে গল্প শুনাবে?
-নন্দিতা ফিরে আয়……
শুভ্রার ঘুমটা আচমকা ভেঙে গেলো। ভয়ে তার আত্মা শুকিয়ে গেছে। চোখ খুলে নিজেকে আবিষ্কার করলো এক অন্ধকার ঘরে।
শুভ্রা মনে মনে ভাবছে,
আমি তো মায়ের বাসায় এসেছি। এইটা মায়ের বাসা মনে হচ্ছে না কেন?
হঠাৎ অন্ধকার ঘরটি আলোকিত হয়ে পড়লো। নিজেকে সেই রহস্যময় বাড়িতে আবিষ্কার করলো শুভ্রা।
শুভ্রা ভয়ে চিৎকার করে উঠলো,
শুভ্রা: মা, মা…সীমান্ত….আমার খুব ভয় লাগছে। আমি এখানে কিভাবে এলাম?
-হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থডে, হ্যাপি বার্থডে, হ্যাপি বার্থডে নদী…..
করতালির শব্দে কানটা ঝাঁঝরা হয়ে গেলো শুভ্রার। তার খুব কাছেই কিছু মানুষের সম্মিলিত কন্ঠ, অথচ সে কাউকে দেখছে না।
-নদীপ্পি, ন…..ন্দি……তা….. নদী এই দিকে তাকা একটা ছবি তুলবো……স্মাইল…..
রোকেয়া: শুভ্রা….এই শুভ্রা….এমন করছিস কেন মা? শুভ্রা…
শুভ্রা আচমকা চোখ খুলে তাকালো রোকেয়া হোসেনের দিকে। ঘামে তার পুরো শরীর ভিজে গেছে। বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো সে। চোখ দুটি ছলছল করছে তার। মনে হচ্ছে খুব কাছের মানুষদের দূরে ফেলে এসেছে।
রোকেয়া শুভ্রার পাশে বসে বলল,
রোকেয়া: খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস?
শুভ্রা নিচু স্বরে বলল,
শুভ্রা: হুম।
রোকেয়া: আচ্ছা, কিছু না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লি যে? আমি তোর জন্য ভাত-তরকারী আনছি ডায়নিংয়ে। হাত মুখ ধুয়ে খেতে আয়।
শুভ্রা: আচ্ছা আসছি।
এরপর ফ্রেশ হয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে সীমান্তকে ফোন দেয় শুভ্রা।
সীমান্ত: ঘুমাওনি?
শুভ্রা: ঘুম থেকে উঠেছি, এখনো কিছু খায় নি। খেয়ে আবার ঘুমাবো। তুমি কোথায়? খেয়েছো?
সীমান্ত: হ্যাঁ, খেয়েছি। আর এখন শুয়ে আছি।
শুভ্রা: কোথায়?
সীমান্ত: ছোটুর পাশে।
শুভ্রা: ছোটু? কোন ছোটু?
সীমান্ত: ওই চাচা ছিলেন না, যিনি আমাদের বাড়ি খুঁজে দিয়েছিলেন? উনার ভাতিজা ছোটু।
শুভ্রা: যার খুন হয়েছে তার কথা বলছো?
সীমান্ত: হ্যাঁ।
শুভ্রা চেঁচিয়ে বলল,
শুভ্রা: তোমাকে মানা করার পরও কেন গিয়েছো আবার ওই বাড়িতে?
সীমান্ত: শুভ্রা ছোটু দোকানে এসেছে৷ আমি যাই নি। তুমি মানা করেছো তাই আর যাই নি।
শুভ্রা: ও কেন এসেছে?
সীমান্ত: তোমার সাথে দেখা করতে এসেছে। তোমার সাথে কথা আছে নাকি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর এতো রাতে তোমার কাছে কিভাবে নিয়ে যাবো? রাত সাড়ে নয়টা বেজে গিয়েছিলো তখন। আর আমি ডিউটিতেও ছিলাম সেই সময়, তাই আর নিয়ে আসতে পারি নি। আর বাসায় নাকি সে একা। কাল রাতেই তো তার চাচা মারা গিয়েছিলো। সে নাকি সেখানে ফিরে যাবে না আর।
শুভ্রা: কি করছে ও?
সীমান্ত: ঘুম।
শুভ্রা: আচ্ছা সকালে দেখা হবে। ঘুমাও এখন।
শুভ্রা ফোন রেখে ডায়নিংয়ে আসলো।
রোকেয়া হোসেন বলল,
রোকেয়া: হ্যাপি বার্থডে শুভ্রা।
শুভ্রা অবাক হয়ে বলল,
শুভ্রা: আমার মনেই ছিলো না।
হঠাৎ শুভ্রার মনে পড়লো স্বপ্নটির কথা। সেই বাড়িটিতে নদী নামের একটি মেয়ের জন্মদিনে সবাই শুভেচ্ছা দিচ্ছিলো। কে এই নদী? নামটি আগে কোথায় শুনেছে সে?
খাওয়া-দাওয়ার পর বারান্দায় বসে ছিলো শুভ্রা৷ তার মনে হলো কেউ দাঁড়িয়ে আছে পেছনে। শুভ্রা ভাবলো হয়তো রোকেয়া হোসেন।
তাই পেছনে না ফিরেই বলল,
শুভ্রা: মা, চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দেবে?
একটি হাত এগিয়ে গেলো শুভ্রার মাথায়। পরম যত্নে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। আর শুভ্রাও বকবক করছে। শুভ্রার কথার বিষয়বস্তু এখন সেই রহস্যময় বাড়িটি।
হঠাৎ রোকেয়া হোসেন শুভ্রাকে ডাকলেন দূর থেকে।
রোকেয়া: সীমান্ত কি সকালে আসবে না?
শুভ্রার চোখ দুটি বিস্ফোরিত হয়ে গেলো। গলা শুকিয়ে গেছে মুহূর্তেই। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে৷ যদি মায়ের গলা এতো দূর থেকে আসে, তবে পেছনে কে? খালাম্মা? কিন্তু খালাম্মা তো রাতের আটটায় ঘুমিয়ে পড়ে৷ আর এতো রাতে তিনি সাড়া শব্দ ছাড়া শুভ্রার পেছনে এসেই বা কেন দাঁড়াবেন?
পেছনে না ফিরেই চোখ বন্ধ করলো শুভ্রা। মনে হলো কেউ তার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসেছে। খুব শীতল হাওয়া কানের আশপাশ ছুঁয়ে দিচ্ছে।
একটি ভারী মহিলার কন্ঠ কানে এলো।
-চুলগুলো তো বেশ লম্বা হয়েছে।
কন্ঠটা অপরিচিত ছিলো না। খুবই পরিচিত। কিন্তু কোথায় শুনেছে মনে করতে পারছে না।
রোকেয়া হোসেন শুভ্রার জবাব না পেয়ে ঘরে এসে লাইট জ্বালিয়ে শুভ্রার পেছনে দাঁড়ালেন৷
রোকেয়া: কিরে শুভ্রা। তুই আজ এমন অদ্ভুত ব্যবহার করছিস কেন?
রোকেয়ার উপস্থিতি পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো শুভ্রা।
শুভ্রা: ভালো লাগছে না মা। মনে হচ্ছে কিছু একটা হারিয়ে ফেলেছি। খুব শূন্য শূন্য লাগছে।
রোকেয়া: ঘুমিয়ে পড়।
শুভ্রা: আজ আমার সাথে থাকবে?
রোকেয়া: আচ্ছা।
শুভ্রা রোকেয়ার পাশে শুয়ে পড়লো। ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলেও যেন অনুভব করছে একটি শীতল হাত তার মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে আর একটি ছন্দ দেওয়া গান গাইছে,
ঘুমের দেশের ঘুম পরীরা,
মোদের দেশে আয়।
নদীর বুকে দিয়ে যারে
ভালোবাসার নায়।
.
ঘুমটি এলে চুপটি করে
থাকবে আমার খুকী,
তারার দেশে তারা হলে
আমার হবে ছুটি।
.
ঘুম পরীরা, রাত পরীরা
একলা আমার নদী,
দূরের দেশে আছি মোরা,
নেই তো কোনো যদি।
হাতটি সরে গেলো শুভ্রার মাথার কাছ থেকে। শুভ্রা অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো,
শুভ্রা: মা…….
একটি ধোঁয়া বিলীন হয়ে গেলো ঘর থেকে। আর শুভ্রার ঘুমন্ত চোখ বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।
চলবে—