মায়া,পর্ব:৬

0
1992

#মায়া
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-০৬:

সীমান্ত আর শেফা বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। গত রাতের ক্লান্তি আজ রাতের বিশ্রামে হয়তো দূর হবে। সীমান্তের ঘুম ভাঙবে না হয়তো আজ। শেফা বাবাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে ঘুমের মাঝে সে সুন্দর কোনো স্বপ্ন দেখছে। সেই সুন্দর স্বপ্ন তাকে প্রশান্তির কোনো রাজ্যে নিয়ে গেছে।

আর এদিকে শিশির এখনো টিভি দেখছে। খুব অস্থিরতা প্রকাশ পাচ্ছে তার চোখে মুখে। তবু্ও এক জায়গায় বসে আছে স্থির হয়ে। যেন কেউ তাকে আটকে ধরেছে শক্ত ভাবে।

শুভ্রা সিন্দুকটির দিকে তাকিয়ে আছে এখনো। অনেক ধরণের জিনিস দিয়ে পূর্ণ এই সিন্দুকটি। সবার উপরে একটি কাঠের কারুকাজ করা এলবাম আছে। শুভ্রা সেটি হাতে নিলো।
প্রথম পাতায় লাল আলতা দেওয়া ছোট ছোট হাত আর পায়ের ছাপের ছবি। ছাপগুলোর নিচে নামও লেখা আছে। শুভ্রা আন্দাজ করছে এই বাড়ির বাচ্চাদের পা আর হাতের ছাপ হবে হয়তো।
প্রথম ছাপটির নিচে লেখা আছে রাদিক শাহরিয়ার রুদি। পরেরটিতে লেখা আছে উদিত সুফিয়ান উজি।
শুভ্রা বুঝতে পেরেছে এই ছেলে দুটি হয়তো এই বাড়ির বংশধর। তাই হয়তো তাদের নাম দুটি উপরে। বাকী ছাপ গুলোর নিচে লেখা নামগুলো পড়লো শুভ্রা। রীতিকা শাহরিয়ার রীত, তৈত্রীকা সুফিয়ান তিথী, নন্দিতা শাহরিয়ার নদী। শেষ নামটি পড়ে শুভ্রা শুধু অবাক হয় নি, অজানা ভয়ও তার মনের মধ্যে ভীড় করলো। নামটি ছিলো গীতিকা শাহরিয়ার গীত। গীত নামটি সে শেফার খাতায় দেখেছিলো। তাহলে এই গীত নামটি শেফার খাতায় কিভাবে এলো?

সবকিছুই মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে শুভ্রার। অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে এই বাড়িতে। শুভ্রার মনে এই বাড়িটি সম্পর্কে জানার প্রবল ইচ্ছে জন্ম নেয়। পরের পাতা উল্টানোর সাথে সাথেই শিশিরের চিৎকার শুনে থেমে যায় শুভ্রা। এলবামটি বিছানায় ফেলেই একপ্রকার দৌঁড় দেয় দরজার কাছে।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো যেই দরজাটি কিছুক্ষণ আগেও খোলা যাচ্ছিলো না, সেটি এখন ঠিক সেভাবেই আছে, যেভাবে সে শুরুতে চেপে রেখেছিলো।

শুভ্রা বেশি কিছু না ভেবে শিশিরের কাছে যায় দৌঁড়ে। শিশির হাত-পা ছোড়াছুড়ি করছে সোফায় বসে।

শুভ্রা ছেলের হাত ধরে বলল,
শুভ্রা: শিশির কি হয়েছে তোমার? এমন করছো কেন? শিশির?

শিশির হঠাৎ শুভ্রাকে খুব জোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। শুভ্রা গিয়ে মেঝেতে ছিটকে পড়লো।

শুভ্রা খুব ভয় পেয়ে যায়। শিশির দৌঁড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো। শুভ্রা শিশিরের পেছন পেছন গেলো।
শিশির গতকাল রাতের মতো করছে। তবে কি গতকাল রাতে যা হয়েছিলো তা সত্য ছিলো? শুভ্রা ব্যাপারটি আর উপেক্ষা করলো না। এবার শুভ্রা শিশিরকে গতরাতের মতোই জড়িয়ে ধরে আবার বিভিন্ন সূরা পড়তে লাগলো। অনেক ধস্তাধস্তি করার পর শিশির শান্ত হয়ে গেলো। এরই মধ্যে চন্দ্রগ্রহণ শেষ হয়ে যায়।

হঠাৎ শীতল বাতাস এসে ছুঁয়ে দিলো শুভ্রাকে। এই শীতল বাতাসের মাঝে শুভ্রা অনুভব করলো এক অদৃশ্য মায়া।

খুব ঘুম পাচ্ছিলো শুভ্রার। তবুও শিশিরকে কোলে নিয়ে নিজেকে জোরপূর্বক টেনে তাদের ঘরটিতে এলো। শিশিরকে বিছানায় শুয়ে দেওয়ার পর শুভ্রার শরীরের সব শক্তি হারিয়ে যায়। নিজের ভার বহন করতেও তার কষ্ট হচ্ছিলো। বিছানায় ঢলে পড়লো শুভ্রা।

কলিংবেলের শব্দে ঘুম ভাঙল সীমান্ত আর শুভ্রার। সীমান্ত বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো। শুভ্রাও শেফা আর শিশিরের দিকে একবার তাকিয়ে সীমান্তের চোখের দিকে তাকালো।

শুভ্রার মনে চলছে গতকাল রাতের ঘটনা।

সীমান্ত আড়মোড়া ভেঙে বলল,
সীমান্ত: আমি এতো লম্বা ঘুমিয়েছিলাম? দেখো সকাল দশটা বাজছে। আমাকে রাতে জাগিয়ে দাও নি কেন?

শুভ্রা সীমান্তকে কিছু বলতে চাইলোনা। তবে মনে মনে ঠিক করে ফেললো আর একটা রাত এই বাড়িতে কাটানো সম্ভব না শিশিরকে নিয়ে। শিশিরের ব্যবহার খুব উদ্ভট লাগছে তার। সে চায় না তার সন্তানদের কোনো ক্ষতি হোক।

সীমান্ত: কোথায় ডুবে গেলে?

শুভ্রা সীমান্তের কাছে এসে বলল,
শুভ্রা: তোমাকে জাগিয়ে দিতে চাই নি।

আবার বেল বেজে উঠায় সীমান্ত বলল,
সীমান্ত: এখন কে আসতে পারে?

শুভ্রা: হয়তো দারোয়ান চাচাটি এসেছে।

সীমান্ত: আচ্ছা, আমি দেখছি।

শুভ্রা শিশির আর শেফাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিয়ে তাদের তৈরি করিয়ে দিলো। তারপর নিজেও ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে দেখলো দুজন পুলিশ অফিসার সীমান্তের সাথে কথা বলছে।

শুভ্রা সীমান্তের পাশে এসে দাঁড়ালো। সীমান্তের চোখে মুখে ভয়ের ছাপ।

শুভ্রা: কি হয়েছে সীমান্ত?

দুজন অফিসারের মধ্যে একজন শুভ্রার দিকে তাকিয়ে বলল,
পুলিশ অফিসার: মিসেস সীমান্ত আপনি?

শুভ্রা: জি।

পুলিশ অফিসার: আমরা আপনাদের সাথে গতকাল রাতে যে খুন হয়েছিলো সেই বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে এসেছি।

শুভ্রা: খুন?

সীমান্ত শুভ্রার হাত ধরে বলল,
সীমান্ত: যে চাচাটি আমাদের এই বাড়ির খোঁজ দিয়েছিলেন তার গতরাতে খুন হয়েছে।

শুভ্রা সোফায় বসে পড়লো কথাটি শুনে।

পুলিশ অফিসার: সো মিস্টার সীমান্ত। এই বাড়িটির মালিকের কোনো খোঁজখবর নেই। আর আপনারা বিপদে পড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

সীমান্ত: জি।

পুলিশ অফিসার: আপনি কি জানেন এই বাড়ির সদস্যদের খুন করা হয়েছিলো?

সীমান্ত: জি। আমাকে চাচাটি বলেছিলো।

পুলিশ অফিসার: হুম। ঠিক কতো বছর আগে যেন?

পুলিশ অফিসারটি দ্বিতীয় অফিসারটিকে জিজ্ঞেস করলো।
সে বলল, এই দশ-পনেরো বছর আগে পিছে হয়তো।

শুভ্রা কথাটি শুনে ভয় পেয়ে যায়। তার মনের মধ্যে হাজারটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে এখন। সীমান্ত জানতো এই বাসায় এতো বড়ো দুর্ঘটনা ঘটেছিলো তবুও কেন উঠেছে এই বাড়িতে? এই পুরো শহরে আর বাসা পায় নি সে? সীমান্তের উপর এখন খুব রাগ হচ্ছে তার।

পুলিশ অফিসারটি গম্ভীর ভাবে সীমান্তের দিকে তাকিয়ে বলল,
পুলিশ অফিসার: সবকিছু জেনে শুনে ঝামেলায় জড়ানোর কি দরকার ছিলো?

সীমান্ত: স্যার, চাকরী চলে যাওয়ায় আমার কাছে কোনো অবস্থায় বাসা ভাড়া নেওয়া সম্ভব ছিল না। আর আমার হাতে বিন্দুমাত্র সামর্থ্যও ছিলো না। আমার কোনো আত্মীয়ও নেই, যার বাসায় আশ্র‍য় নেওয়া যাবে। তাই চাচাটি বলল আর আমিও না করতে পারি নি।

পুলিশ অফিসার: এই বাড়ি সম্পর্কে পাড়ার লোকে অনেক কথা বলল। যদিও আমরা এসবে বিশ্বাস করছি না। আর এখন আপনারা এই বাড়িতে থেকে পাড়ার লোকদেরও ভুল প্রমাণ করে দিলেন।

শুভ্রা: নতুন বাসা না পাওয়া অবধি শুধু…. তারপর আমরা এই বাসা ছেড়ে দেবো।

পুলিশ অফিসার: হ্যাঁ, তাতেই ভালো।

দ্বিতীয় অফিসারটি বলল, আমরা এই বাড়ি নিয়ে ঘাটাঘাটি করবো না। আর আমাদের মানাও করা হয়েছে। দশ-পনেরো বছর আগে এই বাড়িতে যে খুন হয়েছিলো, সেই আসামীদেরও এখনো খুঁজে পাওয়া যায় নি। এমনকি আমাদের সিনিয়র যারা এই কেইসে কাজ করেছিলেন তাদের সবাই নিখোঁজ হয়ে যায়। তাদের সন্ধানও এখনো পাওয়া যায় নি।

শুভ্রা: মানে? আপনারা এই বিষয়ে কাজ করা বন্ধ করে কেন দিয়েছেন? আপনাদের তো উচিত ছিলো আরো খুঁটিয়ে দেখা।

সীমান্ত শুভ্রার হাত ধরে তাকে ইশারায় চুপ থাকতে বলল।

পুলিশ অফিসার: মিসেস সীমান্ত, আমাদের কাজ শেখাতে হবে না। উচিত অনুচিত আমাদের জানা আছে। আর নিহতদের পক্ষের কেউ ছিলো না মামলায় বাদী হওয়ার। আর দশ-পনেরো বছর আগের কথা আমরা এখন কেন বলছি? আমরা আপনাদের ভালোর জন্য বলছি, এই বাড়ি ছেড়ে দেওয়ায় ভালো।

সীমান্ত: জি, স্যার। আমরা এই বাড়ি ছেড়ে দেবো এই মাসেই।

পুলিশ অফিসার দুটি চলে যাওয়ার পর শুভ্রা সীমান্তের উপর রেগে গিয়ে বলল,
শুভ্রা: এতো বড়ো সত্য আমাকে বলো নি কেন? এই বাড়ির ইতিহাস ভালো ছিলো না সীমান্ত। তাহলে আমরা কেন এসেছি এখানে?

সীমান্ত: আমি কোথায় যাবো তোমাদের নিয়ে বলো? আমি কি ইচ্ছে করে করেছি?

শুভ্রা: এই পুরো শহরে তুমি একটা বাসা খুঁজে পাও নি?

সীমান্ত: পেয়েছিলাম। কিন্তু ওগুলো থাকার উপযোগী ছিলো না। তোমরা এডজাস্ট করতে পারতে না।

শুভ্রা: এখনো পারছি না সীমান্ত।

সীমান্ত: এখনো পারছি না মানে?

শুভ্রা: তুমি তাড়াতাড়ি বাসা দেখো। আজ রাতের মধ্যেই আমরা এই বাড়ি ছাড়ছি।

সীমান্ত: একটু সময় দেওয়া যায় না? এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে পাবো?

শুভ্রা: আচ্ছা। আমি শিশির আর শেফাকে নিয়ে মায়ের বাসায় যাচ্ছি তাহলে।

সীমান্ত চুপ করে রইলো। তার মুখটি একেবারে চুপসে গেছে।
শুভ্রা সীমান্তের অসহায় মুখটির দিকে তাকিয়ে আছে।

শুভ্রা ভাবছে,
মানুষটির তো কোনো অপরাধ নেই। বরং তার উপর সংসার চালানোর চাপ। তার মাথায় রাত দিন বউ বাচ্চাদের এক বেলা খাওয়ানোর চিন্তা।

অভাবীদের তো তাও কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু হঠাৎ অভাবী হওয়া মানুষগুলোর জন্য অভাব বড়োই যন্ত্রণাদায়ক। কারণ এটি সুখের মাঝে আসা একটি বিষধর সাপ। যেই সাপের ছোবলে ভালোবাসারও মৃত্যু হয়ে যায় মাঝে মাঝে।

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here