মম_চিত্তে পর্ব ১১

0
324

#মম_চিত্তে
#পর্ব_১১
#সাহেদা_আক্তার

মম নিনিকে নিয়ে রায়হান সাহেবের রুম থেকে বেরিয়ে এসে মাথা ঝুলিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। নিনিটা চুপ করে ওর ঘাড়ের কাছে মুখ গুঁজে দিল। মন খারাপেও হেসে ফেলে বলল, নিনি, সুড়সুড়ি লাগছে। তারপর কাছে নিয়ে একটা আদর দিয়ে বলল, এবার যদি বিয়ে হয় তাহলে তোকে নিয়ে যাবো। কিন্তু …… বিয়েটা করছে কে? আমি করবো না। এমনিতেই করব না। তার উপর ঐ খচ্চরটা আছে বাড়িটাতে। তাই না বল নিনি? ঐ খচ্চরটা থাকলে তুই রাজি হতি? নিনি ম্যাঁও করল একবার। মম নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তুই একমাত্র আমার দুঃখ বুঝিস নিনি। আর কেউ বুঝে না। ও নিনিকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজল।

বৃষ্টির ডাকে ঘুম ভাঙল। তাকিয়ে দেখল রুমে আলো জ্বলছে। বাইরে অন্ধকার হয়ে গেছে। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে বুঝতে পারল না। নিনিটাও নেই পাশে। বৃষ্টি বলল, ওঠ নাস্তা করবি। দুপুরেও তো কিছু খাসনি। খাওয়ার কথা বলতে ওর পেট কো কো শব্দ করে উঠল। ও উঠে ওয়াশরুম চলে গেল ফ্রেশ হতে। বর্ষা টেবিলে নাস্তা আনছে। মাধুরী খালা পাকোড়া ভাজি করছে। রান্নাঘর থেকে তেলের আওয়াজ আসছে। ও বসার রুমে আসতেই নিনিকে দেখতে পেল। কি নিয়ে যেন খেলা করছে। গিয়ে দেখল একটা বল নিয়ে খেলছে। ওর সাথে খেলতে যাচ্ছিল। বৃষ্টি ওকে টেনে টেবিলে বসিয়ে বলল, আগে খেয়ে নে। ও বসে বলল, আব্বু কোথায়? মাধুরী খালা রান্নাঘর থেকে এসে বললেন, খালু তো রুমে শুয়ে আছেন। তুমি খাইয়া নাও মা। মম চুপচাপ খেয়ে উঠে গেল। রায়হান সাহেবের রুমে গিয়ে দেখল তিনি মুখের উপর হাত রেখে শুয়ে আছেন। কিছু বলবে বলবে করেও না বলে চলে এল। এসে বর্ষাকে বলল, আপু, একটু আব্বুকে জিজ্ঞেস করবে যে শরীর খারাপ লাগছে কি না।

– তুই গিয়ে জিজ্ঞেস কর। হঠাৎ আমাকে বলছিস!?

– এমনি। দেখো না। কেন শুয়ে আছে।

– তা না হয় জিজ্ঞেস করব। তোর আর খালুর মধ্যে কি কিছু হয়েছে?

– না না।

– তাহলে দুইজন এভাবে চুপ হয়ে আছিস?

– আরে কিছু না। আমি রুমে যাচ্ছি।

মম রুমে চলে এল। ওর পেছনে পেছনে নিনিও এল। ও নিনিকে কোলে নিয়ে বলল, নিনি, আমার সাথে কেন এমন হচ্ছে বল তো? বিয়ে করা কি এতই জরুরি? আব্বুটা কেমন যেন হয়ে রয়েছে। নিনি……। মম ওর গায়ে গাল ঘষতে লাগল।

হঠাৎ মমর ফোনে কয়েকটা ম্যাসেজের শব্দ হল। ও তাকিয়ে দেখল একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে ওর হোয়াটস অ্যাপে ম্যাসেজ আসছে। মম নিনিকে রেখে ফোন হাতে নিল। এর মধ্যে তিন চারটা ম্যাসেজ চলে এসেছে। ও ওপেন করে দেখল ম্যাসেজ দিয়েছে, কেমন আছো; কি অবস্থা; সবাই ভালো আছে? মম ম্যাসেজ করে জানতে চাইল, আপনাকে কি আমি চিনি?

– মম, আমি আলিফ।

– আমার নাম্বার পেয়েছেন কোথায়?

– আদ্রিতার ফোন থেকে।

– ও দিয়েছে না চুরি করে নিয়েছেন?

– মম…

– কেন ম্যাসেজ দিচ্ছেন? আমাকে তো ঠকিয়েছেন এখন কি বউকেও ঠকানোর ইচ্ছে হচ্ছে?

– মম তোমার সাথে একবার দেখা করতে চাই।

– আমার ইচ্ছে নেই।

– প্লিজ একবার। আর বলব না। শুধু একবার দেখা করো।

মম কি ভেবে বলল, কালকে অফিসের লাঞ্চ আওয়ারে কথা বলব। তবে দশ মিনিট। আলিফ তাতেই রাজি হয়ে বলল, তাতেই হবে। মম একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফোন লক করে বিছানায় ফেলে দিল। একে তো বিয়ের প্যারা তার উপর এই প্যারা। ভালো লাগছে না।

রাতে খাওয়ার সময়ও রায়হান সাহেব আগে আগে খেয়ে শুয়ে পড়লেন। মমর ব্যাপারটা মোটেই ভালো লাগছে না। কালকে ছুটি নেওয়া যাবে না। সবে জয়েন করে পর পর দুই দিন ছুটি গেছে অফিসে। এভাবে ঘন ঘন ছুটি নিলে ব্যাপারটা খারাপ দেখা যায়। নাহলে কালকে ছুটি নিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে আনতো তাঁকে। কি সমস্যা হল কে জানে। রাতে ঘুমানোর আগে রায়হান সাহেবের রুমে একবার চক্কর কেটে এল। তাঁকে দেখে মনটা আপনিই খারাপ হয়ে গেছে। আম্মুটা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বাবাকে ছাড়া একটুও থাকতে চাইতো না ও। আর আজ বাবাকে অসুস্থ দেখে আরো মন টানছে। তাঁকে ছেড়ে কি করে যাবে!? মম সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। কালকে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিবে বলে নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল।
.
.
.
.
আজকে রায়হান সাহেব ঘুম থেকে উঠলেন না। মম জিজ্ঞেস করতেই মাধুরী খালা বললেন, আমি ডাকসিলাম, খালু কইলো পরে উঠবো। তাই আমি আর কিসু কই নাই। ও নাস্তা করতে এসে দেখল বর্ষা আর বৃষ্টি রেডি হয়ে খেতে এসেছে। ওদের দেখে বলল, রেডি হয়ে কোথায় যাচ্ছো!? বর্ষা নাস্তা করতে করতে বলল, তোমার ভাই না খেতে পেয়ে মরে যাচ্ছে। তাই যেতে হচ্ছে। মম খানিকটা হেসে বলল, কখন যাচ্ছো?

– এই তো খেয়ে দশ মিনিট পর বের হয়ে যাবো।

– আচ্ছা। সাবধানে যেও।

– হুম।

দ্রুত নাস্তা সেরে তৈরী হয়ে নিল মম। ওর দেরি হয়ে যাচ্ছে। লেট হয়ে গেলে ঢুকতে দেবে না। জুতো পরে একবার রায়হান সাহেবের রুমের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেল।

আজকে পাঁচ মিনিট আগে এসে পৌঁছালো। কালকের বাকি ফাইলগুলো শেষ করতে করতে আরো কাজ এসে জমেছে। নতুন ডিলের কাজ চলছে। সবাই ব্যস্ত সময় পার করছে গত দুইদিন। মম কফিতে চুমুক দিয়ে খেতে খেতে কাজে মন দিল।

নয়টার সময় রিয়ান অফিসে এল। সবাই দাঁড়িয়ে স্বাগতম জানালো। কেউ কেউ কনগ্রেচ্যুলেশন জানাতে লাগল এত বড় ডিল ফাইনাল হওয়ার জন্য। মম এতই কাজে ডুবে ছিল যে রিয়ানের উপস্থিতি খেয়াল করেনি। পাশ থেকে তৌসিফা ওকে গুঁতো দিয়ে বলল, মম, এই মম। মম না তাকিয়ে বলল, হুম।

– স্যার এসেছেন।

– হুম তো?

– আরে দাঁড়িয়ে কনগ্রেচ্যুলেশন জানা।

– কেন?

– কা……

রিয়ান তৌসিফাকে চুপ করিয়ে দিয়ে ওর টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে রইল। ওকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। কিন্তু ও কাজে এতই মনোযোগী যে রিয়ানকে খেয়ালই করছে না। রিয়ান গলা ঝেড়ে বলল, মিস মম? গলা খেয়াল করে তাকাতেই ও উঠে দাঁড়িয়ে বলল, জ্বি বলুন কি সাহায্য করতে পারি? তৌসিফা পেছন থেকে আবার গুঁতো দিয়ে বলল, আমাদের ছোট স্যার। মম বুঝতে পেরে বলল, সরি স্যার। আমি নতুন তাই চিনতে পারিনি। রিয়ান হেসে বলল, ইট’স ওকে। বসে কাজ করুন। মম খেয়াল করল রিয়ান হাসলে ডান পাশে টোল পড়ে।

দুপুরের লাঞ্চ ব্রেক হতেই মম বেরিয়ে পড়ল। অফিসের লাঞ্চের জায়গায় যাওয়াটা সুবিধাজনক নয়। আলিফের সাথে দেখে কে কখন কি মনে করে। কুৎসা রটাতে মানুষ সময় নেয় না। এ কান ও কান করে দ্রুত ছড়িয়ে যায়। আলিফ অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল ওর জন্য। ওকে নিয়ে বাইরের একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসল। লোকেশনটা অফিসের কাছেই। বসার পর আলিফ জিজ্ঞেস করল, কি খাবে?

– এখানে খেতে আসি নি। যা বলার বলুন।

– একটা রেস্টুরেন্টে এসেছি অথচ না খেয়ে চলে যাবো!? খারাপ দেখায় না?

– এক কাপ কফি।

– ওকে। আর?

– আর কি? যা বলার সরসরিই বলুন। এত ভণিতা ভালো লাগছে না। কি বলতে চান?

– তুমি রিয়ানকে বিয়ে করতে রাজি?

– কেন? আপনি চান না বিয়ে হোক?

– ঠিক তা নয়। রিয়ান বেশ ভালো ছেলে। তোমার সাথে ভালো মানাবে। তুমি বিয়ে করতেই পারো।

– তাহলে জিজ্ঞেস করছেন কেন? কোন অধিকারে জানতে চাইছেন?

– আমাকে মাফ করে দাও মম। আমার তোমাকে এভাবে ছেড়ে যাওয়া উচিত হয়নি।

– হঠাৎ এক বছর পর এই কথা? মাফ করে দেওয়ার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এখন চাওয়ার কোনো মানে হয় না।

– প্লিজ মম। আমার আর আদ্রিতার সংসার ভেঙো না। আমার মেয়েটা আমাকে অনেক ভালোবাসে।

– এসব বলার মানে কি? তোমাদের সংসার আমি ভাঙবো কেন; অদ্ভুত!

– দেখো ও আমাদের কথা কিছুই জানে না। জানলে ও খুব কষ্ট পাবে।

– দেখুন মিষ্টার আলিফ, আমি আপনার মতো কুরুচিপূর্ণ মানুষ নই। আমার কমন সেন্স বলে একটা ব্যাপার আছে। ওর সাথে আমার সম্পর্ক আপনার থেকে বেশি। তাহলে ওর ভালো খারাপের চিন্তাটাও আমার আপনার থেকে বেশি। আমি এমন নই যে আমার কলেজ ফ্রেন্ড নিজের অজান্তে আমার প্রাক্তনকে বিয়ে করেছে বলে আমি তার সংসার ভেঙে দেবো বা হিংসে হচ্ছে। এমন ধারণা আপনার মাথায় আসাই সম্ভব। বললে আমি অনেক আগেই বলতে পারতাম। কিন্তু যারা নিজেদের মধ্যে ভালো আছে তাদের ঘর জ্বালানোর ইচ্ছে অন্তত আমার নেই। আর আমার জীবনে ফারদার কোনো ইন্টারফেয়ার না করলে খুশি হব। আর যদি করেন তাহলে আমি কি কি করতে পারি সে ব্যাপারে আপনার আইডিয়া থাকা উচিত। আপনার দশ মিনিট শেষ।

মম উঠে চলে গেল। আলিফ মাথা নিচু করে বসে রইল। কফিটা আসতেই ও তাতে চুমুক দিয়ে বাইরে আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে কালো মেঘ দেখা যাচ্ছে।

মম নিজের টেবিলের কাছে আসতেই রিয়ানকে দেখতে পেল। সে টেবিলে থাকা মমর ফ্যামিলি ফটোটা দেখছিল হাতে নিয়ে। ও আসতেই ওকে লক্ষ্য করে একটা হাসি দিল। মম কাছে এসে বলল, কিছু বলবেন স্যার?

– হুম। ফলো মি।

মম রিয়ানের পিছু পিছু গিয়ে ওর রুমে উপস্থিত হল। ওর টেবিলে খাবার সাজানো। রিয়ান নিজে চেয়ারে বসে মমকে বসতে বলল। মম চুপচাপ এসে বসল চেয়ারে। রিয়ান বলল, খাওয়া শুরু করো।

– এত খাবার আমি খাবো?

– ওমা! আমাকে বাদই দিয়ে দিলেন!? ভালো। এবার খাবার নিয়ে খাওয়া শুরু করুন।

মম বুঝতে পারছে না তাকে এত আতিথিয়েতার কারণ। ও সংকোচ নিয়ে খাবার প্লেটে নিল। প্রথম চামুচ মুখে দিতেই রিয়ান প্রশ্ন করে বসল,আলিফ ভাইয়ের সাথে আপনার কি সম্পর্ক?

চলবে…

বি.দ্র: স্টাডি ট্যুর নিয়ে ব্যস্ত থাকায় পর্ব দেওয়া অনিয়মিত হতে পারে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here