মম_চিত্তে পর্ব ১২

0
358

#মম_চিত্তে
#পর্ব_১২
#সাহেদা_আক্তার

মম সেখানেই খাওয়া থামালো। রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল, প্রশ্নটি করার কারণ জানতে পারি, স্যার? রিয়ান নিজের জন্য খাবার বাড়তে বাড়তে বলল, যেহেতু আপনাকে আমার বউ হিসেবে সিলেক্ট করা হয়েছে সেইক্ষেত্রে জানতে চাওয়াটা বোধহয় অযৌক্তিক নয়। মম রিয়ানের দিকে এক পলক তাকিয়ে থেকে আবার খাওয়ায় মনযোগ দিল। কি বলবে ভাবতে লাগল। রিয়ান ওকে চুপ থাকতে দেখে বলল, বললেন না যে। বললে আমার জন্য সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হতো।

– কি ব্যাপারে? বিয়ে?

মমকে শান্ত দেখে রিয়ান ভেতরে ভেতরে অস্বস্থিবোধ করতে লাগল। বাইরে তা প্রকাশ না করে বলল, হ্যাঁ। মম দ্রুত খাওয়া শেষ করে বলল, আপনার আগে আমি আমার সিদ্ধান্ত আপনাকে জানিয়ে দেই। আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারব না।

রিয়ানেরও খাওয়া শেষ করে চামুচ প্লেটে নামিয়ে রাখল। ও এভাবে রিজেক্ট হবে আশা করেনি৷ সে চায়ের অর্ডার দিয়ে আরাম করে বসে বলল, আলিফ ভাইয়ের জন্য? মম হেসে বলল, অন্ধকারে ঢিল মারছেন? রিয়ান কিছু বলল না। ওর দিকে তাকিয়ে রইল। মম খাওয়ার প্লেটটি ঠেলে রেখে বলল, তা এক প্রকার ঠিকই বলেছেন।

– যেমন।

– আলিফ আমার ভার্সিটি ফ্রেন্ড ছিল একসময়। বলা চলে সিনিয়র ছিল। পরবর্তীতে ব্যক্তিগত কারণে এখন সে অপছন্দের তালিকায়। বাকিটা তাহলে আপনার বোঝা উচিত।

– কি ব্যক্তিগত কারণ?

– আমার ব্যক্তিগত কথা জানার অধিকার আপনি এখনো পাননি। যেহেতু বিয়েটা হচ্ছে না তবে এই প্রসঙ্গে আমি কথা বলতে চাইছি না। আপনি হঠাৎ আলিফকে নিয়ে প্রশ্ন করছেন কেন? সে কি কিছু বলেছে?

– না। আপনাদের দুইজনকে অফিসের সামনে দেখেছিলাম।

– ও, তাতেই এত প্রশ্ন করছেন!

ওদের একজন স্টাফ চা দিয়ে গেল। রিয়ান কিছু না বলে ওকে দিয়ে যাওয়া চা টায় চুমুক দিল। মম কিছু আড়াল করতে চাইছে যা তার অজানা। আলিফের আচরণে কখনো খারাপ কোনো আচরণ প্রকাশ পায়নি। তাকে ভালো বলেই জানে সবাই। তাহলে কি এমন ব্যক্তিগত কারণ যা তাকে মমর অপছন্দের তালিকায় ফেলল!? ব্যাপারটা ওর মনে খচখচ করতে লাগল৷ কিন্তু মম নিজে থেকে বলবে না সেটা বেশ ভালো করেই বোঝা যাচ্ছে। তাই অন্য প্রসঙ্গে যেতে চাইল। ভাবল কানের দুলটা ফেরত দিয়ে কোটের কথা জানতে চাইবে। কোটটা ওর ভীষণ পছন্দের। বিয়ে না হোক অন্তত কোটটা উদ্ধার করা প্রয়োজন।

রিয়ান মুখ খোলার আগেই মমর ফোন বেজে উঠল। ও চা শেষ করে ফোনটা হাতে নিল। মাধুরী খালার ফোন। রিসিভ করতেই তাঁর ভয়ার্ত কন্ঠ শুনে মম বলল, কি হয়েছে খালা? এমন গলায় কথা বলছো কেন? কারো কিছু হয়েছে? মাধুরী খালা বললেন, মা, তুমি তাড়াতাড়ি আসো। খালু কেমন যেন করতেসে। তোমার খালুরে এম্বুলেন্সে কল করতে পাঠাইসি। তুমি কই? মম দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, কি হয়েছে আব্বুর?

– জানি না মা। তুমি তাড়াতাড়ি আসো। আমার ভয় লাগতেসে।

– আমি এখুনি আসছি। হাসপাতালের এম্বুলেন্স এলে আমাকে এড্রেসটা পাঠিয়ে দাও।

মম বলতে বলতে বেরিয়ে গেল রিয়ানকে কিছু না বলে। এদিকে রিয়ান আর কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেল না।
.
.
.
.
রায়হান সাহেবকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হুট করে বুকে ব্যাথা উঠেছিল সকালে। তাই শুয়ে ছিলেন। খাবার খাওয়ার পর বুকে ব্যাথা আরো বাড়তে থাকে। শ্বাস নিতেও বেশ কষ্ট হচ্ছিল৷ তারপর শরীর আরো খারাপ হতে থাকে। হাসপাতালে আসতে আসতেও ঘেমে একাকার হয়ে গেছেন৷ তাই তার পোশাক চেঞ্জ করে দিয়েছে হাসপাতালের বয়। মাধুরী খালা ভয়ে চুপসে বসে আছেন এক পাশে। জাবেদ খালু দৌঁড়াদৌঁড়ি করছেন। মম পৌঁছাতেই মাধুরী খালা কাছে এসে বললেন, মা, দেখো না খালুর কি হইয়া গেল। সকালে উঠল না। তারপর এক ঘন্টা পর উঠে খাইয়া আবার শুইয়া পড়ল। দুপুরে ডাক দিলাম। উইঠা ওয়াশরুম যাইতে গিয়া পইড়া গেল। দেখি শ্বাস নিতে পারে না। জোরে জোরে শ্বাস টানে বুকে হাত দিয়া। ঘামতেসিলো অনেক। তোমার খালুরে কইতেই সে ……। মাধুরী খালা কাঁদতে লাগলেন। মম আশ্বস্ত করে বলল, ভয় পেয়ো না। আমি এসে গেছি না? ডাক্তারের সাথে কথা বলে দেখছি। জাবেদ খালু কোথায়?

– ঐ যে।

তিনি পেছনে ইশারা করলেন। মম তাকিয়ে দেখল তিনি একজন ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে মনযোগ দিয়ে শুনছেন কি বলছে৷ ও গিয়ে বলল, ডক্টর কি বুঝলেন? ডাক্তার ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, এখুনি বুকের এক্স-রে, রক্ত পরীক্ষা, ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম আর করোনারি অ্যাঞ্জিওগ্রাম করিয়ে নাও। শুনে যা মনে হচ্ছে হার্ট ব্লক হয়ে গেছে কোথাও। রিপোর্ট দেখে আমরা পরবর্তী ধাপে আগাবো।

– আচ্ছা।

মম চলে গেল রায়হান সাহেবের বুকের পরীক্ষা গুলো করাতে। জাবেদ খালুও ওর পেছন পেছন গেলেন। ডাক্তার ওর চলে যাওয়া দেখতে দেখতে ফোন বের করল এপ্রোন থেকে। কল করে বলল, রিয়ান, মমর বাবা অসুস্থ। রিয়ান ফাইল দেখছিল। ফাইল বন্ধ করে রেখে বলল, তুমি জানলে কি করে, নিক্বণাপু?

– কিছুক্ষণ আগে আমাদের হসপিটালে ভর্তি হয়েছে। অবস্থা ভালো লাগছে না। পরীক্ষা দিয়েছি। রিপোর্ট আসলে বুঝতে পারব।

– এজন্যই আমার সামনে থেকে চলে গেল কিছু না বলে।

– কথা বলছিলি নাকি?

– হুম।

– ও একলা সামলাতে পারবে কি না বুঝতে পারছি না। তুই আসবি একবার?

– দেখি। তুমি আর বড়চাচা তো আছো।

– তা আছি।

– আমাকে রিপোর্ট দেখে বোলো কি অবস্থা। আর…

– কি?

– কিছু না। পরে বলব।

– আচ্ছা। আমি যাই। রাউন্ডে যেতে হবে।

নিক্বণ ফোন রেখে দিল৷ রিয়ান একবার ভেবেছিল মমর বিয়েতে আপত্তি থাকার কথা বলে দেবে। কিন্তু পরমুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলল। আগে বিপদটা কাটুক তারপর বিয়ের ব্যাপারে কথা বলা যাবে।

রিপোর্ট ভালো আসেনি রায়হান সাহেবের। হার্টের কয়েক জায়গায় ব্লক হয়ে গেছে বাজে ভাবে। রক্ত চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়ছে। নিক্বণ সব রিপোর্ট দেখে বলল, যতদ্রুত সম্ভব বাইপাস সার্জারি করা লাগবে।

– এতে কত খরচ পড়বে?

নিক্বণ মমর মাথায় হাত রেখে বলল, কদিন পর যাদের সাথে আত্মীয়তা হতে যাচ্ছে তাদের সাথে টাকার হিসাব নাই বা করলাম। আমি সব কিছু ঠিক করছি তুমি শুধু দোয়া করো যাতে তোমার আব্বু তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যায়। এইটুকু বলে ও চলে গেল। নিক্বণ কি বলল কিছু বুঝতে পারল না কিন্তু এটা ঠিকই বুঝতে পারল নিজে যতই শক্ত দেখাক বাইরে ভেতরটা ভয়ে কিছুক্ষণ পর পর শিউরে উঠছে। মম সার্জারি জিনিসটা ভীষণ ভয় পায়। ছোটবেলায় এক সার্জারির মাঝেই ওর আম্মু ওদের দুইজনকে ছেড়ে যায়। তখন থেকে সার্জারি জিনিসটা ওর কাছে মৃত্যু সমতুল্য। যেন সার্জারি করলেই মরে যাবে যে কেউ। ও মাধুরী খালার দিকে তাকিয়ে বলল, আব্বু বাঁচবে তো?

– এসব কি বলো মা। নিশ্চয়ই বাঁচবো।

মম মাধুরী খালাকে জড়িয়ে ধরল। সত্যিই কি ফিরে আসবে রায়হান সাহেব অপারেশন থিয়েটার থেকে!?

অপারেশনের আগে রায়হান সাহেবকে দেখে কান্না পেল মমর। নাকে অক্সিজেন নল লাগানো। হাতে ক্যানেলা। রক্ত স্যালাইন চলছে। একদিনে মুখ শুকিয়ে চেনা যাচ্ছে না তাঁকে। ওর সামনে দিয়ে নিয়ে গেল অপারেশন থিয়েটারে। মম জামা খামচে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল। অপারেশন শুরু হওয়ার একটু পর রিয়ানের পুরো পরিবারকে হাসপাতালে দেখে অবাক হলো ও। দিদুনকে তুলি ভাবির কাছে রেখে এসেছে। তিনি আসতে চেয়েছিলেন কিন্তু কেউ দেয়নি। রিতু, অনিমা, নীলিমা প্রাইভেটে। ফেরদৌসী ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করো না। মায়ের স্পর্শ পেয়ে মম তাঁকে জড়িয়ে ধরল। কিছুক্ষণ পর পর ওর কাঁপুনি বুঝিয়ে দিল ও নিঃশব্দে কাঁদছে।

টানা কয়েক ঘন্টার অপারেশনের পর রাশেদ হাসান বের হলেন। মম দৌঁড়ে গিয়ে বলল, আব্বু কেমন আছে? তিনি ওর মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ভালো আছে। তাঁকে ইনটেনসিভ কেয়ারে রাখতে হবে। হৃদযন্ত্র, রক্তচাপ, নিঃশ্বাস ও অন্যান্য ভাইটাল সাইনের উপর অনবরত নজর রাখা হবে। সেখানে দুই তিন দিন রাখা হবে। তারপর অবস্থা অনুযায়ী জেনারেল ওয়ার্ডে শিফট করে দেবো। মম ভালো মেয়ের মতো মাথা নাড়ল। একটুপর রায়হান সাহেবকে দুইজন বয় মিলে অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করে নিয়ে যেতে লাগল। মম তাঁর বুকের দিকে তাকিয়ে রইল। ভয়ে হচ্ছে এই ভেবে যদি দেখে তাঁর বুক ওঠা নামা বন্ধ হয়ে গেছে! তাঁকে দেখে মম মুখ চেপে ধরল। তার এই অবস্থা দেখে ওর বুক ফেটে যাচ্ছে। তাঁকে এমন দেখবে ভাবতেই পারছে না ও। শুক্রবার ডাক্তার দেখাবে ভেবেছিল আর তার আগেই কি হয়ে গেল! আদ্রিতা প্রিয়ান্তুকে কোলে নিয়ে কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। ওর কাছে এসে বলল, মম, তুই বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নে। নাহার চাচি ওর সাথে একমত হয়ে বললেন, আদ্রি ঠিকই বলছে। তুমি বাড়ি যাও মা। রাত হয়ে যাচ্ছে অনেক। নিক্বণ আর ওর বাবা আছে। তারা দেখে রাখবে।

– না, আমি আব্বুর কাছে থাকবো।

– তোমাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হবে না।

– না পারলে না পারি। বাইরে থেকে দেখবো। জ্ঞান ফিরলে আব্বু আমাকে খুঁজবে। আমি জানি।

মমকে দেখে কেউ কিছু বলল না। ও কেবিনের সামনে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল রায়হান সাহেবের দিকে তাকিয়ে। তাঁকে ছেড়ে ও কোথাও যাবে না। কখনো না। আর বিয়ে তো কোনোদিনও না।

রাত সাড়ে এগারটা বাজে। রিয়ানের পরিবারের সবাই বাড়িতে চলে গেছে। মমকে বার বার বলেও বাড়িতে পাঠানো যায়নি৷ এখন সে কেবিনের সামনে দেয়ালে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। কেউ সামনে দিয়ে হেঁটে গেলেই জেগে উঠে। মাধুরী খালা আর জাবেদ খালুকেও জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছে ও। রিয়ান যখন হসপিটালে পৌঁছালো তখন দেখল মম চোখ বন্ধ করে হাতের উপর মুখ রেখে ঘুমাচ্ছে। ক্লান্তির ছাপ ওর চোখে মুখে। ঘুমে পড়ে যাচ্ছিল; রিয়ান গিয়ে ওর মাথাটা ধরল। সাবধানে ওকে সোজা করে পাশে বসল। মাথাটা নিজের কাঁধে রাখল। ওর দিকে তাকিয়ে দেখল ওর মুখে চোখের পানি শুকিয়ে আছে। আপনা থেকে হাত দিয়ে পানিটা মুছে দিতে গিয়েও হাত সরিয়ে ফেলল। মম জেগে উঠছে। চোখ খুলে পাশে রিয়ানকে দেখে বলল, আপনি এখানে?

– আপনার আব্বুকে দেখতে এসেছি। আমার পরিবার এখনো জানে না আপনি আমাকে রিজেক্ট করেছেন। তাই দায়িত্ব তো পালন করাই লাগবে।

– ও। আচ্ছা শুনুন। ডক্টর নিক্বণ আপনার বোন, তাই না?

– হ্যাঁ কেন?

– তার থেকে আমায় বিলটা নিয়ে দেবেন। যেখানে বিয়েটাই হচ্ছে না সেখানে সুবিধা ভোগ করার কোনো মানেই হয় না।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here