মম_চিত্তে পর্ব ১০

0
351

#মম_চিত্তে
#পর্ব_১০
#সাহেদা_আক্তার

রাতে রওশন আরার ঘর থেকে রিয়ানের ডাক পড়ল। ওর পিছু পিছু সবাই আসতে চেয়েছিল কিন্তু রওশন আরা না করে দিলেন। তিনি রিয়ানের সাথে একলা কথা বলতে চান। তাঁর ইশারায় ঢুকেই ও দরজা মেরে দিল। ভাই বোন সবগুলো দরজায় কান পাতলো। পাছে কিছু মিস করে যায়!

– আয় দাদুভাই, আমার কোলে মাথা রেখে একটু বিশ্রাম নে।

রিয়ান ভালো বাচ্চা ছেলের মতো তাঁর কোলে শুয়ে বলল, কতদিন যেন তোমার কোলে শুই না দিদুন। খুব মিস করি। তোমার আর আম্মুর কোলে কি যে শান্তি! তিনি মাথা হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, কেমন গেল এ কদিন দাদুভাই? ও আরামে চোখ বুজে বলল, একটু পরিশ্রম তো হয়েছে। সকাল বিকাল শুধু মিটিং আর মিটিং। তিনি হেসে বললেন, ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করেছিস? এত শুকনো লাগছে।

– কি যে বলো তুমি!? সকালে ব্রেকফাস্ট, দুইবেলা খাবার। তার সাথে নাস্তা তো আছে। খেয়ে খেয়ে ভুঁড়ি বেড়ে গেছে।

– তাহলে তো আমার দাদুভাই ভুড়িওয়ালা হয়ে গেছে।

– ঠিক বলেছো দিদুন। জিম করে এই ভুঁড়ি কমাতে হবে।

– তা কমাস। দাদুভাই, একটা কথা বলব?

– বলো। তার আগে মাথাটা টিপে দাও তো। খুব ধরেছে।

রওশন আরা মাথা টিপতে টিপতে বললেন, আমি চলে গেলে কে মাথা টিপে দিবে শুনি? রিয়ান চোখ বন্ধ করে ছিল। সেভাবেই বলল, তুমি কই যাবা শুনি। তোমাকে কোথাও যেতে দিবো না। তিনি হেসে বললেন, তা কি করে হয়? আমার সময় তো বেশিদিন নেই……। রিয়ান বাঁধা দিয়ে বলল, ধুর, এসব বলার জন্য ডেকেছো?

– না রে। একটা অনুরোধ করার জন্য। আমার একটা কথা রাখবি?

– কি বলো তো।

– আমার মম মেয়েটাকে খুবই পছন্দ হয়েছে রে দাদুভাই। আমার মন বলছে ওকে বিয়ে করলে তুই অনেক সুখে থাকবি। তুই শুধু অনুমতি দে। যদি দেখার পর তোর পছন্দ না হয় তাহলে বাদ।

– দিদুন তুমিও!? ওকে, দেখো তোমরা।

– আমাদের তো দেখা হয়ে গেছে। তুই যেহেতু রাজি তাহলে কালই প্রস্তাব দেবো৷ তারপর তুই দেখে নিবি।

রিয়ান কিছু বলল না। চুপ করে শুয়ে রইল রওশন আরার কোলে। আর যাই হোক দুলের মালিককে দেখার কৌতুহল হচ্ছে খুব। কেন এই দুল ওকে এত টানছে জানা দরকার। বিয়ে হোক না হোক দুলটা দেওয়ার জন্য হলেও ওকে দেখা করতে হবে।

বাসায় ফিরতে ফিরতে সাড়ে দশটার উপরে বাজলো। শরীর এতো ক্লান্ত লাগছে মমর যে ইচ্ছে করছিল না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়তে। কলিংবেল বাজাতেই মাধুরী খালা দরজা খুলে দিলেন। ও রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখল খালা টেবিলে খাবার দিচ্ছেন। মম বসে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলল, সবাই খেয়েছে?

– হ।

– আব্বু আজকে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল মনে হচ্ছে। আগে তো এগারটা পর্যন্ত খেলা দেখে তারপর ঘুমাতো।

– হ, শরীরটা একটু ভালা না মনে হয়। বুকে নাকি হালকা ব্যাথা করতেসিলো।

– ওষুধ খেয়েছে?

– আমি নিজে দিসি আইজকা।

– ভালো করেছো। আব্বুর প্রেশারটা ক’দিন ধরে বেশিই আপ ডাউন করছে। ডাক্তার দেখাতে হবে।

মাধুরী খালাও একমত হলেন। মম খাওয়া দাওয়া সেরে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। নিনিটা পাশে বসে ম্যাঁও ম্যাঁও করছে। ও হাত দিয়ে মাথায় আদর করতে লাগল। ভাবছে আগামী শুক্রবার রায়হান সাহেবকে ডাক্তার দেখাবে; কেন এমন হচ্ছে জানা দরকার।
.
.
.
.
সকালবেলা রায়হান সাহেবের ফোনে একটা কল এলো। তিনি ধরতেই অপর পাশ থেকে একটি পুরুষ কন্ঠ বললেন, মি. রায়হান বলছেন? তিনি প্রতিউত্তরে হ্যাঁ বলতেই অপরজন বললেন, আমি রাকিব হাসান বলছি। মম যে কোম্পানিতে আমি সেখানকার এমডি।

– ও আচ্ছা; মমকে খুঁজছেন? ও এই মাত্রই বেরিয়ে গেল।

– না, আমি আপনাকেই খুঁজছিলাম। আপনার সাথেই কিছু কথা বলার ছিল।

– জ্বি বলুন।

মম অফিসে ঢুকে প্রথমে ফাইল নিয়ে রাকিব হাসানের রুমে গেল। কাল অনেকক্ষণ একটানা কাজ করে ফাইলগুলো শেষ করেছে। এগুলো গুরুত্বপূর্ণ দেখে আগে এই নয়টা ফাইল দেখে রিপোর্ট টাইপ করে নিয়েছে। এখনো আরো ফাইল বাকি। আজ শেষ করতে হবে। হয়ত শেষ করতে করতে আরো ফাইল জমা হবে। কাজের শেষ নেই।

নক করতে রাকিব হাসান প্রবেশের অনুমতি দিলেন। ঢুকে ও বলল, স্যার, রিপোর্ট আর ফাইল গুলো। তিনি কম্পিউটারে কাজ করতে করতে বললেন, ঐ শেলফে জায়গা মতো রাখো। মম শেলফের সামনে গিয়ে খুঁজে খুঁজে জায়গা মতো রাখতে লাগল আর হামি দিতে লাগল। কালকে নিনি তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গিয়েছিল। রাত তিনটার সময় এসে ওকে জ্বালাতন করছিল খেলার জন্য। বাধ্য হয়ে এক ঘন্টা খেলে আবার ঘুম। সাতটায় আবার নিনির অত্যাচারে ঘুম থেকে উঠে যেতে হয়েছে। এখনো বেশ ঘুম পাচ্ছে। রুম থেকে বের হয়ে সোজা কফি আনতে যেতে হবে। মম চলে যেতে লাগলে রাকিব হাসান ডেকে বললেন, তোমার আজকে দুপুর থেকে ছুটি।

– কিসের ছুটি স্যার?

– তোমার বাবা আমার কাছে ছুটি চেয়েছেন তোমার জন্য।

– আচ্ছা।

কি বলবে বুঝে না পেয়ে মম বেরিয়ে এল। হঠাৎ রায়হান সাহেব ওর জন্য ছুটি চাইলেন কেন!? বুঝতে পারছে না কিছু। ভাবতে ভাবতে কফি বানিয়ে নিজের জায়গায় এসে দেখল রাসেল ওর টেবিলের দিকে কেমন বাঁকা হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে। এটা ওটা দেখছে। ওকে খেয়াল হতে বলল, তোমার তো দেখি এখনো কাজ শেষ হয়নি। কতগুলো ফাইল এখনো বাকি। মম কফির কাপ রেখে বলল, জ্বি।

– স্যারের গুলো শেষ?

– জ্বি।

রাসেল ওর পিঠের মাঝ বরাবর চাপড় দিতে দিতে বলল, গুড গুড। এগুলোও তাড়াতাড়ি শেষ করো। দেখবে স্যার খুব খুশি হবে। তা এক কাপ কফি খাবে? চলো তোমাকে খাওয়াবো৷ মম ওর কফি দেখিয়ে বলল, আমি কফি এনেছি।

– দেখেছো আমি খেয়ালই করিনি। তাহলে দুপুরে একসাথে লাঞ্চ করব। কাছেই একটা হোটেল আছে।

– সরি, দুপুরে আমি বাসায় চলে যাবো। স্যার ছুটি দিয়েছেন।

সে আবার ওর কাঁধে হাত দিয়ে বলল, সমস্যা নেই। তাহলে অন্য একদিন হবে। মন খারাপ করো না। বলে ওকে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে চলে গেল। মন খারাপ তো দূরের কথা মমর ঘৃণায় গা গুলিয়ে উঠল। এই লোকটার আসলেই চরিত্র খারাপ। কথায় কথায় শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হাত দেয়। তৌসিফার কাছে শুনেছিল একটা মেয়েকে হ্যারাস করেছিল খুব বাজে ভাবে এক পার্টিতে। তারপর মেয়েটা অভিযোগ করতে গেলে রাসেল বুদ্ধি করে মেয়েটাকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করে। ‘যত সব খারাপ লোকজনগুলো আমার পেছনে লাগা শুরু করেছে একসাথে,’ ভাবতে ভাবতে কাজে মন দিল।

দুপুরে কাজ শেষ করে রওনা দিল বাসায়। মাথায় অনেক কিছু ঘুরছে। কিসের ছুটি নিল তা ভাবতে ভাবতে বাসায় পৌঁছে গেল। নক করতে বর্ষা দরজা খুলল। ওকে দেখে বলল, কি রে, আজও তাড়াতাড়ি এলি!? ও জুতো রাখতে রাখতে বলল, আব্বু ফোন দিয়ে ছুটি নিয়েছে আমার জন্য। সিরিয়াস কিছু কি? বর্ষা ওকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বলল, জানি না। আজ খালু অফিসে যায়নি দেখলাম। ফোন দিয়ে ছুটি নিয়েছেন হঠাৎ। সকাল থেকে রুমের রকিং চেয়ারে বসে আছেন। পর্দা টানা। রুম একটা অন্ধকার। মম ফ্রেশ হয়ে রায়হান সাহেবের রুমে গেলেন। দরজা ভেজানো। আস্তে ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। ভেতরটা কেমন ঘুটঘুটে অন্ধকার৷ ও গিয়ে পর্দা সরিয়ে দিতেই চারপাশে আলোয় ভরে গেল। রায়হান সাহেব চোখ মেললেন৷ ওর দিকে এক পলক তাকিয়ে থেকে বললেন, এসেছিস? মম কাছে এসে হাঁটুর কাছে বসে বলল, তা তো এসেছি। তোমার কি হয়েছে? অফিস যাওনি!? শরীর খারাপ? রায়হান সাহেবের কোলে নিনি ঘুমাচ্ছে। তিনি নিনির গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, না, আমি ভালো আছি৷

– তাহলে? হঠাৎ আমার অফিস থেকে ছুটি চেয়ে নিলে? নিজেও ছুটি নিলে।

– তোর সাথে কিছু কথা বলতাম।

– কি এমন জরুরি কথা আব্বু যে অফিস থেকে ছুটি নিতে হলো!

রায়হান সাহেব ইতস্তত করতে লাগলেন। নিনি জেগে উঠে মমর কোলে চলে এল। মম ওকে আদর করতে করতে তাঁর দিকে তাকালেন। তাঁকে অনেক নার্ভাস লাগছে। মম তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল, কি হয়েছে আব্বু? কিছু বলবে? বলো। আমি শুনছি। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তোর জন্য একটা বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। মম চুপ করে থেকে বলল, কে দিয়েছে? তিনি একটু সাহস নিয়ে বললেন, তোর বান্ধবী আদ্রিতার বড় চাচা তোকে তার ছেলের জন্য চাইছেন।

– আব্বু তুমি চাও আবার তোমার হিরে অযত্নে অবহেলায় হারিয়ে যাক!?

– আমার বিশ্বাস তারা তোকে যত্নে রাখবে। আচ্ছা তুই শুধু একবার দেখ। যদি পছন্দ না হয় তো বাদ দিয়ে দিস।

– আমাকে সময় দাও আব্বু।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here