মন প্রাঙ্গনে এলে যখন পর্ব ২৩

0
845

#মন_প্রাঙ্গনে_এলে_যখন
#লেখনীতেঃ #আলফি_শাহরিন_অর্পা
#পর্ব_২৩

স্তব্ধ নীল আকাশ। নেই কোনো তারার মেলা। চাঁদটার ও দেখা মিলছে না হয়ত মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলছে আর নয়ত সেও আকাশকে আঁধারে ডুবিয়ে দিয়েছে। এত নির্জন রাতেও মানুষের কোলাহলের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কিছু মানুষের আওয়াজে বুঝা যাচ্ছে হয়ত নতুন ভাবে জীবন গড়ার সুযোগ পেয়েছে আর কিছু মানুষের আওয়াজে বুঝা যাচ্ছে প্রিয়জন হারানোর হাহাকার। এমন হৃদয় বিদারক আকুতি জয়ের ভিতরের সত্তাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। বারবার মুখের সামনে ভেসে উঠছে প্রিয়তমার নিস্তেজ মুখখানি। সে কী আর একটা সুযোগ পাবে না? পাবে না নিজের প্রিয়তমার হাত ধরে তার কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ? নাকি সারাজীবন অনুতাপের আগুনে দগ্ধ হবে সে? তখনি তার মস্তিষ্কের দৃশ্যপটে ভেসে উঠে পূরানো সব স্মৃতি।

~অতীত~

তখন ছিলো বসন্তকাল। প্রকৃতির তখন নতুন রূপে সেজেছিল। চারদিকে ছিলো ফুলের সমাহার। বসন্তের ফুলের মতোও ছোট্ট পরশির হৃদয়েও ফুটে ছিলো ভালোবাসার ফুল কিন্তু ফুলটি পরিপক্বতা পাওয়ার আগেই নিংড়ে যাবে তা হয়ড পরশি কখনো ভাবে নি।

দিনটি ছিলো সোমবার । স্কুলে শেষে বাড়ি ফিরছিলো পরশি। খুবই ক্লান্ত ছিলো সে, তাই কখন গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো সে বুঝতে পারেনি। তীব্র হর্নের শব্দে তার ঘুম ভাঙে। সে বুঝতে পারে প্রত্যেকদিন এই দুপুর বেলা এমন জাম পড়ে কেন? কখনো কখনো তার মনে হয় গ্রামে যেয়ে বসবাস করি, এমন যানজটে তো আর পড়তে হবে না। আর এই ড্রায়ভার আংকেল কেনো গাড়ির জানালা লাগিয়ে রেখেছে কেনো? সে তো জানে তার বদ্ধ গাড়িতে থাকতে ভালো লাগে না। বিরক্তিতে ‘চ’ উচ্চারণ করলো সে। তখনি তার চোখ যায় জানালার বাহিরে। সেখানে বাইকে একজোড়া কপোত-কপোতী বসে আছে। যে কেউ দেখলেই তারা বলে দিবে এরা সুখী দম্পতি। কেননা রোদের তীব্রতার জন্য পুরুষটির শরীর থেকে ঘাম চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে আর নারীটি সযত্নে রুমাল দিয়ে তার ঘাম পরিষ্কার করে দিচ্ছে। এসব দেখে পরশির চোখ দুটি ছলছল করে উঠলো। আর যাই হোক নিজের ভালোবাসার মানুষকে অন্যের পাশে দেখে মনে হচ্ছে কেউ তার হৃৎপিণ্ডে ছু’ড়ি চালাচ্ছে।

আজ তিনদিন হলো নিজেকে রুমে বন্ধ করে রেখেছে পরশি। কারো সাথে কোনো কথা বলছে না। শুধু রুম বন্ধ করে কান্না করে যাচ্ছে। রুদ্ধ এসে কতবার জিজ্ঞেস করলো তার কী হয়েছে? অসুস্থ কি না? কিন্তু প্রত্যেকবার তার একই জবাব সে ঠিক আছে কিন্তু সে এখন একা থাকতে চায়। পরশির কোনো খবরাখবর না পেয়ে তার বান্ধবীরা তাকে দেখতে আসে। বান্ধবীদের কাছে আর লুকাতে পারলো না তারা এমন ভাবে চেপে ধরেছিল যে সে সবটা শিকার করতে বাধ্য হয়। সবকিছু শুনে বললো তোর হয়ত কোনো ভ্রান্তি হচ্ছে। যতটুকু তোর কাছ থেকে শুনে বুঝেছি জয় ভাইয়ার চরিত্র এমন না। তার কোনো কাজিনও তো হতে পারে। ওর এইটুকু কথা শুনে পরশির মনে আশার কিরণ জ্বলে উঠলো। অতঃপর আবার সে বলল, আচ্ছা শুন, তুই তে এখনো জয় ভাইকে নিজের মনের কথা জানালি না। এখনও সময় আছে জানিয়ে দে পরে যদি দেরি হয়ে যায় পরে আফসোস করবি। ব্যাস এইটুকুই যথেষ্ট ছিলো পরশির মনে ভয় ঢুকানোর জন্য। সে তার ভালোবাসাকে হারাতে চায় না, তাই সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো সে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জয়কে সব জানিয়ে দিবে।

______________________

জয় কিছু অফিশিয়াল কাজের জন্য রুদ্ধের বাসায় এসেছিল। কাজটা খুবই জরুরি ছিলো তাই এত রাতে আসা। বাসায় যাচ্ছিলো তখনি পরশি কোথা থেকে দৌড়ে এসে তার হাতে একটি কাগজ দিয়ে চলে গেল। কাগজে মুড়ানো ছিলো তার অনুভূতি যা সে কখনো ব্যক্ত করতে পারতো না।

আজ জয় পরশিকে একান্তে কথা বলার জন্য ডেকেছে, তাই সে খুব খুশি। হয়ত জয়ও তাকে তার মনের কথা জানিয়ে দিবে। তাই সে আজ নিজেকে জয়ের পছন্দের রঙ নীলে সাজিয়েছে। মামনি একবার তাকে বলেছিল শাড়ি পড়া মেয়েদের জয়ের খুব ভালো লাগে তাই সেও আজ শাড়ি পড়েছে। যেই আজ তাকে দেখবে সেই বলবে নীলপরি।

–দেখ পরশি আমি তোকে আজ এক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার জন্য ডাক দিয়েছে। জানিনা তুই কথাটা কিভাবে নিবে তাও তোকে এখন এই ব্যপারে আনার জানানো দরকার। এইটুকু বলে জয় থামলো। জয়ের এমন কথা শুনে পরশির হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। জয় আবার বললো-

–দেখ পরশি তোর বয়সটা খুবই কম। এই বয়সে অপজিট জেন্ডারের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হবে এটা স্বাভাবিক। এটা তোর আবেগের বয়স, আমিও এই বয়স পার করে এসেছি। তোর বয়সে আমারও এমন অনুভূতি হত। কিন্তু যত বয়স বাড়লো ততই আমও বুঝতে পারলাম এটা নিতান্তই আমার আবেগ ছাড়া কিছুই না। এই বয়সে আবেগকে অনেকেই ভালোবাসা মনে করে। তোর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।

তুই যে চিঠিটা দিয়েছিলি তা আমি পড়েছিলাম। তোর জায়গা অন্য কোনো মেয়ে হলে নিশ্চিত আমার হাতে চ’ড় খেতো। কিন্তু তোর সাথে আমি করতে পারবো না। যদি তোকে মেরে বুঝাই তাহলে তুই যেকোনো সময় ভুল কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে দ্বিধা বোধ করবি না কেননা তোর বয়সটাই এমন। কিছু কথা বলছি মন দিয়ে শুন তোর সামনে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ পড়ে আছে, সেটার জন্য নিজেকে প্রস্তুত কর। মন দিয়ে পড়ালেখা কর। তোর ভাইয়ের অনেক স্বপ্ন তোকে নিয়ে সেদিকে মন দে। আমার চেয়েও ভালো ছেলে পাবি। তাছাড়া আমার ভালোবাসার মানুষ আছে আমি তোকে ভালোবাসতে পারবো না। খুবই কঠোর ভাবে কথাগুলো বললো জয়। জয়ের কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিলো পরশি। জয়ের এমন কথাবার্তা শুনে চোখ তার টলমল করছে, তাও নিজেকে শান্তনা দিয়েছে এখনো তার কাছে সুযোগ আছে জয়ের হৃদয়ের খুব আপন হওয়ার। কিন্তু তার “ভালোবাসার মানুষ আছে” এই উক্তিটি তার ভিতরকে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে।

–জয়! পিছন থেকে কোনো মেয়েলি কণ্ঠ জয়কে ডাকছে। তার ডাক শুনে জয়ের চেহারার কঠোর ভাবটা চলে গেল। উজ্জ্বলতা বেড়ে গেলো, ঠোঁটে দেখা দিলো বিরাট এক হাসি। তার মস্তিষ্ক তাকে সংকেত দিয়ে জানাচ্ছে মেয়েটি কে হতে পারে কিন্তু মন তা মানছে না। তারও পিছে ফিরার সাহস নেই। তবে মেয়েটি তার সামনে এসে ঠিকই দাঁড়ালো।

–তুমি নিশ্চয়ই পরশি? আমি হলাম মেঘা। জয় আমাকে তোমার ব্যাপারে সবকিছু জানিয়েছে। এটা তোমার পড়ালেখার বয়স সেদিকে মন দাও। আবেগের জলে গা ভাসিও না। এই বয়সে আমারো এমন একটু আধটু হয়েছিল কিন্তু যখন বুঝতে শিখেছি তখন থেকে মনে হত অতীতে কী কী না করেছিলাম। আর বাচ্চা একটা মেয়ে শাড়ি পড়েছো কেন? হাসি-মজা করার বয়সে বিয়ে করে বাচ্চা পালবে এমন ইচ্ছে থাকলে মাথা থেকে ঝাড়ো। পরশি এতক্ষণ মেঘার সব কথা গলাধঃকরণ করছিলো। মেয়েটিকে জয়ের সাথে সেদিন বাইকে দেখেছিলো কিন্তু এই মেয়ে তাকে এত কথা কেনো শোনাচ্ছে তা বুঝতে পারছে না।
জয়ের দিকে তাকাতেই সে ইশারায় বুঝালো এই সে মেয়ে। এই মেয়ের উপর তার খুব হিংসে হচ্ছে কেনো সে তার ভালোবাসার মানুষটিকে পেলো,সে কেনো পেলো না।

______________________

~বর্তমান~

ফ্লোরের মধ্যে বসে আছে রুদ্ধ। দৃষ্টি তার অপারেশন থিয়েটারের উপর লাগোয়া বাতিটির দিকে। তখনি তার পাশে এসে স্নিগ্ধা বসলো কিন্তু রুদ্ধ তা টের পেলো কি না কে জানে? স্নিগ্ধা তার হাতটা রুদ্ধের কাঁধে রাখলো। কারো নরম হাতের স্পর্শ পেয়ে রুদ্ধ সেদিকে তাকালো। আজ রুদ্ধের চেহারায় সে কঠোর ভাবটা ছিলো না, ছিলো একরাশ করুন চাহনি, বোনের জন্য ভাইয়ের আকুতি। সে তো কেঁদে কেটে নিজের অনুভূতি জানাতে পারে কিন্তু রুদ্ধতো তা পারবে না। স্নিগ্ধা কিছু বলতে যাবে এর আগেই রুদ্ধ তাকে জরিয়ে ধরলো। প্রথমে সে হতভম্ব হয়ে গেলেও পড়ে সেও রুদ্ধকে জরিয়ে ধরে। অতঃপর মিহি কণ্ঠে বলে-

–চিন্তা করবেন না আপু ঠিক হয়ে যাবে। আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন।
রুদ্ধের মনের উত্তাল পাতাল কে শান্ত করার জন্য স্নিগ্ধার এইটুকু কথাই যথেষ্ট ছিলো।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here