মন প্রাঙ্গনে এলে যখন পর্ব ২৭

0
928

#মন_প্রাঙ্গনে_এলে_যখন
#লেখনীতেঃ #আলফি_শাহরিন_অর্পা
#পর্ব_২৭

রুদ্ধ আজ পা’র্টি অফিস থেকে বাসায় তাড়াতাড়ি এসে পড়েছে। আজ কেনো জানি তার মনটা শুধু খচখচ করছিলো। ও বাসায় আসতেই স্নিগ্ধা দৌড়ে তার কাছে গেলো। তার হাতে থাকা ব্যাগটা নিজের হাতে নিয়ে সেখান থেকে চলে গেল। রুদ্ধ হলরুমের সোফায় বসলো আর রিমোট দিয়ে এসিটা অন করে দিলো। বাহিরে রৌদ্রের উষ্ণতা প্রখর ছিলো তাইতো তার গায়ে থাকা সাদা পাঞ্জাবিটা ঘামের দরুন প্রচন্ড ভিজে গেছে। ফলে সাদা পাঞ্জাবিটা শরীরের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে লেপ্টে গেছে। কিছুক্ষণ পর স্নিগ্ধা গ্লাসে করে লেবুর শরবত রুদ্ধের জন্য আনলো। রুদ্ধ লেবুর শরবত দেখে মনে মনে অনেক খুশি হলো কিন্তু তা মুখে প্রকাশ করলো না। তাও স্নিগ্ধাকে একটু ভয় দেখানোর জন্য কণ্ঠে রাগ মিশ্রিত করে বললো-

–তুমি জানো না! আমি প্রত্যেকদিন বাসায় আসার পর চা খাই। তাহলে আজ এই শরবত কেনো এনেছ?

রুদ্ধের এমন গম্ভীর স্বর শুনে কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো স্নিগ্ধা। স্নিগ্ধা ভেবে পাচ্ছে না কী বলবে তাও নিজের মধ্য কিছুটা সাহস সঞ্চার করে বললো-

–আপনাকে দেখে অনেক ক্লান্ত মনে হচ্ছিল তাছাড়া বাহিরে প্রচণ্ড গরম ছিলো তাই আমি ভাবলাম আপনার জন্য লেবুর শরবত করে আনি। আর এমনেও আপনার অবস্থা দেখে আমার মনে হয়েছে চায়ের চেয়ে এখন আপনার এক গ্লাস ঠান্ডা লেবুর শরবতের প্রয়োজন।

কথাগুলো বলার সময় স্নিগ্ধার কথায় খানিকটা জড়তা আর মুখে ভয় ফুটে উঠেছিল যা দেখে রুদ্ধের দম ফা”টা হাসি আসছে। এখন তার মনে হচ্ছে এখন যদি স্নিগ্ধাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করি তাহলে সে নিশ্চয়ই এখনই ফ্লোরে বসে পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বা”চ্চাদের মত কান্না করবে? তাই সে আর কিছু না বলে ওর হাত থেকে শরবতের গ্লাসটা নিয়ে নিলো আর এক ঢোকে তা পান করলো। ক্লান্ত শরীরে শক্তি উৎপন্নের জন্য এক গ্লাস ঠান্ডা লেবুর পানি বেস্ট। এবার সোফা থেকে উঠে দাড়ালো দুই দু দিকে ছড়িয়ে হালকা একটু ব্যায়াম করে নিলো অতঃপর স্নিগ্ধার উদ্দেশ্য বললো-

–আজ সারাদিন প্রচুর কাজ করেছি। তাই খুবই ক্লান্ত আমি। এখন একটু ঘুমোতে যাবো। রাতের খাবারের আগে ডাক দিয়ে দিও। আর হ্যাঁ! আমাকে যেন কেউ ডিসটার্ব না করে এই দায়িত্ব তোমার। যদি কারো কারণে আমার ঘুমের কিঞ্চিৎ পরিমাণও ব্যাঘাত ঘটে তাহলে এর শাস্তি তোমাকে পেতে হবে।

–আশ্চর্য আমি কী এখন আপনাকে পাহারা দিবো নাকি?স্নিগ্ধা কথাটা বিরবির করে বললেও রুদ্ধ তা শুনে ফেললো। আর জবাবে বললো-

–দরকার পড়লে তাই দিবে। এটা বলে সে নিজের রুমের দিকেই যাচ্ছিল তখনই তার পা স্লিপ কা”টে ফলে সে পরে যেতে নেয় কিন্তু তখনি একজোড়া কোমল হাতের মালিক তার দুটো হাত দিয়ে তার কোমড় ধরে ফেলে ফলে সে নিচে পড়ে না। তাই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। কিন্তু পরক্ষণেই তাকে ধরে রাখা হাত দুটোর মালিক কে দেখে সে একটা ঝ”ট”কা খেলো। কেননা সে এখন স্নিগ্ধার বাহুবন্ধনীতে আবদ্ধ। সে অবাক দৃষ্টিতে স্নিগ্ধার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কী হয়ে গেল তার বুঝতে একটু সময় লাগছে। ঠিক তখনি কিছু পড়ার শব্দে তাদের দু’জনের ঘো’র ভাঙলো। তারা সামনে তাকিয়ে দেখলো পরশি আর জয়া দাড়ানো। জয়ার হাতে কিছু ফলমূলের ব্যাগ ছিলো। ব্যাগটি নিচে পড়ার ফলে এর ভিতরের থেকে কিছু ফল বের হয়ে ড্রইং রুমের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে গেল। আর পাশে থাকা পরশির মুখ তো বিষ্ময়ে হা হয়ে গেল আর চোখ কোটর থেকে বের হবে এমন উপক্রম। ওদের এমন অবস্থা দেখে রুদ্ধ আর স্নিগ্ধা নিজেদের দিকে চাইলো, নিজেদের দিকে তাকাতেই হালকা করে একটা ঝ’ট’কা খেলো। তারা তাড়াতাড়ি একে অপরের থেকে দূরে সরে আসলো। এসব দেখে জয়া স্তব্ধ হলেও পরশি মিটিমিটি হাসছে। তার হাসিকে রুদ্ধ এতটা পাত্তা না দিলেও স্নিগ্ধার বেশ লজ্জা লাগছে। স্নিগ্ধার ইতস্ততা দেখে এবার পরশি না পেরে খিলখিল করে হেঁসে দিলো। তার হাসির ঝং’কা’র দেখে রুদ্ধ এবার বেশ বিরক্ত হলো।

–এমন পে”ত্নী”দের মত হাসি দেওয়া বন্ধ কর।

–ওমা! আমার এত সুন্দর হাসিকে তোমার পেত্নীদের মত লাগলো ভাইয়া। দিন দিন তোমার চোখের বিশাল অধপতন ঘটছে। এখন তো ডাক্তার দেখালেও কাজ হবে না। ভাবুকতার ভঙ্গিতে কথাগুলো বললো পরশি।

ওর এমন আজগুবি কথা শুনে রুদ্ধের ভ্রু কুঁচকে গেলো। সে তাকে খানিকটা রাগী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো-
–কেনো?

–কেনো মানে? যে হারে বয়স বাড়ছে, তুমি বুড়ো হচ্ছো, এতে ডাক্তারের করণীয় কী? হ্যাঁ সে অবশ্য তোমাকে চশমা পড়ার কথা বলতে পারে? কিন্তু এখানে আমার একটা আফসোস রয়েই যাবে। বাবা ডাক শুনার বয়সে তোমাকে দাদু ডাক শুনতে হবে, আমি বোন হয়ে সেটা কীভাবে মানি? চেহারায় দুঃখী দুঃখী ভাব এনে জবাব দিলো পরশি।

–তবে রে? এই বলে রুদ্ধ তেড়ে গেল পরশির দিকে আর রুদ্ধকে আসতে দেখে পরশি দিলো এক দৌড়। আর স্নিগ্ধা এসব দেখে হতবাক। কেননা সে যখন থেকে এই বাড়িতে এসেছে তবে থেকে রুদ্ধ আর পরশিকে এতো দুষ্টমি করে কথা বলতে দেখেনি বা এভাবে ঝ’গড়া করতেও দেখেনি। কিন্তু বিষয়টা দেখে ভালো লাগছে। পরশির কাছ থেকে তার অতীত সম্পর্কে শুনেছে সে। বিষয়টা প্রচণ্ড খারাপ লেগেছিল তার।

স্নিগ্ধা এতক্ষণ পর জয়াকে খেয়াল করলো। সে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। জয়াকে নিজের নিকট আসতে দেখে সে বুঝে গেছে সে এখন তাকে ১০ টা ভাষণ কথা আর ৩০ টা ফা”লতু কথা শুনাবে। আর ভালো মুডটা খারাপ করবে। সে নিজেকে প্রস্তুত করছিলো ওর কথা শোনার জন্য কিন্তু তাকে চমকে দিয়ে জয়া এসে তাকে জরিয়ে ধরলো। জয়ার আকস্মিক এমন কাজে সে হতভম্ব।

–আসলে আমি খুবই দুঃখিত আমার করা কর্মকাণ্ডের জন্য। আমার তোমার সাথে এমন করা উচিত হয়নি? আমাকে প্লিজ ক্ষমা করে দাও।

–তুমি ক্ষমা চাচ্ছো কেন? আর কি এমন করেছো যার জন্য তুমি অনুতপ্ত?

এবার জয়া স্নিগ্ধাকে ছেড়ে দিলো। সে একটা মিস্টি হাসি দিয়ে বললো-
–আসলে স্কুলে তুমি ভর্তি হওয়ার পর আমার তোমাকে অপদস্ত করা একদম উচিত হয়নি। কোনো ভদ্র ঘরের মেয়ে এসব করতে পারে না। তোমাকে নিচু করতে যেয়ে আমি নিজেই অনেকের কাছে নিচু হয়ে গেছি। সেজন্য আমি ক্ষমা চাইছি। তাছাড়া পরশি আপু যখন অসুস্থ ছিলো তুমি তাকে কত সাহায্য করেছো। এসব দেখে আমার চিন্তাধারা পরিবর্তন হয়ে গেছে। তাই আমি খুব অনুতপ্ত। আমি আশা করি তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিবে।

স্নিগ্ধার মন জয়াকে বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না। কিন্তু তার বাবার বলা একটা কথা স্মরণ হলো তার কেউ যদি মন থেকে অনুতপ্ত হয়ে তোমার কাছে ক্ষমা চায় তোমার তাকে ক্ষমা করে দেওয়া উচিত। সুযোগ একবার হলেও সবাইকে দেওয়া উচিত। এই কথা ভেবে সে জয়াকে ক্ষমা করে দিলো। এতে জয়া খুশি হয়ে তার নিকট বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলো। স্নিগ্ধাও অতশত না ভেবে রাজি হয়ে গেল।

–উফফ! ভাইয়া! থামো! আর দৌড়াতে পারছি না। এই বলে পরশি হাঁপাতে লাগলো। আজ কতদিন পর যে এমন দৌড় কে জানে? যতটুকু মনে আছে শেষবার দৌড়ে ছিলো স্কুলের বার্ষিক ক্রিয়া প্রতিযোগিতায়।

–এতটুকুতেই তোর হাওয়া শেষ আর আমাকে বু’ড়ো বলছিস। আসলে তুই নিজেই বু”ড়ি।

–এখন কী বাসায় ৩য় বিশ্ব যু”দ্ধ করতে চাও?

–আমি পা”গ’ল নাকি তোর সাথে ল”ড়া’ই করে নিজের বাসা ধ্বংস করবো?

— ঠিক আছে! থাকবো না তোমার বাসায় এখনই স্নিগ্ধাকে নিয়ে বেড়িয়ে যাবো।

–তুই যাবি যা। ওকে কেনো টা’ন’ছি’স?

–আজব আমি আবার ওকে কোথায় টানলাম? স্নিগ্ধা যেহেতু আমার সাথে এ বাসায় এসেছে আমি চলে গেলে স্নিগ্ধাও আমার সাথে যাবে? ভাবলেশহীন কণ্ঠে বললো পরশি। পরশি এবার আড়চোখে রুদ্ধকে পরখ করছিল। তার বেচারা ভাইয়ের এতক্ষণ উজ্জ্বল করতে থাকা চেহারাটা নিমেষে আঁধারে ডুবে গেল। তাকে আরেকটু জ্বা”লা’নো’র জন্য বললো-

— তাছাড়া এখন না গেলেও একদিন না একদিন তো তাকে যেতেই হবে।

পরশির এই কথাটা শুনে রুদ্ধের ভ্রু খানিকটা কুঁচকে এলো। সে গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো-
–কোথায় যাবে ও? যতটুকু আমি জানি ওর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।

–আরে এখন নেই, তাই বলে কী ভবিষ্যতে ও থাকবে না এমন তো নয়। ওকে তো বিয়ে দেওয়ার দ্বায়িত্ব কিন্তু আমাদের। স্নিগ্ধারও তো ইচ্ছে করে নিজের বাড়ি থাকবে, সংসার থাকবে, যেখান থেকে কেউ তাকে তাড়াতে পারবে না। তাছাড়া আমাদের বাড়িতে আর কত কাল আশ্রিতা হয়ে থাকবে?

পরশির এসব কথাশুনে রুদ্ধের যথেষ্ট রাগ হলো। এক হাত মুষ্টি বন্ধ হয়ে গেল এবং চোখ বন্ধ করে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে লাগলো। পরশি রুদ্ধকে আরেকটু জ্বালানোর জন্য বললো-
–জানো ভাইয়া সেদিন পা”র্টি’তে স্নিগ্ধাকে একটা ছেলে পছন্দ করেছে, মামনি আমাকে এই কথা বলেছিল। ছেলে দেখতে শুনতেও ভালো ছিলো আর তার পরিবারের অবস্থা ও ব্যবহার খুবই সুন্দর ছিলো। আমি তাদের সাথে সেদিন কথা বলেছিলাম। তখনি মামনি এসব বলে আমাকে। জানো ভাই আমার কত ইচ্ছে ছিলো সারাজীবনের জন্য আমাদের কাছে রেখে দেওয়ার, আজ যদি আমার আরেকটা ভাই থাকতো তাহলে হয়তো ওকে রাখতে পারতাম।

পরশির কথা শুনে রুদ্ধের চোখ দুটি ছোট ছোট হয়ে যায়।
–ওকে এখানে রাখার জন্য তর আরেকটা ভাইয়ের কেনো দরকার?

–আরে আমার যদি আরেকটা ভাই থাকতো তাহলে তার সাথে স্নিগ্ধার বিয়ে দিয়ে তাকে এই বাসায় রাখা যেত? অবশ্য এখনো রাখা যেতে পারে যদি তুমি ওকে বিয়ে করো? কিন্তু সে কী তুমি করবে? সারাজীবন তো চিরকুমার থাকার প্লান আছে তোমার।তাই ভাবছি মামনির সাথে কথা বলবো স্নিগ্ধা আর ঐ ছেলের বিয়ে নিয়ে।

–এই থাম! তোকে কে বলেছে আমার চিরকুমার থাকার প্লান আছে। আমি বিয়ে করবো। আর তুই যদি এত করে চাস স্নিগ্ধা তোর ভাবি হয় তাহলে তাই হবে। কোনো ছেলেপেলের সাথে কথা বলার দরকার নেই। আর আমি এতটাও অকর্মা নই যে নিজের বোনের এতটুকু ইচ্ছা পূরণ করতে পারবো না। কিছুটা আমতাআমতা করে বললো রুদ্ধ। রুদ্ধের অবস্থা দেখে পরশির খুব হাসি পাচ্ছে।

–কিন্তু ভাই তোমার রাজি হলে তো খালি হবে না। স্নিগ্ধার ও রাজি হতে হবে? ও রাজি নাহলে আমার ইচ্ছে পূরণ হবে কীভাবে?

–কেনো! ও রাজি কেনো হবে না? আমি কী ছেলে খারাপ নাকি আমার মাঝে কিছুর কমতি আছে?

–ব্যাপারটা তা নয়। আসলে মেয়েদের কিছু স্বপ্ন থাকে তাদের স্বপ্ন পুরুষ নিয়ে। তারা চায় তার জীবন সঙ্গী তাকে স্পেশাল ফিল করাক, তার ছোট ছোট ইচ্ছা গুলো পূরণ করুক, সে যখন রাগ করবে তার রাগ ভাঙাবে ইত্যাদি। স্নিগ্ধার ও অবশ্যই কিছু এক্সপেকটেশন তার জীবন সঙ্গী নিয়ে? তাছাড়া তুমি কখনো ওর সাথে ভালোভাবে কথা বলোনি, সবসময় ধমকের উপর রেখেছো তাই তোমার চান্সটা খুবই কম। পরশির কথা শুনে এখন রুদ্ধও ভাবনায় পড়ে গেল। আজ জীবনে প্রথমবার নিজের করা কাজের জন্য নিজের উপর রাগ হচ্ছে। যে বলেছে ঠিকই বলেছে-

“ভাবিয়া করিও কাজ,
করিয়া ভাবিও না।”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here