ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু পর্ব_২৩

0
990

ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু
পর্ব_২৩
#সুলতানা_সিমা

আজ দিহান ও অরিন শান্তি নীড় যাবে। শায়লা চৌধুরী অনেকবার বলেছেন আরো একটা দিন থেকে একটু সুস্থ হয়ে যেতে কিন্তু দিহান থাকবেনা। তাকে আবার কানাডা ব্যাক করতে হবে। হাতে মাত্র তিনদিন সময়৷ এই তিনদিনের ভেতর সবকিছু ম্যানেজ করতে হবে। এখানে থাকলে চলবে না। রাতে অরিন শাঞ্জুর রুমে ঘুমিয়ে গেছিলো। তাকে আর জাগানো হয়নি। শাওন আর দিহান জাগাতে নিষেধ করলো। শাওন দিহানকে অনেক কেয়ার করেছে। দিহানের ক্ষত জায়গায় মলম লাগানো অষুধ খাওয়ানো সব করেছে।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই দিহান একবার গিয়ে অরিনকে দেখে আসলো। সে এখনই কান্না করে যাচ্ছে। দিহানকে দেখে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছে। কাঁদবেই বা না কেন? জীবনে কি পেলো মেয়েটা? সব সময় শুধু লাঞ্চিত অপমানিত হয়েছে। ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শাওনের রুমে পা বাড়ালো দিহান। শাওনকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে সে। শাওনের চোখে সে কিছু একটা দেখতে পেয়েছে। রাতে শাওনের ফ্যাসফ্যাসে কান্নার শব্দ শুনা গেছে। একবার উঠে গিয়ে বারান্দায় কার সাথে ফোনে কথা বলে হাউমাউ করে কেঁদেছে। দিহান সব দেখেও চুপ থেকে সকালের অপেক্ষা করেছে। তাই জানতে যাচ্ছে তাঁর মাথায় ঘুরপাক খাওয়া প্রশ্নগুলার উত্তর কি। রুমে এসে দেখলো শাওন খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। দিহান শাওনের পাশে বসে বলল,

“কি রে শুয়ে আছিস কেন? শরীর খারাপ?” দিহানের গলা কানে আসতেই চট করে চোখের পানিটা মুছে উঠে বসলো শাওন। চোখ মুছলেও চোখের কোণে একটু পানি রয়ে গেছে। দিহান কপাল কুঁচকে তাকাল। হাত বাড়িয়ে এক আঙুলে পানিটা মুছে বলল,”কেঁদেছিলি?
_না না কাঁদবো কেন? আমার চোখ দিয়ে মাঝে মাঝে পানি পড়ে। চোখে একটু সমস্যা আছে রে।” দিহান শাওনের হাতের উপর নিজের হাতটা রাখলো। তারপর বলল,”রাতে কাঁদলি কেন শাওন?” দিহানের প্রশ্নে যেন শাওন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। হা হয়ে তাকালো দিহানের দিকে। সে কি বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। দিহান তাঁর কান্না শুনেছে? সে তো শুধু নিরবে কেঁদেছিলো। দিহান আবার বলল,”বল কাঁদলি কেন?”
_দূ দূ দূর কাঁ কাঁদবো কেন?
_আমার পাশের বালিশে শুয়ে কেউ কাঁদবে আর আমি বুঝবো না? কোথাও এমনটা নয়তো শাওন তুই অরিনকে ভালোবাসতি? আমি কাল দেখেছি শাওন তুই অরিনকে দেখে কতটা কেঁদেছিলি। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তোর মনে অরিনকে নিয়ে কিছু একটা আছে।
_আরে না কি থাকবে?
_কিছু যখন নেই তাহলে ওকে দেখে তোর চোখ ছলছল হয় কেন? শাওন কি লুকাচ্ছিস বল? তোর চোখের ভাষা আমাকে কিছু বলে দিচ্ছে।”দিহানের কথায় শাওন অনেক বড় ধাক্কা খেলো৷ তাহলে কি দিহান জেনে গেছে অরিনকে সে ভালোবাসে? এখন দিহান অরিনকে ভুল বুঝবে নাতো? না না অরিনের আর দিহানের মাঝে অশান্তি আনা যাবেনা। শাওন জোরপূর্বক হেসে দিহানকে বলল,”
_দূ দূর আসলে তে তেমন কিছু না। অরিন তো আমার বো বো বোনের মতো। দেখিস না ও আমায় ভাইয়া ডাকে। আমি তাকে ভালোবাসলে কি ভাইয়া ডাকতে বলতাম? আর অরিনকে দেখলে না আমার খারাপ লাগে। ওর সাথে কখনো ভালো হয়না। কিভাবে মারলো ওরা ওকে দেখ।” দিহান বলল,”তাহলে কাল রাতে কাঁদলি কেন?”
_আব,,,,মানে। না মানে,,,,””শাওন কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। দিহান তাকে সন্দেহ করছে। অরিনকে নিয়ে ভয় হচ্ছে শাওনের। দিহান অরিনকে ভুল বুঝলে তো অরিন একেবারেই অসহায় হয়ে যাবে। দিহান আবার জানতে চাইলো কেন কেঁদেছে। শাওন ম্লান হেসে বলল,”
_ আমার জিএফ না রাগ করেছে তাই কেঁদেছি।
দিহান ভ্রুযুগল কুঁচকে প্রশ্ন ছুঁড়লো,”
_তোর জিএফ? তুই প্রেম করিস?
_আব,,,হ্যাঁ। ক করি তো। নীল জানে বিশ্বাস না হলে নীলকে জিজ্ঞেস করে নিস।
_নীল জানে আর আমি জানিনা? মানে নীলকে বললি আর আমাকে বললি না? মিথ্যে বলছিস তাইনা?
_আরে না না মিথ্যে না। আসলে নীল জেনে গেছিলো। আমি ওকে বলিনি।
_তো নীল আমাকে বলল না কেন?
_না মানে,,,, না মানে হলো গিয়ে,,,,আসলে মেয়েটা দিশা তো তাই তোকে বলিনি।” দিহান সম্মতিসূচক মাথা নাড়াতে নাড়াতে কি যেন ভাবলো। কিন্তু সেকেন্ডের ভিতর তাঁর মুখটা হা হয়ে গেলো। চোখ বড় বড় করে শাওনের দিকে তাকিয়ে বলল,”কিইইইইইই? দি দি দিশা মানে? দি দিশার সাথে তুই প্রেম করিস?” শাওন শুকনো একটা ঢোক গিললো। সে বলতে চেয়েছিলো তাদের ফ্রেন্ডসার্কেলের একটা মেয়ের নাম কিন্তু তাঁর অজান্তেই মুখ থেকে দিশার নাম বেরিয়ে গেছে। জিভে কামড় দিয়ে চোখ খিঁচে বসে থাকে শাওন। দিহান চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। দিহান গলাটা একটু ঝেড়ে বলে,”আর কে কে জানে তোদের ইটিসপিটিসের কথা?
_ইশি লুপা নীল জানে। দিশাও জানে।
_দিশার সাথে যখন চলছে দিশা তো জানবেই তাইনা?” শাওন কিছু বলল না। শুধু আহাম্মকের মতো বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হি হি হি করে হাসলো। দিহান বলল,”এতোগুলা মানুষ জানে অথচ আমাকে কেউ জানানোর প্রয়োজনও মনে করলো না?
_আসলে প্রথম প্রেম তো তাই ভুল হয়ে গেছে। দ্বিতীয়বার যখন করবো তোকে সবার আগে জানাবো।
_তুই আমার সামনে বসে,দিশাকে রেখে আরেকটা মেয়ের সাথে প্রেম করবি বলছিস?” শাওন আবারও জিভ কাটলো। দিহান কুত্তা বলে শাওনের মাথায় চাপড় মারলো। তারপর বলল,”আচ্ছা শুন। আমার সাথে তোকে যেতে হবে রে।
_আমি কেন যাবো? তোরা যা না।
_তোকে খুব প্রয়োজন শাওন। অরিনকে নিয়ে যাওয়ার পর জানিনা বাড়ির লোক কেমন রিয়েক্ট করবে। তুই থাকলে সবাইকে বুঝিয়ে বলতে পারবি।” শাওন আর কথা বাড়ালো না। সে রাজি হয়ে গেলো। দিহান সত্যি বলেছে হঠাৎ এভাবে তাঁদের দেখলে সবাই রাগ করতে পারে। তাছাড়া শান্তি চৌধুরী জানেন অরিনকে শাওন ভালোবাসে। উনাকেও তো বুঝাতে হবে।

দুপুরে খেয়ে শাওন গ্রেজে গিয়ে দিহানের গাড়ি নিয়ে আসলো। শায়লা বেগম একটা লাল রংয়ের কাতান শাড়ী এনে দিলেন অরিনকে। শাড়ীটা শাওন এনেছে। অরিন শাড়ীটা পড়ে রেডি হয়ে গেলো। দিহান অনেক আগে থেকেই রেডি হয়ে আছে। শায়লা বেগম বার বার দিহানকে বলছেন একটা দিন থেকে যেতে কিন্তু দিহান শুনছে না।

জহুরা বেগমকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে অরিন। অরিনের কান্না দেখে দিহানের বুকটা ফেটে যাচ্ছে। শায়লা বেগম অরিনকে বললেন,”অরিন গাড়িতে উঠো দেরী হয়ে যাচ্ছে।” অরিন কান্না থামিয়ে শায়লা বেগমের দুটো হাত ধরে বলল,”মাকে একটু দেখে রাখবেন চাচি। পারলে আপনার সাথে রাখবেন।” শায়লা চৌধুরী কিছু বললেন না। অরিনের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে বললেন, “যাও গাড়িতে উঠো।” দিহান অরিনকে ধরে নিয়ে গাড়িতে উঠলো। শাওন ড্রাইভিং সিটে বসলো। অরিন দিহান পিছনে। সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো শাওন।

শায়লা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখের পানিটা মুছলেন। ভয় হচ্ছে বাড়ির লোকদের চিন্তা করে। না জানি এসব দেখে উনার মা আবার অসুস্থ হয়ে যান কিনা। ভিতরে যেতে গিয়ে পা বাড়িয়ে আবার পা থামিয়ে দিলেন তিনি। জহুরা বেগম গাড়ির দিকে তাকিয়ে আছেন। শায়লা বেগম তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, “এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাব না ধরে বাড়িতে যাও। যত্তসব।” বলতে বলতে পা বাড়ালেন ভিতরের দিকে। দিহানের সাথে অরিনের মতো একটা বিধবা লো ক্লাস মেয়েকে মেনে নিতে পারছেন না তিনি৷ কিন্তু কি করার দিহানের দিকে তাকিয়ে তো চুপ থাকতেই হবে।

______________________________

সকাল নয়টা বাজে। শান্তি নীড়ে এসে গাড়ি থামলো দিহানের। গাড়িতে বসা দুটো মানুষের ভিতরে ভয় কাজ করছে না জানি কে কেমন রিয়েক্ট করবে এটা ভেবে। শাওন গাড়ি থেকে নেমে দিহানকে নামতে বলল। অরিন দিহানের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। অরিনের ঘুমন্ত মুখটাও বিষন্ন। দিহানের কলিজা মুচড় দিয়ে উঠলো। কপালে চুমু এঁকে দিয়ে অরিনকে জাগালো। গাড়ির বাইরে থেকে ভিতরের এই দৃশ্যটা দেখে শাওনের দম বন্ধ হয়ে আসছে। সে চোখ ফিরিয়ে নিলো। দিহান নেমে বাড়ির দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। শাওন দিহানের বাহু ধরে বলল,”দিহান কিছুতেই যেন বাড়ির কেউ না জানে তোদের বিয়ের পেছনে এতো ঝামেলা হয়েছে। নয়তো সবাই অরিনকে খারাপ উপাধি দিবে। প্রথমবার তোদের বিয়েটা যেভাবে হয়েছে সেভাবেই বলবি। আর তোদের মুখের দাগ গুলা দেখে যদি কিছু জিজ্ঞেস করে বলবি এক্সিডেন্ট হয়েছিলো।” দিহান হেসে শাওনকে জড়িয়ে ধরে বলে,”তুই আমার ভাই রে।” শাওন দিহানকে ছেড়ে বলল,”হুম ভাই তো এবার চল।” দিহান অদিনকে গাড়ি থেকে বের করলো। অরিন গাড়ি থেকে নেমে অবাক হয়ে চারদিকে তাকালো। এতো বড় বাড়ি? এটা তো একটা প্রাসাদ। এই বাড়ির ছেলে দিহান? অরিনের মন খারাপ হয়ে গেলো। তাঁর মতো একটা মেয়েকে এই বাড়িতে মেনে নিবে তো? প্রশ্নটা মনে উঁকি দিতেই বুকটা ধুক করে উঠলো তাঁর। দিহান অরিনের হাত ধরে বলল,”চলো।” অরিন দিহানের সাথে পা বাড়ালো।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দিহান ঘামতে লাগলো। তাঁর কেন জানি ভয় হচ্ছে খুব। ভয়টা অরিনকে নিয়ে। কেউ যদি কিছু বলে ফেলে আর অরিন কষ্ট পায়? শাওন কলিংবেল বাজালো। এখন নিশ্চয়ই সবাই ব্রেকফাস্ট করছে। তারমানে সবাই এখন এক সাথেই আছে। শাওন আরেকবার কলিংবেল বাজালো।

ইশি পরোটা এক টুকরো ছিঁড়ে মুখে ঢুকাতে ঢুকাতে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। শাওনকে দেখে আনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠে বলল,”শাওন ভাইইইই তুইইই?” কথাটা বলার সাথে সাথে ইশির হাসি উধাও হয়ে গেলো। এ কাকে দেখছে সে? মাথা নিচু করে অরিন দাঁড়িয়ে আছে আর তাঁর হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে দিহান। ইশি পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকালো। তাঁর চোখে মুখে বিস্ময়।

টেবিলের সবাই ইশির দিকে তাকিয়ে আছে। শাওন এসেছে বলে চিৎকার দিলো অথচ শাওন এখনো ভিতরে আসছে না। ইশির কোনো সাড়াশব্দ নাই দেখে দিশা উঠে গেলো। ইশির মতো দিশাও একটা ঝাটকা খেলো। লাল শাড়ি গায়ে অরিন। তাঁর হাত ধরে তাঁর পাশে দাঁড়ানো দিহান। এই দৃশ্যটা দেখে কিছুই বুঝতে বাকি নেই দিশার। তবুও শাওনকে জিজ্ঞেস করলো,”শাওন ভাই এটা অরিন না? ও এখানে তাও তোমাদের সাথে?”
_দিশা,দিহান আর অরিন বিয়ে করেছে।” শাওনের কথায় ইশি আর দিশার মাথায় বাজ পড়লো। দিহান বিয়ে করেছে তাও পালিয়ে? দিশা দুপা পিছিয়ে গিয়ে বলল,”ভাইয়া তুই বিয়ে করেছিস?” দিশার কথা টেবিল পর্যন্ত আসে। টেবিলের সবাই ৪৪০ ভোল্টের শকড খেলো। শুধু শান্তি চৌধুরী মৃদু হাসলেন। উনি তো আগে থেকেই জানতেন দিহান বিয়ে করেছে। শুধু জানতেন না দিহানের বউটা কে বা দেখতে কেমন। আজ তাহলে দেখবেন তিনি। একে একে টেবিল থেকে সবাই উঠে গেলো শান্তি চৌধুরীও উঠে গেলেন।

সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। অরিন দিহানের থেকে হাত ছাড়াতে চাইছে কিন্তু দিহান ছাড়ছেই না। সে আরো শক্ত করে ধরছে। অরিনের ভয় হচ্ছে খুব। মনে হচ্ছে এই বুঝি কোনো ঝড় চলে এলো। শান্তি চৌধুরী ভারি নিঃশ্বাস ফেলছেন। এতো বড় শকড উনি নিতে পারছেন। শাওন জিভ দিয়ে তাঁর শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁটটা ভিজিয়ে বলল,”নানুমনি ওদের ভিতরে ঢুকাবে না?
শান্তি চৌধুরী অবাক চোখে শাওনের দিকে তাকালেন। শাওন কাতর চোখে উনার দিকে তাকালো। শাওনের কাতর চোখ দুটো শান্তি চৌধুরীর বুকটা পুড়িয়ে শেষ করে দিচ্ছে। তিনি তীক্ষ্ণ চোখে অরিনের দিকে তাকালেন। অরিনের মুখটা দেখে রাগে উনার শরীর রি রি করে উঠলো। কাল রাতে শাওন ফোন করে হাউমাউ করে কেঁদেছে কিছুই বলেনি কেন কাঁদছে সেটাও বলেনি। শুধু একবার বলেছে “জীবন এতো কষ্টের কেন নানুমনি?” উনি ভেবেছিলেন অরিনের সাথে মনমালিন্যতা চলছে তাই তিনি শাওনকে কান্না থামাতে বলেছিলেন। আর অরিন কিনা শাওনকে ছেড়ে দিয়ে দিহানের হাত ধরেছে? উনার দু দুটা নাতির জীবন নিয়ে খেলছে অরিন? শাওন তাঁর নানুমনির মনের চলা ঝড়টা অনুভব করতে পারলো। উনাকে না বুঝালে উনি কিছুই বলবেন না। আর উনি কিছু না বললে শান্তি নীড়ের কেউ কিচ্ছুটি বলবে না। শাওন বলল,”ওদের বিয়েটা একটা এক্সিডেন্টে হয়ে গেছে নানুমনি। আসলে,,,,,,শাওন আর কিছু বলতে পারলো না। শান্তি চৌধুরী হাত বাড়িয়ে শাওনকে থামিয়ে দিলেন। গম্ভীর গলায় সুমনা চৌধুরীকে বললেন,”বউমা।
_জ্বি আম্মা।
_ওদের ঘরে তুলো।”শাওন কাতর গলায় বলল,”নানুমনি তুমি ঘরে তুলো না।
_যার বউ সে ঘরে তুলবে আমি কেন ঘরে তুলবো?” শান্তি চৌধুরীর কণ্ঠ কর্কশ। উনার চোখের দৃষ্টি কঠিন। উনার এমন কঠোরতা দেখে দিহানের চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এলো। অসহায় চোখে শান্তি চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে ভেজা গলায় উচ্চারণ করলো,”দাদুমনি।”

দিহানের ভেজা গলার দাদুমনি ডাকে শান্তি চৌধুরীর কলিজায় গিয়ে বিষাক্ত তীর ঢুকলো। বিষে বিষে ভরিয়ে দিলো উনার প্রতিটি শিরা। কঠিন চোখ দুটো শীতল হয়ে এলো। এই একটা সমস্যা উনার। উনি উনার নাতি নাতনির মলিন মুখ কান্নাভেজা চোখ দেখতে পারেন না। চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা দম ছাড়লেন তিনি। দিহানের জন্য হলেও অরিনকে মেনে নিতে হবে। কিন্তু অরিনকে শাস্তি তিনি ঠিকই দিবেন। শাওনকে ধোঁকা দেওয়ার শাস্তি। চোখটা খুলে মোলায়েম গলায় বললেন “আয় বউ নিয়ে ঘরে আয়।” দিহান অরিনকে নিয়ে ঘরের ভিতর পা রাখলো। দিহান অরিনের দিকে কিঞ্চিৎ ঝুঁকে সালাম করতে বলল। অরিন শান্তি চৌধুরীকে সালাম করলো। শাওন এসে হানিফ চৌধুরী ও সুমনা চৌধুরীকে দেখিয়ে বলল,”দিহানের বাবা মা।” অরিন হানিফকে সালাম করলো। হানিফ চৌধুরী কিছু বললেন না। হাত পিছনে বেঁধে দাঁড়িয়ে আছেন। উনার কপাল কুঁচকে আছে। মুখে বিরক্তির চাপ। মনের মধ্যে অনেক কথা আসছে বলার জন্য কিন্তু এই পরিবারের কেউ শান্তি চৌধুরীর কথার উপর কথা বলেনা। তাই চুপ আছেন তিনি। নয়তো এই মূহুর্তে এই মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করে দিতেন। আদৌ কী এই মেয়ে দিহানের যোগ্য? রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে উনার। অরিন উঠে গিয়ে সুমনা চৌধুরীকে সালাম করতে গেলে উনি অরিনকে ধরে উঠালেন। অরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদু হেসে বললেন,”পায়ে ধরে সালাম করতে নেই মা। মুখে সালাম দিও।” দিহান স্বস্থির নিঃশ্বাস ছাড়লো। যাক তাঁর মা তো অরিনের সাথে মিষ্টি ভাষায় কথা বলছেন। একে একে সবার সাথে পরিচয় করানো হলো অরিনকে। দিহানের বড় চাচ্চুর মুখটা অন্ধকার। উনি যে শুধু উনার মায়ের জন্য মনের বোমটা ফাটাতে পারছেন না তা বুঝাই যাচ্ছে। শাওন দিহানকে বললো,”তুই অরিনকে নিয়ে উপরে যা রেষ্ট নে। আমি নানুমনির সাথে কিছু কথা বলবো।” শাওন শান্তি চৌধুরীকে নিয়ে উনার রুমে চলে গেলো৷ দিহান অরিনকে নিয়ে তাঁর রুমে। সবাই ভিতরে ভিতরে রাগে ফোঁস ফোঁস করছে। এতোবেশি রাগ হচ্ছে যে রাগে ওদের চোখেই পড়েনি দিহানের কপালে মারের দাগ। ওরা চলে যাওয়ার পরে দিলারা চৌধুরী বললেন,

“দিহান রুচি দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না। এটা কি বিয়ে করে আনছে সে? এই মেয়ে তো শ্যামলা। আর দিহান দেখো কতো সুন্দর একটা ছেলে। এই মেয়ের সাথে তাঁর যায়?” ইশি তাঁর মাকে ধমক দিয়ে বলল,”আম্মু অন্যদের নিয়ে নিন্দা করা বন্ধ করো।”হানিফ চৌধুরী ইশিকে ধমক দিয়ে বললেন,”এই চুপ। পাকনামি না করে সর এখান থেকে।” ইশি চলে গেলো উপরে। তাঁর পরিবারের এতো অহংকার তাঁর ভালো লাগেনা।

ডিনার টেবিলে বসে আছে ইশি দিশা লুপা। তাঁরা একটা বিষয় অনেক্ষণ থেকে চিন্তা করছে, দিহান আর অরিন কি এমন এক্সিডেন্টে বিয়ে করলো। কি এমন হয়েছিলো যে তাঁদের বিয়ে হলো। শান্তি চৌধুরী প্রশ্ন করেন নি দেখে কেউ প্রশ্ন করেনি। কিন্তু সবার মাথায় প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে। কি হয়েছিলো যে তাঁদের বিয়েই কর‍তে হলো। আচ্ছা আসলেই কি তাঁরা সত্যি বলছে? সবাই গালে হাত দিয়ে এগুলা ভেবে যাচ্ছে। হঠাৎ লুপা বলল,”আমি মনে হয় ধরতে পেরেছি আসল সত্যিটা কি।” দিশা ইশি বিচলিত হয়ে বলল,”বল বল বল কি সত্যি।” লুপা কিছু বলার আগেই একে একে সবাই এসে টেবিলে হাজির হয়ে গেলো। লুপা ইশারায় বলল পরে বলবে। শান্তি চৌধুরী অরিনকে সাথে নিয়ে এসে নামলেন। উনার পিছু পিছু দিহান আর শাওন। দুজন এমন ভাবে হেসে হেসে কথা বলে নামছে যেন কিছুই হয়নি। হানিফ, আর হারুন চৌধুরী বাসায় নেই কাজ আছে বলে বেরিয়েছেন। যতই কাজ বলে বের হোন না কেন বাড়ির সবাই ঠিকই আন্দাজ করছে উনারা রাগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছেন। কেননা কাজ হলে লুপার বাবাও যেতেন। কিন্তু উনি বাসাতেই আছেন। বাড়ির অনেকেই ভেতরে ভেতরে রেগে ফেটে যাচ্ছে কিন্তু স্বাভাবিক ভাবে চলছে কারণ শান্তি চৌধুরী স্বাভাবিক। দিহান শাওন পাশাপাশি বসলো। শাওনের এক পাশে রুহান আর দিহানের পাশে অরিন। শাওন আর দিশা সোজাসোজি বসেছে। অরিন মাথা নিচু করে বসে আছে। এখন তাঁর উচিত সে সবাইকে সার্ভ করে দিবে কিন্তু সে খুব নার্ভাস ফিল করছে। এই পরিবেশের সাথে সে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছে না। দিহান অরিনের একটা হাত ধরলো। কিছুটা মুখ নামিয়ে চাপা গলায় বলল,”বউপাখি কাঁপছো কেন?” অরিন আগের মতোই থাকলো৷ দিহানের থেকে হাত ছাড়াতে চাইলো। দিহান ডান হাত ছেড়ে বা হাত ধরে রাখলো। লুপা বসা থেকে উঠে অরিনকে সার্ভ করে দিয়ে বলল,”ভাবি আজ তোমাকে তুলে দিলাম কাল থেকে কিন্তু আমাদের তুমি তুলে খাওয়াবে।” লুপা এসে নিজের চেয়ারে বসলো। দিহান চারিদিকে তাকিয়ে বলল,”মিহানকে দেখা যাচ্ছেনা যে?” শান্তি চৌধুরী বললেন,”ও নীলকে কান ধরে আনতে গেছে। কিন্তু মিহান দুদিন না থাকলে নাকি সে আসবে না। বলছে দু’দিন থাকলে আসবে। তাই থেকে গেছে৷” দিহানকে কথাটা বলে অরিনের দিকে তাকিয়ে দেখলেন অরিন ভাতে হাত দিয়ে বসে আছে। শান্তি চৌধুরী বললেন, “আরে অরিন খাচ্ছো না কেন।” অরিন ম্লান হেসে খেতে লাগলো। শান্তি চৌধুরী খেতে খেতে বললেন,”দিশা আর ইশি কাল শপিংয়ে যাবি। আমি একটা লিষ্ট করে দিবো ওগুলা কিনে আনবি।” ইশি বলল,”দাদুমনি আমি যেতে পারবো না আমার সময় নেই। লুপা তুই যাস দিশার সাথে।
_কাল আমার ক্লাস আছে আমি যেতে পারবো না। দিয়া তুই যা আপুর সাথে।
_আমি কাল স্কুলে যাবো।” শান্তি চৌধুরী বিস্মিত হয়ে বললেন,”তাহলে তোরা কেউ যেতে পারবি না? আমি এতোগুলা জিনিস আনতে পাঠাবো ও একা নিয়ে আসবে কি করে?” দিহান বলল,”
_আরে দাদুমনি এতো চিন্তা কিসের? আমাদের জামা,,,,মানে আমাদের শাওন আছে তো। শাওন ওকে নিয়ে যাবে। কিরে যাবি না।” বলেই শাওনের দিকে একটা চোখ মারলো। শাওন দিহানের দিকে তাকিয়ে আহাম্মকের মতো হেহেহে করে হাসছে। দিহান যে জামাই বলেই ফেলছিলো তা বুঝতে বাকি নেই শাওনের। শান্তি চৌধুরী বললেন,”কিন্তু দিশা কি শাওনের সাথে যাবে?” দিহান বলল,”যাবেনা কেন একশোবার যাবে। তাইনা দিশা?” বলেই দিশার দিকে তাকিয়ে একটা চোখ মারলো। দিশা ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। দিহান শাওনের দিকে তাকিয়ে আরেকবার চোখ মারলো শাওনও দিহানকে চোখ মারলো। লুপা বলল,”তাহলে তো হলোই দাদুমনি। তোমার যা যা লাগবে লিষ্ট করে দিও দিশা আপু আর শাওন ভাইয়া তোমার জিনিস গুলা ভালোবেসে এনে দিবে।” দিহান বলল,”হ্যাঁ হ্যাঁ ভালোবেসে এনে দিবে।” বলেই লুপার দিকে তাকিয়ে একটা চোখ মারলো। ইশি দিশাকে বাহু ধরে টেনে এনে চাপা গলায় বলল,”এই দিহান এতো চোখ মারছে কেন? এরা কোনো প্ল্যান করছে না তো?
_কি জানি আমার তো তাই মনে হচ্ছে। মনে হয় এরা কোনো সারপ্রাইজ প্ল্যান করছে আম্মুদের জন্য বলতে পারছে না।
_ঠিক বলেছিস।” দিহান দিশাকে বলল,”কি রে এখন থেকে কি কি করবি প্ল্যান করছিস নাকি?” বলেই আরেকবার চোখ মারলো। দিশা হেহেহেহে করে হেসে বলল,”হ্যাঁ ভাইয়া। আমরা তো সব জানি শাওন ভাই আমাদের বলে দিয়েছে।” বলেই দিশা দিহানকে চোখ মারলো। দিহান শাওনের দিকে রাগি লুকে তাকালো। শাওনের কানে চাপা গলায় বলল,”তুই না আমাকে নিষেধ করলি সব জানাতে তাহলে তুই দিশাকে বলে দিলি কেন?
_আমি ওই রাক্ষসীকে বলতে যাবো কেন?” ইশি ধমক দিয়ে বলল,”
_ওই কি কানাকানি করছিস তোরা?” দিহান জোরপূর্বক হেসে বলল,”ওই তো এখন থেকে এক্সাইটেড হয়ে আছে।” বলেই ইশিকে মারলো। ইশি অহ আচ্ছা বলে দিহানকে চোখ মারলো।

চলবে,,,,,,।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here