ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু পর্ব_২২

0
1034

ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু
পর্ব_২২
#সুলতানা_সিমা

সেলিনা বেগমের বাড়িতে পা রাখতেই শাওনের কানে এলো অরিনের চিৎকার। উঠুনে অনেকগুলা মানুষ আছে। সবাই কিসব বলাবলি করছে। গাছের সাথে কাউকে বেঁধে রাখা দেখা যাচ্ছে তার মুখ দেখা যাচ্ছেনা। লাইট গুলা সব নিচের দিকে। শুধু হাঁটু গেড়ে কেউ আছে বুঝা যাচ্ছে। অরিন আবার চিৎকার দিয়ে উঠলো। শাওন দৌড়ে অরিনের ঘরে গেলো। তানিয়া খুব বাজে ভাষায় অরিনকে গালি দিচ্ছে আর তাকে চুল ধরে টেনে মারছে। ঘরে অরিন তানিয়া ছাড়া কেউ নেই। শাওন তেড়ে গিয়ে তানিয়ার গলা টিপে ধরলো। আকস্মিক ঘটনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা তানিয়া। শাওন তানিয়াকে টেবিলের চেপে ধরলো। এভাবে টেবিলে চিৎ হয়ে তাকায় তানিয়া নড়তে পারছেনা। অরিন শাওনকে আটকানোর জন্য উঠতে চাইলো। দাঁড়িয়েই সাথে সাথে হাঁটু ভেঙে পড়ে গেলো। তলপেটের অসয্য ব্যথা তার দুনিয়া উলট পালট করে দিচ্ছে। অরিন খাটে ভর দিয়ে দাঁড়ালো। দু পা এগিয়ে শাওনকে ধরে তানিয়ার থেকে ছাড়াতে চাইলো। কিন্তু তাঁর দূর্বল শরীর শাওনকে এক আঙুলও নাড়াতে পারছে না। শাওনের রক্তিম চোখ দিয়ে আগুনের গোলা বের হচ্ছে। অরিনের গায়ে একটা ফুলের টোকাও সে ভাবতে পারেনা। আর এই মেয়েটা কিনা অরিনকে একের পর এক আঘাত করে গেছিলো? অরিন শাওনকে ক্ষীণ গলায় বলল,”ভাইয়া ছেড়ে দিন প্লিজ।” শাওন ছাড়লো না। তানিয়া চোখ উল্টে যাচ্ছে সেলিনা বেগম আর আমিরুন নেছা হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে এসে টেনে শাওনকে ছাড়ান। তানিয়া যেন অতল সাগরে ভাসতে ভাসতে মাত্র কিনার পেয়েছে। উঠে দৌড়ে সেলিনার পিছে দাঁড়িয়ে বড় বড় নিঃশ্বাস ছেড়ে ছেড়ে কাশতে লাগলো। শাওন আবার তেড়ে গেলো। রাগে তাঁর শরীর কাঁপছে। অগ্নি চোখ দিয়ে খুন করে যাচ্ছে তানিয়াকে। সেলিনা বেগমকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। চিৎকার করে বলে উঠলো, “আর যদি একটা আঘাত করবি কেউ ওকে, তাহলে তোদের কেটে টুকরো টুকরো করে কুকুরকে খাইয়ে দিবো।” শাওন বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। আসার সময় দরজার চিপায় রাখা একটা লাঠি দেখে ওটা হাতে নিয়ে এলো। ছেলেটাকে মেরে লাশ বানিয়ে দিবে আজ। তাঁর কলিজায় হাত দিয়েছে। উঠুনে লোকজন কানাঘুষা করে যাচ্ছে। শাওন গাছ তলায় গিয়ে দাঁড়ালো। ফোনের ফ্লাশ জ্বালিয়ে সামনে থাকাতেই দেখলো গাছের সাথে বাঁধা অবস্থায় আর কেউ নয় তারই প্রাণের ভাই দিহান। শাওনের হাত থেকে লাঠি পড়ে গেলো। বুকের পাজরগুলো দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন বিশাল আকারের একটা পাথরের পাহাড় তাঁর বুকের উপর রাখা। এ কাকে দেখছে সে? দিহান? তাঁর ভালোবাসার অরিনের ঘরে দিহান? তাহলে কী দিহান আর অরিন একজন আরেকজনকে ভালোবাসে? এখন কিভাবে মারবে সে দিহানকে? দিহান যে তাঁর ভাই। প্রাণের প্রিয় একটা ভাই। ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে সে। অস্পষ্ট ঠোঁটে বলে উঠে, “দিহান।

কানাকানি আর তামশা দেখার রাজ্য হয়ে উঠেছে তমালপুর। যুবতী মেয়ের ঘরে পরপরুষ ধরা পরেছে। কথাটা সবাই বিদ্রুপ নিয়ে বলছে। সকাল হতে না হতেই গ্রামের সব মানুষ এসে সেলিনা বেগমের বাড়িতে জড়ো হয়েছে। গ্রামের সব মানুষ যেন চলে এসেছে এখানে। সবাই মুখ টিপে হাসছে আর অরিন দিহানকে দেখছে।

গাছের সাথে বেঁধে রাখা দিহানের ফর্সা গায়ে মারের দাগ আগলে আছে। ঠোঁটের কোণে রক্ত শুকিয়ে আছে। গালে কপালে রক্ত জখম হয়ে আছে। মাথা তুলে উপরে থাকাতে পারছে না। লজ্জা অপমানে তাঁর মরে যেতে ইচ্ছে করছে। মারের কষ্টের থেকে অপমানের কষ্টের দ্বিগুণ। এ কোন পাপের শাস্তি আল্লাহ দিলেন। এতো কঠিন পরিস্থিতি তাঁর মাঝে আসবে বুঝেইনি সে।

শাওন যেন পাথর হয়ে গেছে। তাঁর মস্তিষ্ক শূন্য। চোখ ফুলে মারিবেলের মতো হয়ে আছে। পুরুষরা নাকি কাঁদেনা। কিন্তু তাঁর চোখ দিয়ে আজ অঝর ধারা বৃষ্টি ঝরছে। চার বছর ধরে অরিনকে ভালোবাসে সে। আর আজ কিনা জানলো অরিন দিহানের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। খুব কষ্ট হচ্ছে তাঁর। খুব বেশি। একদিকে ভালোবাসার মানুষকে অন্যের সাথে দেখা অন্যদিকে তাঁর ভালোবাসার মানুষটির ভালোবাসার জায়গায় নিজের ভাইকে দেখা।

ঘরে বাইরে মূর্তির ন্যায় শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অরিন। চুল গুলা এলোমেলো অগুছালো। চোখ মুখ ফুলা। গালে স্পষ্ট থাপ্পড়ের দাগ। ঠোঁটে থুতনিতে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। তার পাশের অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন জহুরা বেগম। উনার চোখে পানি দিচ্ছেন দুজন মহিলা। খবর পেয়ে এসে মেয়ের এই অবস্থা দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেন নি তিনি।

ভীর ঠেলে আসলেন শায়লা বেগম। মনসুর সাহেব ফোন করে জানালেন দিহানকে অরিনের সাথে ধরেছে। উনি বিশ্বাস করেন নি কিছু। নিজের চোখের দেখতে ছুটে এসেছেন। দিহানকে বাঁধা অবস্থায় দেখে মুখ চেপে ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি। এইটা কি দেখছেন তিনি? পাশ থেকে একজন মহিলা চেঁচিয়ে বলে উঠলো,”এই দেখো আইছেন শিক্ষিত ফ্যামেলির কন্যা। অহংকারে মাটিতে পা পড়েনা উনার। আর তলে তলে বুঝি ভাইপুকে দিয়ে এসব করে বেড়ান।”

লজ্জায় অপমানে শায়লা বেগমের ইচ্ছে করছে এই মাটি ফাটুক আর এই উনি মাটির নিচে ঢুকে যান। মনসুর সাহেব শায়লার দিকে অসহায় চোখে তাকালেন। নিজের স্ত্রীকে কি বলে স্বান্তনা দিবেন নিজেই জানেন না। দিহান এমন কাজ করবে কখনো স্বপ্নেও ভাবা যায়না। যখন সবাই বলছে “মনসুর সাহেব পোলাতো আপনার মেহমান।” তখন অপমানে উনার মাথা কাটা যাচ্ছে।

দিহান তার জলভর্তি চোখ দুটো তুলে উপরে থাকালো। শায়লা বেগমের কলিজা মুচড় দিয়ে উঠে দিহানের মুখের দিকে তাকিয়ে। এ কেমন অবস্থা হয়েছে তাঁর। দিহান কোনো মেয়ের ঘরে ধরা খেয়েছে? শান্তি নীড় পর্যন্ত যখন এই কথা যাবে তখন তো উনার মা মরেই যাবেন। দিহান অস্পষ্ট ঠোঁট নেড়ে বলল,” ফুপি।” শায়লা বেগম চোখ নামিয়ে নিলেন। আশে পাশে যা মহিলা দাঁড়িয়ে ছিলেন সবাই উনাকে শুনিয়ে শুনিয়ে একের পর এক কথা বলে যাচ্ছেন। একজন মহিলা বলল,”বড়লোকের পোলারা এমনই হয়। দিনরাত মাইয়া নিয়া ঘুরবো সুযোগ পাইলে মাইয়াগো ঘরে ঢুকবো। খুঁইজা দেখো বাপও হইবো এমন।” আরেকজন বলল,”যতই কও। পরিবার যে শিক্ষা দিবো অইটাই তো শিখবো,তাইনা?”

মহিলাদের কথা শুনতে শুনতে শায়লা বেগম রাগে দিহানের দিকে তেড়ে গেলেন মারার জন্য। শাওন চট করে উঠে তাঁর মাকে আটকায়। শায়লা চেঁচিয়ে বলেন,”ছাড় আমায়। ওরে কি এই শিক্ষা দিয়ে বড় করেছে সবাই। ওর জন্য সবাই আমার পরিবার তুলে কথা বলে।
_আম্মু প্লিজ মাথা ঠান্ডা করো। দেখো সবাই মেরেছে ওকে। দেখো চেয়ে। দেখো আম্মু নানুমনির কলিজাটার গায়ে কত মারের দাগ দেখো।” শায়লা বেগম হাউমাউ কেঁদে উঠেন। শাওন তাঁর মাকে বুকে জড়িয়ে সেও কেঁদে দিলো। চেয়ারম্যান মেম্বার সাহেব ও কিছু গণ্যমান্য লোক চেয়ারে বসলেন। মনসুর সাহেব মাথা নিচু করে বসে আছেন। একজন লোক পান চিবুতে লুঙ্গি ধরে দিহানের সামনে এসে দাঁড়ালো। একটা আঙুল দিয়ে গালের চিপায় থাকা পান বের করে আবার আঙুল চুষে চিবুতে লাগলেন। কী বিশ্রী একটা দৃশ্য। উনি সবাইকে বললেন,”এত সহজে চাইরা দিবানা। এমন শাস্তি দেওন লাগবো যেন অন্য কোনো মাইয়া বা পোলা আর এগুলা না করে।” উনার কথার পরে অনেকজন বলল,”হ্যাঁ হ্যাঁ তাই হোক। শাস্তি দাও ওকে।”

লোকটা দিহানকে মারতে গেলে শাওন একটা ধাক্কা দিয়ে উনাকে ফেলে দিলো। আচমকা ধাক্কা খাওয়ায় উনি উল্টে পড়লেন গিয়ে। সাথে সাথে পরিবেশটা হইচইপূর্ণ হয়ে উঠলো। মনসুর সাহেব অগ্নি চোখে ছেলের দিকে তাকালেন। শাওন সবার উদ্দেশ্যে বলল,”সবাই থামুন প্লিজ। প্লিজ সবাই থামুন। আমার কথাটা শুনুন সবাই।” শাওনের কথায় কিছুটা শান্ত হলো সবাই। শাওন দু’কয়েক শুকনো ঢোক গিলে বলল,” আপনাদের কথা এটা যে ওরা অবৈধ কাজ করেছে। তাইতো?” উপস্থিত সবাই হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।” শাওন বলল,”তাহলে ঠিক আছে। কাজি ডাকুন,ওদের বিয়ে পড়িয়ে দিন। তখন যদি দিহান অরিনকে বিয়ে করেনা তারপর গিয়ে ওকে শাস্তি দিবেন। এর আগে ওর গায়ে আর কেউ একটা ফুলের টুকাও দিবেন না।” চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলে শাওনের পাশে দাঁড়িয়ে শাওনকে চাপা গলায় বলল,”শাওন এসব কি বলছিস? তুই না অরিনকে ভালোবাসিস?” শাওন অসহায় চোখে তাকাল। তার চোখ দুটো জানান দিচ্ছে সে অরিনকে ভালো দেখতে চায়। চোখের পানিটা মুছে নিয়ে চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ্য করে বলল,”আপনি বলছেন আপনি ওকে দেখেই চিনেছেন। আপনাদের উচিত ছিলো আমাদের জানানো। উচিত ছিলো কাজি ডেকে ওদের বিয়ে পড়ানো। আপনাকে রেখে ওদের এতো নিষ্ঠুর অত্যাচার করলো কিভাবে? আপনারা তো বিচার করেন। তাহলে আপনাদের রেখে ওদের মারে কেমনে? আপনারা কি দিহানকে বলেছেন যে তুমি মেয়েটাকে বিয়ে করো। ও কি না বলেছে যে ওকে এভাবে মারলেন?” শাওনের কথায় কোনো জবাব নেই কারো মুখে। শাওন বলল,”এই ঘটনার তো একটাই সমাধান হবে ওদের বিয়ে পড়ানো। তাহলে ডাকুন না কেন কাজি?”

চেয়ারম্যান সাহেব মেম্বার সাহেব শাওনের কথা ঠিক মনে করলেন। মসজিদের ইমাম সাহেবকে খবর পাঠালেন তাঁরা। শাওন গিয়ে দিহানের দঁড়ি খুলতে লাগলো। শায়লা বেগমের থেকে চাদরটা এনে দিলো চেয়ারম্যানের ছেলে। দিহানের গায়ে চাদরটা জড়িয়ে দিতেই আর্তনাদে সে আহহহ বলে কুঁকিয়ে উঠে। তার জখম হওয়া জায়গায় চাদর লাগতেই জ্বলে উঠছে শরীর। চোখ দুটো তাঁর নিবুনিবু। শাওনের কলিজা মুচড় দিয়ে উঠছে। কতো নিষ্ঠুরভাবে মেরেছে দিহানকে। দিহানের ঠোঁট দুটো শুষ্ক। শাওন তাঁর পাশে দাঁড়ানো চেয়ারম্যানের ছেলেটাকে বলল,”ফারহান পানি নিয়ে আয়।” ফারহান পানি আনতে চলে গেলো। গ্লাসে করে পানি এনে দিহানকে খেতে দিলো। দিহান পানিটা খেতে পারছে না। পানিটা মুখে টেনে যে ভিতরে নিবে এই শক্তিটা তাঁর নেই। কিছুটা পানি খাইয়ে শাওন গ্লাসটা রেখে দিহানকে বলল,”খুব কষ্ট হচ্ছে রে তোর?” দিহানের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। শাওন আর নিজেকে দমাতে পারলো না। দিহানকে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। দিহানের অবস্থা দেখে তাঁর এতো কষ্ট লাগছে। দিহান তো এই অবস্থার শিকার তাঁর কতটা কষ্ট হচ্ছে?

শাওনের এখনো মনে আছে দিহান যখন ক্লাস নাইনে ছিলো তখন দিহানকে তাঁর মা একটা ধমক দিয়েছিলেন বলে শান্তি চৌধুরী পুরো বাড়িটা মাথায় তুলে নিয়েছিলেন। উনার নাতিকে ধমক দেওয়ার সাহস পায় কই কথাটা গলা ছিঁড়ে বলছিলেন। আজ কি উনি দেখছেন উনার কলিজার টুকরা নাতিকে তমালপুরের মতো তুচ্ছ একটা গ্রামের মানুষ ইচ্ছে মতো মেরেছে? খুব নিষ্ঠুরভাবে তাঁর মুখে আঘাত করেছে, দেখেছেন নি তা?” ইমাম সাহেব এলে ফারহান শাওনের কাঁধে হাত রেখে বলে,”শাওন ইমাম সাহেব এসেছেন।” শাওন দিহানকে ছেড়ে চোখটা মুছলো। দিহানকে ধরে উঠাতে চাইলো। দিহান উঠতে পারছেনা। তার একটুও শক্তি নেই। শরীরটা যেন খসে খসে পড়ে যাচ্ছে। ফারহান এক পাশে শাওন এক পাশে ধরে উঠালো দিহানকে। দিহান দূর্বল চোখে অরিনের দিকে তাকালো। অরিনের বিষন্ন শুষ্ক মুখটা দেখে তার বুকটা হু হু করে উঠলো। তাঁর বউপাখিটাকে কত কষ্ট দিয়েছে এরা। কতো অত্যাচার করেছে সবাই। চোখটা আবার ভিজে এলো।

দিহানকে ধরে এনে সবার মাঝখানে রাখা হলো। জহুরা বেগমের জ্ঞান ফিরেছে মিনিট খানেক হলো। উনি আঁচলে মুখ চেপে কাঁদছেন। সবাইকে হাতে পায়ে ধরে বলেছেন অরিন আর দিহান বিবাহিত। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করেনি। উল্টো সবাই বলছে উনি এসব করাচ্ছেন। অরিনকে ধরে নিয়ে দিহানের পাশে রাখা হলো। দুজন দুজনার দিকে তাকালো না। দুজনই ভাবছে তাঁর নিজের ভুলে তাঁর ভালোবাসার মানুষটা আজ মার খেলো। অরিন ভাবছে সে যদি দিহানকে ঘরে না আনতো দিহান এতো মার খেতো না। দিহান ভাবছে সে যদি ঘরে না ঢুকতো অরিন এতো মার খেতো না। মানুষের কানাঘুঁষা আর চাপা হাসির শব্দ শুনা যাচ্ছে। দিহান অরিন মাথা নিচু করেই থাকলো।

বিয়ে পড়ানো শেষে চেয়ারম্যান মেম্বার শাওন আর মনসুর সাহেবের সাথে কথা বলে চলে গেলেন। তাঁদের বলে গেলেন দিহান যেন অরিনকে নিয়ে তাঁদের বাড়ি যায়। যদি অরিনকে ফেলে চলে যায় ডাক্তার বাড়ি বাকিটা বুঝবে। একে একে সবাই চলে গেলো। শায়লা বেগম কেঁদে কেঁদে চলে গেলেন। উনার পিছু পিছু মনসুর সাহেব। শাওনের কাঁধে ভর দিয়ে দিহান দাঁড়ালো। পায়ে অনবরত আঘাত করার কারণে পা ব্যথায় জমে আছে। মনে হচ্ছে পায়ে কোনো শক্তি নেই পা দুটো অবশ। শাওন দিহানকে বলল,”চল আমাদের বাড়ি যাবি।” দিহান ক্ষীন গলায় বলল,”আমি ঢাকায় চলে যাবো।
_তার আগে আমাদের বাড়ি আয়,রেষ্ট নিয়ে কিছুটা সুস্থ হয়ে যাবি।” দিহানেরও মনে হলো তাঁর রেষ্ট দরকার। অরিনকে আনতে বলল। জহুরা বেগম অরিনকে নিয়ে আসলেন। ডাক্তার বাড়িতে এসে অরিনকে নেওয়া হলো শাঞ্জুর রুমে দিহানকে ড্রয়িংরুমে বসানো হলো। শায়লা চৌধুরী দিহানের সামনে আসতে পারছেন না। দিহানের মুখটা দেখলেই উনার কলিজা মুচড় দিয়ে উঠছে। কিন্তু না এসে কেমনে থাকবেন তিনি? দিহান যে উনার কলিজা টুকরা। দিহানের পাশে বসে এসে কান্না জড়িত গলায় বললেন, “তুই এটা কেন করলি দিহান? তুই তো এমন ছিলি না।” দিহান শায়লাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। শাওন খুব সাবধানে তাঁর চোখটা মুছে নিলো। মনসুর সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। দিহান কেঁদে কেঁদে বলল,”ও আমার ওয়াইফ ফুপি। আজ থেকে দেড়মাস আগে ওর সাথে আমার বিয়ে হয়েছে।” দিহানের কথায় যেন উপস্থিত সবার মাথায় বাজ পড়লো। দিহানকে ছেড়ে শায়লা চৌধুরী বিস্মিত চোখে তাকালেন। শাওন একটা ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করলো, “এসব কি বলছিস দিহান?” দিহান একে একে সবকিছু সবাইকে খুলে বলল। সব শুনার পরে স্তব্ধতা নেমে এলো পুরো ঘর জোরে। শাওন জোরপূর্বক হেসে বলল,”স্বয়ং উপরওয়ালাই তোর সাথে রে।

অরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে জহুরা বেগম শীর্ণ গলায় বললেন,”কারো লগে মিশতে না করতাম না? কেন করতাম জানস? আমি চিনি তাগো রে। এই গেরামের সব মানুষরে আমি চিনি। যে বুড়ি মহিলার লাইগা খাইয়া না খাইয়া দৌড়াইতি এই বুড়ি তোরে মারলো। যে মাইয়ারে নিজের বইন মনে কইরা আদর করতি আইজ এই মাইয়াই তোর ছোট অওয়ার পরেও তোরে মারে। এই সমাজে কেউ ভাল নারে। এই সমাজ আঘাত করতে জানে। মলম লাগাতে জানেনা। তাই ভাল থাকতে অইলে এই সমাজের অসুস্থ মানুষের থাইকা দূর থাকতে অয়।” জহুরা বেগমের চোখটা মুছে নিলেন। অরিন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাঁর চোখে ভাসতেছে দিহানের রক্ত জখমে বিষন্ন মুখটা।

গ্রামের উত্তরের মাঠে বসে হাউমাউ করে কাঁদছে শাওন। তাঁর কান্না দেখে কাঁদছে ফারহান। অরিন দিহানকে বাড়িতে রেখেই এখানে ছুটে এসেছে সে। চিৎকার করে কাঁদতে না পারলে সে মরেই যাবে। তাই কাঁদতে এসেছে সে। আজ যে তাঁর ভালোবাসা হারিয়েছে। তাঁর জীবন হারিয়েছে আজ। ফারহান শাওনের পাশে বসে বলল,”শাওন আর কতক্ষণ কাঁদবি?” শাওন ফারহানের হাত নিজের গলায় লাগিয়ে বলল,”আমার দম গলায় আটকে গেছে রে। আমাকে মেরে দে প্লিজ। অরিনকে কি করে ভুলবো রে বল? অরিনকে ছাড়া থাকবো ভাবলেই তো আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।
_কাঁদিস না শাওন। নিজেকে শক্ত কর। তুই তো ওকে দিহানের হাতে তুলে দিয়েছিস।
_কি করতাম বল। অরিন তো আমায় ভালোবাসে না। দিহানকে ভালোবাসে বলেই তো দিহানকে তাঁর ঘরে রেখেছে। ও আমাকে ভালোবাসেনি কেন রে? আমি কী খুব খারাপ দেখতে?” মাথার চুলে মুঠি ধরে আগের থেকে উচ্চ স্বরে কেঁদে উঠে শাওন। চিৎকার করে বলতে লাগলো।” অরিইইইইন। অরিইইইন তোমাকে খুব ভালোবাসি অরিইইইন। কি করে থাকবো তোমায় ছাড়া? হে আল্লাহহহহ। তুমি কেন আমার কপালে অরিনের নামটা লিখনি? কেন ওর হওয়ার যোগ্যতা আমায় দাওনি? আর যখন ওকে আমার জন্য বানাও নি তাহলে কেন ওর প্রতি মনে এতো ভালোবাসা জন্মালা আল্লাহ। কেন?

চলবে,,,,।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here