ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু পর্ব_১৯

0
1238

ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু
পর্ব_১৯
#সুলতানা_সিমা

সূর্য ডুবেছে মিনিট খানেক হবে। মুয়াজ্জিন তাঁর মধুর স্বরে মুমিনদের নামাজের জন্য আহবান দিচ্ছে। এ গ্রাম ও গ্রামের প্রতিটি মুয়াজ্জিনের মধুর ধ্বনি মিলে হয়েছে এক অসাধারণ হৃদয় ছোঁয়া কলরব। আকাশ পাতালের সব কিছুও স্তব্ধ হয়ে কান পেতে শুনছে প্রভুর ঘরের ডাক। বাড়ির পিছনের পুকুর পাড়ে বসে আছে অরিন। বসে আছে বললে ভুল হবে। হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে বসে কাঁদছে সে। আজানের সাথে নাকি দোয়া করলে দোয়া কবুল হয়। সেও মনে মনে আজানের জবাব দিচ্ছে ও দোয়া করছে।

আসরের নামাজ শেষে রান্না ঘরে গেছিলো সে। ওখান থেকে এসে দেখে খাটের উপর ফোন রাখা। অরিন দৌড়েগিয়ে ফোন হাতে নেয়। ফোনটা অফ হয়ে আছে। তারমানে তাঁর সন্দেহই ঠিক। ফোনটা তানিয়া নিছিলো। অরিন তৎক্ষণাৎ ফোন চার্জে দেয়। ফোনটা অন করে সাথে সাথেই কল দেয় দিহানকে। দিহান ফোন কেটে দিয়ে মেসেজ দেয়,” থাকো তুমি ওয়েটিংয়ে আমি আসবো না আর।” তারপর সেও ফোনটা বন্ধ করে দেয়। সেই থেকে অরিন ফোন দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু দিহানের ফোন বন্ধ। দিহানকে মিস করে সে কেঁদেই যাচ্ছে। এখানে এসে বসেছে অনেক্ষণ হলো। চারদিকে অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে তবুও এখান থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না অরিনের। কিন্তু নামাজটা ও তো পড়তে হবে। অরিন উঠে ঘরে চলে আসে। নামাজ শেষে আবার ট্রাই করে,দিহানের ফোন বন্ধ। তাঁর কিছু খেতে, বা পড়তে বসতে ইচ্ছে করছেনা। কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলে আছে। চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে আছে। অরিন একটু পর পর দিহানকে ফোন দিয়ে যাচ্ছে। বারবারই বলছে দিহানের ফোন বন্ধ। অরিন দুহাতে চুল টেনে একটু শব্দ করে কেঁদে উঠে।

কান্নার শব্দ রান্না ঘরে থাকা জহুরার কানে চলে যায়। উনি রান্না ঘর ছেড়ে দ্রুত পায়ে শুবার ঘরের দিকে পা বাড়ান। ঘরে এসে দেখেন অরিন বালিশে মুখ চেপে কান্না করছে। জহুরা বেগম দৌড়ে এসে উদ্বিগ্ন হয়ে বলেন,”কি অইছে অরিন? কি অইছে তোর ক? এইরম করতাছস কেন? কানতাছস কেন?” অরিন এবার আগের থেকে আরেকটু শব্দ করে কেঁদে উঠে। জহুরা বেগম ঘাবড়ে যান। আজ অরিনকে ফোনে কথা বলতে দেখা যায়নি। তাহলে কি দিহানের সাথে কিছু হইছে? প্রশ্নটা মনের ঘরে উঁকি দিতেই জহুরা বেগমের আত্মা অজানা ভয়ে কেঁপে উঠলো। অরিনের পাশে বসে তাঁর কাঁধে হাত রেখে বলেন,”কি অইছে রে অরিন? ওই পোলা কিছু কইছে?” অরিন কিছুই বলে না। সে কেঁদেই যায়।

দরজার সামনে সেলিনা বেগম আর উনার ছোট মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জহুরা বেগম উনাদের দেখে বললেন,”ওর পেট ব্যথা করতাছে।” সেলিনা বেগম কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। জহুরা কার সাথে কথা বলছেন দেখতে অরিন মুখ তুলে তাকায়। সেলিনা বেগম তীক্ষ্ণ চোখে তাকাতে তাকাতে চলে যান। জহুরা অরিনকে বলেন,”ক অরিন কি অইছে তোর?
_কিছু না মা। তুমি যাও।” জহুরা বেগম আর কথা বাড়ান না। কিছুক্ষণ বসে থেকে তিনি রান্নাঘরে চলে যান। উনি চলে যাওয়ার মিনিট খানেক পরে শাওন আসে। দরজায় দাঁড়িয়ে অরিনকে ডাক দেয়। অরিন হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে ছিলো। মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে শাওন দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা শপিং ব্যাগ। অরিন ভেতরে ভেতরে কিছুটা কেঁপে উঠল। সেদিনের ঘটনাটা চোখে ভেসে উঠল। একটুর জন্য শাওনের হাতে ধরা খেয়ে যেতো। ধরা খেলে অবশ্য অরিনের কিছু যায় আসেনা। কিন্তু দিহানের ফোন যদি চিনে ফেলতো। অরিন ভয়ার্ত চোখে তাকায়। শাওন গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,”আব,,,চাচি কই অরিন?” অরিন খাট থেকে নামতে নামতে বলল,”রান্না ঘরে ভাইয়া।” শাওন জহুরাকে ডাক দেয়। উনি রান্না ঘর থেকে আসেন। অরিন মন খারাপ করে খাটে বসে আছে। তার মুখটা শুকিয়ে আছেম চোখ মুখ ফোলা। শাওন তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে আছে। অরিনকে দেখার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে ছিলো। কিন্তু কিভাবে আসবে বুঝতে পারেনি তাই কাপড় সেলাই দেওয়ার উছিলায় এসেছে। জহুরা বেগম শাওনের এভাবে তাকানো দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। স্বাভাবিক ভাবেই বললেন,”কি অইছে বাজান?” শাওন চমকে উঠল। উনার হাতে ব্যাগ দিয়ে বলল,”আমার জামাটা।
_কি করতে অইবো বাজান?” শাওন কি বলবে বুঝতে পারলো না। অরিনকে দেখার জন্য এতো পাগল হয়ে গেছিলো যে একটা টিশার্ট ভরে নিয়ে চলে আসছে। এখন কি বলবে সে? জহুরা আবার বললেন,”
_কি অইলো বাজান?
_আব,,,,মানে,,,ইয়ে,,,,আসলে চাচি,,,,,আসলে এটার সেলাইয়ের উপরে আবার সেলাই দিয়ে দিবেন। মানে,,,,বুঝেন তো এগুলা দুদিন পড়লেই সেলাই খুলে যায়।
_আইচ্ছা বাজান। সকালে আইসা নিয়া যাইয়েন।
_জ্বি আমি সকালে আসবো। যাই। যাই অরিন।
_জ্বি ভাইয়া।” শাওন অরিনের দিকে তাকিয়ে চলে গেলো। জহুরা বেগম ব্যাগটা সেলাই ঘরে রেখে রান্না ঘরে চলে গেলো।

অরিন দিহানকে আবারও ফোন দিলো। এখনো বন্ধ। অরিন কেঁদে উঠলো। দিহানের জন্য সে কতটা পাগল সেটা আজ উপলব্ধি করতে পারছে। দিহানের সাথে কথা বলার জন্য মনটা ছটফট করছে। একবার ইচ্ছে করছে দিহানের কণ্ঠটা শুনতে। আচ্ছা দিহান কি বুঝেনা সে মরে যাচ্ছে। তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসছে কথা না বলে। চোখটা মুছে খাট থেকে উঠে গিয়ে খাতা হাতে নিয়ে টেবিলে বসলো। দিহানের সেই লেখাটা বের করলো। দিহানের হাতের ছোঁয়া লেগেছে এই খাতায়। orin+dihan লেখাটায় হাত বুলায় অরিন। সেই রাতটার কথা খুব মনে পড়ছে। দিহানের ঠোঁট কামড়ে হাসিটা চোখে ভেসে উঠছে বার বার। খাতাটা বুকে জড়িয়ে নিঃশব্দে কেঁদে উঠে অরিন। কিছুক্ষণ পর পর দিহানকে ফোন দিয়েই যায়৷ কিন্তু বার বার ফোনের ওপাশ থেকে বিরক্তিকর এক কণ্ঠস্বর ভেসে আসে যেটা বার বার বলছে ফোন বন্ধ। রাগে অরিন রাতেই খায়না। সারাক্ষণ দিহানকে ফোন দিতে থাকে।

রাত তিনটায় অরিনের ফোনে কল আসে। দিহানের নাম্বারটা দেখে অরিন তৎক্ষণাৎ ফোন ওঠায়। ফোন ধরে অরিন মুখ চেপে কেঁদে উঠে। কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারেনা। ফোনের ওপাশেও দিহান কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। অরিন অভিমানী স্বরে বললো, “আমাকে কেন ফোন দিছেন? আমি কে আপনার? দিহান গম্ভীর গলায় বলে,”বাইরে আসো।
_কেন?
_আগে আসো। বাইরে এসে তোমাদের ঘরের পিছন দিকে আসো। ওখানে একটা জিনিস আছে ওটা নিয়ে যাও।” অরিনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন রেখে দেয় দিহান। অরিন উঠে খাট থেকে নেমে পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো। ঘরের পিছনে এসে চারদিকে তাকিয়ে দেখল কিছুই নেই।ভয় লাগছে তাঁর। মনে মনে আয়াতুল কুরসি পড়ছে। চারপাশে কিছু নেই দেখে চলে যেতে পিছন ঘুরলে কেউ তাঁর হাত ধরে ফেলে। ভয়ে অরিনের গায়ের সব পশম দাঁড়িয়ে যায়। শুকনো একটা ঢোক গিলে সে। ভয়ে একদম জমে গেছে। চিৎকার দিতে যাবে তার আগেই তাঁর মুখ চেপে ধরে কেউ। অরিন নিজেকে ছাড়াতে ছটফট করে। তাঁর কানের কাছে মুখ এনে বলে,”অরিন আমি।” সাথে সাথে জ্বলে ওঠা অরিন শীতল হয়ে যায়। এই কণ্ঠস্বর তাঁর অচেনা নয়। বহুদিনের চেনা না হলেও এটা হাজারের ভিরে একটাই স্বর যেটা শুনার জন্য সে ব্যাকুল হয়ে বসে থাকে। দিহান অরিনের সামনে এসে দাঁড়ালো। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা না গেলেও দিহানের হাসি হাসি মুখটা ঠিকই বুঝা যাচ্ছে। দিহান পকেটে হাত ঢুকিয়ে দুপা এগিয়ে অরিনের একদম সামনে এসে দাঁড়ালো। অরিন এখনো শকডের উপর আছে। দিহানের গায়ের সেই পাগল করা ঘ্রাণটা যেন সব দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। দিহান মৃদু গলায় বলল “সারপ্রাইজ বউপাখি।
অরিন অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,”আ আ আপনি?” দিহান মৃদু হাসে। অরিন দু’হাতে মুখ চেপে কেঁদে উঠল। এই কান্নাটা সুখের কান্না। তাঁর স্বামীকে দেখার সুখ এটা। দিহান চট করে অরিনকে জড়িয়ে ধরে। অরিনও দিহানকে আঁকড়ে ধরে তাঁর বুকে মাথা রেখে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল। নাক টেনে কেঁদে কেঁদে দিহানকে বলল, “আপনি খুব খারাপ। খুব বেশি খারাপ আপনি। জানেন কতটা কষ্ট হয়েছে আমার। ইচ্ছে করে ফোন বন্ধ রাখছিলেন তাইনা?
_নিষেধ করার পরেও ওই মেয়েকে আবার ফোন দিছিলা কেন?” অরিন কিছু বলল না।
_জানো পাগল হয়ে গেছিলাম আমি। তোমার গলা শুনার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়েছিলো।
_তবুও তো ফোন বন্ধ রেখেছিলেন। পাষাণ আপনি।” দিহান অরিনকে ছেড়ে দিয়ে অরিনের কপালে চুমু দিলো। দিহানের ঠোঁটের স্পর্শে অরিনের শরীরে শীতল একটা স্রোত বয়ে যায়। সে কিঞ্চিৎ কেঁপে ওঠে। দিহান তাঁর ঠান্ডা হাত দুটো অরিনের গালে রাখে অরিন আবার কেঁপে ওঠে। দিহান ঠোঁট কামড়ে হাসে। চাঁদের মৃদু আলোয় দিহানের ঠোঁট কামড়ে হাসিটা দেখতে অসাধারণ লাগছে। লজ্জায় অরিন মাথা নিচু করে রাখে। দিহান অরিনের কপালে নিজের কপাল ঠেকায়। নাকের সাথে নাকের স্পর্শ লাগে। দিহান ফিসফিসিয়ে বলে। “মিস করছিলা বউটা?” অরিন কিঞ্চিৎ ভাবে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।
_আমিও খুব মিস করছিলাম। কিন্তু ফোন দেইনি দিলে সারপ্রাইজ দিতাম কেমনে?
_আপনার সারপ্রাইজের জন্য আমার অবস্থা মরার মতো হয়েছিলো।
দিহান অরিনের কপাল থেকে কপাল সরিয়ে ধমকের গলায় বলল, ”
_চুপ। কিসব উল্টা পাল্টা বলো।
অরিন দিহানের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,”
_সরি। কখন রওনা দিছিলেন?
_বিকাল চারটায়।
_ট্রেনে এসেছেন?
_উঁহু গাড়ি নিয়ে। বাজারের একটা গ্রেজে গাড়ি রেখে এসেছি।
_গ্রেজ চিনলেন কেমনে?
_চিনতেই তো হতো। শ্বশুরবাড়ির বাজার বলে কথা
। তাইনা?” অরিন হাসে। দিহান অরিনকে জড়িয়ে ধরে বলে,”আই লাভ ইউ বউপাখি।”
_হুম।
_হুম কি?
_জানি তো।
_আর তুমি?
_আমিও।
_আমিও কি?
_ভালোবাসি।

কিছুক্ষণ দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে রাখলো। কিছুক্ষণ পরে অরিন বললো, ”
_বাইরে খুব ঠান্ডা। ভিতরে চলুন।
_তোমার আম্মু?
_মা তো শুবার ঘরে ঘুমাচ্ছে। আপনি চলুন আমার সাথে।” অরিন দিহানের হাত ধরে সেলাই ঘরের দিকে নিয়ে যায়। ঘরের পিছন থেকে বের হতে যাবে তখনই দেখে সেলিনা বেগম বাথরুম থেকে আসছেন। চট করে দুজন লুকিয়ে যায়। দুজনের পায়ের শব্দ সেলিনার কানে যায়। উনি অরিনদের ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তিনি চলে যান। উনি চলে যাওয়ার পরে দিহান অরিন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। এতোক্ষণ ভয়ে দুজনের কলিজা শুকিয়ে গেছিলো। পা টিপে টিপে এসে সেলাই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয় অরিন। ঘরটা অন্ধকার। অরিন লাইট জ্বালায় না বাইরে থেকে আলো দেখা যায়। যদি কেউ বাইরে বের হয় আর ঘরের ভিতর আলো দেখে ফেলে? দিহান ফোনের ফ্লাশ জ্বালিয়ে চারদিকটা দেখলো। ঘরে একটা সেলাই মেশিন, একটা চেয়ার, ও ছোটখাটো একটা চৌকি। দিহান পিছন থেকে ব্যাগটা খুলে চৌকির উপর রাখে। ব্যাগ রাখায় কিছুটা শব্দ হয়। অরিন ফিসফিস করে ভয়ার্ত গলায় বলে,আস্তে। আর,ফ্লাশ অফ করুন প্লিজ৷ বাইরে থেকে কেউ দেখে নিবে।
_ঘরের ভেতর লাইট জ্বললে বাইরে থেকে মানুষ দেখবে কেমনে?
_আস্তে কথা বলুন।” দিহান নিজের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে দাঁড়ায়। দিহানের কান্ডে অরিন হেসে উঠে। দিহান ফোনটা উল্টো করে চৌকির উপর রাখে। ফোনের ফ্লাশের আলো পুরো ঘর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। দিহান সেলাই মেশিনের উপরে একটা শপিং ব্যাগ দেখে। ওটার থেকে টিশার্ট বের করলো। টিশার্টটা পাতলা। দিহান এক পাশ ফোনের উপর রাখে। ফ্লাশের আলোটা চাঁদের মিষ্টি আলোর মতো মৃদু হয়ে যায়।

দিহান অরিনের দিকে তাকালো। এই মৃদু আলোয় অরিনকে আরো আকর্ষণীয় লাগছে। দিহান চৌকিতে বসে অরিনকে কোলে বসিয়ে জড়িয়ে ধরে বসলো। কিছুক্ষণ দুজন কথা বলল। কিছুক্ষণ পরে দিহান অরিনকে বলল,”বউপাখি।
_হুম।
_ক্ষিধে লাগছে গো।” অরিনের বুকটা ধুক করে উঠলো। সিম ভর্তা ছাড়া কিছুই নেই। এখন দিহান ক্ষিধে লাগছে বলছে। ওকে কি খেতে দিবে? দিহান আবার বলল,”কিছু খেতে দিবা?
_আপনি বসুন আমি আসছি।
_আসছি মানে, কই যাবা?
_বসুন।” অরিন বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। দিহান ডাক দিয়েও দিতে পারলো না। সে চাইলো কি আর অরিন বুঝলো কী? কিছুক্ষণ পরে অরিন প্লেটে করে ভাত ও গ্লাসে করে পানি নিয়ে আসলো। অরিন এসে বসতেই দিহান বলল,”আমি কি ভাত খেতে চাইছি?
_আপনি না বললেন ক্ষিধে লাগছে?
_হ্যাঁ বলেছি। কিন্তু আমি তো অন্যটা বুঝিয়েছিলাম।
_অন্যটা বলতে?” দিহান কথা বাড়ালো না৷ তাছাড়া তাঁর যে ক্ষিধে লাগেনি তেমনটা নয়। তাঁর ক্ষিধা লাগছে। দিহান বলল, “তুমি খাইয়ে দিবা?” অরিন মুখটা ছোট করে বলল,”আপনি এসব দিয়ে খেতে পারবেন তো?
_তোমার হাতের হলে পারবো।” অরিন মৃদু হেসে ভাত মেখে দিহানের মুখে দিলো। দিহান হেসে হেসে ভাত মুখে নেয়। কিন্তু সাথে সাথেই তাঁর হাসি মুখটা মলিন হয়ে যায়। প্রথম লোকমা নিয়েই তাঁর বমি পাচ্ছে। খাবারটা তাঁর কাছে কেমন যেন লাগছে। ঠান্ডা ভাত তাঁকে গলায় ছুরি লাগালেও খাওয়ানো যায়না। তাও এটা সিম ভর্তা। সে সিমের তরকারিও খায়না। অরিন দিহানের দিকে তাকিয়ে আছে। দিহান গ্লাস হাতে নিয়ে একটু পানি খেলো। তারপর বলল, “তুমি রেঁধেছো?” অরিন হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। মাথা নাড়িয়েই আবার চট করে মনে পড়ে যায় আজ তো সে রান্নাই করেনি। দিহানের অরিনের হাতে চুমু খেয়ে বলল, “অনেক মজা হয়েছে। তোমার হাতের রান্না তো এমনই হবে। মনে আছে? ফুপির বাড়ি এক সপ্তাহ থেকে কিন্তু আমি মোটা হয়ে যাচ্ছিলাম। শুধু মাত্র তোমার হাতের রান্না খেয়ে। সবি তোমার হাতের জাদু। দাও খেতে দাও।” অরিন মৃদু হেসে দিহানকে খাওয়াতে লাগলো৷ দিহান এক লোকমা খাচ্ছে তো একটু পানি খাচ্ছে। গ্লাসের পানি শেষ হয়ে গেলে অরিন গ্লাস নিয়ে যেতে লাগে পানি আনতে। দিহান বলে গ্লাস রাখো জগ নিয়ে আসো। অরিন গিয়ে জগ নিয়ে আসে। পানি আসতেই দিহান এক গ্লাস পানি খেলো। অরিনের কাছে বিষয়টা কেমন জানি খটকা লাগছে। সে দিহানকে খেতে দেখেছে কিন্তু এভাবে পানি খেতে দেখেনি। দিহান অরিনের হাত ধরে মুখে ভাত নিতে লাগলে অরিন হাত সরিয়ে আনে৷ দিহান বলে,”কি হলো?
_আমি জানি আপনি খেতে পারছেন না।
_আমি খেতে পারছি বউপাখিটা। আর তুমি জানো না। এটা সত্যি অনেক মজা হয়েছে।
_আপনি মিথ্যে বলছেন। এতো পানি খেতে তো আমি আপনাকে কখনো দেখিনি।
_পাগলী। এতোদূর জার্নি করে এখানে এসেছি। পিপাসা লাগবে না? দাও খাওয়াও।” অরিন আর কথা বাড়ায় না সে খাইয়ে দেয়। দিহানের জোরাজোরিতে সেও দুতিন লোকমা খায়। খাওয়ার শেষে দিহান বলে,”আমি কিন্তু ভাত খেতে চাইনি।
_তো কি খেতে চাইছিলেন?” দিহান অরিনের কোমর জড়িয়ে ধরে। অরিন কিঞ্চিৎ কেঁপে ওঠে। দিহান অরিনের পেটের সাইটে চিমটি কাটে। অরিন কিঞ্চিৎ জোরে আহহ বলে আওয়াজ করে লাফ দিয়ে উঠে। দিহান অরিনের মুখ চেপে ফিসফিসিয়ে বলে,”এখন বুঝি বাইরে থেকে কেউ শুনবে না?” অরিন চাপা গলায় ধমক দিয়ে বলল,”আপনি চিমটি দেন কেন?” দিহান অরিনের হাত ধরে হাতে চুমু খেলো। তারপর অরিনের কপালে চুমু এঁকে দিয়ে অরিনের ঘাড়ে নাক ডুবিয়ে দেয়। এক হাতের অরিনের কোমর চেপে ধরে এক হাতে অরিনের বাঁধা দেওয়া হাতটা ধরে রাখে৷ দিহানের এতো গভীর স্পর্শ অরিন হজম করতে পারছেনা। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো সে দিহানকে বাধা দিতেও পারছে না। অতি সুখ,লজ্জা,শিহরণে সে জমে গেছে। তার গলা দিয়ে কথা আসছে না। দিহানের হাত অরিনের স্পর্শকাতর অঙ্গে ছুটে যায়। তাঁর উদ্দেশ্য বুঝতে বাকি নেই অরিনের। দিহানের স্পর্শ গভীর থেকে গভীরে চলে যাচ্ছে। অরিন দিহানকে হালকা ধাক্কা দিয়ে দু পা পিছিয়ে যায়। জোরে জোরে দু কয়েক শ্বাস ফেলে সে। দিহান বলে,”

_what happened?
_ক্ক ক্ক কেউ চ চ চলে আসবে দিহান।
_কে আসবে? কেউ আসবে না।” দিহান আবার অরিনকে ধরতে গেলে অরিন আরো দুপা পিছিয়ে যায়। দিহান অরিনকে হেঁচকা টানে কাছে নিয়ে আসলো। অরিন ছটফট করছে। দিহান বলল,”এমন করছো কেন?
_আপনি যা করছেন তা ঠিক নয় দিহান।
_ বউপাখি we are husband and wife so don’t worry that’s normal
_দূরে থাকুন প্লিজ।” অরিনের কণ্ঠ ভেজা শুনালো। দিহান দু পা পিছিয়ে গেলো। কেন জানি খুব কষ্ট হচ্ছে তাঁর। ইচ্ছে করছে চলে যেতে। দিহান চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। কিছুক্ষণ পরে বলল,”জড়িয়ে তো ধরতে পারি তাইনা?” অরিন দৌড়ে এসে দিহানকে জড়িয়ে ধরলো। দিহান অরিনকে শক্ত করে জড়িয়ে রেখে বলে,”সরি বউপাখি। আমি কন্ট্রোলেস হয়ে গেছিলাম।
_আমার ভয় হয় দিহান। কোন একটা অজানা ভয় আমার মনের ঘরটা খুঁড়ে খুঁড়ে খায়। কেন জানি বার বার মনে হয় এই বুঝি কিছু হতে চলল। মনে হয় খুব বড় একটা ঝড় আমাদের পিছু ধেয়ে আসছে। কখন জানি সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিবে।” দিহান অরিনের দুগালে হাত রেখে মুখটা তুলে বলল, “কিছু হবে না বউপাখি। যতদিন তোমার স্বামী থাকবে ততদিন কোনো বাঁধা আমাদের আলাদা করতে পারবে না।” দিহান চৌকিতে বসে টিনের বেড়ায় হেলান দিয়ে বসলো। অরিনকে কোলে বসিয়ে জড়িয়ে রেখে ফিসফিসিয়ে কথা বলতে লাগলো। কথা বলতে বলতে দুজন কখন যে ঘুমিয়ে যায় সেটা তাঁরা টেরই পায়নি।

সকালে সূর্য উঠে চারিদিকে তার আলো ছড়িয়ে পড়ে। সেলিনা বেগম থেকে শুরু করে বাড়ির সবাই ঘুম থেকে জেগে ওঠে শুধু সেলাই ঘরে গভীর ঘুমে তলিয়ে পড়ে থাকে দিহান আর অরিন। টিনের গেটের ভিতর পা রাখে শাওন। ঠোঁটের কোণে তাঁর মৃদু হাসি। আবারও সে অরিনকে দেখবে।

____________________________________

সকাল নয়টা বাজে। শুধু এক কাপ কফি খেয়েই কলেজের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে গেলো লুপা। রাতে কিছুই খায়নি। এভাবে শুধু কফি খেয়ে বের হচ্ছে দেখে তার বড়মা দিলারা চৌধুরী অনেক বকা দিলেন। লুপা এসবে পাত্তা দেয়না। কেনই বা পাত্তা দিবে। উনি তো এমনই। বাইরে এসে রিকশা নিলো লুপা। গাড়ি নেয়নি আজ। নেয়নি বলতে নিতে পারেনি। তাদের তিনটা গাড়ি। একটা দিহানের সাথে আছে। কে জানে কই গেছে। কাল সবাই বলল সে নাকি তাঁর এক বন্ধুর বাসা গেছে। আর বাকি দুটো গাড়ি অফিসে। একটু জায়গা আসতে চোখে পড়ে তার সেই খালাতো ভাই আহসানকে। লুপা তৎক্ষনাৎ রিকশাওয়ালাকে বলে,” চাচা চাচা থামান থামান।” রিকশা থামালে লুপা আহসানকে ডাক দেয়। সে এসে লুপাকে দেখে বলল,”কি ব্যাপার আপু তুই? কই যাচ্ছিস?
_কই আর যাবো নিশ্চয়ই কলেজে যাচ্ছি? তুই হাঁটছিস কেন আয় উঠ এসে।
_না আপু তুই যা। এই একটু সামনে যাবো।
_আরে আয় তোর জায়গা মতো গেলে নেমে যাবি।” আহসান উঠে রিকশায় বসলো। লুপা আহসান সৌজন্যমূলক কথা বলে শুরু করলো তাঁদের নানু বাড়ির বিষয়ে কথা বলা। কথা বলতে বলতে কলেজে পৌঁছে যায়। রিকশা থামতেই আহসান কথা বন্ধ করে অবাক হয়ে লুপার দিকে তাকায়। তাদের মামার বাড়ির গল্পে এতোটাই মগ্ন ছিলো যে আহসান তাঁর গন্তব্যে না নেমে লুপার কলেজে চলে এসেছে খেয়ালই করেনি। আহসানের বোকামিতে লুপা আর আহসান অনেক জোরে হেসে উঠে।

কলেজের বাইরে একটা গাছের নিচে দুটো ছেলের সাথে নীল দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো। আজ হঠাৎ একটা জরুরী কাজে তাকে এখানে আসতে হয়েছে। হাসি শব্দ কানে আসতেই তাকিয়ে দেখে লুপা সেই শপিংমলের ছেলেটার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। তৎক্ষনাৎ রাগে নীলের চোখ দুটো রক্তিম হয়ে যায়। লুপা হাসতে হাসতে রিকশা থেকে নামলো। ডান দিকে চোখ যেতেই দেখে নীল দুটো ছেলের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেগুলা কথা বলছে আর নীল লুপার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। লুপা চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আহসানকে বায় বললো। আহসান রিকশা ঘুরিয়ে নিয়ে সে চলে গেলো। নীলের কাছে ব্যাপারটা এমন দেখালো যে ছেলেটা লুপাকে কলেজে পৌঁছে দিলো। লুপা কলেজের গেটের ভিতর ঢুকতে যাবে তখনই নীল ডাক দেয়,”লুপা দাঁড়া।” লুপা দাঁড়িয়ে যায়। নীলের গলা স্বাভাবিক শুনাচ্ছে। নীল সাথের দুজনের সাথে কি যেন কথ বলল। ওরা দুজন বিদায় নিয়ে তাদের বাইক নিয়ে চলে যায়। নীল বাইক ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থেকেই লুপার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়। লুপা এগিয়ে এসে বলল,”কি?” নীল কি জানি ভেবে তাচ্ছিল্য হেসে বলল, ”

_তোকে একটা হেল্প করবো। জানিস? আমি একটা brothel চিনি। তুই যাবি সেখানে?” লুপা অবাকের চোখে তাকায়। নীলের কথাটা তাঁর বুকে এসে সুচের মতো বিঁধেছে। নীল অবশেষে এটাও বলল? লুপার চোখ দুটো ছলছল হয়ে যায়। নীল আবার বলল,”দেখ তুই আমার আত্মীয়। বলতে গেলে আপনজনও বলা যায়। তুই রোজ রোজ কষ্ট করে একটার পর আরেকটা খুঁজবি এগুলা দেখলে না আমার খুব কষ্ট হয়। তাই ভালো হবে তুই ওখানে চলে যা। না তোর কাউকে খুঁজতে হবে। আর না তোর এতো কষ্ট হবে। তোকে খুঁজে খুঁজে একজনের পর আরেকজন আসবে। আর তুইও মজা নিবি। ভালো হবেনা?” লুপা চোখ আর বাঁধ মানেনি। তার চোখ দিয়ে টুপ করে একফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো। নীল দেখার আগেই লুপা চট করে চোখ মুছে নেয়। নীল তাকিয়ে দেখল লুপা রাগি চোখে তাকিয়ে আছে। নীল বলে,”এভাবে তাকিয়ে কি বুঝাতে চাস? তুই খুব ভালো মেয়ে? হা হা হা জানিস? সেদিন হোটেল থেকে আসার পরে ওই ছেলেটাকে এনে ইচ্ছেমতো মেরেছিলাম। কেন জানি মনে হয়েছিলো সবকিছু মিথ্যে। তাই ভেবেছিলাম মারলে হয়তো বলে দিবে ভাই ওগুলা মিথ্যে। কিন্তু বলেই নি। আরে মিথ্যা বলবে কিভাবে সব তো সত্যিই ছিলো। শুধু মিথ্যা ছিলো তোর ভালোবাসি বলা জবান টা।”[দাঁতে দাঁত চেপে] সাথে তোর চরিত্রটাও।” লুপা নিজেকে কিছুটা সামলে নিলো। কণ্ঠ স্বাভাবিক করে প্রশ্ন করলো,”এগুলা বলতে ডেকেছো?
_কেন শুনতে ভালো লাগছে না তোর? আচ্ছা আমি তোকে এড্রেস দিয়ে দিচ্ছি তুই তাঁদের সাথে যোগাযোগ করিস।
_আমি না হয় খারাপ। তুমি তো ভালো। তাহলে তুমি brothel চিনো কেমনে?
_ওই যে বললাম। তোর হেল্প করছি। তোর জন্যই খুঁজলাম।” লুপা একটা ঢোক গিলে নিজেকে শক্ত করলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে চোখে জমে যাওয়া জলটা আটকে রাখার বৃথা চেষ্টা করলো। নীল বলল,”আগামী মাসে বিয়ে করবো। এই মাসেও করে ফেলতে পারি। শিওর নয়। আম্মুকে পাঠিয়ে দিয়ে দাওয়াত দিবো। সবার সাথে তুই চলে আসবি। আমার কয়েকটা foreigner ফ্রেন্ড আসবে। তোকে ওদের লাগতে পারে৷ [তারপর চশমা পড়তে পড়তে বললো] এনজয় করার জন্য।” কথাটা বলেই নীল বাইকে উঠে বাইক নিয়ে চলে গেলো। লুপার চোখে আটকানো পানিটা এবার গাল গড়িয়ে গেলো। অবাকের চোখে তাকিয়ে থাকলো সেই মানুষটার যাওয়ার দিকে যে মানুষটা একসময় তাঁর জন্য পাগল ছিলো। তাকে কেউ একটা বকা দিলে যে মানুষটার জন্য কেউ জানে রক্ষা পেতোনা। আজ তারই মুখে এতো কঠিন কথা। নীলের বাইকটা চোখের আড়ালে চলে গেলে ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো লুপা। তার কানে বেজে উঠল, ” আগামী মাসে বিয়ে করবো। এই মাসেও করে ফেলতে পারি। শিওর নয়। আম্মুকে পাঠিয়ে দিয়ে দাওয়াত দিবো। সবার সাথে তুই চলে আসবি। আমার কয়েকটা ফরেনার ফ্রেন্ড আসবে। তোকে ওদের লাগতে পারে৷ এনজয় করার জন্য।”

চলবে,,,,।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here