ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু পর্ব_১৮

0
1060

ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু
পর্ব_১৮
#সুলতানা_সিমা

দিহানের মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। আজ সে অরিনকে দেখতে যাবে অথচ আজও অরিনের ফোন ওয়েটিংয়ে। নিশ্চয়ই আবার তাঁর চাচাতো বোনকে ফোন দিয়ে দিছে। দিহানের খুব রাগ হচ্ছে কিন্তু রাগটা দমিয়ে নিলো। সবার থেকে বিদায় নিয়ে সে বেরিয়ে গেলো। দুপুরে বের হওয়ার কথা ছিলো কিন্তু অরিনের ফোন ওয়েটিং অরিনের সাথে কথা হচ্ছে এগুলা তার মাথা নষ্ট করে দিছিলো। কিন্তু পরক্ষণে ভাবলো কি হবে রাগ করে জানিই তো আমার বউপাখিটা সহজ সরল। সবাইকে বলেছে বন্ধুর বাসায় যাচ্ছে শুধু তাঁর দাদুমনিকে বলেছে বউ দেখতে যাচ্ছে। উনি গম্ভীর ছিলেন জিজ্ঞেস করেননি বউয়ের বাড়ি কই বউ কেমন ইত্যাদি। দিহান বুঝতে পারে উনি এখনো রেগে আছেন। কিন্তু দিহান মনে মনে হাসে যখন জানবেন অরিন তাঁর বউ তখন তো খুশি আধখানা হয়ে যাবেন। দিহান একবার ভেবেছিলো শাওনদের বাড়িতে যাবে কিন্তু কেন জানি তাঁর মন আগ দিচ্ছেনা। শাওনদের বাড়িতে গেলে অরিনকে মন ভরে দেখতে পারবে না। তাই সে চিন্তা করেছে বাজারে কোথাও উঠবে। আর সেখানে দুদিন থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে অরিনের সাথে দেখা করবে। দিহানের গাড়ি একদিকে বেরিয়ে গেলো অন্যদিকে এসে মিহানদের গাড়ি থামলো।

গাড়ি থামতেই লুপা গাড়ি থেকে নেমে তাঁর ব্যাগ গুলা নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। অন্যদিনের মতো আজ আর সবাইকে চিল্লিয়ে জড়ো করে তাঁর কেনা জিনিসগুলা দেখালো না। রুমে ঢুকে হাতের ব্যাগ গুলা ফ্লোরে ছুঁড়ে মারল। তারপর দরজায় পিঠ ঠেকে কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়লো। নীলের ঘৃণিত দৃষ্টি চোখে লেগে আছে। হাঁটুতে মুখ গুঁজে কেঁদে কেঁদে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,” খুব ভালোবাসি তোমায় নীল। খুব বেশি ভালোবাসি।”

অতীত
———–

লুপা যখন ক্লাস নাইনে উঠে তখন থেকে লুপাকে ভালোবাসে নীল। ভালোবাসার কথা লুপাকে কখনোই জানাতে পারতো না সে। লুপা যখন ক্লাস টেনে উঠে, তখনই নীল লুপাকে নিজের ভালোবাসার কথা জানায়। লুপা প্রথমবার নীলকে ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু দ্বিতীয়বার দিতে পারেনা। কারণ সেও ছিলো নীলের উপর আসক্ত। লুপার সাথে সম্পর্ক শুরু হওয়ার থেকে নীল সব ছেড়ে ছুঁড়ে এসে মামার বাড়ি পড়ে থাকতো। আর জমিয়ে প্রেম করতো দুজন। কারো চোখে এসব পড়তো না। একদিন লুপা আর নীল ছাদে ছিলো৷ একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে অনুভব করছিলো হৃদপিণ্ডের চলাচল। হঠাৎ দিশা ছাদে আসে। লুপা ও নীল চট করে একজন আরেকজনকে ছেড়ে দেয়। সেদিন থেকে দিশার চোখে সন্দেহ জন্ম নেয়। নীলকে আর লুপাকে অন্য চোখে দেখতে লাগে। কিন্তু সেদিনের পর থেকে নীল আর লুপা সাবধান হয়ে যায়।

লুপার এসএসসি পরিক্ষা শুরু হলে তাকে নীলদের বাসায় যেতে হয়। সেখানে যাওয়ার পরে নীল, লুপা আরো বেশি করে চুটিয়ে প্রেম করতে থাকে। নীলদের বাসায় নীল,তাঁর দাদী,তাঁর বাবা আর তাঁর মা ছাড়া কেউ ছিলোনা। নীলের বাবা সারাদিন অফিসে থাকতেন। রাত বারোটায় বাসায় আসতেন। আর নীলের দাদী তাঁর ফুপির বাসায় ছিলেন। যার কারণে তাঁদের বিরক্ত করার মতো কেউ ছিলো না। সারাদিন পড়ার উছিলায় লুপা আর নীল একটা ঘরে পড়ে থাকতো৷ নীল লুপাকে এক্সাম দিতে নিয়ে যেতো আবার নিয়ে আসতো। আর এই সুযোগে সারাদিন নানান জায়গায় ঘুরে বেড়াতো দুজন। নীলের মা শিলা চৌধুরী কখনো এ নিয়ে নীল লুপাকে বকতেন না। নীলকে আর লুপাকে অনেকবার অনেক রকম দেখেছেন তিনি তবুও না দেখার ভান করে থেকেছেন।

একদিন নীল ইজি চেয়ারে বসে বসে ফোন টিপছিলো। লুপার খাতা আর কলম নিয়ে এসে নীলকে বলল,”নীল ভাই এই অংকটা বুঝতে পারছিনা।” নীল লুপাকে টান দিয়ে নিজের খুলে বসিয়ে দেয়। ফোনটা সাইটে রেখে দু’হাতে লুপাকে জড়িয়ে ধরে তাকে জিজ্ঞেস করে,”কোনটা বুঝতেছিস না?” লুপা দেখিয়ে দেয়। নীল এক হাতে লুপাকে জড়িয়ে ধরে এক হাতে কলম তুলে নেয়৷ লুপাকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে অংকটা করে দেয় সে। লুপা আরো দুটো অংক দেখিয়ে নীলের দিকে ঘুরে নীলকে জড়িয়ে নীলের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে। নীল বলে,”ওই উঠ। না দেখলে বুঝবি কেমনে?” লুপা চোখ বন্ধ রেখেই বলে,”উহু উঠবো না।
_আরে না দেখলে বুঝবি কেমনে?
লুপা ঝাঁঝালো গলায় বলে,”
_আমার ভালো লাগছে না।” নীল কিছু বলেনা। সে খাতাটা রেখে দিয়ে লুপাকে জড়িয়ে ধরে। ঠিক তখনই শিলা চৌধুরী নীলকে ডাকতে ডাকতে রুমে এসে ঢুকেন। উনার উপস্থিতিতে লুপা চট করে নীলের কোল থেকে দাঁড়ায়। নীলও দাঁড়িয়ে ভয়ার্ত চেহারায় উনার দিকে তাকায়। শিলা চৌধুরী স্বাভাবিক গলায় নীলকে বলেন,”দেখ না আমার ফোনের কী হয়েছে তোর নানুর কল এসে ঢুকছে না।” নীল কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন হাতে নেয়, লুপা খাতা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। সেদিন লুপা সারাদিন তাঁর ফুপির সামনে যায়নি। মনে মনে সারাদিন দোয়া ইউনুস পড়ে। কিন্তু উনি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি। এর দুদিন পরে একদিন বিকালে লুপা সোফায় বসে টিভি দেখে দেখে ভাত খাচ্ছিলো। নীল বাইরে থেকে এসে লুপাকে খেতে দেখে বলল,”এখন খাচ্ছিস কেন?
_ঘুমিয়ে গেছিলাম।” নীল চারদিকে তাকিয়ে লুপার পাশে বসে লুপাকে জড়িয়ে ধরে লুপার গালে কিস করে। লুপা চাপা গলায় বলে,”এই এই কি করছো ফুপি কিচেনে।
_আসবে না। আমাকে একটা কিস দে।
_ছাড়ো ফুপি চলে আসবে।
_কিস দে, ছেড়ে দিবো।” লুপা নীলের গালে কিস করে। নীল লুপাকে ছেড়ে দিয়ে একহাতে লুপার কোমর জড়িয়ে ধরে রেখে বলে,” দে আমাকে খাওয়া।” লুপা ভাত মেখে নীলের মুখে তুলে দেয়। দুতিন লোকমা দেওয়া পরে লুপা এক’টুকরো মাংস তুলে দিবে নীলের মুখে তখনই শিলা চৌধুরী ড্রয়িংরুমে আসেন। উনার উপস্থিতিতে লুপা নীল কেঁপে উঠে। নীল উঠে চলে যায় উপরে। উনি কিছুই বলেন না আগের মতোই স্বাভাবিক আচরণ করেন।

তারপর আরেকদিন নীল কলেজ থেকে এসে শুয়ে থাকে। লুপা নীলকে খুঁজে নীলের রুমে গিয়ে নীলকে শুয়ে থাকতে দেখে নীলের কপালে হাত রেখে বলে,”কি হয়েছে? শরীর খারাপ?” নীল লুপার হাতটা মাথায় রেখে ধরা গলায় বলে,”খুব মাথা ব্যথা করছে রে। একটু টিপে দে।” লুপা নীলের মাথা টিপে দেয়। নীল চোখ বন্ধ করে মুখটা বিষন্ন করে রাখে। নীলের বিষন্ন মুখটা দেখে লুপার ভিতর কেঁদে উঠে। কিছুক্ষণ পরে নীলের চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে কানের কাছে চলে যায়। নীলের চোখের পানি মুছে দিয়ে লুপা জিজ্ঞেস করে, ” খুব বেশি ব্যথা করছে তাইনা?” নীল চোখ বন্ধ রেখে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। লুপা কেঁদে দেয়। ফ্যাসফ্যাসে কান্নার শব্দ শুনে নীল চোখ খুলে তাকায়৷ লুপার কান্না দেখে বলে,”কি হইছে বাবুই, কাঁদিস কেন?” লুপা ডুকরে কেঁদে উঠে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,”খুব কষ্ট হচ্ছে তাইনা?” নীল হেসে উঠে। তারপর উঠে বসে লুপাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”কাঁদিস না পাগলী ঠিক আছি আমি।” লুপা নীলকে আঁকড়ে ধরে কেঁদে উঠে। শিলা চৌধুরী রুমে ঢুকে ওদের দেখে কপাল কুঁচকে তাকান। নীল দরজার দিকে মুখ করে ছিলো বলে সে তাঁর মাকে দেখতে পায়। উনাকে দেখে আম্মু বলে চট করে লুপাকে ছেড়ে দেয়। উনি বরাবরের মতো আজও কিছু বললেন না। নীলের হাতে বাজারের লিষ্ট ধরিয়ে দিয়ে বলেন,”বাজার করে আন গিয়ে।” তারপর গম্ভীর গলায় লুপাকে বললেন,”যা গিয়ে পড়তে বস।” লুপা তৎক্ষণাৎ উঠে চলে গেলো। সেদিনও তিনি কিছু বলেননি দেখে লুপা আর নীল বুঝে যায় উনি এটা জানেন যে তাঁরা প্রেম করে। উনার আস্কারা পেয়ে নীল আর লুপা ইচ্ছেমতো চলতে থাকে। উনিও যেন নীল আর লুপাকে সুযোগ করে দিতেন।

সবকিছুই ঠিকমতো চলছিলো। লুপা নীল মুক্ত পাখির মতো আকাশে উড়ছিলো। হঠাৎ একদিন নীলের বাড়িতে তাঁর ফুপি আসমা খাতুন আর দাদীর আগমন ঘটে। উনারা আসার পরের দিন লুপা কিচেনে ছিলো। নীল বাইরে থেকে এসেই লুপাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,”কি করছিস বাবুই?
_দেখো না। আমি পায়েস বানাতে চাচ্ছি অথচ পারছিই না।
_তুই না এটা খেতে পারিস না?
_আমি তো তোমার জন্য বানাচ্ছি। কিন্তু দেখো ইউটিউবে কি বলে আমি বুঝতেই পারছি না।” নীল লুপার ঘাড়ে চুমু খেয়ে বলল, “পাগলী রান্না করতে হবেনা রে। আমাকে আদর খাইয়ে দে।
_কিন্তু আমি তো পায়েস খাওয়াতে চাই।
_কোনো একদিন খাইয়ে দিবি এবার আদর দে।” লুপা পিছন ঘুরে উঁচু হয়ে নীলের ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। নীল সুযোগ পেয়ে পায়দা লুটে। কিছুক্ষণ পরে লুপাকে ছেড়ে দিয়ে বলে,”বাবুই তারাতাড়ি বড় হয়ে যা না।
_কেনো?
_কেনো মানে? আমরা বিয়ে করবো না? আর কতো নিজেকে কন্ট্রোল করবো? কন্ট্রোল করতে কষ্ট হয় জানিস?
_ছিঃ ছাড়ো আমায়।
_চল না আমরা লুকিয়ে বিয়ে করে নেই। পরে সবাইকে জানিয়ে দিবো।
_আমার এতো সাহস নেই। ছাড়ো।
_প্লিজ বাবুই চল না। তোকে গভীর ভাবে কাছে পেতে ইচ্ছে করছে।” লুপা চোখ বড় বড় করে তাকায়। নীল কাতর চোখে তাকিয়ে আছে। লুপা নিজেকে ছাড়াতে ছটফট করতে করতে বলে,”বুঝেছি এখন থেকে আমাদের মাঝে দূরত্ব রাখা দরকার।” নীল কিছু বলতে যাবে তখনই কটকট করে হাঁটার শব্দ এলো। শব্দটা এদিকে আসছে না। এদিক থেকে উপরের দিকে যাচ্ছে। তারমানে এখানে কেউ দাঁড়িয়ে ছিলো। নীল লুপাকে ছেড়ে দৌড়ে আসে কেউ নেই। নীল লুপাকে বলে,”তোকে এসব করতে হবেনা যা পড়তে বস গিয়ে।” নীল চলে গেলো উপরে।

শিলা চৌধুরী ঘুমিয়ে ছিলেন আসমা খাতুন রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে উনাকে ডাক দেন। শিলা চৌধুরী ঘুম থেকে উঠে বলেন,”কী ব্যাপার আপা এভাবে ডাকছেন যে,কোনো সমস্যা?
_সমস্যা মানে? যুবক একটা ছেলে বাড়িতে,সেখানে তুমি তোমার যুবতী ভাইজিকে এনেছো। হ্যাঁ এনেছো ভালো কথা ওরা কি করে না করে সেটা কি খেয়াল রাখবে না?” শিলা চৌধুরীর বুকটা ধুক করে উঠে। উনিও কি লুপা আর নীলকে একসাথে দেখে ফেলেছেন? এতোদিন ওদের একসাথে দেখেও কিছু বলেন নি। ভেবেছিলেন ক্ষতি কি লুপাকে নীলের বউ বানালে। আসমা খাতুন চেঁচিয়ে বলেন,”তোমার ভাইজিকে তুমি সাবধান করে দাও। আমার বংশের একমাত্র ছেলে নীল। তাঁর জন্য এমন মেয়েকে আনবো? যে মেয়ের মাও পালিয়ে বিয়ে করেছে। এসব কি আমরা শুনিনাই? এই মেয়ের মা তো বিয়ের আগেই তোমার ভাইয়ের সাথে ফষ্টিনষ্টি করেছে। যার কারণে ওই মিহান ছেলেটা বিয়ের আগেই পেটে এসেছিলো। এই মায়ের মেয়েকে আমাদের বাড়ির বউ বানাবো? সাফ সাফ জানিয়ে দিচ্ছি তুমি তোমার ভাইজিকে সাবধান করে দাও। নয়তো ভাইজানের কাছে আমি সব বলে দিবো।” কথাগুলা বলেই আসমা খাতুন বেগম চলে গেলেন। শিলা চৌধুরীর বুক ছিঁড়ে কলিজা বেরিয়ে আসে। উনি অপমানবোধ করছেন। ধীর পায়ে হেঁটে লুপার রুমে যান। লুপা পড়ছিলো। উনি লুপার সামনে বসে গম্ভীর গলায় বললেন, “তোর কয়টা পরিক্ষা বাকি?” লুপা বই বন্ধ করে বলে,”দুটো।” শিলা চৌধুরী পূর্বের ন্যায় বললেন, “আজ থেকে যেন নীলের সাথে তোকে দেখা না যায়। এখানে পরিক্ষা দিতে এসেছিস পরিক্ষা দিয়ে চলে যা। অন্যকোনো কিছুতে যেন দেখা না যায়।” লুপা করুন চোখে উনার দিকে তাকালো। উনি উঠে চলে গেলেন। হঠাৎ কেন উনি এসব বলছেন ভেবে পায়না লুপা। সারাদিন লুপা নীলের ঘরের আশে পাশেও যায়নি। ভেতরে ভেতরে ভয় পায় তাঁর ফুপি দেখে নিলে বকবেন। খাবার টেবিলে বসে লুপা মাথা নিচু করে খায়। নীল লুপার পায়ে খুঁচা দেয় তাকানোর জন্য কিন্তু লুপা তাকায় না। খেয়ে সোজা উপরে চলে যায়। রাতে সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পরে লুপা নীলের রুমে যায়। নীল ঘুমিয়ে ছিলো লুপা নীলকে জাগায় নি। কাল এক্সামে গেলে বাইরে নীলকে সব বলে দিবে। নীলের রুম থেকে বের হতেই আসমা খাতুনের সম্মুখীন হয় লুপা। উনার হাতে জগ মনে হয় পানির জন্য বের হয়েছেন। লুপা শুকনো একটা ঢোক গিলে। উনি কিছু না বলে চলে যান। লুপা ভাবে মনে হয় উনি কিছুই টের পাননি।

সকালে ঘুম থেকে উঠে নীলকে বাজারে পাঠিয়ে দেন শিলা চৌধুরী। নীলকে বাজারে পাঠানোর উদ্দেশ্য হলো লুপাকে নিয়ে যেন এক্সামে যেতে না পারে। নীল বেরিয়ে যাওয়ার পরে লুপাকে এক্সামে পাঠিয়ে দেন তিনি। লুপা যাওয়ার পরেই আসমা খাতুন উনার মাকে গিয়ে বলেন,”মা তোমার ছেলের বউকে কি কিছু একটা বলবে?
নীলের দাদী পান চিবুতে চিবুতে বলেন,
_কি হইছে?
_তুমি জানো রাত তিনটায় ওই মেয়েটি নীলের রুম থেকে বেরিয়েছে। বুঝতে পারছো কিছু? কতটা খারাপ করে দিচ্ছে ওরা নীলকে।” নীলের দাদী উঠে হনহন পায়ে হেঁটে যান শিলা চৌধুরীর রুমে। উনাকে গিয়ে গর্জে বলেন,”কাল রাতে না তোমায় এসে বুঝিয়ে বলেছিলাম তোমার ভাইজিকে নিষেধ করতে। তবুও করনি না? আমার একমাত্র নাতির জন্য আমি এমন মেয়ে কোনো দিনও আনবো না। না আমার নাতির সাথে ফুর্তি করার জন্য এমন মেয়ে আমি আনবো। আজই যেন এই মেয়েটি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। নয়তো তুমি এই সংসার করতে পারবা না।” উনার মুখে যা আসলো তাই বলে উনি চলে গেলেন। শিলা চৌধুরী কান্নায় ভেঙে পড়েন। কিছুক্ষণ পরে উনার স্বামী উনাকে ফোন দিয়ে গালাগালি করেন। উনাকে বলেন এই মেয়ে এই বাড়িতে আসলে নাকি উনাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবেন। শিলা চৌধুরী বুঝে উঠতে পারেন না কি করবেন কি বলবেন। মা মেয়ে মিলে শিলাকে অনেক কথা শুনান। নীল বাসায় এসে নিজের রুমে যায়। কানে হেডফোন থাকায় ফুপি দাদীর কথা তাঁর কানে যায়নি।

লুপা বাসায় যখন আসে তখন শিলা চৌধুরী উনার রুমে ছিলেন। লুপা ভাবে নীলের দাদী ফুপি তো আর কিছু জানেন না সে নীলের রুমে চলে যায়। নীল টিভি দেখছিলো লুপাকে দেখে উঠে এসে বিচলিত হয়ে বলে,”এই তোর কি হইছে? তুই আমার থেকে দূরে দূরে থাকিস কেন?
_জানো ফুপি সব জেনে গেছে।
_জানি তো।
_ফুপি আমায় বকেছে।” নীল মৃদু হেসে লুপাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”কোথায় এমন দেখলি যে প্রেম করছে শুনেও গুরুজন বকা না দিয়ে আদর করেছে? ” লুপা নীলকে জড়িয়ে ধরে মৃদু হাসে। অনেক্ষণ লুপা নীল রুমে থাকে। নীল লুপার চুলে চিরনি করতে করতে বলে,”চলনা বাবুই আমরা বিয়ে করে ফেলি। পরে সবাইকে জানিয়ে দিবো
_একটা বছর যাক প্লিজ।”
_এক বছর কেন?
_ওমা আমি ছোট না? বড় হই আগে।” নীল হেসে উঠে লুপাকে জড়িয়ে ধরে।

পরের দিন নীল সকালের নাস্তা করে বাইরে যায়। আসমা খাতুন নীলের দাদী শিলা চৌধুরীকে নিয়ে লুপার রুমে যান। লুপা উনাদের দেখে বই বন্ধ করে মিষ্টি করে হেসে বসতে বলে। আসমা খাতুন লুপাকে বলেন,”লুপা আমার সামনে এসে বসো।” লুপা উনার পাশে বসলো। তাঁর মনের ঘর অজানা ভয়ে কেঁপে উঠছে। উনি কোনো ভণিতা ছাড়াই লুপার হাত ধরে বললেন,”দেখো লুপা নীল আমাদের বংশের একমাত্র ছেলে। তাঁর জন্য আমরা আমাদের মনের মতো মেয়ে আনতে চাই। তুমি খারাপ সেটা বলছি না। কিন্তু তোমার আম্মুর হিস্ট্রি জেনে ভাইজান বলেছে তোমাকে তাঁর ছেলের জন্য আনবে না। আর আমরাও চাই নীলকে আত্মীয়ের মাঝে বিয়ে দিবো না। তুমি নীলকে ভুলে যাও লুপা। নীলের থেকে ভালো ছেলে তুমি পাবে।” উনি আরো কয়েকটা কথা বলেন লুপাকে তারপর উনি চলে যান। উনি চলে যাওয়ার পরে শিলা চৌধুরী লুপাকে বলেন,”তুই চলে যা লুপা।” লুপা করুণ স্বরে উচ্চারণ করলো,”ফুপি।” শিলা চৌধুরী শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,”আমার সংসারে আগুন লাগাস না। আমার সংসারে অশান্তি শুরু হয়ে গেছে। আমাকে দয়া করে চলে যা তুই।” লুপা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে চট করে শিলা চৌধুরীর পা জড়িয়ে ধরে। কেঁদে কেঁদে মিনতির স্বরে বলে, “ফুপি আমি নীল ভাইয়াকে ছাড়া মরে যাবো ফুপি। প্লিজ এমন করো না। আমি বাঁচবো না নীল ভাইকে ছাড়া।” শিলা চৌধুরী কঠিন গলায় বললেন,”শুনলি না কি বলল ওরা? বেরিয়ে যা আমার বাড়ি থেকে।” লুপা আরো জোরে উনার পা আঁকড়ে ধরে বলল ”
_আমি যাবো না ফুপি। তুমি চিন্তা করো না আমি সবাইকে মানিয়ে নিবো। আমি সবার পায়ে ধরে নীল ভাইকে চাইবো। দেইখো সবাই মেনে নিবে।”শিলা চৌধুরী নিজের পা ছাড়াতে চাইলে লুপা ছাড়েনা। সে হাউমাউ করে কান্না করে যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে লুপা বলে,”আমি ফুপার সাথে কথা বলবো ফুপি। উনাকে আমি ঠিক মানিয়ে নিবো দেইখো। আমার মা যা করেছে শত শত মানুষ তা করছে ফুপি। আমার মা খারাপ নয়। উনি শুধু উনার ভালোবাসার মানুষটির হাত ধরে বাবার বাড়ি ছেড়েছেন। নানুরা দাদুরা তো উনাকে মেনে নিয়েছে। আমাকে তাড়িয়ে দিওনা ফুপি প্লিজ। তুমি তো আমাকে বুঝো প্লিজ। আমি সত্যি মরে যাবো।” শিলা চৌধুরী গর্জে বলেন,”কী চাস তুই? আমার সংসার ভেঙে শান্তি পাবি?” লুপা তবুও উনার পা ছাড়েনা। চিৎকার করে কাঁদছে সে। কিছুক্ষণ পরে লুপা উঠে দৌড়ে যায় নীলের দাদীর রুমে। নীলের দাদী খাটে বসে ছিলেন আসমা খাতুন চুলে চিরনি করছিলেন। লুপা দৌড়ে গিয়ে আসমা খাতুনের পা জড়িয়ে ধরে, “আন্টি আমি নীল ভাইয়াকে ছাড়া বাঁচবো না। আপনি প্লিজ ফুপাকে বুঝান। আমি আপনাদের বাসার কাজের মেয়ে হয়েও থাকতে রাজি তবুও আমাকে নীল ভাইয়ার থেকে দূরে দিবেন না প্লিজ।” বিলাপ করে কান্না করে যাচ্ছে লুপা।৷ কিন্তু এই কান্না গিয়ে উনার হৃদয় স্পর্শ করতে পারেনি। উনি বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছেন। কাঁদতে কাঁদতে লুপার হেঁচকি ওঠে গেছে। লুপার কান্না দেখে দরজার আড়ালে থেকে শিলা চৌধুরী চোখের পানি জড়ান। লুপা যে উনার ভাইয়ের কলিজার টুকরা। উনার মায়ের ছায়া লুপা। নীলের দাদী কর্কশ গলায় বললেন, “এই মেয়ে আমার মেয়ের পা ছাড়। এইটুকু বয়সে যৌবন এতো উথলে উথলে পড়ছে তাইনা? ছিঃ ছিঃ ছিঃ আমার জন্মেও আমি এমন নির্লজ্জ মেয়ে মানুষ দেখিনি।”লুপা নীলের ফুপিকে ছেড়ে দিয়ে তাঁর দাদীর পা জড়িয়ে ধরে। লুপার নিজেকে ছোট করা দেখে শিলা চৌধুরী রেগে গিয়ে লুপার চুলের মুঠি ধরেন। লুপাকে টেনে ঘর থেকে বের করে আনেন। তারপর সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলে লুপা এটা ওটা ধরে নিজেকে আটকাতে চেষ্টা করে। লুপা হাত জোর করে কেঁদে কেঁদে বলে,”ফুপি আমি চলে যাবো। অন্তত লাষ্ট এক্সামটা দিয়ে যাই প্লিজ ফুপি। আমি চলে যাবো প্রমিজ।” শিলা শুনেন না। লুপাকে বাসা থেকে বের করে বলেন,”চলে যা। মানুষের বাচ্চা হলে কোনোদিন আমার বাড়িতে এসে পা রাখবি না।” শিলা চৌধুরী দরজা বন্ধ করে দেন। লুপা দরজায় অনেক ধাক্কা দেয় রাগে লাত্তি দেয় শিলা দরজা খুলে দেন না। লুপা চেঁচিয়ে বলে,”আমি নীল ভাইয়াকে সব বলে দিবো। তোমরা কি কি করেছে সব বলবো আমি।”আগের থেকে গলা উঁচিয়ে বলে, “যাবো না আমি এখান থেকে। ওখানেই বসে থাকবো আমি। নীল ভাইয়া আসলে আমি বানিয়ে বানিয়ে বলে তোমাদের বকা শুনাবো।” কাঁদতে কাঁদতে দরজায় পিঠ ঠেকে বসে যায় লুপা। আসমা খাতুন লুপার কথা শুনে তৎক্ষণাৎ নীলকে ফোন দিয়ে উনার বাসায় পাঠিয়ে দেন। বলেন একটা পার্সেল আসবে ওটা নিয়ে আসবি। বাড়িওয়ালার কাছে চাবি আছে। নীল চলে যায় তাঁর ফুপির বাসায়। পার্সেলের অপেক্ষা করতে করতে রাতে উনার বাসায় থেকে যায় নীল। আসমা খাতুন চলে আসবে চলে আসবে বলে নীলকে আসতে দিলেন না। লুপা দরজার পাশেই শুয়ে থাকে। ওর ঘুম লেগে গেলে নীলের বাবা বাসায় আসেন। লুপার উপর রেখেই যান তিনি। নীলের মাকে অনেক বকাঝকা করেন। শেষে উনার গায়ে হাতও তুলেন। নীলের বাবা বলেন,”এই সবকিছু তুই করাচ্ছিস। তুই তোর নষ্টা ভাইজি দিয়ে আমার ছেলেকে নষ্ট করতে নষ্টা মেয়ে এখানে নিয়ে এসেছিস।”

লুপা সকালে ঘুম থেকে উঠে তাঁর ফুপিকে ডাকে। উনি বারান্দায় আসেন। লুপা কেঁদে কেঁদে বলে,”ফুপি দরজা খুলে দাওনা প্লিজ। খুব খিদে লাগছে। কিছু খেতে দাওনা প্লিজ। খেয়েই চলে যাবো প্রমিজ।” শিলা চৌধুরীর শাশুড়ী বারান্দায় বসা ছিলেন। শিলা চৌধুরী নড়লেন না। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকালেন। লুপা আবার কাতর গলায় বললেন,”ফুপি একগ্লাস পানি খেতে দাও।” এবারও শিলা চৌধুরী চুপ। লুপা কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলো। তারপর বলল,”আচ্ছা আমি চলে যাবো। আমাকে গাড়ি ভাড়ার টাকা দাও। আমি চলে যাবো ফুপি।” শিলা চৌধুরী রুমে আসলেন। এক হাজার টাকার একটা নোট বের করে লুপার রুমে গিয়ে একটা ব্যাগে ওর কাপড় চোপড় বড়েন। তারপর সব নিয়ে নিচে আসলেন। উনি দরজা খুলে বেরিয়ে আসছেন দেখে লুপার ঠোঁটে বিশ্বজয়ের হাসি ফুটে উঠলো। এসব গাড়ি ভাড়া খাবার কিছুই সে চায়না। সে মনে মনে প্ল্যান করেছে উনি দরজাটা খুলবেন আর সে দৌড়ে রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে থাকবে তারপর নীল আসলে বেরিয়ে আসবে। লুপা দৌড় দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তখনই চোখে পড়ে তার ফুপির গলায় স্পষ্ট হাতের চাপ। লুপা কপাল কুঁচকে তাকাল। উনি টাকাটা লুপার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,”আমার সংসার আমার সুখ এখন তোর হাতে লুপা। বাবা শিক্ষিত ছেলে দেখে বিয়ে দিয়েছিলো সুখী হবো বলে। কতোটা সুখে আছি হয়তো বলতে পারবো না। কিন্তু এতোটা অশান্তি আমার কখনো হয়নি রে।” লুপার কলিজাটা মুচড় দিয়ে উঠলো। শিলা চৌধুরী আঁচলে চোখটা মুছে নিয়ে বললেন,”আমাকে আর ছেলেকে অভিশাপ দিসনা লুপা।
_তোমার গলায় এটা কিসের দাগ ফুপি?” লুপার কথায় শিলা তাড়াহুড়ো করে কাপড় দিয়ে গলা ঢাকতে লাগলেন। লুপা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, “ফুপা তোমাকে মেরেছে? কেন মেরেছে?” উনি ডুকরে কেঁদে উঠে বলেন”
_চলে যা তুই। আমার সংসারে শান্তি ফিরিয়ে দে। ভুলে যা নীলকে।
_আমি পারবো না ফুপি। আমি মরে যাবো। নীল ভাই আমার রক্তে মিশে গেছে। যা কিছু হয়ে যাক আমি নীল ভাইকে ভুলে যাবোনা। ” লুপা শিলার দুহাত আঁকড়ে ধরে মিনতি করে বলে,”ফুপি আমি বাসায় গিয়ে দাদুমনি বাবা চাচ্চু সবাইকে পাঠিয়ে দিবো। দেখবে ফুপা রাজি হয়ে যাবে।” শিলা চৌধুরী আঁতকে উঠলেন। উনার স্বামী কাল উনাকে সাফ সাফ জানিয়ে দিছেন উনার বাপের বাড়ির কেউ যেন এবাড়িতে না আসে। উনি জানেন কেউ যদি আসে তাহলে সবাইকে অপমান করে দিবেন। নিজের ভাইদের অপমান কেমনে সয্য করবেন? শিলা চৌধুরী কান্না জড়িত গলায় বললেন, “এক কাজ কর। এক বোতল বিষ এনে দে। আমি খেয়ে মরে যাই আর তোরা শান্তি মতো বেঁচে থাক।” বলতে বলতে উনি কেঁদে উঠেন। লুপা পাথর হয়ে যায়। তাঁর ফুপি মার খেয়েছে তাও তাঁর জন্য? চোখটা মুছে চলে যেতে পা বাড়ায়। শিলা চৌধুরী পিছন থেকে ডাক দেন,”শুন।” লুপা পিছন ঘুরে তাকায়। শিলা চৌধুরী বলেন,”নীলকে কিছু বলিস না রে। জানিস তো ও খুব রাগী। একবার যার উপর রেগে যায় তাকে কখনো দেখতেই পারেনা। ও এসব জানলে ওর বাবা আর দাদীকে দেখতে পারবে না। আর ওরাও নীলকে কিছু বলবে না। শুধু রাগটা ঝাড়বে আমার উপর। যার প্রভাব পড়বে আমার সংসারের উপর।” লুপা দৌড়ে এসে তাঁর ফুপিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দেয়। উনিও কাঁদেন। লুপা কেঁদে কেঁদে বলে,”তোমার সংসার আমি কখনো ভাঙ্গবো না ফুপি। দাদুমনির মতো দেখতে হয়েছি বলে তোমরা সবাই আমাকে তোমাদের মায়ের ছায়া বলো। আমি তোমাদের 2nd mom তাইনা? বলো, মা কখনো সন্তানের সংসার ভাঙ্গতে পারে?” লুপা উনাকে ছেড়ে দিয়ে চোখের পানি মুছে। কান্নায় তাঁর পুরো শরীর ঝাঁকিয়ে উঠছে। শিলা চৌধুরী আঁচলে চোখ মুছে বললেন,”বড় হয়ে গেছিস।
_হুম দোয়া কইরো যেন আরো বড় হই। এতো বড় হই যেন কলিজাটা কেউ ছিঁড়ে নেওয়ার সাহস না পায়। ” লুপা আর এক মূহুর্ত দাঁড়ায় না চলে যায়। লুপা যাওয়ার তিন চার মিনিট পরে নীল আসে। সে এসেই আগে লুপাকে খুঁজে। কোথাও তাকে না পেয়ে শিলাকে গিয়ে বলে,”আম্মু লুপা কই?
_তোর মামা আসছিলো নিয়ে গেছে।
_নিয়ে গেছে মানে? ওর না একটা এক্সাম বাকি?
_ওটা নাকি বাসা থেকে দিয়ে দিবে।
_ওদের বাসা থেকে তো অনেক দূর পরে যাবে।
_একটা এক্সাম তেমন কিছু হবেনা।
_তাই বলে আমাকে বলেও যাবেনা? দ্যাত।” নীল হাতের চকলেট গুলো ছুঁড়ে ফেলে উপরে চলে গেলো। পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে শান্তি নীড় চলে যায়। ওখানে যাওয়ার পরে সে লুপাকে জিজ্ঞেস করে এভাবে কেন চলে আসলো। তাঁর জন্য কেন অপেক্ষা করলো না। লুপা স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দেয়,”বাবা জোর করে ছিলো তাই চলে এসেছি।” পরের দিন নীল তাঁর ফুপির ফোন পেয়ে চলে যায়। তারপর প্রতিদিন একবার তাঁর মামার বাসায় আসে লুপার জন্য। লুপা ধীরে ধীরে বদলে যেতে লাগে। তাঁর রেজাল্ট বের হয় সে কলেজে উঠে। তারপর একদিন লুপা নীলকে বলে,”নীল ভাইয়া আমাকে ভুলে যাও। আসলে আমি তন্ময়কে ভালোবাসি। আর তোমার সাথে আমার যা ছিলো শুধু আবেগই ছিলো।” নীল সেদিন লুপাকে একটা থাপ্পড় দেয়। তারপর জড়িয়ে ধরে বলে,”হাজার তন্ময় তোর জীবনে আসলেও তুই আমার থাকবি।” লুপা সেদিন ব্যর্থ হয়। তারপর নীলকে দেখানোর জন্য অনেক ছেলের সাথে মেলামেশা করে তবুও নীল বরাবরের মতোই এসবে পাত্তা না দিয়ে লুপাকে বুঝায়। বলে,”দেখ লুপা এগুলা করিস না। তোকে অন্য ছেলের সাথে দেখলে আমার খারাপ লাগে।
_খারাপ লাগলে আমার সাথে থেকো না।
_থাপ্পড় চিনিস? একটা থাপ্পড় দিয়ে পাকনামো ছাড়িয়ে দিবো।”

নীলকে কখনোই লুপা তাঁকে ভুল বুঝাতে পারেনি। একদিন শিলা চৌধুরী ফোন দিয়ে বলেন,”তুই না বলেছিলি মা সন্তানের সংসার ভাঙেনা? তাহলে রোজ রোজ আমার ঘরে এতো অশান্তি কেন? তুই জানিস না তুই যে কলেজে পড়িস সেখানে নীলের ফুপির মেয়ে পড়ে? প্রতিদিন নীল তোর কলেজে যায় এটা গিয়ে ওর মাকে বলে আর এদিকে শুরু হয় আমার সংসারে অশান্তি। কেন তুই এমন করিস লুপা?” উনি হাউমাউ করে কান্না করেন। লুপা সেদিনের পর থেকে সব খারাপ খারাপ ছেলেকে তাঁর বন্ধু বানায়। আর সবাইকে সে বলে নীলকে যেন বলে লুপা তাদের জিএফ। সবাই নীলকে এটা বলেও কিন্তু নীল বরাবরই মতোই এগুলা পাত্তা দেয়না। শুধু লুপাকে বুঝায় এভাবে না চলতে। এতোকিছু করেও যখন নীলকে পিছু ছাড়াতে পারেনি তখন সে তাঁর এক বেষ্ট ফ্রেন্ডের বুদ্ধিতে মিথ্যে প্রেগ্ন্যাসির রিপোর্ট বানায়। আর সেটা দিয়ে তন্ময়ের ছোট ভাইকে পাঠিয়ে দেয় নীলের কাছে। তাকে শিখিয়ে দেয় নীলকে যেন গিয়ে বলে সে লুপার বাচ্চার বাবা হচ্ছে নীল বিশ্বাস না করলে যেন রিপোর্ট দেখায়। সত্যি সত্যি নীল সেদিন বিশ্বাস করেনি। রিপোর্ট হাতে নিয়ে সোজা হসপিটাল চলে যায়। লুপা আগে থেকেই জানতো নীল হসপিটাল এসে যাচাই করবে তাই সে আগে থেকেই ডাক্তারকে বলে রেখেছিলো কেউ আসলে যেন সত্যিটা না বলে। নীল ডাক্তারের কথাও বিশ্বাস করেনি সে লুপাকে ফোন দিয়ে দেখা করতে বলে। লুপা সেদিন দেখা করলে বার বার নীল বলে,”একবার বল নারে বাবুইপাখি। এগুলা সব মিথ্যে। আমার বিশ্বাস হয়না এসব।
_প্রমাণ তোমার হাতে রেখে যদি বলো বিশ্বাস হয়না আমার কিছু করার নেই নীল ভাই।” নীল সেদিন খুব কাঁদে। লুপার পাশে দাঁড়ানো ছেলেটার পা জড়িয়ে বলে,”ভাই শুন। আমি তোর বড় হয়ে তোর পায়ে ধরছি। যা হবার হয়ে গেছে ও ছোট বাচ্চা। বুঝেনি ভুল করে ফেলেছে। তুই ওকে ছেড়ে দে ভাই।” সেদিন লুপা বাড়িতে ফিরে চিৎকার করে কেঁদেছিলো। নীল তবুও লুপাকে চাইতো৷

তারপর একদিন ওই ছেলেটাকে লুপা নীলের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে তাঁর এক বন্ধুকে নিয়ে হোটেলের একটা রুমে বসলো। ওই ছেলেটাকে শিখিয়ে দিলো নীলকে যেন বলে,”আমি ঠকেছি ভাই। লুপা আমার বাচ্চা নষ্ট করে দিয়ে এখন অন্য ছেলের হাত ধরেছে।” নীল সেদিন এসব শুনে ওই ছেলেকে থাপ্পড় মারে।
তারপর ছেলেটা নীলকে নিয়ে হোটেলে যায়। বলে “আমি প্রমাণ দিচ্ছি তোমাকে লুপা কতোটা খারাপ মেয়ে। ও একটা প্লে গার্ল।” নীল রক্তিম চোখে তাকায়। হোটেল একটা রুমের দরজায় ডাক দিলে একটা ছেলের সাথে লুপা বেড়িয়ে আসে। নীল সেদিন অবাক চোখে লুপাকে দেখেছিলো। যেন সে বিশ্বাস করেনি লুপা এখানে। সেদিন লুপাকে মারতে হাত উঠিয়েও মারেনা। চোখটা মুছতে মুছতে চলে যায় সে। একবার চায় শান্তি নীড়ের সবাইকে জানিয়ে দিবে লুপার কথা কিন্তু জানাতে পারেনা। লুপার বিষয়ে এসব জানলে সবাই লুপাকে খুব মারতো। যা সয্য হতো না নীলের। সেদিনের পর থেকে নীলের চোখে লুপা খারাপ। খুব খারাপ। এতো বেশি খারাপ যে লুপার মুখ দেখবে না বলে শান্তি নীড়েই আসেনা।

——–
বর্তমান

দরজার বাইরে থেকে মায়ের ডাক শুনে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায় লুপা। তাঁর বিষাক্ত অতীতে হারিয়ে গেছিলো সে। সেই অতীতে,যে অতীতে তাঁর সম্পর্ক ভাঙতে সে নিজেই ভিলেন ছিলো। আসলে সত্যি বলতে এই বিষাক্ত শহরে কেউ ভিলেন নয়। ভিলেন আমাদের পরিস্থিতি।

চলবে,,,।

গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি।❤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here