ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু
পর্ব_৬
#সুলতানা_সিমা
[কপি করা নিষেধ। শেয়ার করা যাবে]
একের পর এক শুকনো ঢোক গিলে যাচ্ছে অরিন। শামসুল সাহেবের অগ্নি দৃষ্টি অরিনের কলিজা শুকিয়ে কাঠ করে দিছে। উনার এমন দৃষ্টির কারণ কী? উনি কী সব শুনে নিয়েছেন? এখন কী হবে? সবাই কী তাঁকে এখন খারাপ কথা বলবে? শামসুল সাহেব আবার বললেন,”তুমি তো কামরুলের মাইয়াই। এইহানে কী করো? রাস্তাঘাটে খাড়াইয়া পোলাপানের লগে কথা কও? এ পোলা কেডা?” অরিনের গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছেনা। সে যেন জমে গেছে।” উনি আবার বললেন,”এই পোলা তো আমাগো গেরামের [গ্রামের] পোলা না। এই পোলার লগে তুমি কি কথা কও?” শামসুল সাহেবের কথা শুনে দিহান বুঝতে পারলো তাঁর বলা কথাটা উনারা শুনেন নি। সে কিছুটা সাহস জুগিয়ে বলল,”আসলে আঙ্কেল, আমি উনাকে জিজ্ঞেস করছিলাম শাওনদের বাড়ি কোনদিকে। উনি আমাকে রাস্তা দেখিয়ে দিছিলেন। আর কিছু না।” চেয়ারম্যান সাহেব বললেন,”তুমি ডাক্তার বাড়ির মেহমান?
_জ্বি আঙ্কেল।
_আচ্ছা বুঝলাম। [আঙুল দিয়ে দেখিয়ে] ঐ যে সাদা রংয়ের দোতলা একটা বিল্ডিং দেখতাছো। ওই বাড়িটায় গেলেই শাওনরে পাইবা। আর হ্যাঁ অরিন তুমি বাড়িতে যাও। এইভাবে কোনো পোলার লগে রাস্তায় দাঁড়াইয়া কথা কইবা না। অন্য গেরামের মানুষ দেখলে এই গেরামের বদনাম অইবো।” অরিন ক্ষীণ স্বরে জ্বি বলে মাথা নাড়াল। তারপর চলে যেতে পা বাড়ালো। দিহান দাঁড়িয়ে আছে তাঁর পাশ দিয়ে হেঁটে গেলো অরিন। দিহানের গায়ের ঘ্রাণ অরিনের মনের খুব গভীরে গিয়ে লাগলো। অরিন চলে যাওয়ার পরে চেয়ারম্যান শামসুল সাহেব চলে গেলেন। তারপর দিহানও চলে গেলো। অরিনের সাথে একটু কথা হয়েছে। অরিনের কণ্ঠস্বর যেন অন্যরকম৷ শুনলে মনে হয় মনের ঘুমন্ত অনুভূতি গুলা জেগে ওঠে। অরিনকে দেখলে কেমন যেন অদ্ভুত একটা ফিল হয়। আচ্ছা অরিনকে দেখলে এমন হয় কেন? অরিন তাঁর বউ বলে কী? ভাবতেই ঠোঁট কামড়ে হেসে উঠল দিহান। বাড়িতে গিয়ে সোজা চলে গেলো উপরে। মনটা এখন ফুরফুরে লাগছে। অস্থিরতা সব কেটে গেছে। হয়তো অরিনের সাথে কথা হয়েছে বলে।
______________________________________
অরিন বাড়িতে এসে দেখলো দরজায় তালা দেওয়া। গলা উঁচিয়ে মাকে ডাক দিলো। কোনো সাড়া না পেয়ে আশেপাশে তাঁর মাকে খুঁজলো। কোথাও উনাকে দেখতে পেলোনা। তাঁর চাচাতো বোন দুটো উঠুনে বসে গল্প করছিলো। ওরা অরিনের সাথে কথা বলেনা। জহুরার কথা ওদের জিজ্ঞেস করতে গিয়েও জিজ্ঞেস করলো না। আমিরুন নেছার [বৃদ্ধ মহিলা] ঘরে গিয়ে বসে থাকলো। উনি হচ্ছেন অরিনের বাবার চাচি। উনি এখানে থাকেন। অরিনের চাচির টুকটাক কাজ করে দেন। বিনিময়ে দুবেলা দুমুঠো ভাত পান। অরিনের ঘরে ভালো মন্ধ কিছু রান্না হলে সে উনাকে নিয়ে খাওয়ায়। এতে সে শান্তি খুঁজে পায়। ক্ষিধায় অরিনের পেট চোঁ চোঁ করছে। সকালে অল্প ভাজা ভাত খেয়েছিলো৷ এখনো আর কিছু পেটে যায়নি। কিন্তু তাঁর মা কই গেলেন? ডাক্তার বাড়ি কাজে চলে যাননি তো? অরিনের কলিজা মুচড় দিয়ে উঠল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠুন থেকে তাঁর শুকাতে দেওয়া জামাটা নিয়ে আসলো। গায়ের জামাটা ভিজে গেছে। বোরকা পরে রোদে হাঁটা সোজা কথা নয়। গরমে ঘেমে অবস্থা শেষ। দরজা বন্ধ করে অরিন জামাটা খুলা মাত্রই একজন মহিলা এসে অরিনের মাকে ডাকলেন। সেলিনা বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে বললেন,”কী হইছে? ডাকো কেন?
_জহুরা ভাবি কই?
_জানিনা কই গেছে।
_আমার কয়েকটা থ্রিপিস সেলাই দিতে আইছিলাম। ভাবি যখন নাই তুমি রাখো। ভাবি আসলে দিয়ে দিও। ব্যাগের ভিতর আমার এক্সট্রা সেলোয়ার-কামিজ আছে ঐগুলার মাপ দিলেই হইবো।
_এগুলা আমি রাখতে পারবো না বোন। তাছাড়া জহুরা তো ডাক্তার বাড়িতে কাজ নিছে কিছুদিনের জন্য। এসব জামাটামা এতো তারাতাড়ি পাইবানা। মানুষ জামা দিলে মাসের পর মাস ঘুরে যায় জামা পায়না। তাই বলছি এগুলা অন্য কারো কাছে নিয়ে যাও। সেলাইও সুন্দর হবে তারাতাড়ি পেয়ে যাবা। আমার কথায় কিছু মনে কইরো না। আমি তোমার ভালোর জন্য বলছি।” সেলিনার কথা শেষ হতেই অরিন ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। জামা পরছিলো এই কারণে এতোক্ষণ বের হতে পারেনি। অরিনকে দেখে কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেলেন সেলিনা বেগম। উনি মনে করছিলেন অরিন এখনো আসেনি। অরিন উনাকে বলল,”চাচি ব্যাগটা দিন। মা আসলে দিয়ে দিবো।
_কিন্তু আমার তো জামাগুলা তিন দিনের ভিতর নিতে হবে। আমার ভাইঝির বিয়ে। মেয়েরা সবাই গায়ে হলুদের জন্য জামা বানাচ্ছে। এখানে বারোটা জামা।
_পেয়ে যাবেন খুব তারাতাড়ি৷ আমিও তো সেলাই পারি।
_না মা থাক। পরে যদি দেরি হয়? বুঝই তো বিয়ে বাড়িতে পড়বে। তুমিও তো নতুন সেলাই শিখছো, নষ্ট টষ্ট হলে পরে আরো মনমালিন্যতা হবে। এসব আমার ভালো লাগেনা।” অরিন আর কিছু বলল না। আর কিছু বলা নিজেকে ছ্যাচড়া প্রমাণ করা ছাড়া কিছুই নয়। অরিনের দিকে ওই মহিলা একবার তাকিয়ে সেলিনাকে আসছি বলে চলে গেলেন। অরিনের খুব কান্না পেলো। সেলিনা এইভাবে কাজ ফিরিয়ে দিলেন? রাগ হচ্ছে খুব উনার উপর। কিন্তু কিছু তো বলতে পারবে না। উনার বাড়িতে থেকে উনাকে কী বলবে তাঁরা? রাগে দুঃখে চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে তাঁর। আমিরুন নেছার (বৃদ্ধ মহিলার) খাটে শুয়ে পড়ে সে। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে যায়। ঘুম থেকে উঠে বাইরে বেরিয়ে দেখে রাত হয়ে গেছে। তাঁদের ঘরে এখনো তালা দেওয়া। আমিরুন নেছাকে বলল,”দাদী মা এখনো আসেনি?
_নারে বইন।
_এশারের আজান দিয়ে দিছে?
_হ মাত্র নামাজ পড়লাম।” অরিনের বুকটা ধুক করে উঠল। মা কই গেলেন? সত্যি ডাক্তার বাড়িতে গেছেন তো? উনার তো হাই প্রেশার। রাস্তাঘাটে কোথাও মাথাঘুরে পড়ে যাননি তো? মাথাটা চেপে ধরলো অরিন। সব আজগুবি প্রশ্ন গুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
_______________________________________
জহুরা বেগম একটু পর পর সাঞ্জুকে গিয়ে টাইম জিজ্ঞেস করছেন। উনি ভেবেছিলেন আসরের আজান হলেই চলে যেতে পারবেন। তাই ঘরে তালা দিয়ে এসেছেন। ঘরে তালা না দিয়ে কোথাও বের হলে বাড়িতে এসে দেখেন কিছু না কিছু একটা চুরি হয়ে গেছে। জহুরা বেগমের মনটা বার বার কেঁদে উঠছে। অরিন সকালে তো তেমন কিছু খেয়েও যায়নি। না জানি কিছু খেয়েছে কিনা। ভাত আর আলু ভর্তা যা ছিলো সব শুবার ঘরে রেখে এসেছেন। অরিনের যদি খিদা লাগে কি খাবে? আল্লাহ জানে এখন কি করছে। শায়লা বেগমকে এ নিয়ে ছয়বার বলেছেন ভাবি চলে যাই। কিন্তু শায়লা বেগম যেতে দেননা। পাঁচবারের বেলায় বলেন “এইতো সামনেই তোমার বাড়ি যাবানে। শাওন এগিয়ে দিয়ে আসবে। রাতের খাবারের ঝামেলাটা গুছিয়ে যাও।” জহুরা বেগম তবুও বেহায়ার মতো কিছুক্ষণ পরে আবার বলছিলেন যাওয়ার কথা। তখন শায়লা বেগম ঝাঁজালো গলায় বললেন, “এই তুমি যদি এমন করো তাহলে কাল থেকে এসো না তো। আমি তো তোমাকে আনলামই আমি এসব করতে পারবো না বলে।” শায়লা বেগমের ধমক শুনে জহুরা আর একবারও যেতে বলেন নি। শুধু অপেক্ষা করে যাচ্ছেন কখন সবাই খাওয়াদাওয়া করবে, আর কখন উনি যেতে পারবেন। কাজ এখন কিছুই নাই তাই কিচেনে বসে আছেন তিনি। উনারা সবাই বসার রুমে বসে কিসব আলাপ আলোচনা করছেন। গেলে যদি রাগ করেন তাঁরা তাই তিনি যাচ্ছেন না।
লুপা শাওনের রুমের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো। দরজা খুলা। লুপা রুমের ভেতর তাকালো। খাটে বসে দিহান আর শাওন ল্যাপটপে কি জানি করছে। মনোযোগ পুরোটাই ল্যাপটপে। তাঁদের পাশে খাটে হেলান দিয়ে পা লম্বা করে বসে আছে নীল। এক হাত বাজ করা আর এক হাত দিয়ে কপাল টিপছে। মনে হয় মাথা ব্যথা করছে। মুখের ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে নীলের খুব কষ্ট হচ্ছে। হোয়াইট কালার টিশার্ট পরেছে নীল। এই কালারটা নীলের খুব পছন্দ। শুধু পছন্দ নয়, মারাত্মক পছন্দ। লুপা নীল আর এই রংয়ের মাঝে একটা গভীর সম্পর্ক আছে। যা চারজন মানুষ ছাড়া কেউ জানেনা। বুক ছিঁড়ে আসা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কিচেনে গেলো লুপা। জহুরা বেগম বসে ছিলেন। লুপাকে দেখে তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। লুপাকে যতবার দেখছেন উনার অরিনের কথা মনে পরছে। মেয়েটা অরিনের বয়সি। কত দামী একটা টপস পড়েছে সাথে জিন্স প্যান্ট। হাতে কতো সুন্দর ঘড়ি,দামী ফোন। এরকম ভাবে অরিন থাকলে কেমন লাগতো? নিশ্চয়ই এই মেয়েটার মতোই সুন্দর লাগতো। লুপা জহুরা বেগমের সামনে এসে বলল,”
_ফ্রি আছেন আন্টি?
_কিছু লাগবো মা?
_আন্টি আপনি কফি বানাতে পারেন?
_না মা পারিনা।
_কখনো বানান নি?
_না মা। আমার মাইয়া পারে। ওর মামাগো ওখানে গেলে সবকিছু পায়। আমাগো এখানে তো পাইনা মা। কেমনে বানামু।
_আপনার বাবার বাড়ির আর্থিক অবস্থা ভালোই আছে তাইনা?” জহুরা বেগমের মুখটা কালো হয়ে গেলো। কথা ঘুরাতে বললেন,”আপনে কপি বানান আমি দেখি।” লুপা মৃদু হেসে বলল,” অবশ্যই। তবে কপি নয়। কফি। আর হ্যাঁ আপনি নয়। তুমি।
_আইচ্ছা।”
লুপা তিন কাপ কফি বানালো। তারমধ্যে একটা ব্ল্যাক। ট্রেতে কাপ নিয়ে দুটো কাপ এক পাশে রাখলো। আরেকটা কাপ আলাদা করে আরেক পাশে। তারপর জহুরার হাতে ট্রে দিয়ে বলল,”আন্টি কিছু মনে করবেন না আমি আপনাকে দিয়ে কাজ করাচ্ছি বলে। এই ট্রে টা শাওন ভাইয়ার রুমে নিয়ে যাবেন প্লিজ।
_নিমু না কেন মা। দেও নিয়া যাইতাছি ।” জহুরা লুপার হাত থেকে ট্রে নিলেন। লুপা উনাকে আলাদা কাপটা দেখিয়ে বলল,”আন্টি এই কাপটা। সাদা জামা পরা আছে উনাকে দিবেন। প্লিজ।
_আর কেউ যদি নিয়া নেয়।
_নিবে না। উনারা কাজে ব্যস্ত। আপনি এটা ওর হাতে তুলে দিবেন। প্লিজ আন্টি। ও খুব কষ্ট পাচ্ছে। ব্ল্যাক কফি ছাড়া ওর মাথা ব্যথা কমেনা। আর প্লিজ আমার কথা বলবেন না।
_আইচ্ছা মা।”জহুরা বেগম চলে গেলেন। শাওনের রুমের দরজায় গিয়ে দেখলেন শাওন দিহান ল্যাপটপ নিয়ে কি করছে। নীল শুয়ে আছে। জহুরা বেগম দরজায় দাঁড়িয়ে শাওনকে বললেন,”শাওন বাজান আইমু?” শাওন জহুরাকে দেখে তড়িঘড়ি করে উঠে এসে হন্তদন্ত হয়ে বলে,”আরে চাচি আপনি কেন এসব কষ্ট করছেন। দেন দেন আমার কাছে দেন।
_না না বাজান কষ্ট না।” বলতে বলতে পা বাড়িয়ে এসে রুমে ঢুকলেন তিনি। বিছানার উপর ট্রে রেখে আগে নীলের জন্য দেওয়া কাপ হাতে নিলেন। উনি যেন খুব তাড়া করে কাজটা করলেন। দিহানের চোখে ব্যাপারটা অন্যরকম লাগলো। কিন্তু কিছু বলল না। এতোক্ষণ ধরে সে কফির তৃষ্ণায় ছিলো। কিন্তু বলেনি। কারণ সে জানে কফি খাবো বললেই কাজটা অরিনের মায়ের উপর গিয়ে পরবে। যা তাঁর খুব খারাপ লাগবে। শাওনেরও একই অবস্থা। সেও এতোক্ষণ কফি চায়নি শুধুমাত্র অরিনের মায়ের উপর আরেকটা কাজ পরবে বলে। জহুরা বেগম কাপ নিয়ে নীলকে ডাক দিয়ে বললেন,”বাজান আপনার কফি।” নীল চোখ ছোট ছোট করে মুখ তুলে তাকাল। তারপর উঠে বসে কাপ হাতে নিলো। দিহান শাওন কাপ হাতে নিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। দুজনের মনে একই রকম খারাপ লাগা, লজ্জা কাজ করছে। আর এই খারাপ লাগা লজ্জার কারণ একটাই উনি অরিনের মা। জহুরা বেগম বেরিয়ে আসলেন। নীল কফিতে চুমুক দিতে যাবে তখন তার ফোন বেজে উঠল। ফোন হাতে নিয়ে দেখে শামুর কল। ফোন হাতে নিয়ে বেলকনিতে আসলো। ফোন রিসিভ করে কফিতে চুমুক দিলো। শামু ফোনের ওপাশ থেকে অভিমানী স্বরে বলল,”এই তুমি পরে ফোন দিলে তাইনা? অপেক্ষা করে আমাকেই আগে দিতে হলো।
_সরি ঘুমিয়ে গেছিলাম। ঘুম ভাঙার পরে মাথা ব্যথা ছিলো তাই আর ফোন দিতে পারিনি। আর শুনো,,,” কথা বলতে বলতে নীল আরেক চুমুক খেলো। খেয়েই নীল থমকে গেলো। এই কফিটার স্বাদ এতো চেনা কেনো? কে বানিয়েছে এটা?
_কী হলো জান বলোনা?
_শা শামু তো তোমাকে পরে ফোন দিচ্ছি।
_আরে সব সম,,,বাকিটা বলতে দিলোনা নীল। ফোন কেটে দিলো। তাঁর মনে এখন ঝড় বয়ে চলছে। এই ঝড় চলাকালীন পৃথীবির সবকিছু অসয্য লাগে তাঁর।
________________________________________
রাতের খাবার শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। জহুরা বেগম মনে মনে খুশি। উনার যাওয়ার সময়টা তাহলে ঘনিয়ে আসছে। দিহান,নীল,শাওন,রুহান,মনসুর সাহেব আগে বসলেন খেতে। মনসুর সাহেবের সাথে আরেকজন আছেন। উনার নাম মামুনুল হক। মামুনুল হক এই বাড়িতে কাজে থাকেন। বাড়ির অনেক কাজ উনি করেন। যেমন বাজার করা,বাড়ির চারপাশের লতা পাতা ঘাস ছাড়ানো। গাছের যত্ন করা ইত্যাদি। উনি মনসুর সাহেবের খুব বিশ্বস্ত মানুষ। সহজ সরল ও ধার্মিক তিনি। তাই উনাকে পাশে নিয়ে খেতে মনসুর সাহেবের কোনো দ্বিধা নেই। শাওনের তরকারি লাগবে কিন্তু জহুরা বেগমকে ফরমায়েশ দিতে দ্বিধা হচ্ছে। জহুরা বেগম তরকারির বাটিটা শাওনের এগিয়ে দিলেন। শাওনের খুব লজ্জা লাগছে। এদিকে দিহানের মনটা অস্থির হয়ে আছে। অরিনের মা এখানে তাহলে অরিন ওখানে একা কেমনে কি করছে আল্লাহই জানে। মনসুর সাহেব খেতে খেতে বললেন,
“ভাবি বাড়িতে যুবতী মেয়ে আছে আপনি সন্ধ্যা হলেই চলে যাবেন। চারদিকের অবস্থা ততটা ভালো না।” দিহানের আর শাওনের হাত এক সাথে থেমে গেলো। দুজনই বুক অজানা ভয়ে ধুক করে উঠল। জহুরা বেগম কিছু বললেন না। মনসুর সাহেব বললেন,”শুনলাম বাবুলের ছেলে নাকি তোমার মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিছে?”
_হ ভাইজান।
_তো কী ভাবলেন বিয়ে দিবেন?
_দেহি ভাইজান। আমি তো না কইরা দিছিলাম৷ তয় ওরা পিছু ছাড়ে না। পোলাডাও ভালা আছে। আর তারা কইল বিয়ার পরে নাকি অরিনরে পড়াইব।
_তোমার মতামত হ্যাঁ হলে দিয়ে দাও ভাবি৷ বাবুল হচ্ছে গ্রামের একজন আদর্শ মানুষ। আর ছেলেটাও সত্যি ভালো। টাকা পয়শার চিন্তা করবা না। আমরা আছি।” শাওন তার বাবাকে কিঞ্চিৎ রাগি গলায় বলল,”বাবা সবকিছুতে তুমি বাড়াবাড়ি করো না তো।
_আমি আবার কী করলাম?” শাওন কিছু না বলে প্লেট রেখে উঠে গেলো। নীল শাওনকে ডাকতে ডাকতে সেও উঠে গেলো। দিহানের গলা দিয়ে খাবার নামছেনা। কেন জানি তাঁর বুকে চিনচিন ব্যথা হচ্ছে৷ এমন হচ্ছে কেন তাঁর? অরিনের বিয়ে শুনে? নাকি অন্যকিছু? শেষমেশ দিহানও উঠে গেলো। মনসুর সাহেব বোকা ভনে গেলেন। উনি ধরে নিলেন শাওন রাগ করেছে উনি বিয়ের খরচ বহন করবেন বলেছেন বলে। খাওয়া শেষ করে মনসুর সাহেব আর মামুন সাহেব চলে গেলেন। তারপর শুরু হলো বাকিদের খাওয়া। সবাই খেতে বসে একবারও জহুরাকে কেউ ডাকলো না। লুপা দুইতিন বার ডাকলো কিন্তু পরে আর ডাকলো না। হয়তো শায়লা বেগম না বলেছেন। খাওয়া শেষ হলে সব গুছানো শুরু করেন জহুরা। গুছানো শেষে জহুরা শায়লা বেগমকে বললেন,”ভাবি এহন যাই গা?
_ও হ্যাঁ তুমি খেয়েছিলে?
_বাড়িত গিয়ে খাইমুনে ভাবি। আমার কাছে লাইট নাই কেউ আগাইয়া দিলে ভালো হইতো।
_দাঁড়াও আমি আসছি।” বলেই শায়লা বেগম কিচেনে গেলেন। যেহেতু এখন শীতের সময়। তাই খাবার ফ্রিজে রাখা হয়নি। একটা টিফিনে ভাত তারকারি দিলেন। একটু বেশি করে দিলেন। উনার মেয়ে আছে, তাকে নিয়ে খাবেন এটা ভেবেই। টিফিন এনে জহুরার হাতে দিয়ে শাওনকে গিয়ে বললেন জহুরাকে এগিয়ে দিতে। কথা না বাড়িয়ে শাওন আসে। অরিনদের বাড়ি যাবে শুনে দিহানও শাওনের সাথে আসে। নীলকেও বলে কিন্তু নীল আসেনা।
টিনের গেট খুলে অরিনদের বাড়িতে ঢুকলো সবাই। দিহান চারদিকে তাকাচ্ছে। এই দ্বিতীয়বার সে এই বাড়িতে আসলো। প্রথমবার দিনে এসেছিলো বলে সব দেখতে পারছিলো। এখন রাত তাই কিছুই দেখতে পারছেনা ভালো করে। শাওন জহুরা বেগমের উদ্দেশ্য বলল,”চাচি ঘরে তালা দেওয়া, অরিন কই তাহলে?
_ওর দাদীর ঘরে হইব।
_তাহলে যাই চাচি?” জহুরা বেগম কিছুটা লজ্জার সাথে বললেন,”কিছু খাওয়াতে পারমু না তবুও ঘরে আহো বাজান। একটু বইয়া যাও।” শাওন দিহান দুজনই মনে মনে এটা চেয়েছিলো। তাই কেউই আপত্তি করলো না। জহুরা বেগম তালা খুলে ঘরে ঢুকলেন। দিহান আর শাওন ও পিছু পিছু ঢুকলো। দিহান ঘরের চারপাশটা দেখলো। ঘরটা খুব সুন্দর পরিপাটি। একটা খাট একটা পড়ার টেবিল একটা আলনা আর একটা আলমারি। টিনের ঘরও এতো সুন্দর হতে পারে হয়তো দিহান এখানে না আসলে জানতে পারতো না। দিহান আর শাওন খাটে বসলো। জহুরা বেগম অরিনকে আনতে গেলেন। আমিরুন নেছার দরজায় গিয়ে কয়েক ডাক দেওয়ার পরে আমিরুন নেছা এসে দরজা খুলে দিলেন।
_অরিন আপনের কাছে নি চাচি?
_হ ঘুমাই গেছে।” জহুরা বেগম অরিনকে ডাক দিলেন। একটু নড়ে আবার ঘুমিয়ে যায়। জহুরা বেগম ধরে বসালেন। বিড়বিড় করে বললেন, “বাপের মতন অইছে ঘুমের গাঁধা।” অরিনকে ধরে বসানোয় তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। কিন্তু ঘোর এখনো কাটেনি। জহুরা অরিনকে ধরে ধরে নিয়ে ঘরে আসলেন। দিহান দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো, জহুরা বেগম অরিনকে ধরে নিয়ে এসে ঘরে ঢুকছেন। চোখ বন্ধ করে কাঁদো কাঁদো মুখ বানিয়ে হাঁটছে অরিন। দৃশ্যটা দেখে দিহানের হাসি পেলো। শাওন ঘোর লাগা চোখে অরিনকে দেখছে। ঘরে ঢুকে জহুরা বেগম অরিনকে ঝাকি দিলে অরিন তাকায়। শাওন আর দিহানকে দেখে অরিনের সব ঘুম উধাও হয়ে গেলো। তৎক্ষণাৎ ওড়না মাথায় টেনে নিলো। শাওন হেসে উঠে বলল,”কী অরিন ঘুম ভাংলো?” অরিন লজ্জায় কাল হয়ে গেলো। লজ্জায় মাথা তুলতে পারছে না। তাঁর ঘরে দিহান? ইশ কি লজ্জা। অরিন আড়চোখে একবার দিহানের দিকে তাকালো। তাকাতেই দুজনের চোখাচোখি হয়ে যায়। চট করে চোখ নামিয়ে নেয় অরিন। দিহান যেখানটায় বসেছে ওখানে অরিন ঘুমায়। অরিনের বালিশে দিহানের গা ঘেঁষে আছে। শাওন বলে উঠল,”তাহলে আমরা উঠছি চাচি।
_কিছু খাওয়াইতে পারলাম না বাজান।
_চাচি সমস্যা নেই। কোনো একদিন খেয়ে নিবো।
_আমি কি কোনো খাওয়াইতে পারমু বাজান?
_হয়তো আসবে এমন কোনোদিন না খাওয়ালে চলবেনা তখন খেয়ে নিবো।” বলেই শাওন হেসে উঠে। জহুরাও হাসেন। শাওনের কথার গভীরে হয়তো কেউ যেতে পারেনি। শাওন বসা থেকে দাঁড়িয়ে বলল,”
_ এখন যাই। যাচ্ছি অরিন ঘুমিয়ে পরো।
_জ্বি ভাইয়া।” শাওন ইশারায় জহুরা বেগমকে দরজার সামনে ঢেকে নিলো। বাবুলের ছেলের সাথে যেন অরিনকে বিয়ে না দেয় সেজন্য উনাকে বুঝাতে লাগলো। দিহান এই ফাঁকে অরিনের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল,”যাচ্ছি।” অরিন লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো। কিন্তু সাথে সাথে আবার তাকালো। দিহান তাঁর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে৷ অরিনেরও ঠোঁটের কোণে হাসি চলে আসলো। চোখে চোখ রেখে দুজন দুজনের দিকে চেয়ে থাকলো। দিহান ফিসফিস করে বলল,”যাই?” অরিন মুচকি হেসে সম্মতি জানালো। শাওনের কথা শেষ হলে দিহানকে বলল,”চল যাই।” শাওন বেরিয়ে গেলো। দিহান অরিনের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় দিহানের গা অরিনের গায়ের সাথে ঘষা খায়। দিহান চাপা স্বরে বলে যায়,”গুড নাইট।” দিহান চলে যায়। দিহানের গায়ের ঘ্রাণ দ্বিতীয় বারের মতো অরিনকে মাতাল করে দেয়। ওরা চলে গেলে জহুরা বেগম দরজা বন্ধ করে আসেন। টিফিন বের করে অরিনকে খেতে বলেন। অরিন খেতে চায়না। জোর করে উনি অরিনকে খাওয়ান। খেয়েদেয়ে শুয়ে পরে দুজন। অরিনের বালিশে দিহানের পারফিউমের ঘ্রাণ লেগে আছে। এতে যেন অরিনের হার্টবিট আরো বেড়ে গেলো। বালিশে নাক ডুবিয়ে চোখ বন্ধ করলো। চোখে ভাসলো দিহানের হাসি মুখকানা। অরিন চোখ খুলে নিলো। দিহানের বলা যাচ্ছি,যাই,গুড নাইট কথাগুলা বার বার কানে বাজছে। মানুষটাকে মনে গভীর থেকে অনুভব করছে সে। দিহান যেখানে বসেছিলো সেখান থেকে হাত বুলিয়ে এনে ঠোঁটে লাগিয়ে চুমু খেলো। হঠাৎ এই বোকামিটা কেন করলো, সেটা বুঝলো না অরিন।
__________________________________
সকালে ঘুম থেকে উঠে জহুরা বেগম উঠুন ঝাড়ু দিয়ে গেটের বাইরে আসলেন। এসে দেখলেন গ্রামের সব মানুষজন নদীর দিকে দৌড়ে যাচ্ছেন। জহুরা বেগম একজনকে পুরুষকে বললেন,” কী হইছে ভাইজান সবাই কোনহানে যায়?” লোকটি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,”
_ওই যে বাবুল মিয়া আছে না? উনার পোলার লাশ নদী পাড়ে কাটা অবস্থায় পাইছে।
_কিইইইইইই। এই পোলারে কাটলো কিডা?
চলবে,,,,।
সিজন ওয়ানের মতো এটারও সব কিছু আস্তে আস্তে খোলাসা হবে। তাই ধৈর্য্য করুন প্লিজ। মাত্র তো গল্পের শুরু। গঠন মূলক মন্তব্য আশা করছি।❤