ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু পর্ব_৭

0
1303

ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু
পর্ব_৭
#সুলতানা_সিমা

[কপি করা নিষেধ। শেয়ার করা যাবে]

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে তমালপুরে এমন ঘটনা শুনে আতঙ্কে আছে সবাই। হঠাৎ করে এতো ভালো একটা ছেলেকে এভাবে কে মেরে দিতে পারে। আর কেনই বা তাকে মারবে? কারো মাথায় আসছে না সেটা। পুলিশ এসেছিলো। অনেক তদন্ত করে লাশ নিয়ে গেছে। একটা ঘটনায় পুরো গ্রামবাসী স্তব্ধ হয়ে গেছে। ডাক্তার বাড়িতেও নিরবতা ঘিরে ধরেছে। একটা তরতাজা ছেলের এমন নির্মম মৃত্যু কেউ মেনে নিতে পারছেনা। জহুরা বেগমও আজ কাজে আসেন নি। শায়লা বেগম কোনো রকম সবকিছু সামলে নিলেন। জহুরা বেগম না আসাতে তিনি ভেবে নিলেন, হয়তো এমন ঘটনায় তিনি বেশ আহত হয়েছেন তাই আসেন নি। যেহেতু ছেলেটার সাথে অরিনের বিয়ের আলাপ চলছিলো সেহেতু আহত হওয়ারই কথা।

দিহান শাওন নীল একবার গিয়েছিলো লাশ দেখতে। মাথা ছাড়া রক্তাক্ত দেহ দেখে সবারই মাথা চক্কর দিয়ে উঠে। লাশ দেখে আসার সময় অরিনদের বাড়ির সামনে দিয়ে এসেছে তাঁরা। দিহান অরিনদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে এসেছে। অরিনকে দেখার জন্য মনটা কেমন যেন করছিলো। কিন্তু শাওন একবারও অরিনদের বাড়ির দিকে তাকায়নি। সে একদম নিশ্চুপ ছিলো। অনুভূতিহীন মানুষদের মতো হেঁটে আসছিলো। সেদিন সারাদিন চলে যায় সবারই নিরবতায়। দিহানদের হিসাব থেকে একটা দিন চলে যায়। আর মাত্র চারদিন থাকবে তাঁরা। এই চারদিন পরে তাঁকে চলে যেতে হবে ঢাকায়। ওখানে চলে গেলে তো আর অরিনকে পাবেনা। তখন কী হবে? আচ্ছা অরিনকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে কেমন হয়? দিহানের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। বাসায় গিয়েই তাঁর বাবাকে পাঠিয়ে দিবে। তারপর বিয়ে করে নিয়ে যাবে তাঁর বউকে। বউকে বিয়ে করে বউ বানাবে। ভাবতেই হেসে উঠে দিহান। রাতে আর ঘুম হয়নি তাঁর। বার বার অরিনের লজ্জায় লাল হওয়া মুখটা চোখে ভাসছে। এ কেমন টান অরিনের প্রতি তাঁর? কেন অরিনকে একটা পলক দেখার জন্য মন এতো ছটফট করে? সে কী অরিনকে ভালোবেসে ফেলেছে? দুইদিনের পরিচয়ে কি ভালোবাসা যায়? ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে যায় দিহান।

পরেরদিন সকালে দিশা লুপা ইশি গ্রাম ঘুরতে যাবে বলে তারাতাড়ি নাস্তা সেরে নিলো। শায়লা বেগম তাদের বাড়ির কাজের লোক মামুনুল হককে বলে দিলেন জহুরা বেগমের বাড়িতে গিয়ে যেন বলে আসেন তারাতাড়ি আসতে। ১২টা বেজে গেছে অথচ তিনি এখনো আসেন নি। দুপুরের রান্না করবেন কখন? শাওন নীল তাঁর নানুমনি ও মামাতো বোনদের নিয়ে ঘুরতে বের হলো। গাড়িতে করে যায়নি কেউ। হেঁটে হেঁটে ঘুরাঘুরির মজাই আলাদা। সবাই শায়লা বেগমকেও জোর করে সাথে নিয়ে গেলো। দিহান যায়নি তাঁর মাথা ব্যথা করছে তাই। শায়লা বেগম দিহানকে বলে গেলেন জহুরা বেগম আসলে যেন বলে উনি মাছ মাংস চিংড়ি যা যা ভিজিয়ে রেখেছেন ওগুলা রান্না করতে। আর যা যা রান্না করতে হবে,কোন কোন রুম মুছতে হবে সব বলে গেলেন। উনাদের আসতে দেরি হতে পারে। গ্রামের উত্তরদিকে শাওনদের পুরাতন বাড়ি। ওই বাড়িতেও ঘুরে আসবেন বলে মনে মনে ভাবছেন শায়লা।

______________________________________

অরিনদের বাড়ির ভিতর ঢুকে মামুনুল হক জহুরা বেগমকে ডাক দিলেন। অরিন বেরিয়ে আসলো। সাদা সেলোয়ার ওড়না ও কালো রংয়ের কামিজ পরেছে অরিন। মামুনুল হক কপাল কুঁচকে তাকালেন অরিনের দিকে। উনার কাছে অরিন একটা অলক্ষী মেয়ে। কিছুটা গম্ভীর গলায় বললেন,”

_জহুরা ভাবি কই?
_চাচা মায়ের শরীর খারাপ ঘরে শুয়ে আছেন।
_কইয়ো ডাক্তার বাড়ি থাইকা খবর দিছে তারে তারাতাড়ি যাইতে।” কথাটা বলেই মামুনুল হক চলে গেলেন। অরিন ঘরে গিয়ে দেখল জহুরা বেগম বিছানা থেকে উঠার চেষ্টা করছেন। অষুধ শেষ হয়ে গেলে এই সমস্যা গুলা দেখে দেয় উনার৷ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেন না। অরিন উনাকে ধমক দিয়ে বলল,”শুয়ে থাকো যাওয়ার দরকার নেই।
জহুরা বেগম শীর্ণ গলায় বললেন,”
_যাইতে অইবো রে অরিন। দুইদিন কাজ করার পরে পাঁচশো টাহা দিবো কইছে। আইজকা গেলে টাহাডা দিবো। টাহা ছাড়া অষুধ আনমু কেমনে রে? হাতে যা পঞ্চাশ টাহা ছিলো ওটা দিয়া তো কাইল আলুর দাম দিয়া ডাইল নিয়া আইছিলাম।”

অরিন কিছু বলল না। কি বলবে সে ভেবেই পেলোনা। সত্যিই তো, টাকা ছাড়া কেমনে কী হবে? আজ গেলে যদি পাঁচশো টাকা দেয় তাহলে আজকে যাওয়াটা সত্যি জরুরি। কিন্তু এই অবস্থায় কি উনাকে দেওয়া ঠিক হবে? অনেক্ষণ চুপ করে থাকলো অরিন। জহুরা বেগম উঠতে চাইলে অরিন উনাকে বলে,”তোমার যেতে হবেনা আমি যাচ্ছি।
_না না তুই যাইবিনা। তুই ঘরে বয় আমি যাইতাছি।” মায়ের কথায় অরিন ঝাঁঝালো গলায় বলে,”
_ঘরে বসার মতো ব্যবস্থা করে রাখছো? যেতেই তো হবে তাইনা? ” বলতে বলতে চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে অরিনের। উঠে রান্না ঘরে গিয়ে খাবার এনে টেবিলে রেখে বলল,”খিদে লাগলে খেয়ে নিবা। আমি যাচ্ছি।
_তুই যাইবিনা অরিন।”জহুরা বেগমের কণ্ঠে ধমক। অরিন ঝাঁঝালো গলায় বলল,”
_কেন যাবো না? যদি কারো সাথে মিশে যাই সে জন্য? এতো হিংসা কেন তোমার ভেতর? কারো সাথে মিশল্র কি হয়?”

রাগে অরিন বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। রাগ হচ্ছে তার নিজের তীক্ষ্ণ জীবনের উপর। জহুরা বেগম উঠলেন। খাট থেকে উঠে মাটিতে পা রাখতেই হাঁটু গেড়ে বসে গেলেন তিনি। পায়ে যেন কোনো শক্তি নেই। গলা উঁচিয়ে অরিনকে ডাক দিলেন। অরিন শুনেও দাঁড়ালো না বেড়িয়ে গেলো গেট খুলে। জোরে ডাকার ফলে জহুরা বেগমের কাশি উঠে গেলো৷ কাশতে কাশতে খাটে উঠে বসলেন। উনি অরিনকে যেতে বারণ করছেন কারণ উনি জানেন,ডাক্তার বাড়ি থেকে রাত করে আসতে হবে। তারপর রাতের বেলায় উনাদের যুবক ছেলেকে দিয়ে পাঠিয়ে দিবেন। রাস্তায় কোনো অঘটন ঘটলে তার দায়বার কে নিবে?

ডাক্তার বাড়ির গেটের ভিতর ঢুকতেই অরিন দেখলো দিহান উঠুনে বসে বসে ফোন টিপছে। গেট খুলার শব্দে গেটের দিকে তাকালো দিহান। অরিনকে দেখে তাঁর বুকটা ধুক করে উঠল। অরিন কাজের জন্য আসেনি তো? অরিন মাথা নিচু করে হেঁটে ঘরের ভিতর চলে গেলো। দিহানের সামনে দিয়ে আসতে তাঁর লজ্জা লেগেছে। ঘরের ভিতর এসে দেখলো চারদিকে পিনপতন নীরবতা৷ এই বাড়ির ভেতর অরিন এই নিয়ে তিনবার এলো। আগের দুবারই এসেছিলো সেলাইয়ের কাপড় দিতে। নয়তো যতবার এসেছে বাইরে থেকে চলে গেছে। নিচে কাউকে না পেয়ে উপরে গিয়ে প্রতিটি রুমে উঁকি দিয়ে দেখলো কেউ কোথাও নেই। আবার নিচে নেমে আসলো সে। বাইরে গিয়ে দিহানকে জিজ্ঞেস করবে কি সবাই কোথায়? কিন্তু কী ভাবে জিজ্ঞেস করবে? উনি কী ভাববেন? অরিন আর গেলোনা। সোফায় বসে অপেক্ষা করতে লাগলো।

চারদিকটা তাকিয়ে তাকিয়ে রুমটা দেখছে অরিন। কতো সুন্দর করে সাজানো ড্রয়িংরুমটা। কতো দামী দামী ফার্নিচার৷ দরজার দিকে তাকাতেই কেঁপে ওঠে অরিন। দিহান দাঁড়িয়ে আছে। অরিন বুকে থু থু দিলো। হঠাৎ এভাবে কাউকে চোখে পড়লে ভয়ে মানুষ কিছুটা কেঁপে ওঠেই৷ অরিনের ভয় পাওয়া দেখে দিহান হেসে উঠে। রুমের ভিতর ঢুকতে ঢুকতে বলল, “মানুষ ভূতপ্রেত দেখলেও এভাবে কেঁপে ওঠবে না। তুমি যেভাবে একটা মানুষকে দেখে কেঁপে উঠেছো।” অরিন কিঞ্চিৎ লজ্জা পায়। মাথা নিচু করে বসে ওড়নায় আঙুল পেচাতে থাকে। দিহান বলে, “আব,,,,ফুপি বাড়িতে নেই ঘুরতে গেছেন।” অরিন অবাক হয়ে তাকালো দিহানের দিকে।
_উনি না খবর পাঠালেন আসার জন্য?
_কেন?
_মানে কা কাজ করার জন্য।” দিহানের কলিজা মুচড় দিয়ে উঠে। অরিন সত্যি সত্যি কাজে এসেছে? আসতেই পারে তাতে দিহানের এতো কষ্ট লাগছে কেন? ব্যথিত চোখে তাকাল অরিনের দিকে। তার ফুপি যতটা কাজের হিসাব দিয়ে গেছেন, সেগুলা অরিন কেমনে করবে? দিহানের অস্থিরতা বেড়ে গেলো। তাঁর ইচ্ছে করছে অরিনকে নিয়ে চলে যেতে এখান থেকে। কিন্তু সে অধিকার কী তাঁর আছে?

_উনাকে একটা ফোন দিয়ে বলবেন আমি এসেছি। কী কী করতে হবে একটু জিজ্ঞেস করুন প্লিজ।” দিহান বুক ছিঁড়ে আসা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফোন দিচ্ছি বলে কিচেনে গেলো। মাংস আর মাছ ভিজিয়ে রাখা বোল গুলা লুকিয়ে রাখলো। তারপর এসে অরিনকে বলল,”আসো কিচেনে।” দিহান অরিনকে নিয়ে কিচেনে আসলো। তারপর বলল,আমাকে এক কাপ চা বানিয়ে দাও।
_চাচি এটা বলেছেন?
_হ্যাঁ বলেছেন যে সব রান্না করা আছে, তোকে চা বানিয়ে দিতে বল।” অরিন কথা বাড়ালো না। সে চায়ের পানি বসালো।

দিহান মিটিমিটি হাসছে। মনে মনে ভাবলো অরিন কতো বোকা। দুদিন আগে শাওন বলেছে অরিনের হাতের চা নাকি পৃথীবির সেরা চা। সেও দেখতে চায় তাঁর বউ কেমন চা বানায়। অরিন কাজ করছে আর তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে দিহান। অরিন আড়চোখে একবার দিহানের দিকে তাকাতেই তাঁদের চোখাচোখি হয়ে যায়। দুজনই চট করে চোখ সরিয়ে নেয়। আবারও আড়চোখে একজন আরেজনের দিকে তাকাতেই দুজনের চোখে চোখ পড়ে যায়। দিহান ঠোঁট কামড়ে হেসে উঠে। এই হাসার দৃশ্যটা অরিনের মনের ঘরে কড়া নাড়লো। মনে মনে বলে উঠলে এতো সুন্দর কেন মানুষটা।

দিহান অরিনের একটু পাশ ঘেষে দাঁড়ালো। অরিন সরে যেতে পারেনা কারণ সরে গেলে সে চুলা থেকে দূরে হয়ে যাবে। অরিন আন্দাজ করতে পারছে দিহান তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। দিহানের এতো কাছে আসা এভাবে তাকানো সবকিছুতে একটু অস্বস্তিবোধ করছে অরিন। এমনিতেই দিহানের আশে পাশে থাকলে তাঁর নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসে। দিহান একটা জিনিস লক্ষ্য করলো অরিনের নাকে নাক ফুল নেই। যদিও নাক ফুল শুধুমাত্র নারীদের সৌন্দর্যের একটা অংশ। এর থেকে বেশি কিছু নয়। তবুও বেশির ভাগ বিধবা নারীর চিহ্ন এটা। কেন জানি দিহানের খারাপ লাগলো। অরিন বিধবা বেশে কেন থাকবে? এটা সে মানতে পারছে না। দিহান গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

“আব,,অরিন তোমার নাক ফুল নাই কেন?” অরিন কিছু বলল না। দিহান আবার বলল,”নাক ফুল দিও অরিন। এটা নারীর সৌন্দর্য্য বাড়ায়।
_বিধবা মেয়েদের কোনো সৌন্দর্য্য থাকে না।” গম্ভীর গলায় বলল অরিন। দিহান বলল”
_তুমি এখনো বিধবা?” অরিনের বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো। দিহানের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো দিহান কাতর চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। অরিন চোখ নামিয়ে নিলো। সত্যিই তো সে কী এখনো বিধবা? অরিন চায়ের কাপটা দিহানের হাতে দিয়ে চলে যেতে লাগলো। দিহান বলল”

_Will you be my friend?” অরিন থেমে গেলো। দিহানের দিকে একবার তাকিয়ে কিছু না বলেই বেরিয়ে গেলো কিচেন থেকে। দিহান দৌঁড়ে গিয়ে অরিনের সামনে দাঁড়ালো। অরিন বলল,”পথ ছাড়ুন।
_আমি তো বেশি কিছু চাইনি অরিন? বলোনা? হবে আমার বন্ধু?” অরিন দিহানের পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। দিহানও দৌড়ে অরিনের পিছু পিছু আসলো। গেটের সামনে আসতেই অরিনের হাতে হেচকা টান দিলো। অরিন এসে দিহানের বুকে ধাক্কা খায়। সাথে সাথেই দিহানের আর অরিনের হার্টবিট দ্রুত গতিতে চলতে থাকে। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসে দুজনের। দিহানের এক হাত অরিনের কোমরের পেছানো যার ছোঁয়া অরিন হজম করতে পারছেন না। অরিন নিজেকে ছাড়াতে চায় দিহান ছাড়েনা। অরিন দিহানের ঘাড় সমান হওয়ার দিহানের গরম নিঃশ্বাসগুলা অরিনের নাক মুখ ছোঁয়ে যাচ্ছে। আর এই নিঃশ্বাসের ছোঁয়ায় শিহরণ তুলছে অরিনের প্রতিটি শিরায় শিরায়। শীতল হয়ে আসছে তাঁর অঙ্গ প্রতঙ্গ। অরিন তাঁর কোমর থেকে দিহানের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে কাঁপা গলায় বলল,

“ছা ছা ছাড়ুন।” দিহান নড়লো না। সে ঘোরের মধ্যে আছে। অরিন চোখ তুলে দিহানের দিকে তাকালো। দিহান নেশাভরা চোখে তাকিয়ে আছে। অরিন চোখ নামাতে ছেয়েও পারলো না নামাতে। দিহানের চোখের নেশা তাঁর চোখে প্রভাব ফেলছে। অরিন আবার বলল,”ছাড়ুন।” দিহান মৃদু স্বরে বলল,”তোমার বডি অনেক সফট।” অরিন চোখ বড় বড় করে দিহানের দিকে তাকালো। চট করে ধাক্কা দিয়ে দিহানের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। ধাক্কা খেয়ে দিহান একটু দূরে ছিটকে যায়। ধাক্কায় দিহানের হুস আসে। কি বলে দিছে মনে আসতেই জিভে কামড় কাটে সে। অরিন চলে যেতে চাইলে দিহান আবার অরিনের হাত ধরে নেয়। অরিন বলে,

“হাত ছাড়ুন।”
_সরি অরিন মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে।
_ঠিক আছে। হাত ছাড়ুন।
_তাঁর আগে তোমার নাম্বার দাও।
_আমার তো ফোনই নাই। নাম্বার দিবো কেমনে?
_তোমার আম্মুর তো ফোন আছে। তাঁর নাম্বার দাও।
_দেখুন আপনি বাড়াবাড়ি করছেন। হাত ছাড়ুন।
_ছাড়বো না আগে নাম্বার দিতে হবে।
_আরে আপনি হঠাৎ করে এমন করছেন কেন?
_তুমিই বা এমন করছো কেন?
_আপনি আমার সাথে বেয়াদবি করছেন, আর আমি আমি এমন করবো না?
_বেয়াদবি কাকে বলে practically দেখিয়ে দিবো? বাড়িতে কেউ নেই৷ শুধু তুমি আর আমি। তুমিও আমার হালাল বউ। আমার কিন্তু কোনো প্রবলেম নেই?”

বলেই দিহান একটা চোখ টিপ দিলো। অরিনের ছটফটানি বন্ধ হয়ে যায়। ভয়ার্ত চোখে দিহানের দিকে তাকায়। দিহান ফিক করে হেসে উঠে। অরিনের হাত ধরে ঘরের দিকে নিয়ে যায়। ভয়ে অরিন চিৎকার করতে লাগে। একটা পিলারে ধরে নিজেকে আটকায়। অরিনের কান্ডে দিহানের হাসি থামাতে পারছেনা। সে জোরে জোরে হাসছে। অরিনের কাছে দিহানের হাসি পিশাচের হাসির মতো লাগছে। দিহান অরিনকে কোলে তুলে নিলো। অরিন হাত পা ছুঁড়ে চিৎকার করতে লাগলো। দিহান অরিনকে নিয়ে রুমে আসলো। অরিন নিজেকে ছাড়াতে না পেরে দিহানের ঘাড়ে কামড় দিয়ে বসে। দিহান ব্যথায় কুকিয়ে উঠে। অরিনকে ছেড়ে দিয়ে দরজা এটে দরজা ঘেঁষে দাঁড়ায়। ঘাড়ে হাত দিয়ে আহহহহহ বলে আর্তনাদ করে উঠে। দিহানের মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে দিহান খুব ব্যথা পেয়েছে।

ঘাড়ে ম্যাসেজ করতে করতে দিহান এসে অরিনের হাত ধরে। হাত ধরে রেখে তাঁর লাগেজ খুলে। শাঞ্জুর জন্য দুইটা চকলেট বক্স এনেছিলো। দিতে ভুলে গেছে। এখন এগুলা অরিনকে দিবে। অরিনের দিকে বক্স গুলা বাড়িয়ে দিহান বলল,”যদি উঠুনে দাঁড়াও বলে চলে আসতাম গিয়ে দেখতাম তুমি চলে গেছো। তাই এভাবে আনতে হলো। কিন্তু তুমি তো,,,উফফফফ। খুব লেগেছে।” অরিন মাথা নিচু করে ফেললো। এতো নেগেটিভলি না ভাবলেও পারতো। দিহান অরিনকে বলল,”এগুলা তোমার জন্য।
_ধন্যবাদ। কিন্তু আমি এগুলা নিতে পারবো না।
_প্লিজ অরিন।
_ক্ষমা করবেন আমাকে। হাত ছাড়ুন। যখন তখন কেউ চলে আসলে আমার চরিত্র নিয়ে কথা উঠবে।
_হ্যাঁ ছেড়ে দিবো এগুলা নাও।
_আমি নিতে পারবো না ছাড়ুন আমায়।” দিহান বুঝে গেলো অরিনকে সোজা কথায় মানানো যাবেনা। তাই সে বলল”
_ওকে আমি ফুপিকে আমাদের বিয়ের কথাটা জানিয়ে দিচ্ছি। তখন আর তোমার চরিত্র নিয়ে কথা উঠবে না। অরিন রাগ করে দিহানের হাত থেকে ছু মেরে চকলেট বক্স গুলা নিয়ে চলে গেলো। দিহানও পিছু পিছু আসলো। অরিন গেটের সামনে যেতেই দিহান পিছন থেকে বলে উঠে ,”অরিন আমার কথাটা একটু ভেবে দেখো প্লিজ।” অরিন কিছু না বলে চলে গেলো। দিহান আগের থেকে কিঞ্চিৎ গলা উঁচিয়ে বলল, “আরে কামড় দেওয়ার জন্য একটা সরি তো বলে যেতে।” অরিন আর থামলোই না।

দিহান কিচেনে গিয়ে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে দেখলো চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। ঠান্ডাই খেয়ে নিলো। হোক ঠান্ডা, তাতে কি? অরিন তো বানিয়েছে। দিহান বুঝতে পারছে না আজ হঠাৎ তাঁর হলো কি। অরিনের কোমর জড়িয়ে ধরা, হাত ধরা, কোলে নেওয়া। এগুলা কেমনে করলো সে? চা খেয়ে মাছ মাংসের বোল বের করলো। অরিন অন্যের বাড়ি কাজ করবে, এতো কষ্ট করবে, এটা কেন জানি তাঁর সয্য হয়নি। তাই সে সব লুকিয়ে রাখছিলো যেন অরিনকে কিছু করতে না হয়। যেহেতু রান্নায় অরিনের নাম হবে তাই তাকে অনেক মজা করে রাঁধতে হবে। মশলাপাতি সব বের করে রান্না করতে লাগলো। বেশিরভাগ সময় বাইরে থেকেছে বলে তাকে সবকিছুই রান্না শিখতে হয়েছে। এমনিতেই রান্নার হাত তাঁর অনেক ভালো। মনোযোগ দিয়ে রান্না করলে তো স্বাদের তুলনা হয়না। এই কথাটা হচ্ছে তাঁর মায়ের। উনার কাছে দিহানের রান্নার কোনো তুলনা হয়না। কিন্তু দিহান এই কথার বিশ্বাসী নয়। তাঁর কাছে তাঁর মায়ের রান্নাই বেস্ট। উনার রান্না ছাড়া কারো রান্না তাঁর ভালো লাগেনা। ভাগ্যক্রমে আজ অরিনের রান্না খাওয়া হতো কিন্তু সেটা দিহানের হজম হতোনা। তাঁর বউ অন্যের বাড়িতে রান্না করে খাওয়াচ্ছে, এটা ভাবলে খাবার কেমনে হজম হতো? বউয়ের হাতের রান্নাটা না হয় তাঁর বাড়িতে নিয়ে খাবে। রান্না শেষ করে সবকিছু নিয়ে টেবিলে রাখলো। এখন তাঁর ফুপি আসলে বলে দিবে এইসব অরিন করে গিয়েছে।

___________________________________

গ্রামের কয়েক জায়গায় ঘুরাঘুরি করার পর শাওনের ফোনে একটা কল এলো। একজন রুগি দেখবে বলে চলে গেলো শাওন। শাওন চলে যাওয়ার পরে নীল একা হয়ে যায়। পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখে লুপা সরিষার ক্ষেত দিয়ে হাঁটছে। হলুদ রংয়ের স্কার্ট দু’হাতে ধরে মেলে রেখেছে। দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে তাকে। নীল চোখ ফিরিয়ে নিয়ে হাঁটতে লাগলো। লুপা যতই সুন্দর হোক লুপার চরিত্র ভালো না। আর যার চরিত্রের ঠিক নেই তাঁকে চায়না নীল।

অনেক্ষণ ঘুরাঘুরি করার পরে শান্তি চৌধুরী বললেন”শায়লা চল এবার চলে যাই।” দিশা বলল”হ্যাঁ দাদুমনি আমারও আর ভালো লাগছে না।” শায়লা বললেন”আমি চাইছিলাম আমাদের পুরাতন বাড়ি যেতে। চল ঘুরে আসি।” কেউ রাজি হয়নি পরে শায়লার জোরাজোরিতে শেষমেশ শাওনদের পুরাতন বাড়িতে আসলো তাঁরা। বাড়িটা গ্রামের শেষ প্রান্তে পরেছে। এটা অনেক পুরনো বাড়ি। শাওনের দাদার জন্ম হওয়ার আগে এই বাড়ি ছেড়েছিলেন শাওনের বড় বাবা। বাড়িটা কিছুটা জমিদার বাড়ির মতো। শ্যাওলা পড়ে ভূতুড়ে বাড়ির মতো হয়ে গেছে। চারদিকে কতো গাছগাছালি। দেখতে মনে হচ্ছে জঙলের মাঝখানে বাড়ি এটা। ইশি দিশা লুপা দোতলায় হেঁটে হেঁটে ভিডিও করছে। দিয়া, শাঞ্জু,রুহান, শান্তি চৌধুরী নীলের সাথে নিচটা হেঁটে দেখছেন। শায়লা চৌধুরী সিঁড়ি দিয়ে উপরের দিকে উঠছেন। সিঁড়িতে কালো রংয়ের কিসব লেগে আছে। দেখতে ছাই মনে হচ্ছে। যেন কাগজ পোড়ানোর চাই। উনার কপাল কুঁচকে এলো। মনে হয় পোলাপান এসে এখানে বসে আড্ডা দেয়। এটা ভেবে এসবে পাত্তা না দিয়ে দু’এক সিঁড়ি উঠে দোতলায় গেলেন তিনি। একটা রুমের ভিতর থেকে পায়ের শব্দ এলো। কোনো রুমেরই দরজা নেই৷ দরজা থাকার কথাও না। এতো পুরনো বাড়িতে দরজা কেমনে থাকবে? আবারও পায়ের শব্দ আসলো রুমের ভিতর থেকে। শায়লা রুমে ঢুকতে গিয়েও ঢুকলেন না। পা পিছিয়ে চলে আসলেন। ভাবলেন কেউ মনে হয় ভেতর দেখতে রুমে ঢুকেছে। হেঁটে হেঁটে অন্যপাশে চলে গেলেন তিনি।

শায়লা বেগম চলে যাওয়ার পর পরই লুপা ভিডিও করতে করতে এসে এই রুমে ঢুকে গেলো। জানালা চারপাশে অনেক জায়গা ভেঙে গেছে। লুপা জানালার সামনে এসে বাইরের দিক ভিডিও করতে লাগলো। গাছে দুটো পাখি বসেছে। লুপা ক্যামেরার zoom না করে পা বাড়িয়ে সামনে এগুলো। জানালার সামনের ফ্লোর অনেকটা ভাঙা। লুপা পা এগুতে এগুতে ভাঙা জায়গায় পা রাখতে যাবে তখনই কেউ তাঁর হাতে হেঁচকা টানে তাকে সরিয়ে আনে। লুপা ভয়ে পিছনে তাকাতেই দেখে কালো চাদর গায়ে জড়ানো কেউ তাঁর হাত ধরে আছে। চোখ ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অগ্নি চোখে লুপার দিকে তাকিয়ে আছে । লুপা আহহহহহহ বলে চিৎকার দিয়ে উঠলো। ততক্ষণাৎ লোকটি লুপার হাত ছেড়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার সময় গায়ের ধাক্কা লেগে লুপা পড়ে যায়। ফ্লোরে পরে ভাঙা কিছু একটাতে লেগে হাত কেটে যায়। লুপার চিৎকারে সবাই দৌড়ে রুমের দিকে আসছিলো। লোকটি শাওলা বেগমের সাথে ধাক্কা খায় শায়লা পড়ে যান। নীল সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে উঠছিলো। লোকটি নীলের সাথেও ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায়। চাদরে মুখ ঢাকার ফলে ভালো করে পথ দেখছেনা সে। নীল খপ করে চাদর ধরে নেয়। মুখ থেকে চাদর সরাতে ধ্বস্তাধস্তি করে। নীলকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে লোকটা অন্যদিকে দৌড়ে চলে যায়। লোকটার চোখ দুটো নীলের অনেক চেনা লাগছে।৷

আপাতত এটা ভাবার সময় নেই। লুপার চিৎকার এখনো বন্ধ হয়নি। নীল দৌড়ে উপরে গেলো। লুপার হাত দিয়ে রক্ত পড়ছে সবার তাঁর পাশে বসে আছে। নীল এসে রুমে ঢুকতেই লুপা বসা থেকে উঠে দৌড়ে এসে নীলকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। ভয়ে লুপার শরীর কাঁপছে। লুপার হাতের বাধন শক্ত হয়ে আসে। দুহাতে খামচে ধরে নীলের শার্ট। নীল চোখ খিঁচে ফেলে। হৃদপিন্ডটা অস্বাভাবিক ভাবে লাফাচ্ছে। শুকনো একটা ঢোক গিলে নীল এক হাত দিয়ে লুপাকে জড়িয়ে ধরে ছোট করে বলল, “Don’t cry”।,” লুপা কান্না থামায় কিন্তু তাঁর শরীরের ঝাঁকুনি থামেনা। নীল লুপাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে বলল,”খালামনি চলো। এখানে থাকা আর ঠিক হবেনা।” বলেই বাইরে চলে এসে ফোঁস করে একটা দম ছাড়লো। লুপা এভাবে ধরায় তাঁর নিশ্বাস আটকে আসছিলো। বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেটের সামনে এসে সবাই দেখলো শাওন আসছে। শাওনকে দেখে শাঞ্জু দৌড়ে গিয়ে শাওনকে জড়িয়ে ধরে। শাওন বলল” তোমরা বাড়ি চলে গেছো ভেবে আমি বাড়িতে গেলাম। অথচ তোমরা কেউই নেই। ভাগ্যিস আমি অনুমান করতে পেরেছি তোমরা এখানে হবে।” শাওন অনুভব করলো শাঞ্জু কাঁদছে। কেন কাঁদছে জিজ্ঞেস করলে,শায়লা বেগম ঘটে যাওয়া ঘটনাটা বললেন। শাওন চিন্তিত মুখ করে বলল,”কি বলছো এসব? কে হতে পারে?” নীল বলল,”জানিনা শাওন। কিন্তু চোখ দুটো কেন জানি খুব চেনা চেনা লাগছিলো।” শাওন বাড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে বলল,”বিষয়টা পরে দেখা যাবে এখন চলো।

চলবে,,,,,,।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here