ভালোবাসায় বন্দিনী পর্ব ১

0
4052

#ভালোবাসায়_বন্দিনী
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_১

বর পক্ষ এবং কনে পক্ষের মধ্যে তুমুল বেগে ঝগরা চলছিলো।ঝগরার এক পর্যায় বরপক্ষের একজন সামনে থাকা ফিতা একটানে ছিঁড়ে ফেলে কনে পক্ষের একজনকে কষিয়ে এক থাপ্পড় লাগালো। ঘটনা স্থলে উপস্থিত সকলেই হতবাক। এমন ঘটনার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলো না।সকলেরই প্রেশার দ্বিগুন বেড়ে গেলো যেনো কয়েক সেকেন্ডেই।

বিয়ে বাড়িতে গেটের এপাশ ওপাশ দাঁড়িয়ে কনে পক্ষের লোকজন বর পক্ষের লোকজনের সাথে টাকা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করবে এটাই স্বাভাবিক।
হয় যদি কনের বন্ধু, বান্ধব বা ছোট বোন তাহলে তো কথাই নেই। এই স্বাভাবিক একটা বিষয়ে এমন অস্বাভাবিক ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে এটা কনে পক্ষের সকলেরই ভাবার বাইরে ছিলো।

থাপ্পড় টা খেয়েছে হৈমী। তাঁর নরম গালে কাঠের মতো শক্ত হাতের পাঁচ আঙুলের দাগ খুব কড়া ভাবেই পড়েছে। কিন্তু তাঁর চোখ দুটো বন্ধ থাপ্পড় টা এতোই জোরে ছিলো যে হৈমীর মাথাটা ঝিম ধরে গেছে। হৈমীর পাশে থাকা সকলে হৈমীর কাঁধ চেপে ধরলো।সকলের চোখে,মুখে আতঙ্ক। এদিকে বর পক্ষের সকলের জান যায় যায় অবস্থা। ছোট ছেলে রুদ্র শেখ এমন কান্ড ঘটাবে তা ভাবনার বাইরে ছিলো রেদওয়ান শেখের। এই ছেলে বিয়েতে আসুক তা কেউ চায়নি। শুধু মাএ রাদিফ শেখ রেদওয়ান শেখের বড় ছেলের জোরাজোরিতে এই ছেলেকে আনতে বাঁধ্য হয়েছে রেদওয়ান শেখ। যদিও রুদ্র আসার জন্য মোটেও পাগল ছিলো না। বরং নিয়ে আসায় বেশ বিরক্ত হয়েছে তবুও মায়ের দেওয়া কসম আর ভাইয়ের করা অনুরোধেই সে এসেছে।
রাদিফের বুকটা ধকধক করছে।এই মূহুর্তে বর বেশে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর জন্য খুবই লজ্জাজনক এবং কষ্টকর হচ্ছে। তাঁর মনে হচ্ছে ছোট ভাইকে দরদ দেখিয়ে না নিয়ে আসাটাই ভালো ছিলো।
কি আর হতো সকলে যখন প্রশ্ন করতো আপনার ছোট ভাই কেনো এলো না? তখন না হয় বলে দেওয়া যেতো আমার ভাই একটা সাইকো এখানে আসেনি তাই সকলের মঙ্গল হয়েছে। নয়তো তাঁর অপছন্দীয় কিছু দেখলেই পাগলামি শুরু করবে। এটা বুঝবে না গোটা দুনিয়া তাঁর নিয়মে চলবে না, গোটা দুনিয়ার মানুষ তাঁর নিয়ম মানতে বাঁধ্য থাকবে না। গোটা দুনিয়ার মানুষ রুদ্র শেখের গোলাম হবে না। রাদিফের ইচ্ছে করছে এখান থেকে ছুটে পালাতে না জানি কনে পক্ষের লোকরা এখনি ঘাড় ধরে বের করে দেয়।

বিয়ে বাড়িতে কনে পক্ষের সাথে বরপক্ষের তর্কাতর্কি ভালোই চলছিলো। হয়তো এসব তর্কবিতর্কে বিরক্ত হয়েই যে মেয়েটা বেশী মুখ চালিয়েছে তাঁর গালে থাপ্পড় লাগিয়ে দিয়েছে। এতে যে নিজের ভাইয়ের সর্বনাশ ঘটতে পারে বা যার গায়ে হাত তুলেছে সে কোন স্টেপ নিতে পারে এতে কোন মাথা ব্যাথা নেই। বরপক্ষের সকলে তাই ভাবতে লাগলো।

এদিকে হৈমী পিটপিট করে চোখ খুলে তাকালো সামনের মানুষ টার দিকে।দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো তাঁর গাল বেয়ে। পাশে থাকা সকলে আতঙ্কিত কন্ঠেই বললো,”হৈমী তুই ঠিক আছিস”
সাথে সাথে হৈমী নিজের দুকান চেপে আতঙ্কিত হয়ে দিলো এক চিৎকার। থাপ্পড় খাওয়ার এতো সময় পর রিয়্যাক্ট হলো আর এভাবে হলো যে সকলেই দ্বিগুণ আঁতকে ওঠলো। হৈমীর চিৎকার শুনে,লাল টকটকে মুখখানি দেখে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে রুদ্র বিয়ে বাড়ির ভিতরে এগুতে লাগলো৷ এদিকে সকলের ভয়ে হাত,পা কাঁপতে শুরু করেছে। বরের বাড়ির কয়েজন মেয়ে এসে হৈমীকে বোঝাতে লাগলো। স্বান্তনা দিতে শুরু করলো। রেদওয়ান শেখ লজ্জায় মাথা নিচু করে রেখেছে,রাদিফের মুখটা চুপসে গেছে। কনে নয়নার ছোট বোন নয়ন হৈমীকে থামানোর চেষ্টা করছে হৈমী এবার আতঙ্কিত কন্ঠেই বললো,

— বিয়ে বাড়িতে বন মানুষ ঢুকে কিভাবে। জঙ্গলের ভূত এসে আমার সুন্দর গাল লাল করে দিয়ে চলে গেলো। আর তোরা আমাকে থামতে বলছিস। এই যে বরমশাই আমাদের স্বাদের দুলাভাই শালিদের সাথে লড়তে পারবেন না বলে জঙ্গল থেকে জংলে ভূত ধরে এনেছেন??

বরপক্ষের সকলের এবার হাঁটু কাপতে শুরু করলো।
রুদ্র কে এসব কি বলছে রুদ্র শুনতে পেলে আর রক্ষে থাকবে না। হয়তো এবার তুলে এক আছাড় দিবে। রাদিফের বড় মামি এসে হৈমীর গালে আলতো করে ছুঁয়ে বললো,

— সরি আম্মু দুঃখ পেও না আমরা অত্যন্ত লজ্জিত।
আসলে আমাদের ছোট ছেলে একটু ক্ষেপাটে টাইপের। ওর হয়ে আমরা সকলে তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

রেদওয়ান শেখ নয়নার বাবার কাছে ভীষণ লজ্জা এবং দুঃখ প্রকাশ করলো। নয়নার বাবা হৈমীর দিকে অসহায় মুখে তাকালো। হৈমী তাঁর অসহায় মুখটা দেখে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। সাথে সাথে ভূবন ভূলানো এক হাসিও দিলো এবং বললো,

— ডোন্ট ওয়ারি আংকেল আমি কিছু মনে করেনি।
বন মানুষ রা প্রকৃত মানুষের মাঝে চলে আসলে এমন ওলটা পালটা কাজ করেই থাকে। বাপরে ভয়ংকর দেখতে মা গো মা ঘাড় অবদি চুল মুখ ভর্তি দাঁড়ি মনে হয় জঙ্গলের রাজা ওঠে আসছে মানুষের মাঝে। জঙ্গলের রাজা আমার মতো সুন্দরী মেয়ের মর্ম বুঝবে কি করে। বোঝেনি বলেই তো হুনুমানের মতো আচরন করে গেলো হুমহ!

নয়নার বাবা এসে হৈমীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

— সরি রে মা আমাদের জন্য তোকে অপমানিত হতে হলো।

হৈমী ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,

— আংকেল আমি কিন্তু কেঁদে দিবো।

নয়নার বাবা হৈমীর কপালে চুমু খেয়ে বললো,

— না না কাঁদলে তো তোর মেকআপ নষ্ট হয়ে যাবে।
তখন তুই কি করে সবার থেকে পারফেক্ট এন্ড ডিফারেন্ট এন্ড সুপার ওমেন হয়ে থাকবি বলতো??

সাথে সাথে হৈমী বড় হা করে একহাত গালে দিয়ে রাদিফের দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে বললো,

— আল্লাহ রে আল্লাহ কি ঘটে গেলো। দুলাভাই আপনি এখানে দাঁড়ান আমি একটু আমার সাঁজ ঠিক করে আসি। বন মানুষের হাত পড়ছে গালে। আল্লায় জানে মেক আপ ঠিক আছে কিনা। ভাবছিলাম নয়না আপুর দেবরদের সাথে লাইন মারবো৷ তা না কোথা থেকে এসব আজাইরা ফালতু লোক ধরে আনছেন কে জানে৷ বাই দ্যা রাস্তা আপনার কয়টা ভাই আসছে বিয়েতে?? বলেই এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো।

রাদিফ হকচকিয়ে গেলো একদমে এতোগুলো কথা একটা মানুষ কিভাবে বলতে পারে। তবুও সম্পূর্ণ অচেনা, অজানা এতগুলো লোকের ভীড়ে৷ কে বলবে কিছুক্ষণ আগে এই মেয়েটা কারো হাতে থাপ্পড় খেয়েছে। বরের বাড়ির সকলে সহ বর বেশ অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। এতক্ষণ এখানে ভীষণ সিরিয়াস কিছু ঘটার কথা ছিলো৷ অথচ মেয়েটা কিভাবে সব ম্যানেজ করে নিলো। কেমন রসিকতা শুরু করে দিয়েছে।

কনের বাড়ির সকলে মিটি মিটি হাসছে৷ তাঁরা তো জানে তাঁদের হৈমী ডিফারেন্ট গার্ল। তাঁর লিষ্টে রাগ,অভিমান,দুঃখ কষ্ট সিরিয়াস কোন বিষয়ই নেই। সে শুধু প্রাণখুলে হাসতে জানে, ননস্টপ কথা বলতে জানে। অচেনা মানুষ কে দুমিনিটে চেনা করে নেওয়া আপন করে নেওয়া তাঁর বা হাতের খেল।

সকলে হৈমীর দিকে অবাক চোখে চেয়ে আছে। হৈমী হিহি করে হেসে বললো,

— কি আমাকে চিনতে পারছেন না৷ আরে আমি হলাম হৈমন্তী ডাকনাম হৈমী। কিছুক্ষণ পর আপনার সাথে যার বিয়ে হবে মানে নয়না আপ্পি তাঁর বোনের থেকেও বেশী কিছু। এই যে নয়ন, নয়নের কাঁধ জরিয়ে বললো, নয়ন হলো আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড+বেষ্ট বনু। এবার চিনেছেন তো,,, আপনারা সবাই বসতে থাকুন আমি আসছি। বলেই হৈমী খুশি মনে পিছন ঘুরলো।আবারো বরের বাড়ির লোকের দিকে ঘুরে উৎসুক নয়নে চেয়ে বললো,এই যা আসল কথাই জিগ্যেস করা হয়নি আমাকে কেমন লাগছে??
সাঁজ টা ঠিক আছে তো সুন্দর লাগছে না আমায়?? একদম পঁচা বলবেন না তাহলে এখনি কান্না করে সাগর বানিয়ে ফেলবো তখন কিন্তু জাহাজ ছাড়া বউ নিয়ে যেতে পারবেন না। কথাগুলো বলেই হিহি করে হাসতে লাগলো হৈমী।

কনের বাড়ির লোকেরাও হাসতে লাগলো। বরের বাড়ির লোকের চোখ কোটড় থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। রেদওয়ান শেখের হৈমীকে ভীষণ পছন্দ হলো।বর্তমান সময়ের মেয়েরা এতো প্রাণখুলে মিশতে পারে জানা ছিলো না তাঁর। এখন তো মেয়েরা সব জায়গায় নিজেকে অতি আধুনিক ভাবে প্রেজেন্ট করতে গিয়ে নানারকম ভনিতা করে নিজেদের প্রতিবন্ধী করে ফেলে। চোখের পলক ফেলা থেকে শুরু করে কথা বলা সবটাতেই থাকে ঢং আর ন্যাকামোতে ভরা। তিনি গলা খাকারি দিয়ে বললেন,

— বাহ বেশ সুন্দর লাগছে তো মামনি তোমাকে।
একদম প্রিন্সেসের মতো লাগছে।

সাথে সাথে হৈমী লাফিয়ে ওঠলো। রেদওয়ান শেখের গালে টোপ করে চুমু খেয়ে দু গাল টেনে দিয়ে বললো,

— ওয়াও আংকেল আপনি কত্তো কিউট। আচ্ছা আমি একটু আসছি নিজেকে আরেকটু সুন্দর করে গুছিয়ে আনছি।তারপর আপনার বাড়ির ছেলেদের সাথে লাইন মারবো চিন্তা নেই। দেখেন মুখটা কেমন অস্বাভাবিক হয়ে গেছে এই মুখ দেখে আবার আমাকে কম সুন্দরী বলতে পারে।
.
গেটের সকল নিয়ম নয়ন সম্পন্ন করলো। হৈমী যতো ডিমান্ড করেছিলো তাঁর থেকেও দশহাজার টাকা বেশী দেওয়া হলো। বরপক্ষের টেনশন কিছুটা কমে গেছে। রেদওয়ান শেখ এদিক, ওদিক তাকিয়ে দেখলো তাঁর গুনোধর ছোট পুএ পায়ের ওপর পা তুলে চেয়ারে বসে আছে।মুখে তাঁর গম্ভীর্যভাব মনে হয় গোটা রাজ্যের চিন্তা সে একাই করে বেড়াচ্ছে।
বিয়ে বাড়িতে এসেছে কই আনন্দ, ফুর্তি করবে তা না। নিজে তো একটা বোরিং, রোবট পার্সন বাকি সবার ও আনন্দও প্রায় মাটি করে সারছিলো। ভাগ্যিস মেয়েটা বাচ্চা ছিলো তাই বিষয়টা সেভাবে গায়ে মাখায়নি৷ ইচ্ছে করলো গিয়ে বেশ ধমকাতে কিন্তু ধমকানোর পর যা রিয়েকশন হবে তা ভেবে আর এগুলেন না। তাঁর শালিকার মেয়ে সূচনা কে বললো,

— মামনি তুমি ঐ পাগলের কাছে যাও৷ তুমি আর তোমার খালামুনি ছাড়া কেউ তো সাহস করে ওর ধারে কাছেও যেতে পারে না৷

সূচনা খানিকটা লজ্জা পেলো। মাথা নিচু করে বললো,

— আচ্ছা খালুজান আপনি চিন্তা করবেন না। আমি দেখছি আর জিগ্যেসও করবো এমন ঘটনা কেনো ঘটালো। এটা তো আমাদের আত্মীয় বাড়ি।

রেদওয়ান শেখ এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,

— তা কি ওর ভাবনায় আছে। সব জায়গায় গাওজেরি করে বেড়ায়। এই ছেলের জন্যই না জানি কবে আমি স্ট্রোক করে মরে যাই৷ পড়াশোনা শেষ কতো করে বোঝালাম বিজনেসে বস। না সে বিজনেসে বসবে না। বাবা,ভাই এর ঘাড়ে বসে খাবে আর সব জায়গায় পাওয়ার খাটাবে। রাস্তা দিয়ে কোন মেয়ের নেগেটিভ কাজ দেখলেও ছাড় দিবে না।
মারধর শুরু করবে। ছেলেদের কথা তো বাদই দিলাম। সেদিন এক লোক ফোন করে জানালো তাঁর ছেলে নাকি আমার ছেলের জন্য প্রেমটাও করতে পারেনা। তাঁর ছেলে গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরাঘুরি করছিলো আমার গুনোধর পুএ আর তাঁর বন্ধুরা আটকিয়ে মেয়েটাকে ধমকেছে আর ছেলেটাকে কয়েকটা চড়, থাপ্পড় দিয়েছে। রাস্তা দিয়ে ছেলে,মেয়ে বিয়ের আগে এমন ঘুরাঘুরি নাকি সে এলাউ করবে না। ছেলেটা যেই বলছে এটা পাবলিক প্লেস সবার আসার অধিকার আছে তখনি নাকি সমানে মাইর লাগাইছে। ভাবা যায় এগুলা।

সূচনা মুচকি হেসে বললো,
— খালুজান ওর মতো করে যদি আর একজনও ভাবে তাহলে হয়তো ওর কাজ কারো বিরক্ত লাগবে না। বরং সকলে মিলে ওকে নিয়ে গর্ববোধ করবে।

রেদওয়ান শেখ বললেন,
— না রে মা দুনিয়াটা ও যেভাবে ভাবে যে ভাবে দেখতে চায় সেভাবে দুনিয়া চলে না রে। এখানে সবাই স্বাধীন চেতা মানুষ। দেখ না আজকে ওর কান্ড দেখে সকলেই ওকে কতো কি ভাবছে। কিন্তু আমি তো বাবা আমি ঠিক বুঝেছি এর পিছনে যৌক্তিক কারন অবশ্যই আছে। কিন্তু কি সেটা আমি বা আমরা খেয়াল করিনি, বুঝতে পারিনি কিন্তু ও ওর কাজে সঠিক।

সূচনা বললো,

— জ্বি খালুজান আমি কিছুটা আঁচ করেছি। বাকিটা সিওর হওয়া দরকার। মেয়েটা তো বাচ্চা মেয়ে তাঁকে এভাবে মারা ঠিক হয়নি এটা বোঝাবো ওকে আমি।
.
রুদ্রর পাশে এসে বসলো সূচনা। নরম গলায় বললো,
— এভাবে একা বসে আছো কেনো? রাদিফ ভাইয়ার কাছেও তো বসতে পারতে।

রুদ্র চুপ রইলো না সূচনার দিকে তাকালো। আর না কথা বললো। এতে সূচনার জায় আসে না। কারন রুদ্র এমনই ছোট বেলা থেকে দেখে আসছে সে রুদ্রকে। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে নেয়। তাই রুদ্রর মা তাঁর খালামুনি তাকে নিয়ে আসে নিজের কাছে৷ তাঁর কন্যা সন্তান ছিলো না আর নিজের বোনের মেয়ে সৎমায়ের কটু কথা শুনে বড় হোক তা সে চায় নি। তাই নিজের কাছে রেখে নিজ সন্তানের মতোই বড় করেছেন সূচনা কে। সূচনা এবার অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে। বয়সে পাঁচ বছরের ছোট সে রুদ্রর আর রাদিফের সাত বছরের।
.
সূচনা বললো,
— তুমি মেয়েটাকে কেনো মারলে বলবে প্লিজ।

রুদ্র কোন উত্তর না দিয়ে ফোন বের করে ফোন টিপতে লাগলো।

সূচনা এক ঢোক গিলে নিয়ে আবারো জিগ্যেস করলো,
— কেনো মারলে বাচ্চা একটা মেয়ে । বিয়ে বাড়িতে এসব তর্ক হয়ই এটা ত মজা তুমি মেরে ঠিক করো নি।

রুদ্র কঠিন চোখে তাকালো। সূচনা মাথা নিচু করে বললো,
— সরি।

রুদ্র এবার গম্ভীর গলায় বললো,
— এখানে কি করছিস যা ওদের সাথে গিয়ে বস। সবাই আমার ধারে কাছে আসার চেষ্টাও করেনা। আর তুই এতো কাছে বসে আছিস। ভয় লাগে না তোর।

সূচনা মুচকি হেসে বললো,
— না। কারন আমি জানি তুমি নিজের মা আর এই মা মরা মেয়েটা কে কখনো কষ্ট দিবে না। তাই তো আমার কোন ভয় নেই তোমার কাছে।

রুদ্র দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
— চুপচাপ গিয়ে ওদের সাথে বস। আমার এতো কথা শুনতে ভাল্লাগে না।

সূচনা মুখটা গোমড়া করে বললো,
— বা রে আমি তো কথাই বললাম না। জানো হৈমী একদমে কতো কথা বলে।

রুদ্র ভ্রু কুঁচকে জিগ্যেস করলো “হৈমী কে”??

— এই জঙ্গলের রাজা, গোমরামুখো হনুমান। বন মানুষ কোথাকার একদম আমার নাম নিবেন না।
কি ভাবেন কি নিজেকে কি এমন আছে হেহ গায়ের জোর আছে বলে হৈমীর গায়ে হাত তুলে পার পেয়ে যাবেন। আপনার যেমন গায়ে জোর আছে আমারো তেমন মুখে জোর আছে। আপনি জানেন আপনার জন্য আমার কতো ক্ষতি হয়ে গেছে। বলেই চেয়ার টেনে রুদ্র সূচনার কাছাকাছি বসলো।

হৈমীর কথা শুনে সূচনা ভয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। হাত, পা ঠান্ডা হয়ে আসছে তাঁর এক ঢোক গিলে কাঁপা গলায় বললো,”হৈমী চলো আমরা ওদিকটায় যাই”

সূচনার কথা শুনে হৈমী একদম রুদ্রর মুখোমুখি মুখ করে বসলো। ডাগর ডাগর চোখের বড় বড় পাপড়ি গুলো পিটপিট করতে করতে রুদ্রর দিকে চেয়ে বললো,

— ওয়েট আপু ওয়েট এটাকি কোন যন্ত্রমানব এমন রোবটের মতো বসে আছে কেনো। এমন শক্ত করে চেয়েই বা আছে কেনো৷ ঐ ব্যাটা কি সমস্যা দোষ কে করছে আপনি না আমি। একদম চোখ নিচে রাখেন।
দোষ করছেন সো এখন সরি বলেন নয়তো আজকে কপালে খাবাড় জুটবে না। আমার মতো অবলা শিশু,অবলা মেয়ে,অবলা নারী,কিউট বাচ্চা গোলাপি রানীর গায়ে হাত তুলতে আপনার বিবেকে নাড়া দিলো না হে! জানেন স্কুল,কলেজে সবাই আমাকে গোলাপি দিদি বলে ডাকে। নামটা আমিই বলে দিছি ওদের। গোলাপি আমার ফেভারিট কালার তাই তো আমি গোলাপি রানী, গোলাপি দিদি।যাক আসল কথায় আসি দেখেন গাল টা কি লালই না করে দিছেন লাল করার ইচ্ছা হইছে বললেই হতো আমি মেক আপ করে লাল করে নিতাম৷ এইভাবে কেউ মারে দেখেন পাঁচ টা আঙুল স্পষ্ট। বাই দ্যা পুকুর ঘাট আপনার হাত টা দেখি কি বসাইছেন লোহা নাকি অন্য কিছু। বলেই হাত ধরতে নিতেই রুদ্র ঠাশিয়ে আরেকটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিতেই চেয়ার থেকে নিচে পড়ে গেলো হৈমী। সূচনা এবার কেঁদেই দিলো ভয়ে।
বাচ্চা মেয়েটা এবার বুঝি আর নাই ভেবেই হৈমীকে দুহাতে ওঠাতে নিলো। হৈমী এবার ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে শুরু করলো। আর বলতে লাগলো “রাক্ষসের বাপ, শয়তানের ব্যাটা জঙ্গলের ভূত তোর কপালে ডাইনী বউ জুটবে দেখে নিস।পেত্নীর মতো দেখতে হবে তোর বউ। যে সকাল বিকাল তোর রক্ত চুষে খাবে। আমার চেহেরা যদি আবার খারাপ হয় রে তোর হৃদপিণ্ড জ্বালাই ফালাবো আজ মনে রাখিস আমি হৈমী। এইবার আমার গায়ে হাত তোলার শাস্তি তোকে দিয়েই ছাড়বো। ভালোর কাল নাই বোঝা হইছে আমার। ওরে আমার কোমড়টা বুঝি আর নাই রে। আমার কপালে বুঝি রোমান্টিক জামাই আর জুটলো না রে নয়ন। তোর দুলাভাই এই কোমড় ভাঙা মাইয়ারে বুঝি আর পছন্দ করলো না রে।

রুদ্র কথা গুলো শোনার আগেই সেখান থেকে রাগে হন হন করে চলে গেছে।

সূচনা ভয় অবাক দুটোই হলো। এমন অবস্থাতেও এই মেয়ের মুখ ঠিকি চলছে৷ একজনের হাত চলছে তো আরেকজনের মুখ চলছে। সূচনা হৈমীকে চেয়ারে বসিয়ে তাঁর চোখের পানি মুছে দিতে লাগলো। দু গালে দশ আঙুলের দাগ স্পষ্ট। বড্ড খারাপ লাগছে সূচনার। সূচনার বেশ সন্দেহ হলো দু দুবার এভাবে গায়ে হাত তোলা তো এমনি এমনি না।এতো রাগই বা কিসের জন্য যে এইটুকুন একটা মেয়েকে এভাবে মারছে। নিশ্চয়ই এখানে অন্য কোন ব্যাপার আছে কিন্তু কি??
হৈমী বেশী কথা বলে তাই?? নাকি অন্য কিছু??
.
আপাতত সব চিন্তা কে দূরে ঠেলে হৈমী কে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো সূচনা। হৈমী যে হারে ননস্টপ বকবক করে যাচ্ছে এখনি আবার সকলে জেনে যাবে দ্বিতীয় বার রুদ্রর থাপ্পড় দেওয়ার কথা। আর এবারে নিশ্চয়ই কেউ রুদ্রকে ছেড়ে কথা বলবে না। যতোই মেয়ের বাড়ির লোক সাধাসিধে হোক না কেনো। ছেলের বাড়ির কেউ এমন বিহেভিয়ার করলে তবুও দু দুবার কেউ ছাড় দিয়ে কথা বলবে না। এদিকে হৈমীও এবার ভিষণ রেগে যাচ্ছে। কি সব বকে যাচ্ছে। রুদ্র কে কেউ বাজে কথা বললে একদম সহ্য করতে পারে না সূচনা। তবুও বার বার রুদ্রকে নিয়ে কটু কথা শুনতে হয়। হৈমী ছোট একটা মেয়ে সবে ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছে ওর সাথে যা হয়েছে এতে রেগে যাওয়ারই কথা। তাই ওর কথাগুলো ধরছে না। কিন্তু এরপর যদি বাকিরা কথা শোনায় রুদ্রকে তাহলে সূচনা সহ্য করতে পারবে না। রুদ্র রেগে গিয়ে বাড়ি ছাড়া হলে দিনের পর দিন রুদ্র কে এক নজর না দেখেও থাকতে পারবে না সূচনা।
তাই হৈমীকে বুঝিয়ে সুজিয়ে নিয়ে গেলো সেখান থেকে। হৈমীতো বকেই যাচ্ছে সমান তালে রুদ্র কে ।
.
সূচনা আর হৈমী চলে যাওয়ার পরই রুদ্র আবারো বড় বড় পা ফেলে সেই জায়গাটায় এলো। এক হাঁটু গেড়ে বসে নিচে পড়ে থাকা হোয়াইট স্টোনের টিকলি টা তুলে নিয়ে হাতের মুঠোয় বন্দি করে ফেললো। গভীর এক শ্বাস ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো। চোখে,মুখে সেই গম্ভীর ভাবটাই স্পষ্ট রয়েছে, খানিকটা রেগে যে আছে তাও বোঝা যাচ্ছে। হাতের মুঠো খুলে টিকলি টা চেয়ে দেখলো আবারো থাপ্পড় খেয়ে নিচে পড়ে যাওয়ার সময়ই হৈমীর টিকলিটা খুলে পড়ে গেছে বোধ হয় ভেবেই আরেকদফা গভীর শ্বাস ছাড়লো,,,

চলবে।
বাই দ্যা সদর ঘাট ভালো লাগলে জানাবেন থাপ্পড়ের রহস্য জানতে চাইলে গঠনমূলক মন্তব্য করবেন৷ দ্বিতীয় পার্টে ঘটনা ক্লিয়ার হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here