বৌপ্রিয়া পর্ব ১৯ + ২০

0
718

#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – |১৯|

দুপুরের খাবার পর্ব শেষ হলে, বসার ঘরে মেহমানদের দারুন হইচই চলতে লাগলো। চায়ের আসর ইতিমধ্যে খুব জমে উঠেছে। এই ফাঁকে উচ্ছ্বাস বসার ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে চলে এসেছে। একটা প্রেসক্রিপশনের ছবি এসেছে হোয়াটসঅ্যাপে। বসার ঘরে এত হইচই এর কারণে সেটা নিয়ে মাথা ঘামানো যাচ্ছে না। শান্তি পরিবেশ পেতে নিজের রুমে এসে বিছানায় বসে। কুসুম বসে গল্প করছিল ভাবির সঙ্গে। উচ্ছ্বাসকে উপরে যেতে দেখে ভাবি কুসুমকে ইশারা করে বললেন,

‘ উচ্ছ্বাস নিজের রুমে গেছে, কুসুম। ‘

কুসুম বুঝতে পারলো না ইশারা। ও বলল, ‘ দেখেছি আমি। ‘

ভাবি বললেন, ‘ তুমিও যাও। দেখো কিছু লাগবে কিনা। ‘

কুসুম উত্তর দিল, ‘ লাগলে তো ডাকবেন। ডাকেন নি এখনো। ‘

ভাবি বিরক্ত হলেন। বললেন, ‘ গতকাল রাতে কিছু হয়েছে তোমাদের মধ্যে? ‘

কুসুম আচমকা এমন প্রশ্নে অস্বস্তিতে পরে গেল। এদিক ওদিকে চেয়ে আবার ভাবির দিকে তাকালো। মৃদু কন্ঠে বলল, ‘ জানি না আমি। ‘

ভাবি ভ্রু কুচকে তাকালেন। বললেন, ‘ মানে? গতকাল রাতে তোমাদের মধ্যে কি হয়েছে তুমি জানো না? ‘

কুসুম কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তারপর থেমে থেমে বলে, ‘ গল্প হয়েছে। ‘

ভাবি অবাক হয়ে বললেন, ‘ শুধু গল্প? আর কিছু নয়? ‘

কুসুম মাথা দুলিয়ে বলল, ‘ না। ‘

উচ্ছ্বাসের ভাবি ভাবলেন অনেক কিছু। উচ্ছ্বাসকে বাচ্চা না নেবার কথা বলেছে তার মানে এই নয় যে, দুজন দুজনের থেকে এতটা দুরত্ব বজায় রেখে চলবে। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে দুরত্ব যত কম হবে, ভালোবাসাটাও বাড়বে। আজকাল সংসার ভাঙন সেটা হাতের ময়লার ন্যায় হয়ে গেছে। যে যেভাবে পারছে, সংসার ভাঙছে, গড়ছে। আজকাল বাচ্চারা সম্পর্কের মূল্য দিতে জানে না।

উচ্ছ্বাসের ভাবি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। হাত বাড়িয়ে কুসুমের মাথায় আঁচল তুলে দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করে বললেন,

‘ শুনো কুসুম। তুমি আমার ছোট বোনের মত। তাই আমি যা বলছি, তোমার ভালো ভেবেই বলছি। মন দিয়ে শুনবে। উচ্ছ্বাস আর তোমার বয়সের তফাৎ কত জানো? ১০ বছর! এটা একটা স্বাভাবিক পার্থক্য হলেও এই পার্থক্য তখনই স্বাভাবিক থাকে, যখন উচ্ছ্বাস তোমাকে নিয়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট থাকবে। হোক সেটা শারীরিক কিংবা মানসিক। উচ্ছ্বাস পুরুষ মানুষ। তার যেমন মানসিকতা,বিয়ের পর তুমি না এগিয়ে আসলে সে কখনোই তোমাকে জোর করবে না। কিন্তু পুরুষ মানুষ যতই ভালো হোক না কেন, একটা জায়গায় সে দূর্বল। সেটা হচ্ছে তার স্ত্রী। তুমি যথেষ্ট বড় হয়েছ। একজনের বউ তুমি। তোমার স্বামীর সুবিধা অসুবিধার দিকটা তোমাকেই দেখতে হবে। সে যেন ঘরের বাইরে সুখ খুঁজতে না যায়, সেদিকটা তোমাকেই নজরে রাখতে হবে। আশা করি, এর বেশি খুলে তোমাকে কিছু বলতে হবে না। আমার কথা কি তুমি বুঝতে পেরেছ? ‘

কুসুম এতক্ষণ ভীষন মনোযোগ দিয়ে ভাবির কথা শুনল। পুরুষ মানুষ কেমন হয় সাধারণত, সেটা কুসুমের জানা। সকল পুরুষ মানুষ উচ্ছ্বাসের মত ভালো হয় না, সেটাও কুসুম জানে। ভাবি কি বোঝালেন? কুসুম কি তবে উচ্ছ্বাসের ভালো হওয়াটার ফায়দা নিচ্ছে! অবশ্যই না। কুসুম উচ্ছ্বাসকে বিয়ের এক বছরের মাথায়ই ভালোবেসেছে। চেয়েছে মনেপ্রাণে। বিয়ের পর সেই চাওয়া আরো দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু এখন তাদের সম্পর্ককে পরিণতি দিতে উচ্ছ্বাস নিজে এগিয়ে না এলে, কিভাবে কুসুম মুখ ফুটে বলবে? কুসুম তো একজন মেয়ে। মেয়েদের কি এভাবে নির্লজ্জ হওয়া মানায়? উচ্ছ্বাস যদি কুসুমকে ভালোবাসত, তবে কুসুম নয়। উচ্ছ্বাস ইশারা করে হলেও কুসুমকে বোঝাত যে কুসুমকে সে চায়। শারীরিক, মানুসিক দুইভাবেই। কিন্তু উচ্ছ্বাস কিছুই বলে নি, বোঝায় নি। বরং ভালো মানুষ সেজে বসে আছে। কুসুম এতে কি করবে? মেয়ে মানুষ কতটুকুই বা এগিয়ে যেতে পারে?

ভাবি কুসুমকে নাড়ালেন। কুসুম তাকাল। ভাবি বললেন,’ কফি বানাতে পারো? উচ্ছ্বাসের জন্যে বানিয়ে নিয়ে যাও। মাথা ব্যথা থাকলে সেরে যাবে। যাও।’

কুসুম মৃদু হেসে রান্নাঘরে গেল। ঝটপট কফি বানিয়ে সিড়ি ভেঙে উপরে চলে গেল। উচ্ছ্বাস বিছানায় বসে একটা বড় মোটাসোটা বই ঘাটছে। বারবার হাত উচু করে কপাল চেপে ধরেছে। হয়ত মাথা ধরেছে তার। কুসুম ধীর পায়ে উচ্ছ্বাসের পাশে এসে দাঁড়াল। একটু ঝুঁকে উচ্ছ্বাস কি করছে দেখার চেষ্টা করল। তারপর জিজ্ঞেস করল,

‘ কি করছেন? ‘

উচ্ছ্বাস বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে জবাব দিল, ‘ একটা নতুন কেইস সামনে এসেছে। রোগটার ড্রাগ, মেকানিজম দেখছি। ‘

কুসুম হাতে থাকা কফির কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ আপনার কফি।’

উচ্ছ্বাস মাথা তুলে তাকালো। কফির কাপ হাতে নিয়ে চমৎকার হেসে বলল, ‘ সত্যি, এই সময়ে এককাপ কফির খুব দরকার ছিল। থ্যাংক ইউ, কুসুম। ‘

কুসুম হালকা হাসলো। উচ্ছ্বাস কফির কাপে চুমুক দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিল। তারপর কুসুমের দিকে চেয়ে বলল,

‘ কুসুম, তুমি কি জানো যে তুমি চমৎকার কফি বানাও? ‘

কুসুম হেসে উঠে বলল, ‘ জানতাম না। এখন জেনে গেছি। ‘

কুসুম আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়। ভেজা চুলে এতক্ষণ আঁচল তোলা ছিল বিধায় আঁচলটা নামিয়ে ফ্যান ছেড়ে দেয়। শুকানোর জন্যে চুলের খোঁপা খুলে দেয়। উচ্ছ্বাস কফি খেতে খেতে সেদিকে চেয়ে ভ্রু কুচকে বলে,

‘ ভেজা চুল খোঁপা করে রেখেছিলে নাকি? ‘

কুসুম বাতাস খেতে খেতে বলল, ‘ হ্যাঁ। সকাল সকাল ভেজা চুল ছেড়ে বাইরে যেতাম নাকি? ‘

উচ্ছ্বাস কিছুটা গম্ভীর হয়ে বলল,’ শুনো কুসুম, কখনোই ভেজা চুল বেঁধে রেখো না। চুল পড়ে যাবে, তাছাড়া মাথায় উকুন ধরতে পারে। তোমার চুল খুব সুন্দর। চুলের যত্ন নাও। বুঝেছ? ‘

উচ্ছ্বাসের কথা শুনে কুসুম মাথা দুলাল। তারপর বলল,

‘ সকাল সকাল ভেজা চুলে বাইরে গেলে সবাই উলটাপালটা ভাববে। আমার লজ্জা লাগবে দেখে বেধে রেখেছিলাম। নাহলে আমি বাঁধি না সচরাচর। ‘

কুসুমের কথা শুনে উচ্ছ্বাসের একবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হল, বিয়ের পর বৌ ভেজা চুলে বের হওয়া খুবই স্বাভাবিক কুসুম। সবাই জানে, নতুন বিয়ে হওয়া স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কি ঘটতে পারে। কার এত মাথা ব্যথা থাকবে যে, বউ ভেজা চুলে বেরিয়েছে নাকি শুকনো চুলে? কিন্তু উচ্ছ্বাস জিজ্ঞেস করল না। থাক না, শুধুশুধু কুসুমকে লজ্জা দেবার কি দরকার?

উচ্ছ্বাস বই পড়ে রিপোর্ট লিখে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দিল। বিছানা থেকে উঠে বই শেলফে রেখে টিশার্ট টেনেটুনে ঠিক করে শার্ট প্যান্ট গায়ে দিতে লাগলো। উচ্ছ্বাসকে রেডি হতে দেখে কুসুম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ কই যাচ্ছেন? ‘

উচ্ছ্বাস শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বলল, ‘ ওয়ার্ডে একটা প্যাশেন্ট এসেছে, ক্রিটিক্যাল। স্যার বলেছে যেতে। পরে প্র্যাকটিস করতে কাজে লাগবে। ‘

কুসুমের মন খারাপ হয়। এইতো দুপুরে সবে এলো বাড়িতে। এক্ষুনি আবার যেতে হবে? বিয়ের পরদিনই যদি বরকে সারাদিন পাশে না পায়, সারাজীবন কি করে পাশে পাবে? উচ্ছ্বাস কি সারাজীবন এভাবেই ডাক্তারি করতে, শিখতে ব্যস্ত থাকবে? কুসুমকে কি সময় দেবার সুযোগ হবে না তার। কুসুম মুখ লটকাল। বিড়বিড় করে কিছু কথা বলে চুল আর শুকাল না। মাথায় আঁচল তুলে চলে যেতে চাইল। উচ্ছ্বাস বোধহয় বুঝতে পেরেছে কুসুমের মন খারাপের বিষয়টা। তাই কুসুম চলে যাবার জন্যে পা বাড়াতেই উচ্ছ্বাস পেছন থেকে কুসুমের হাত খপ করে ধরে বলল, ‘ অ্যাই, কই যাচ্ছ? ‘

কুসুম তাকাল না। মৃদু স্বরে বলল, ‘ নিচে। ‘

উচ্ছ্বাস কুসুমের হাত টেনে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল। কুসুম তখনো মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে। লম্বায় উচ্ছ্বাসের বুক বরাবর কুসুম। লম্বায় মেয়েটা কাধের সমানও না, অথচ অভিমান, রাগ, দুঃখ এসব যেন আকাশছোঁয়া। কী হবে এই মেয়েকে নিয়ে?

উচ্ছ্বাস কুসুমের গালে হাত রাখলো। নরম কণ্ঠে বলল, ‘ রাগ করেছ নাকি? আমি আসব আর যাব। এই ধরো, এক ঘন্টা! তারপরই চলে আসবো। হুঁ? মন খারাপ করো না। ‘

কুসুম মাথা নেড়ে বলল, ‘ সাবধানে যাবেন আর দ্রুত আসবেন। ‘

উচ্ছ্বাস হেসে বলল, ‘ ঠিকাছে। এবার যাই? ‘

কুসুম সম্মতি দিল। উচ্ছ্বাস কুসুমকে ছেড়ে ঘুরে দাঁড়াতেই কুসুম ব্যথাতুর চিৎকার দিয়ে উঠলো। উচ্ছ্বাস চমকে উঠে পেছনে ফিরলো। কুসুম কানে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে। চোখে জল টলমল করছে। উচ্ছ্বাস নিজের শার্টের হাতার দিকে তাকায়। শার্টের হাতের বোতাম ছিঁড়ে মাটিতে পরে আছে। কুসুমের কানের দুল খুলে সেটাও বোতামের সঙ্গে নিচে পরে। উচ্ছ্বাস আঁতকে উঠল। কুসুমের দিকে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে কানে হাত রেখে বলল,

‘ সরি, সরি। অ্যাই, ব্যথা পেয়েছ? হায় আল্লাহ! লাল হয়ে গেছে কানের লতি। দেখি, দেখতে দাও আমাকে। ‘

কুসুম হাত সরালো কান থেকে। চোখের থেকে পানি বেরিয়ে গেছে তার। কান গরম হয়ে ভনভন করছে। জ্বালাতন করছে কানের লতি। উচ্ছ্বাস কানের মধ্যে ফু দিল। পানিপূর্ণ টাওয়াল দিয়ে কান ভেজাল। জ্বালাতন কমে এলে, কুসুম কিছুটা শান্ত হয়েছে। উচ্ছ্বাস ভীষন খারাপ লাগা নিয়ে বলল, ‘ সরি কুসুম। তাড়ার মধ্যে ছিলাম। খেয়াল করি নি। এখনও কি ব্যথা করছে? ‘

কুসুম উত্তর দিল, ‘ না, কমেছে আগের থেকে। ‘

উচ্ছ্বাস শান্ত হয়েছে এ কথা শুনে। কুসুমের কানের দুল মাটি থেকে তুলে বলল, ‘ দুলটা আমি যেহেতু খুলে ফেলেছি, তাই আমিই আবার পরিয়ে দিয়ে শোধবোধ করে দেই? ‘

কুসুম মৃদু হেসে লাজুক কণ্ঠে বলল, ‘ হু। ‘

উচ্ছ্বাস হেসে এগিয়ে এলো। খুব যত্ন নিয়ে কুসুমের কানে দুল পরিয়ে দিতে লাগলো। উচ্ছ্বাসের মুখ ভীষন কাছাকাছি কুসুমের। কুসুম আজকে খুব কাছ থেকে উচ্ছ্বাসকে খেয়াল করছে। উচ্ছ্বাস পুরু ঠোঁট, খাড়া নাক, আর কানের পেছনে থাকা একটা ছোট্ট তিল। তিলটা দেখেই কুসুম কেমন ছন্নছাড়া হয়ে গেল। কুসুমের চোখে কী সুন্দর ঝলমল করছে তিলটা। কুসুমের ইচ্ছে হয়, ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতে ওই তিলে। পরপরই লজ্জায় নিজেকে আটকায়।

‘ ও আল্লাহ গো। আমি কিছু দেখি নাই গো। আমারে মাফ কইরো গো। তওবা তওবা। ‘

আচমকা ফুলির চিৎকারের শব্দ শুনে কুসুম কেপে উঠে। উচ্ছ্বাসও ঘাড় উচু করে সামনে তাকায়। ফুলির মুখে হাত চেপে তওবা করতে করতে দরজার সামনে থেকে সরেছে। কুসুম হতভম্ব হয়ে যায়। কী দেখেছে ও, যার জন্যে এমন অদ্ভুত স্বরে চিৎকার করল? উচ্ছ্বাস কিছু একটা ভেবে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল,

‘ কুসুম, আজকে তুমি শেষ। ফুলি তোমার লজ্জাকে গুলি করে মেরে দেবে সবার সামনে। ‘

কুসুম বোকা বোকা কণ্ঠে উচ্ছ্বাসকে জিজ্ঞেস করল, ‘ কিন্তু কেন? আমরা তো কিছুই করছিলাম না। ‘

উচ্ছ্বাস হেসে বলল, ‘ আমরা কিছু করিনি এটা আমরা জানি। কিন্তু ফুলি ভেবেছে,আমরা শুধু কিছু নয়, অনেক কিছু করেছি। আহারে! কই লুকাবে তুমি আজকে? ‘

কুসুম বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, ‘ অনেক কিছু বলতে? ‘

উচ্ছ্বাস কিছুটা ঝুঁকে এলো কুসুমের দিকে। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, ‘ লাইক লিপ-কিস! ‘

#চলবে

#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – ২০

উচ্ছ্বাস হেসে বলল, ‘ আমরা কিছু করিনি এটা আমরা জানি। কিন্তু ফুলি ভেবেছে,আমরা শুধু কিছু নয়, অনেক কিছু করেছি। আহারে! কই লুকাবে তুমি আজকে? ‘

কুসুম বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, ‘ অনেক কিছু বলতে? ‘

উচ্ছ্বাস কিছুটা ঝুঁকে এলো কুসুমের দিকে। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, ‘ লাইক লিপ-কিস! ‘

কুসুম এক মুহূর্তের জন্যে বোকা বনে গেল। চোখ পিটপিট করে চেয়ে হঠাৎ করে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ কিহ! ‘

উচ্ছ্বাস এখনো হাসছে। কুসুম মুখটা ছোট করে বলল,

‘ ফুলি যদি এখন এসব সবাইকে বলে বাসার সবাই কি মনে করবে? উফ! আপনি এখনো হাসছেন? খারাপ লোক। এমন পরিস্থিতিতে আপনার হাসি আসছে কিভাবে? ‘

উচ্ছ্বাস হাসি থামালো। মুখখানা গুরুগম্ভীর করার চেষ্টা করে বুক উচু করে বলল,

‘ হাসি থামালাম। এখন কি বসে কাদব? স্বামী স্ত্রী আমরা। নিজেদের বেডরুমে কি করছিলাম সেটা নিয়ে বাড়ির লোকেদের মাথা ব্যথা কেন থাকবে? শান্ত থাকো। ওকে? ‘

কুসুম মাথা দোলালো। উচ্ছ্বাস বিছানার দিকে এগিয়ে গেল। বিছানার উপর থেকে সাদা ফাইল হাতে নিয়ে বেরিয়ে যাবার জন্যে উদ্যত হল। কুসুম এগিয়ে এল। হাতে উচ্ছ্বাদের সেলফোন। সেলফোন উচ্ছ্বাসের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘ এটা কে নিবে? ‘

উচ্ছ্বাস মৃদু হেসে সেলফোন নিয়ে পকেটে রেখে দিল। আসছি বলে বেরিয়ে গেল রুম ছেড়ে। পেছনে পেছনে কুসুমও এলো। নিচে নামতেই ফুলির ভাবির সঙ্গে খুসুরফুসুর কানে এলো। কিছু কথা কুসুমের কানেও এলো। তাতেই লজ্জায় কেমন গুটিয়ে গেল কুসুম। ভাবি কুসুম এবং উচ্ছ্বাসকে আসতে দেখে চোখ রাঙালেন ফুলিকে। ফুলি বড় ভাবির গরম চোখ দেখে মিনমিন করে সেখান থেকে সরে গেল। যাবার আগে কুসুমের কানের কাছে অপরাধবোধ নিয়ে আবার বলে গেল, ‘ আমি সত্যি কিছু দেহি নাই তো ভাবি আফা। মাফ কইরেন আমারে। ‘

কুসুম এবার হেসে ফেলল। কিছু দেখি নি, দেখি নি বলে বলে সবাইকেই কি দেখেছে বলে বেড়াচ্ছে। বোকা মানুষ। ভাবি উচ্ছ্বাসকে ব্যাগ পত্র নিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখে এগিয়ে এলেন। বললেন,

‘ কোথায় যাচ্ছ? ‘

উচ্ছ্বাস উত্তর দিল, ‘ হসপিটাল। জরুরী প্যাশেন্ট আছে। মাকে বলে রেখো। দুপুরে আসব। ‘

তারপর কুসুমের দিকে চেয়ে ভাবিকে বলল, ‘ ওকে দেখে রেখো একটু। আমি চলে যাচ্ছি। ওর একা একা লাগতে পারে। ‘

উচ্ছ্বাসের কুসুমকে নিয়ে চিন্তা হয় দেখে ভাবি মৃদু হাসলেন। কুসুমের পাশে দাড়িয়ে বললেন, ‘ আমি দেখে রাখব ওকে। তুমি যাও। কাজ শেষ করে আসো। ‘

উচ্ছ্বাস চলে গেল। ভাবি কুসুমকে নিয়ে একটা ফাঁকা রুমে এসে বসলেন। ফ্যান ছেড়ে কুসুমকে বললেন, ‘ চুলটা শুকিয়ে নাও। নাহলে মাথা ব্যথা করবে। ‘

কুসুম যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। শাড়ির আঁচল মাথা থেকে সরিয়ে চুল মেলে দিল। ভাবি কুসুমের পাশে এসে বসলেন। দুজন মিলে গল্প করলেন জমিয়ে। এতেই কুসুমের মন খারাপ হু হু করে পালিয়ে গেল এক ফাঁকে।

দুপুরে খাবারের সময়ও উচ্ছ্বাস এলো না। কুসুম উচ্ছ্বাস আসবে বলে না খেয়ে ছিল। সবাই খেয়ে নিতে বললেও খেলো না সে। বিকেল ৪ টায় উচ্ছ্বাস কল করল তার মাকে। সন্ধ্যায় আসবে এবং সে খেয়ে নিয়েছে জানিয়ে ফোন রেখে দিল। তার খানিক পরই কুসুমকে কল করল। কুসুম তখন অভিমানে, অভিযোগে গরম হয়ে আছে। উচ্ছ্বাসের কল রিসিভ করে কুসুম চুপ করে বসে রইল। কেন আসছে না, ক্খন আসবে কিছুই জিজ্ঞেস করল না। কুসুমকে চুপ থাকতে দেখে উচ্ছ্বাস নিজেই খানিক ঘাবড়ে যাওয়া কণ্ঠ নিয়ে বলল,

‘ দে-দেরি হবে আসতে। খেয়ে নাও প্লিজ। ‘

কুসুম উত্তর দিল না। শুধু জিজ্ঞেস করল, ‘ খেয়েছেন? ‘

উচ্ছ্বাস মৃদু স্বরে বলল, ‘ হু। ‘

কুসুমের আর কিছুই জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনবোধ হল না। চট করে ফোন কেটে দিয়ে খেতে বসল। রাগ, অভিমান এবং অভিযোগে খাবার গলা দিয়ে নামল না। বিয়ের পরের দিন স্বামী কাজের বাহানায় বাইরে বাইরে ঘুরে বেরালে কার মন মেজাজ ঠিক থাকবে। বিয়ের জন্যে ছুটি নিয়েছে। অথচ ঠিকই হাসপাতাল যাচ্ছে। একে ছুটি নেওয়া বলে? যাচ্ছে যাক। তাই বলে সারাদিন সেখানে থাকবে? খাবার সময়েও বাসায় আসবে না? এ কেমন কাজ? কুসুম সবাই খারাপ মনে করবে দেখে চেষ্টা করল অনেকটা খাবার। খাওয়া শেষ হলে বাড়ির কাজের লোকেরা, ভাবি আর উচ্ছ্বাসের মা মিলে সব গোছগাছ করছিলেন। কুসুম নিজেও কিছুটা সাহায্য করল। রান্নাঘরে ভাবি আছেন শুধু। কুসুম ভাবির পাশে দাড়িয়ে উচ্ছ্বা সের বাবার জন্যে চা বানাচ্ছে। ভাবি কাজ করার ফাঁকে জিজ্ঞেস করলেন,

‘ মন খারাপ নাকি? ‘

কুসুম মৃদু স্বরে বলল, ‘ না। ‘

ভাবি বললেন, ‘ উচ্ছ্বাস ডাক্তার মানুষ। ডাক্তারদের সঙ্গে থাকলে এসব অভ্যাস করে নিতে হবে। ঠিকমত বাসায় না আসা, মধ্যরাতে হুট করে বিছানা ছেড়ে হসপিটাল যাওয়া, মাঝেমধ্যে নাইট আউট, ডিনার ক্যান্সেল করতে হবে। রোগী এলে পরিবার ছেড়ে রোগীর কাছে যেতে হবে। এটাই ডাক্তারদের জীবনে স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। মানিয়ে নাও। যত দ্রুত মানিয়ে নিতে পারবে তত ভালো থাকবে, সুখী থাকবে। নাহলে অযথা সংসারে ঝামেলা বাড়বে। ‘

কুসুম শুনল। কিন্তু কিছুই বললো না। চা বানিয়ে বেরিয়ে গেল রান্নাঘর থেকে।

যখন উচ্ছ্বাস এলো তখন রাত প্রায় ১ টা। কুসুম অপেক্ষা করতে করতে সবেই ঘুমিয়েছে। ঘুমন্ত কুসুমের হাতে মোবাইল। মোবাইলে ডায়াল করা উচ্ছ্বাসের নাম্বার। রাতে প্রায় কয়েকবার কুসুম কল করেছিল উচ্ছ্বাসকে। উচ্ছ্বাস কয়েকবার রিসিভ করলেও শেষবার ব্যস্ততার কারণে রিসিভ করতে পারেনি। উচ্ছ্বাস ঘরে এসে বুঝতে পারলো ঘরে এই মুহূর্তে বোম রাখা। কুসুম জেগে গেলেই বিপদ। বোম ফাটতে দু মিনিট সময় নেবে না। উচ্ছ্বাস শব্দ না করে ঘড়ি খুলে টেবিলে রাখল। শার্ট প্যান্ট পাল্টে হাফ ট্রাউজার আর টিশার্ট পরল। কুসুমের গায়ে কাথা টেনে নিজেও কুসুমের পাশে শুয়ে পরল। কুসুমের হাত থেকে ফোন নিয়ে বন্ধ করল। কুসুম প্রায় ঘেমে গেছে। তাই এসি চালিয়ে দিল। ঘুমানোর চেষ্টা করলে কুসুম ঘুমের ঘোরে এসে উচ্ছ্বাসের সঙ্গে ঘন হয়ে শুয়ে পরল। উচ্ছ্বাস কিছুটা ভরকাল। কুসুম যেন উচ্ছ্বাসের বুকের মধ্যে ঢুকে পরতে চায়। উম নিতে চায় উচ্ছ্বাস গায়ের। উচ্ছ্বাস মৃদু হাসল। হাত বাড়িয়ে কুসুমকে টেনে নিজের বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিল। কুসুমের মেয়েলি পিঠে হাত গলিয়ে জড়িয়ে নিল স্ত্রীকে নিজের সঙ্গে। কুসুম আরামে কয়েকবার গুঙিয়ে উঠল। উচ্ছ্বাস হেসে উঠল। বাচ্চাদের মত ঘুমায় কুসুম। শুরু থেকে বাচ্চা মেয়ে বলতে বলতে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলা উচ্ছ্বাস আজ বুঝতে পারল কুসুম মোটেও বাচ্চা না। বরং বয়সের সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্বশীল, বুঝদার একজন মেয়ে। কাল সকালে কি হবে ভাবতেই উচ্ছ্বাস কিছুটা শঙ্কিত। নিশ্চয়ই কালকে নিজেদের বেডরুমে কুসুম বোমা ফাটাবে। এবং সেই বোমাটা পরবে সোজা উচ্ছ্বাসের বুকে। ম্যাডাম রেগেমেগে আগুন হয়ে আছেন। আগুন থামাতে উচ্ছ্বাসকে কাল পানি হয়ে যেতে হবে। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা পানি।
_____________________________
সকালে কুসুম আগেই উঠেছে। উচ্ছ্বাস তখনও ঘুমে কাহিল। উচ্ছ্বাসের বুকে নিজেকে দেখে কুসুম অবাক হল। পরপরই পুরোনো রাগ মাথাচাড়া দিতেই চট করে সরে এল উচ্ছ্বাসের থেকে। কুসুম আচমকা বাহুবন্ধন থেকে সরে যাওয়ায় ঘুম ছুটে গেল উচ্ছ্বাসের। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাল সে। কুসুম উঠে বসেছে ততক্ষণে। এলোমেলো চুল হাতখোপা করল। পেছনে শুয়ে থাকা উচ্ছ্বাসও উঠে বসেছে। খ্যাঁক-খ্যাঁক করে গলা কেশে কুসুমের মনোযোগ পাবার চেষ্টা করল। তাতে বিশেষ লাভ হল না। কুসুম একবারও তাকালও না উচ্ছ্বাসের দিকে। বিছানা থেকে নেমে শাড়ি নিয়ে বাথরুমে চলে গেল। উচ্ছ্বাস দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মেয়েটা ভারী ক্ষেপেছে। যতটা ভেবেছিল তার থেকেও বেশি। কুসুম বাথরুম থেকে বের হয়েছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল ঝাড়ছে। হঠাৎ পেছন থেকে উচ্ছ্বাস কুসুমকে জড়িয়ে ধরতেই ভরকে গেল কুসুম। থরথর করে কেঁপে উঠল সর্বাঙ্গ তার। হাত থেকে টাওয়াল খসে পরে গেল। ঘাড়ে উচ্ছ্বাসের গরম নিঃশ্বাস অনুভব করল। সঙ্গে অনুভব করলে মৃদু নেশালো এক কন্ঠ,

‘ স-সরি কুসুম। ‘

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here